- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- নভেম্বর ৯, ২০২১
ভয়

অলঙ্করন: দেব সরকার
| পিঙ্কি ঘোষ |
অনিতা বৌদির হাতটা শক্ত করে ধরে কাউন্টার থেকে দু গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে পলি। বৌদি ওর চেয়ে ৫ বছরের বড়ো । পলির চোখ ঘুরছে । স্টেশন জুড়ে হুড়োহুড়ি, ছুটোছুটি । ঢাউস বোঝা মাথায় একটা লোক দূর হঠো দূর হঠো বলতে বলতে পলির গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল । আরেকটু হলেই মুখ থুবরে পড়ে যেত ও। খেয়াল কর পলি, কোনক্রমে ওকে সামলে নিল অনিতা।
কী রে, লাগলো তোর?
হ্যাঁ, তুমি না ধরলে আরো বেশি লাগত। দাদা এখনো তো ফিরল না ?
মনে হয়, কাউন্টারে ব্যাপক ভিড় । পুজোর সময় তো, সবার বাড়ি ফেরার তাড়া ।
স্টেশনটা কী বিশাল !
হাওড়া স্টেশন বলে কথা । তুই এই স্টেশনে, প্রথম এলি?
হ্যাঁ । আমাদের বাড়ি থেকে বেরোলেই তো রিক্সা বাস-অটো। বছর দুই আগে মাসির বাড়ি বজবজ যাওয়ার সময় শিয়ালদা স্টেশনে গেলেও হাওড়া স্টেশনে এই প্রথম ।মাইকে ঘনঘন অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে, জে এ ওয়ান ওয়ান হাওড়া টু কাটোয়া লোকাল দু নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ৫:৩৮ মিনিটে ছাড়বে । কান খাড়া করে শুনল পলি। একটি বিহারি পরিবার, জনা পাঁচেক বাচ্চা আর বড় বড় বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে ওদের সামনে দাঁড়াল । মহিলার কোলে এক মাসের ছোট্টো এক শিশু। মায়ের আঁচল ধরে বছর দুয়েকের মেয়ে । বড় মেয়েটির বয়স বড়ো জোর ৮ । হাতে ভারী ব্যাগ আর কোলে সেজো ভাই। পাশে মাথায় বোচকা নিয়ে আরও এক বোন দাঁড়িয়ে। ওদের বাবার গায়ে সস্তা দামের শার্ট দুই কাঁধে, দুটো বড় বড় ব্যাগ— মেঝেতে দড়াম দড়াম করে রেখে ভদ্রলোক বললেন— তুম লোক ইধর খড়ে রহো, মে আভি টিকিট কাটকে আতা হু । মেজ মেয়েটি হাত বাড়িয়ে স্টেশনের ভেতরে খাবারের দোকান দেখিয়ে বলল, পাপা হামকো ও খানা লা দিজিয়ে না। ভদ্রলোক ধমক দিয়ে বললেন, চুপ রহো । পহলে ট্রেন তো পকড় নে দো ।
ভদ্রলোকের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো অনিতা। চোখের ইশারায় পলিকে বলল, শখ দেখ, পাঁচ খানা বাচ্চা।
পলি এবার ভদ্রমহিলার দিকে তাকালো। পরনে চুমকি বসানো শাড়ি । মাথায় ঘোমটা। হাত দুটো সরু সরু কাচের চুড়ি তে ভরা। চোখদুটো কোটরে । মহিলার শরীরে সামনে পেছনে কোনও ঢেউ নেই । বয়স কম। সংসারের ভারে কিংবা স্বামীর ভয়ে যুবুথুবু । ছেলেমেয়েগুলোর চোখেমুখেও অপুষ্টির ছাপ ।
অনিতা বলল, ওই দেখ তোর দাদা আসছে, চল আমরা এগোই।♦♦♦
আমি জানলার পাশে বসব। বলেই পলি এগিয়ে গেল। রঞ্জন বলল, বসবি তাহলে এদিকটায় আয় । উল্টোদিকে হাওয়া নেই । ব্যাগগুলো বাংকারের উপর তুলে দিয়ে রঞ্জন অনিতার গা ঘেঁষে বসে পড়ল। বিয়ের পর ওদের এটাই প্রথম পুজো। রঞ্জন চেয়েছিল অনিতা এবার শহরেই পূজো কাটাক। কিন্তু অনিতা বাবা-মা ভাইদের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতেই থাকতে চায়। অনিতাকে খুশি করতেই রঞ্জন শ্বশুড়বাড়ি যাচ্ছে । পুজোয় মেয়েরা বাপের বাড়ি থাকতেই ভালোবাসে । রঞ্জন তাই আপত্তি করেনি। ওরা দুজনেই পলিকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিল। পলিরও ইচ্ছা ছিল । প্রতিবারই তো পুজো শহরে কাটায়, একবার না হয় গ্রামে গিয়ে দেখা যাক। পলির মায়ের আপত্তি ছিল । কিন্তু রঞ্জন আর আনিতা দুজনে জোর করলো, পলির ইচ্ছাকেও গুরুত্ব দিতে হল । তবুও মা পলিকে বলেছিল, পুজোর সময় গ্রামের লোকেরা শহরে আসে পুজো দেখতে আর তুই কিনা গ্রামে যাবি। পলি হাসি হাসি মুখে মায়ের গলা জড়িয়ে জেদ ধরল।
হাত দুই এগোতেই ভুতুড়ে গাছ। দৈত্যের মতো চেহারা। নমিতা আর এগোতে চাইল না।
ট্রেনটার গতি বাড়ছে । পলির দেহটা দুলছে। ওর হাই উঠছে। সে কোন ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে রওনা দিয়েছে। ওর দেখাদেখি অনিতারও হাই উঠল । রঞ্জনের বুকের উপর ঘুমের ঘোরে অনিতা ঢলে পড়ল ।
পলির দৃষ্টি জানলার বাইরে। দূরে আরও দূরে ছুটছে। কখনও ফিরে আসছে কামরায়। হকাররা ভিড় ঠেলে এগোচ্ছে, ঝালমুড়ি ঝালমুড়ি। এই অনি ঝাল মুড়ি খাবে? উত্তরের অপেক্ষা না করে রঞ্জন ঝাল মুড়ি অর্ডার করল । আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে —একজন অন্ধ লাঠি হাতে গান গাইছেন । গলায় সুর আছে । কেউ কেউ খুচরো পয়সা ওনার হাতে গুঁজে দিচ্ছে, কেউ কেউ চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। দাশ নগর স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াল। যতজন নামল তার থেকে দ্বিগুন বেশি লোক উঠল । পলি শরতের আকাশ, পেঁজা তুলোর মতো ভাসমান মেঘ, বিস্তৃত মাঠ, সারি সারি গাছপালায় ডুবে আছে । সেফটিপিন, চিরুনি, সায়ার দড়ি, কানের দুল । একজন বয়স্ক যাত্রী সব জিনিস ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছেন । কুড়ি টাকার নোট ধরিয়ে কয়েক প্যাকেট সেফটিপিন আর দুটো চিরুনি কিনলেন…
সোনপাপড়ি মুচমুচে খাজা মিষ্টি ভারি, মুখে দিলে মিলিয়ে যাবে । ১০ টাকায় এক বাক্স। এই কয়েক প্যাকেট কিনে নাও না। রঞ্জন বলল, কি হবে, মিষ্টি তো নিয়েছি। আরে নাও না ভাইগুলো তো আছে।
সাঁতরাগাছি স্টেশন পেরিয়ে ট্রেন ছুটছে । রেললাইনের ধারে ছোটো দিঘিতে পদ্মফুল হাঁসছে । পলি চিৎকার করে বলল— দেখো দেখো বৌদি…
হ্যাঁ, তোদের শহরে তো দু একটা স্থল পদ্ম গাছ চোখে পড়লেও দিঘি ভরা পদ্ম দেখা যায় না। আর গ্রামে অন্য ছবি । এখান থেকেই তো পদ্মফুল শহরে যায় । দুর্গাপুজোয় ১০১ খানা পদ্ম লাগে । পদ্মচাষিরা পুজোর অপেক্ষায় দিন গোনে । জানিস পদ্ম ফুল তুলতে গিয়ে অনেকেই সাপের কামড় খেয়ে প্রাণ হারায় ।
আহা রে, বলেই পলি মুখ ঘুরিয়ে আবার আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় ।
খানিকবাদে রঞ্জন বলল, চলো এবার নামতে হবে।স্টেশনে নেমে পলি দেখল হলুদ সাইনবোর্ডে। কালো কালির সাঁকরাইল জংশন । ওভার ব্রিজ পেরিয়ে ওরা বাজারের দিকে এল । বাজারে এক কোণে একটা ছোটো পুজো প্যান্ডেল। আরম্বর নেই, কিন্তু নিয়মের খামতি নেই। মন্ডপের ছেলেমেয়েদের ভিড়। পরনে নতুন জামার উচ্ছ্বাস। মাথায় লাল গামছার ফেট্টি জড়িয়ে এক মনে ঢাক বাজাচ্ছেন একজন ঢাকি । পুজো মণ্ডপের একপাশে কাঁশফুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে । মাথায় রাঙ্গা সিঁদুর, পায়ে গাঢ় আলতা, লালা পেড়ে সাড়ি পড়ে পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত মহিলারা । সবাই যেন মা দুর্গার শান্ত, মিন্ময়ী প্রতিমার প্রতিরূপ ।
পলি জানতে চাইল, বৌদি আর কতো দূর? এই তো উঠে পড় ভ্যানে। মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা তিন চাকা গাড়িতে ওরা উঠে পড়ল। চওড়া রাস্তা দুপাশে সারি সারি ইউক্যালিপটাস গাছ । অনিতার সঙ্গে গল্পে মশগুল পলি । অনিতা ওকে দু’পাশের গাছপালা বাড়িঘর দেখাচ্ছে । দিগন্তে বিস্তূত ফাঁকা মাঠ। জমি ভরা ফসল। কাঁচা বাড়ির মাঝখানে দু একটা পাকা ঘর । হঠাৎ রাস্তার ধারে একটা গাছ দেখিয়ে অনিতা বলল দেখ পলি, এই গাছটায় আমাদের পাড়ার একজন গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে । জানিস রাতে এখানে অনেকেই নিশির ডাক শুনতে পায় । ভ্যানওয়ালা কাকু হাসতে হাসতে বলল— কিরে সখি শহরে বিয়ে হয়ে গেল তোর তবুও ছেলেমানুষি গেল না। ধুর বাচ্চা মেয়েটাকে ওসব বলিস না ও ভয় পাবে । পলি ভালো করে গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখল । ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড গাছটা । রোদে কচি পাতা গুলো চিকচিক করছে ।
♦♦♦
অনিতার বাবা-মা খুব খুশি। মেয়ে জামাই এসেছে। অনিতার মাসিও তার ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন। অনিতার দুই ভাই পুলক আর তিলক, মাসির মেয়ে নমিতা আর ছেলে সজল। এরা পলির সমবয়সী। জমজমাট আড্ডা । পলির ভালো লাগছে ।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার শেষ। বড় মাটির বারান্দায়, চাটাই বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে সবাই গল্প করছে। পুলক বারবার পলির দিকে তাকাচ্ছে আর চোখ টিপছে। পলি মনে মনে ভাবছে, ছেলেটা খুব বদ। কথা বলতে বলতে হঠাৎ ভুতের প্রসঙ্গ উঠে এলো। পলি বলল- ধূৎ, ভূত বলে কিছু আছে নাকি। অনিতা রঞ্জন দুজনেই দুজনেতে মশগুল। অনিতার মাসির মেয়ে নমিতা, পুলক তিলক আর সজল বলছে ভূত আছে । নমিতা বলল, তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো যখন ভুতের সামনে পড়বে না আত্মারাম খাঁচা হয়ে যাবে । পুলক বলল, ঠিক বলেছিস । শহরের মেয়েরা নিজেদের একটু বেশি স্মার্ট মনে করে । পলি মুখ বেঁকিয়ে বলল তাই তো, আমরা তো স্মার্টই । ঠিক আছে, সময় এলেই দেখা যাবে।
সেজেগুজে বিকেলের সঙ্গী হয়ে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়ল ওরা । ট্রেনে করে আমতলায় নেমে কয়েকটা ঠাকুর দেখার পর, বড় একটা মাঠে বিশাল মেলায় ঢুকে পড়ল । সেখানে হাত ভর্তি করে চুরি পড়লো অনিতা- পলি –নমিতা। পুলক- তিলক- সজল বাঁশি কিনল। রঞ্জন খাবার কিনছে আর খাচ্ছে। রাত বাড়ছে। পলি আর হাঁটতে পারছে না । ও বাড়ি ফিরতে চায় । নমিতারও একমত। কিন্তু অনিতা আর রঞ্জন সারারাত ঠাকুর দেখবে বলে ঠিক করল । বাধ্য হয়ে ওরা ছোটরা বাড়ি ফিরবে সিদ্ধান্ত নিল । স্টেশনে পৌঁছে রঞ্জন আর অনিতা ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। ছোটদের গ্রুপটা বাড়ি পথ ধরল । গভীর রাত। ভ্যানগাড়ি নেই । ওরা আবার হাঁটতে শুরু করল ।
ফাঁকা রাস্তায় । চাঁদের নিভু নিভু আলো । ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ আর রেলের ঝিকঝিক আওয়াজটাও আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে । পাঁচজন হাঁটছে । দু’পাশের গাছের সারিতে আটকে আছে চাঁদ । গা ছমছম করা গাঢ় অন্ধকার । এমন সময় পুলক কড়ি আঙুল দেখিয়ে বলল— তোমরা এগিয়ে যাও আমরা আসছি। পলি আর নমিতা আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। নমিতা ভয়ে জড়োসড়ো। রাম নাম জপছে।
এই নমিতা চুপ করো তো । ভয় পাচ্ছ কেন ! ওরা তো এক্ষুনি এসে পড়বে । তোমরা গ্রামের লোকেরা বড্ড ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করো । ভয় আবার কী ?
জানো না তো । অন্ধকারে তেনাদের বাস। পলির হাতে হাত রেখে নমিতা বলল— আমার সত্যিই ভয় করছে । ওরা তো এখনও এল না। অন্য পথ ধরে, বাড়ে ফিরে যায় নি তো !
ভয় কিসের, আমি তো আছি । মুখে একথা বললেও পলির গলাও শুকিয়ে আসছে, হাত-পা আড়ষ্ট । নমিতাকে কিছুই বলতে পারছে না।আর হাত দুই এগোলেই ওই ভুতুড়ে গাছ । অন্ধকারে গাছটাকে দৈত্যের মতো দেখাচ্ছে। নমিতা আর
এগোতে চাইল না। বারবার পেছনে তাকাচ্ছে ওরা । চলো স্টেশনে ফিরে যাই। এমন সময় হঠাৎ গাছ থেকে কারা যেন নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ল ।পলি অজ্ঞান। যখন চোখ খুললো তখন দেখল ওর মাথার কাছে সবাই বসে আছে। রঞ্জনের গলার আওয়াজ কানে বাজল । পলি যে এতোটা ভয় পাবে বুঝতে পারিনি । খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে মিটমিটে হাসি ছড়িয়ে পুলক বলল—কি ম্যাডাম, কেমন লাগছে ?
❤ Support Us