Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • জানুয়ারি ২৬, ২০২৫

কমল চক্রবর্তী: বিমূর্ততায় ধরা থাকে অনন্তের সম্ভাবনা

মোস্তাক আহমেদ
কমল চক্রবর্তী: বিমূর্ততায় ধরা থাকে অনন্তের সম্ভাবনা

আলোকচিত্র সৌজন্য গহন পত্রিকা

সম্পাদকের কথা: ‘গহন’ পত্রিকা

 
‘গহন’ পত্রিকার কমল চক্রবর্তী সংখ্যা ছাপা চলছে। একদিন সন্ধেবেলা ‘আরম্ভ’ পত্রিকার সম্পাদক বাহার উদ্দিন এলেন আমার বাড়িতে। তাঁকে শোনালাম কমল চক্রবর্তী সংখ্যার ‘সম্পাদকের কথা’। তিনি লেখাটি ‘আরম্ভ অনলাইন’-এ প্রকাশের প্রস্তাব দিলেন। একেবারেই অপরিবর্তিত অবস্থায়। আমি অবাক, এমনও হতে পারে ! একটি শিরোনাম যোগ করে লেখাটি পাঠিয়ে দিলাম। কৃতজ্ঞ ‘আরম্ভ’-এর এমন এক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তে।

 

এভাবে তোমার যাওয়ার কথা ছিল না। এই অসময়ে। ‘গহন’-এর সংখ্যা বেরোতে আরও দেরি হয়ে গেল। তুমি নেই। কাকে রোজ রোজ মোবাইলে জ্বালাব— ছুটে ছুটে যাব ভালোপাহাড় ! তুমি নেই। রাস্কার অরণ্যে বেদনার বেহাগ। নীলসায়রের জলে বিমর্ষ গাছের ছায়া। ডাঙরজুড়ির বাতাসে পাতার মর্মরধ্বনি। তুমি নেই। তুমি বলেছিলে ‘অভিমান’ চালের ভাত খাওয়াবে একদিন। তোমার লেখার টেবিলের পেছনেই বোর্ডে লেখা ছিল সে চালের নাম। আমার অভিমান আজ তোমাকেই খুঁজছে, কত কী কথা দিয়েছিলে! এভাবে ‘মিথ্যে কথা’র জাল বুনে কী লাভ হল বলো !
 
চারদিকে অবরুদ্ধ বাতাস, ঘুমন্ত শয্যায় সবুজের পাণ্ডুলিপি, মৃত যৌনতার জোনাকি মরীচিকা। শীতল শ্যাওলা-জন্ম। বেসুরো বাজে চেনা তানপুরা। ঘর খোঁজে প্রবেশের পথ। পথ বলে চিহ্ন রেখে কী লাভ! নিয়মের হাতুড়ি গর্জায়, বেঁধে রাখে সব অহেতুক ইচ্ছে, রোমান্টিকতা ভেঙে চুর চুর। তুমি তখন বারোজের ‘কাটআপ মেথড’, জলজ কোলাজ। দিশাহীন আলোহীন তবু এ জোনাকিযাপন। সকল প্রচলকে তুড়ি মারার দুঃসাহস তোমার সহজাত। সেখানে তুমি অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট, মুক্ত ভাবনার অক্লান্ত বিহঙ্গ। শব্দ তোমার খ্যাপামোর দোসর, আদরের দুলাল। বাক্য যেখানে খুশি থেমে যেতে পারে। যেখানে থামার নয়, সেখানেই তোমার সিদ্ধি। বিষয়হীন বিষয় তুলে আনো অনায়াস অববোধে। শব্দ, ব্যাকরণ তুমি নির্মাণ করো। না-ব্যাকরণের পথ বেয়ে সে এক নতুন পৃথিবীর হদিশ। মূর্ত-বিমূর্ত ভাবনা একাকার হয়।গভীর গভীরতর অন্ধকার থেকে তুলে আনো মুঠো মুঠো সাদা রোদ। উজ্জ্বল, মেদহীন, নির্ভেজাল। ভেজা মাটিতে ছড়িয়ে দাও প্রিয় ফুলের গন্ধ, ঘাসের বীজ আর প্রিয়জনের স্পর্শ। প্রকৃতি, মানুষ মেতে ওঠে সম্পর্কের প্রগাঢ়তায়। খুলে যায় সব চেনা প্রতিরোধ। খোলা মাঠ, জলছবি চেয়ে থাকে ঘুমের ভেতর। বাউলের গেরুয়া উড়তে থাকে অসীম অপারে। ক্যাকটাস থেকে ঝরে পড়ে জল। সবুজের অবিরাম অকৃত্রিম হাতছানি। চরাচর জুড়ে স্বাভাবিক বিশুদ্ধির অতল সুর। এক একটি লেখার আশ্চর্য জন্ম ঘটে। এক একটি ভাবনার। বিস্মিত পাঠক মৌন আবেশে তোমাতে ডুব দেয়। চেটেপুটে নেয় চিরন্তনের স্বাদ।
 
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে যখন আমরা প্রথম জানতে শুরু করি, তখন অনেক স্তরগত ভাবনা পরম্পরার মধ্যে একটা বিষয়ে বেশ বিস্ময় জন্মায় যে, চেনা ভূগোলের সীমাকে তিনি কী অনায়াসে অতিক্রম করে যাচ্ছেন ! এই অতিক্রমের আবহে তিনি ইতিহাসকে ব্যবহার করেছেন। তোমাকে পড়তে পড়তে বারবার সেই অনুভূতিরই অনুরণন তৈরি হয় ভেতরে ভেতরে। অথচ তোমার লেখালেখির ভূগোল তো চেনা সীমানার বাইরে খুব একটা বেরোয়নি। তাহলে এরকম মনে হওয়ার কারণ কী ? আসলে লেখালেখির প্রেক্ষাপট চেনা হলেও তোমার ভাবনায় আছে আন্তর্জাতিক স্বর, আলবদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি, শেকড় চেনা হলেও তোমার জীবন দেখার অভিজ্ঞতা ভিন্নতর, কোনোরকম গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। ‘চার নম্বর ফার্নেস চার্জড’ থেকে ‘কমলের মৃত্যু’ কিংবা ‘আমার পাপ’ থেকে ‘কমল চক্কোত্তির শাদ্ধের পুন্ন পতিবেদন’ এবং আরও অনেক অনেক লেখা আমাদের সেসব অনুভূতিকেই জারিত করবে। আবহে জেগে থাকবে পুরাণ, মিথ, আঞ্চলিকতা, প্রকৃতি আর অনন্য বলার ঢং।
 
যে-কোনো ধরনের রেনেসাঁসের একটা বড়ো বিশেষত্ব হল মুক্ত ভাবনার প্রকাশ। রেনেসাঁস সব সময় খুব বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে আসে এমনটা নয়। ব্যক্তি মানুষ ছোটো ছোটো পদক্ষেপেও রেনেসাঁস নিয়ে আসেন। নিজে বিবর্তিত হন। বিবর্তনের আলো ছড়ান চারপাশে। তুমি রেনেসাঁসের বাহক, রেনেসাঁসের সমর্থক। এ তোমার ভেতরের জারণ। খুব সহজেই তাই তুমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে নিজের মত প্রকাশ করো, করতে পারো। তুচ্ছ করতে পারো বাহ্যিক কূটকচাল— ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ তোমার কাছে অনুঘটক। প্রতিষ্ঠিত বাজারকে স্বীকৃতি দিয়েছ বিরুদ্ধতার অকপট উচ্চারণে। বহুভাবে জীবনকে ছেনে দেখার অভিজ্ঞতা তোমার সম্পদ। যেভাবে কেউ দেখেনি, কেউ দেখে না, তুমি সেখানেই নতুনকে খুঁজে পাও। ভানুমতির খেল্‌ সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকেই নির্মিত হয়। পাঠক তাই নির্বাক হয়— আহা, এভাবে তো ভাবিনি আগে ! তোমার লেখা তাই ভীষণ বিশ্বাসযোগ্য। বানানো নয়, নির্মাণ। সমস্ত ‘ভার্চুয়াল’ বলে ভেঙে ফেলো— ভেঙে ফেলো যা কিছু বানানো— বানানো, কেননা সে জন্মায়নি। নীল সাগরের জলে উথাল-পাতাল ঢেউ। পদ্ম দুলে চলে তবু নির্ভয়। যতই জড়াও তাকে বিষ আলিঙ্গনে, জলে ধুয়ে যায় অকারণ সঞ্চয়।
 
আপাতভাবে তোমার লেখা শৃঙ্খলাহীন মনে হলেও আদপে সেগুলি সুস্পষ্ট অভিপ্রেত ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ফসল। তোমার লেখা পড়তে গেলে তাই পাঠককে একটা প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সীমাহীন সুতো তখন পাঠককে বেঁধে রাখে অতঃপর। একধরনের নাটকীয়তা আছে তোমার বলবার ঢঙে, যা পাঠককে হঠাৎ ঝাঁকুনি দেয়। ভাষার সংকেতময় ও সচেতন ব্যবহারে সে ঝাঁকুনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে— স্বতন্ত্র ভাবনায় প্রতিষ্ঠিত। তোমার ব্যক্তিগত দর্শনচেতনা, স্বপ্ন-অভিপ্রায়ের বীজ লুকিয়ে আছে লেখার ভাঁজে ভাঁজে। কখনো কখনো দু-একটা আঁচড়ে তা চরমকে ছোঁয়। তোমার লেখায় পড়াশুনোর পরিধিও টের পাওয়া যায়, সেখানেও তুমি ঈর্ষণীয়। তবে সে পড়াশুনো শুধুই পুঁথিগত সাবেকি নয়— যা দেখছি, যা শুনছি সব মিশে যায় বোধে, সৃজনের ক্যানভাসে।
 

তুমি একদিকে সাহিত্যিক, সম্পাদক ও অন্যদিকে সমাজসেবক। ‘ভালোপাহাড়’-এ তুমি বিঘের পর বিঘে শূন্য অনুর্বর জমিতে লাগিয়েছ অনেক অনেক গাছ। সবুজে ভরে উঠেছে নিষ্প্রাণ ধূসর ভূমি। পিছিয়ে পড়া, দরিদ্র, অসহায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে তৈরি করেছ এক অনবদ্য অবৈতনিক স্কুল। পাশে থেকেছ দৈনন্দিন যাপনে। পৌঁছে দিয়েছ খাদ্য, পোশাক-আশাক, ঔষধপত্র। প্রতিষ্ঠা করেছ একটি দাতব্য চিকিৎসালয়। পাশাপাশি পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিয়মিত প্রকাশ করেছ ‘কৌরব’। ১৩৪টি সংখ্যার সঙ্গে তোমার ছিল নাড়ির সম্পর্ক। এত কাজের মাঝেও তুমি লেখালেখিকে ব্রাত্য করোনি। তোমার ভাষা, তোমার ভাবনা চিনিয়ে দেয় তোমার স্বাতন্ত্র্য।
 

দুই

 
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর তোমার জন্ম। মামাবাড়িতে। এখনকার বাংলাদেশের বিক্রমপুরের কাটিয়াপাড়ায়। তোমাদের নিজেদের বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের কামারগাঁও। তুমি আমাকে জানিয়েছিলে এসব কথা। তুমি যখন জন্মাও তখন সমস্ত বাংলায় দুর্ভিক্ষ। তোমাকে সবাই বলতেন ‘দুর্ভিক্ষের ছেলে’। তোমার ডাকনাম ছিল উজ্জ্বল, খোকন। লেখার ক্ষেত্রে অনেক সময় তুমি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছ— কখনো নিতাই ধর, কখনো মানিক দাশগুপ্ত বা অরিন্দম দাশগুপ্ত কিংবা ঈষৎ মুখোপাধ্যায়। মূলত বাণিজ্যিক পত্রিকাতেই ছদ্মনামে লিখেছ। ভয় পেয়ে নয়— নিজেকে আড়াল করার খুব ইচ্ছেও তোমার ছিল, এমনটাও নয়। একই সংবাদপত্রের পাতায় তোমাকে একাধিক লেখা লিখতে হয়েছে। একই নামে অনেক লেখা কি ভালো দেখায় ! হয়তো সেকারণেই কোনো বই ছদ্মনামে প্রকাশ করোনি। স্কুলে ভর্তির সময় মাস্টারমশাইয়ের বদান্যতায় তোমার নতুন জন্মতারিখ হয় ৭ জানুয়ারি ১৯৪৬। এমনটা তোমাদের সময়ে হামেশাই ঘটত। তোমার বাবা জিতেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন টাটা স্টিল ট্র্যান্সপোর্টের ফোরম্যান। মা মায়া রাণী দেবী। ঠাকুরদা গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তী। দাদু অমূল্যচন্দ্র চক্রবর্তী। তোমরা তিন ভাই, চার বোন। সকলের বড়ো তুমি।
 
১৯৬৮-তে টাটা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড লোকোমোটিভ কোম্পানি লিমিটেড, জামশেদপুরে ইনস্পেক্টর পদে তুমি যোগ দাও। এবছর অক্টোবরে গড়ে ওঠে ‘কবিগোষ্ঠী কৌরব’। ১৯৬৯ সালের ১২ জানুয়ারি তোমার লেখা ‘সূর্যের বুকে ফসিলের নীড়’ নাটকটি অভিনীত হয়। এই প্রেক্ষিতে একটা মুখপত্র বের হয়, যার নাম ‘কৌরব’। ১৯৭০-এর মে মাসে প্রকাশ পায় ‘কৌরব প্রকাশনী’র প্রথম কবিতার বই। সবুজ মলাট। সঙ্গে নিমাই দত্তের কালো নামাঙ্কন ‘কৌরব’। কবিতার সংকলন। সম্পাদক সুভাষ ভট্টাচার্য, বারীন ঘোষাল, অরুণ আইন ও তুমি। দাম দু-টাকা। সংকলনের কবিরা হলেন স্বদেশ সেন, নিমাই দত্ত, সমীর মজুমদার, ভূষণ গোপ, দেবজ্যোতি দত্ত, সুভাষ ভট্টাচার্য, বারীন ঘোষাল, বাসুদেব নন্দী, শক্তিপদ হালদার, অরুণ আইন। আর ছিল তোমার কবিতা। কেমন একটা দমকা হাওয়ার মতো তোমার উদয় !
 
১৯৭১-এর জুলাই মাসে বের হয় তোমার প্রথম কবিতার বই ‘চার নম্বর ফার্নেস চার্জড’। গ্রন্থটি পাঠককে নতুন অনুভূতি দেয়। শুরু হয় কবি হিসেবে তোমার পথচলা। সেপ্টেম্বরে ‘মহিষ’ নামে পত্রিকা প্রকাশ পায় ‘কৌরব’ তত্ত্বাবধানে। সম্পাদক এবং প্রকাশক সুভাষ ভট্টাচার্য। তোমার কবিতা ও গদ্য ছাপা হয়। ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় সংখ্যা ‘যীশু ফিরে আসছেন রাত ১২টা’। এই সংখ্যায় তোমার গদ্য প্রকাশ পায়। মার্চে ‘প্রতিবিম্বের কাছে কৈফিয়ৎ’ নামে পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যা বের হয়। ‘চার নম্বর ফার্নেস চার্জড’-এর পাণ্ডুলিপি থেকে চারটি কবিতা ছাপা হয়। জুলাই-এ ‘গুড বাই মিলি’ নামে পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যা বের হয়। দ্বিতীয় বর্ষ শারদ সংখ্যা ১৩৭৯/সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৭২ থেকে পত্রিকার নাম হয় ‘কৌরব’।
 
১৯৭৮ সালে রাঁচী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুমি প্রাইভেটে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করো। খুব ইচ্ছে ছিল শিক্ষকতা করবে। ইচ্ছে ছিল বাংলা সাহিত্য পড়াবে। সে আর হয়ে ওঠেনি। বোহেমিয়ান যাপনে কেটে যায় বছরের পর বছর। তবু তুমি লিখে গেছ অনর্গল। ‘কৌরব’ বের হয়েছে দাপটের সঙ্গে। ১৯৮০ সালে ‘বিভাব’ পত্রিকার পক্ষ থেকে ‘কৌরব’কে শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিন হিসাবে ‘ডি কে অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়। পুরস্কার তুলে দেন অন্নদাশঙ্কর রায়। চলতে থাকে সাহিত্যচর্চা, পত্রিকা আর জীবনকে নানাভাবে চেখে দেখা।
 
১৯৯৬-এ ভালোপাহাড়ের জন্য প্রথম জমি কেনা। ভালোপাহাড়ের জন্মদিন পালন শুরু ১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর আয়োজিত হতে থাকে ফুটবল টুর্নামেন্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ১৯৯৭ সালে ‘ব্রহ্মভার্গব পুরাণ’ উপন্যাসের জন্য ‘ঋত্বিক’ পুরস্কার পাও। আর ১৯৯৮ সালে গদ্যের জন্য ‘সাহিত্য সেতু’। এবছরই শুরু হয় ভুবনমেলা। চলেছিল ২০০৩ পর্যন্ত। ১৯৯৯ সালে ছোটোগল্পের জন্য পাও ‘মহাপৃথিবী’ পুরস্কার।
 

তোমার রহস্যময় সেই শোবার ঘরে, কোথায় যে সব লুকিয়ে রাখতে ! বাচ্চাদের মতো অদ্ভুত করতে।  কখনো আত্মহারা, “আমি কুড়িটা নাটক লিখেছি !— তুই ফাইল হাতড়ে না বের করলে আমি জানতেই পারতাম না ! আচ্ছা, তুই এসব করছিস কেন ? কী হবে ? আমি তো ভাবিনি কখনো লেখাপত্তর গুছিয়ে রাখা দরকার।”

 
টাটা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড লোকোমোটিভ কোম্পানি লিমিটেড, জামশেদপুরের প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট থেকে স্বেচ্ছাবসর নাও ২০০০ সালে। ভালোপাহাড়ে মাছচাষ শুরু করো। ২০০২ সালে কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র ‘কৌরব’কে শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার দেয়। ২০০৩-এ শুরু হয় পলাশমেলা। ২০০৪ সালে ভালোপাহাড় স্কুল। পশুপালন কেন্দ্রের উদ্বোধন হয় ২০০৬-এ। ২০০৭-এ ভালোপাহাড় স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হয়। ২০০৮ সালে ‘দি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা ভালোপাহাড় স্কুলকে ‘বেস্ট কেয়ারিং স্কুল’ পুরস্কার প্রদান করে। এইসময় ভূগোলের মাস্টারমশাই সৌম্যজিৎ বসুর সঙ্গে তোমার সম্পর্কের কারণে মাওবাদী সন্দেহে পুলিশি হেনস্থার শিকার হতে হয়। তোমার রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে চিরকাল কূটকচাল হয়েছে। সেসব অবশ্য তুমি পাত্তাই দাওনি।
 
২০১২ সালে ‘ব্রহ্মভার্গব পুরাণ’ উপন্যাসের জন্য ‘বঙ্কিম’ পুরস্কার পাও। শুরু হয় ঈশ্বরমেলা। ২০১৩ সালে মতি নন্দী স্মৃতিরক্ষা কমিটি ‘মতি নন্দী’ পুরস্কার প্রদান করে। ২০১৭ সালে সুথল কোম্পানি সামাজিক সামগ্রিক অবদানের জন্য ‘পথিকৃৎ’ পুরস্কার দেয়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোম সায়েন্স বিভাগ দেয় ‘প্রকৃতি’ পুরস্কার। এই সেদিন আবার তুমি কলকাতা এলে, ১৫ আগস্ট ২০২৪— পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল তোমার হাতে তুলে দিলেন ‘স্বাধীনতা দিবস’ পুরস্কার। ছবিটা এখনও চোখে ভাসছে।
 
এমনই বর্ণময় চরিত্র তোমার। এতকথা বলছি একারণে যে, তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি তোমাকে জেনেই। বলতে পারবে না, কিচ্ছু জানি না । আবার এটাও তো সত্যি, সবটা জানিও না। সেকারণেই তোমার পদতলে বসে পাঠ নিতে চাই, তুমি ফিরিয়ে দিতে পারবে না । ফিরিয়েই তো দিয়েছ, এমনটা কী কথা ছিল ! তোমার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা তেরো, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত নাটকের সংখ্যা কুড়ি। উপন্যাস ও নভেলেট লিখেছ ত্রিশটিরও বেশি। ছোটোগল্প প্রায় দেড়শো। এক ডজনের উপর গদ্যগ্রন্থ।পনেরোটির কাছাকাছি সম্পাদনা করেছ নানা আঙ্গিকের বই। আর আছে ‘কৌরব’সহ বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনার অভিজ্ঞতা। তোমার লেখায় আমরা মুগ্ধ। তোমার ব্যক্তিত্বে আমরা আবেশিত। তোমাকে নিয়ে আমাদের কত বিতর্ক ! তোমাকে কেন্দ্র করে আমাদের কত উত্তেজনা, আবেগ—পৃথিবী জয় করবার দুর্জয় সাহস ! সেই তুমি, সত্যিই কি চলে গেছ ! এমনটাও কি হতে পারে!
 

তিন

 
তোমাকে নিয়ে কাজ করা কি চাড্ডিখানি কথা ! প্রায় তিন বছর লাগল এই পত্রিকা প্রকাশ করতে। তাও যতটা পরিকল্পনা করা গেছিল তার সবটা বাস্তবে করে ওঠা যায়নি । তোমার অগোছালো জীবনের মতো সবকিছুই অগোছালো । বহু লেখার কোনো হদিশ নেই, বহু বই, বহু পত্রিকার। তোমার কাছে, ‘ভালোপাহাড়’ ছুটে গেছি যে কতবার ! স্কুলের লাইব্রেরির ধুলো, উই, অসম্ভব নোংরা ঘেঁটে কিছু কিছুর খোঁজ মেলে। বারীন ঘোষালের সব বই নাকি এখন সেখানে। কিন্তু কোথায় সব বই ! বই ঘাঁটতে গিয়ে দেখা গেল বেশিরভাগই বেপাত্তা। তার মানে, এমন হয়তো হতে পারে যে, ‘ভালোপাহাড়’-এ বইগুলো আসার আগেই অনেক বইয়েরই হাতবদল ঘটে গেছে। কিছু বই, পত্রিকা তোমার শোবার ঘরে। সে ঘরের অবস্থা মারাত্মক। সব বইয়েই পোকা, সারা ঘর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বই, তুমি কোথায় যে ঘুমোতে ! আদৌ কি ঘুমোতে ! সেখান থেকেও পাওয়া গেল কিছু। জলের ট্যাঙ্কের উপরে তুমি একটা ঘর বানিয়েছিলে, ওখানে বসে লিখবে বলে। সেখানে বস্তার ভিতর থেকে বেরোলো কয়েকটা। ‘ভালোপাহাড়’-এ ডাক্তারবাবু আর মাস্টারমশাই যে ঘরে ঘুমোন সেখানেও বই-পত্রিকার স্তূপ। ঘেঁটেছি সেসবও। যেখানে যত কাগজ, ফাইল পেয়েছি উলটেছি— যদি কিছু মেলে ! তুমি কখনো ভালোবেসে এটা ওটা বের করে এনে দিয়েছ। কখনো আবার একটু দেখিয়ে সিঁধিয়ে গেছ তোমার রহস্যময় সেই শোবার ঘরে। কোথায় যে সব লুকিয়ে রাখতে ! বাচ্চাদের মতো অদ্ভুত করতে। কখনো গালাগালি দিতে এতসব ঘাঁটছি বলে। কখনো আত্মহারা, “আমি কুড়িটা নাটক লিখেছি !— তুই ফাইল হাতড়ে না বের করলে আমি জানতেই পারতাম না ! আচ্ছা, তুই এসব করছিস কেন ? কী হবে ? আমি তো ভাবিনি কখনো লেখাপত্তর গুছিয়ে রাখা দরকার।” আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল আরও কিছু। কিন্তু তোমার পাহাড়প্রমাণ লেখা, সম্পাদিত অসংখ্য পত্রিকার তুলনায় আমার সংগ্রহ যথেষ্ট হয়ে উঠছিল না। মন ভরছিল না। আরও দরকার। বুঝতে পারছিলাম, শুধু ‘ভালোপাহাড়’– এ হবে না।
 
একদিন জামশেদপুরে ২৫এ এগ্রিকো বাগান, তোমার বাড়িতে হানা দিলাম। তোমাকে সঙ্গে নিয়েই। ছিলেন তোমার ভাই তমালদা, জয়তিদি আর ‘ভালোপাহাড়’-এর আঁকার মাস্টারমশাই অপূর্ব রায়। খোঁজ খোঁজ রব। তন্ন তন্ন বাড়ি। এই সেই ঐতিহাসিক ঠিকানা। পুলকিত আমি। দু-একটি বইয়ের প্রথম সংস্করণ পেলাম, কিছু পত্রিকা। সে কী আনন্দ ! সেদিন ‘ভালোপাহাড়’-এই ফিরে গিয়েছিলাম। তখন আবার আস্তে আস্তে মনখারাপে ডুবে যাই। সব তো মিলল না। বরং একটা খুঁজতে গিয়ে সন্ধান পাচ্ছি আরেকটার। তালিকা বেড়েই চলেছে। তাহলে এরপর ? এবার একটা তালিকা তৈরি করলাম, কার কার ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকতে পারে ? ‘কৌরব’ ও তোমার নিকটজনদের বা এমন কেউ যিনি বই-পত্রিকা ভালোবেসে সংগ্রহ করেন এবং এই ধরনের সংগ্রহে তাঁর বা তাঁদের উৎসাহ থাকবে।
 
দ্বিধাহীনভাবে পাশে এসে দাঁড়ালেন সম্মাননীয় পূর্ণেন্দুশেখর মিত্র, অরূপকুমার দাস, শ্যামলকান্তি দাশ, শংকর চক্রবর্তী, প্রবালকুমার বসু, সিদ্ধার্থ বসু, সুদেষ্ণা মজুমদার, দেবাশিস গুপ্ত, বিজয় সিংহ, গৌতম মিত্র, দেবাশিস্‌ করণ প্রমুখ। কেউ দিয়েছেন সংগ্রহের পত্রিকা, কেউ দিয়েছেন বইয়ের প্রথম সংস্করণের কপি, তোমার লেখা চিঠি… আরও কত কী যে ! সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কারও এতটুকু কার্পণ্য নেই। অবাক হয়েছি, তাঁদের উদারতায়। বন্ধু মারুফ হোসেন, অভিযান পাবলিশার্সের কর্ণধার বরাবর সব কাজে উৎসাহ দিয়েছে। তোমার বইগুলি নতুনভাবে প্রকাশের যে দায়িত্ব সে নিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসার। আর একজনের কথা আবারও বলতে হবে, তিনি অপূর্ব রায়— বিশিষ্ট শিল্পী ও ‘কৌরব বাহিনী’র অন্যতম সৈনিক। তুমি জানো কিনা জানি না, ইতিমধ্যে তাঁদের উদ্যোগে বেরিয়েছে ‘কৌরব’ ১৩৫। অপূর্ব রায় দিনের পর দিন ‘ভালোপাহাড়’-এর লাইব্রেরি ও তোমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ ঘেঁটে খাতার পর খাতায় জড়ো করেছেন তোমার লেখালেখির নানা খবর। এছাড়া আছে বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে তথ্য সংগ্রহ। আমার ছাত্র কুনাল রায় দিনের পর দিন লাইব্রেরিতে কাজ করেছে। প্রুফ সংশোধন ও বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেছে সঞ্চারী হালদার, বন্দনা সাহা, মধুরিমা মান্না। সাক্ষাৎকারের অনুলিখন করেছে সৃজিতা ব্যানার্জী। অনেকের সহযোগিতায় শেষমেশ পত্রিকা প্রকাশ পাচ্ছে। তাও খেদ থেকে গেল, সবটা হল না। অন্বেষণ তাই চলতেই থাকবে। আসলে তোমার মতো বটবৃক্ষের সর্বাঙ্গীণ পরিচয় তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। এ এক বিনম্র প্রয়াস শুধু।
 

চার

 
পত্রিকার প্রথম অংশে আছে মূলত তোমার কাছের মানুষদের স্মৃতিচারণা। তোমার তুমি হয়ে ওঠার ইতিহাস। বৃক্ষনাথ হয়ে ওঠার ইতিহাস। তবে সেসব লেখার ভেতর উঁকি দিয়ে গেছে তোমার লেখালেখির সমালোচনাও। দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে তোমাকে বোঝবার একটা আবেগসিক্ত আকাঙ্ক্ষা। যৌক্তিক, না-যৌক্তিক মুগ্ধতা আর দুর্নিবার আকর্ষণ। তৃতীয় পর্যায়ের বিষয় ‘ভালোপাহাড়’। ‘ভালোপাহাড়’ তোমার লেখকসত্তার দোসর নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী ! ‘ভালোপাহাড়’ কোথাও কি আড়াল করেছে তোমাকে! চতুর্থ পর্যায় তোমার কবিতার আলোচনা, কাব্যগ্রন্থের আলোচনায় পূর্ণতা পেয়েছে। অনেকেই তোমার কবিসত্তাকেই প্রধান হিসেবে ভেবেছেন। আক্ষেপও আছে, কবিতাকে তুমি  অবহেলা করেছ এই অভিযোগে। পঞ্চম পর্যায়ে আলোচনায় উঠে এসেছে নাটক। প্রকাশিত নাটকের সংখ্যা গোটা সাতেক হলেও নাটক লিখেছ প্রায় কুড়িটি। তুমি নিজেও জানতে না এত নাটক লিখেছ। সেসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। ষষ্ঠ পর্যায়ে আছে উপন্যাসের আলোচনা। এই পর্যায়টি বেশ দীর্ঘ। সপ্তম পর্যায়ের বিষয় তোমার ছোটোগল্প। অষ্টম পর্যায়ে তোমার বৃক্ষ নিয়ে লেখা গদ্যগুলি প্রাধান্য পেয়েছে। নবম পর্যায়ে মিশে গেছে বিভিন্ন আঙ্গিক। কবিতার সঙ্গে উপন্যাস, উপন্যাসের সঙ্গে গল্প, গল্পের সঙ্গে ব্যক্তিগত গদ্য… এরকম নানাবিধ বিষয়। দশম পর্যায়ে আছে ‘কৌরব’-এর কথা, ‘শিরোনামায় পাঠক’ নিয়ে আলোচনা। বিশেষ একটি সাক্ষাৎকার রয়েছে একাদশ পর্যায়ে। দ্বাদশ পর্যায়ে থাকছে জীবনপঞ্জি, গ্রন্থপঞ্জি বা লেখালেখির তালিকা এবং ‘কৌরব’ সংক্রান্ত নানা তথ্য। তোমার সঙ্গে কাটানো শেষ মুহূর্তের ছবি খুব সংক্ষেপে ধরা আছে ত্রয়োদশ পর্যায়ে। আর থাকছে পরিশিষ্ট অংশ। এগুলির ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব সম্পূর্ণ ও যথাযথ তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিছু সংযোজন বা বিয়োজন থাকলে তোমার সচেতন পাঠকের কাছে অনুরোধ সহযোগিতার। পরবর্তী ক্ষেত্রে আমরা আরও নির্ভুল ও পূর্ণতার দিকে যাতে এগোতে পারি। তবে, পত্রিকার জন্য প্রত্যেকে খুব ভালোবেসে লিখেছেন। লেখাগুলিতে সে ছোঁয়া খুব সহজেই টের পাওয়া যায়। আজন্ম ভিক্ষুক তুমি, ‘ভালোবাসা’ সে ভিক্ষার মূলধন, ‘ভালোবাসা’ই প্রাপ্তি।
 

জানুয়ারি সংখ্যার প্রচ্ছদ

পত্রিকার এই সংখ্যা শুধু তোমাকে মনে করাবে, ব্যাপারটা এভাবে ভাবিনি। বরং ভেবেছি, তোমার সৃষ্টিকে পাঠক কীভাবে দেখেন সেই আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে। ‘ভালোপাহাড়’ বা ‘রাস্কার অরণ্য’ নিঃসন্দেহে তোমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু তোমার লেখালেখি ? সেগুলো নিয়ে কি কথা হয় কম ! তোমাকে ঘিরে উচ্ছ্বাসটাই প্রধান হয়ে ওঠে ! ‘গহন’ চেষ্টা করেছে তোমাকে তোমার সবটা সমেত পেতে। তাই-ই এতটা সময় লাগল। তিন বছরও মনে হয় কম সময়। তোমাকে ধরতে গেলে আরও সময় দরকার। শুরুতে ভেবেছিলাম অনেক তাড়াতাড়ি কাজ এগোবে। আসলে কাজে নামলে বোঝা যায়, বাস্তব আর পরিকল্পনা এক নয়। এগোতে এগোতে কাজ বাড়ে, তথ্য বাড়ে, লেখা জমা হতে থাকে। কিছু কিছু বিষয় নিয়ে লেখা তাও বাকি থেকেই গেল ! আক্ষেপ, তোমার ছোটোদের লেখা নিয়ে কোনো আলোচনা রাখা গেল না। শেষদিনেও লেখা এল না। এরকম কত ‘না’-এর গল্প জমা হয় !
 
ও, এই সুযোগে কয়েকটি বিষয় তোমায় একটু বলে রাখি:
 
  ♦ দেখো, বেশিরভাগ লেখা যখন পেয়েছি, তখন তুমি আমাদের মধ্যে ছিলে। কিছু লেখা তুমি চলে যাওয়ার পর। ফলে লেখার মধ্যে তোমার থাকা, না-থাকার স্পষ্ট ছাপ আছে। আশা করি, সেকথা তুমি বুঝবে।
 
  ♦ এই পত্রিকায় প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বানানবিধি মানা হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও প্রাবন্ধিক বা সমালোচকের সচেতন ভাবনাই গুরুত্ব পেয়েছে। আবার গ্রন্থনাম, গ্রন্থের উদ্ধৃতি ব্যবহার প্রভৃতি ক্ষেত্রে তোমার বানান অপরিবর্তিত রাখার চেষ্টাই জারি থেকেছে। তবে কোথাও একেবারে অযৌক্তিক ভুল বানান ব্যবহার করা হলে বা মুদ্রণ-প্রমাদ থাকলে সেগুলো সংশোধন করে দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই তুমি বুঝবে, বানান-সমতা ভাবনায় প্রাধান্য পেলেও, সর্বত্র তা রক্ষার যান্ত্রিক চেষ্টা একদম করা হয়নি।
 
  ♦ শব্দবন্ধ, যতিচিহ্ন, তথ্যসূত্র, সজ্জা প্রভৃতি ব্যবহার বা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সবসময় প্রামাণ্য রীতি বা নিয়ম মানা হয়েছে এমনটাও নয়। প্রাবন্ধিক বা সমালোচকের স্বাতন্ত্র্য ও প্রয়োজনের গুরুত্ব বুঝে এইসব সিদ্ধান্ত। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত জগমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘গবেষণাপত্র অনুসন্ধান ও রচনা’ গ্রন্থের ভাবনাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছে। তুমি কাছে থাকলে অবশ্য এসব নিয়ে আরও অনেক তর্ক করা যেত।
 
  ♦ অনেকেই তোমার অনুকরণে গদ্য লেখার চেষ্টা করেছেন। তাতে কখনো সম্পাদনায় সুর বাঁধতে সুবিধে হয়েছে, কখনো লেখায় অনেক বদল আনতে হয়েছে। সকলের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আশা করি, এটুকু ধৃষ্টতা তাঁরা মেনে নেবেন।
 
  ♦ নানা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য সবসময় প্রামাণ্য বিষয়ের ভিত্তিতে যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসার। সেকারণে অনেকের লেখাতেই তথ্যের বদল ঘটে গেছে। কিংবা, একই তথ্য বার বার বহুজন ব্যবহার করায় কখনো খুব প্রয়োজনীয় না হলে সেগুলি বাতিল বা সংক্ষেপিত করা হয়েছে।
 
বিশ্বাস করো, আরও কথা বলতে ইচ্ছে করছে। একটা পত্রিকা করতে গিয়ে কত ধরনের যে অভিজ্ঞতা হয় ! ‘কৌরব’-এর এতগুলো সংখ্যা কীভাবে যে বের করেছিলে ! তাও আবার জামশেদপুর থেকে ! আরও কত সংখ্যা তোমার ভাবনায় জন্ম নিত ! তোমার নাটকগুলোর আবার প্রিন্ট নিয়েছি। তুমি তো প্রুফ দেখে দিতে পারলে না ! সংযোজন, বিয়োজনও করতে হয়তো ! তোমার বিদ্যাসাগরকেন্দ্রিক লেখাগুলোও কম্পোজ হয়ে গেছে। উপন্যাস সমগ্রের পঞ্চম খণ্ড বের হচ্ছে। কাজ চলছে ছোটোগল্প সমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ডের। সবই বেরোবে। শুধু তোমার হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হবে না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরও অজস্র লেখা, তোমার ভাবনা। একদিন সেসব কেউ না কেউ জড়ো করবে। তুমি হয়তো কিছুই জানতে পারবে না ! অথবা, অলক্ষে মুচকি হেসে নতুন কোনো গান ধরবে, যে গান হবে আত্মবীক্ষণের মন্ত্র। সমস্ত অভিমান ভুলে আমরা তখন তোমার কাছে এসে বসব। তুমি বলবে, বৃক্ষনাথের জয়— মানুষের জয়।
 

 
পুনশ্চ

 
‘গহন’-এর প্রথম দু-টি সংখ্যার পাঠক-প্রীতি আমাদের মুগ্ধ করেছে। আমরা উৎসাহ পেয়েছি। আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ। পরের সংখ্যা ‘অথ রাম কথা’। অতি দ্রুত এই সংখ্যাটি প্রকাশের চেষ্টা করা হবে। পাঠকেরা নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে থাকবেন। তবেই আমাদের অনাবিল আনন্দ। মনে পড়ছে, ‘অথ রাম কথা’ সংখ্যায় কমলদা লিখবেন, এমনটা জানিয়েছিলেন। কেমন হত সে লেখা ! কে জানে ! আর এক ‘না’-এর গল্প জমা হয়।

 

♦•♦♦•♦–♦•♦♦•♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!