Advertisement
  • খাস-কলম প্রচ্ছদ রচনা
  • ডিসেম্বর ৬, ২০২২

সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাসের তিনদশক পরের সামাজচিত্র। ক্ষমতা মত্ততায় নিঃশব্দ চাবুকের কনসার্ট।

ভাঙন আর ভাবনার সংশয়কে অতিক্রম করে বহুত্বের ভারত, নির্বিশেষের ভারত যে ইমারত গড়ে তুলবে, তা সারকি রাজাদের মিশ্ররীতির বাবরি স্থাপত্যের চেয়ে অনেক উচুঁ, অনেক প্রশস্ত ও সাঙ্কেতিক হয়ে উঠবে

বাহার উদ্দিন
সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাসের তিনদশক পরের সামাজচিত্র। ক্ষমতা মত্ততায় নিঃশব্দ চাবুকের কনসার্ট।

আজ সেই কালো ডিসেম্বর


বারবার অযোধ্যা ছুটে গেছেন। হাতে হাত রেখে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং এখনও একই অঙ্গীকারে অবিচলন তাঁরা। এরকম দুই সাংবাদিক খতিয়ে দেখলেন বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেওয়ার প্রেক্ষাপট আর ইতিহাসকে। ভবিষ্যতের সঙ্কেত ফুটে উঠল তাঁদের উচ্চারণে।


আজ বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেবার ৩০ বছর পূর্ণ হবে। তিন দশকে, সমাজের বহুমুখে– রাজনীতিতে, সংস্কৃতির নির্মাণ আর পূর্ণনির্মাণে ওই সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাসের যে প্রভাব পড়েছে, তার রাহু থেকে ভারতীয় গণতন্ত্রের মুক্তির ইঙ্গিত এখনো অস্পষ্ট। আমজনতা সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ আর সন্ত্রাসের চেহারা নিয়ে ক্ষুব্ধ। কিন্তু সংশয়াচ্ছন্ন রাজনীতি ধুঁকছে।পথও খুঁজছে। কোনও কোনও দল ও তাদের মঞ্চ ঠিক করে নিয়েছে, ক্ষমতার আধিপত্যের নামে সাম্প্রদায়িকতা আর সাংগঠনিক সন্ত্রাসকে সামনে রেখে মেরুকরণ গড়ে তুলবে। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে এই প্রবণতা বেড়েছে । গো বলয়ের বিভিন্ন প্রদেশ তাদের দখলে । কোথাও কোথাও আপোস করে তারা আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে আঁতাত গড়ে তুলে ক্ষমতায় টিকে আছে। ব্যতিক্রম দেশের ১৩টি রাজ্যে। এসব অঞ্চলে তারা পিছিয়ে থাকলেও রাজনীতির মূল স্রোত থেকে দূরে নয়।

ভাঙন আর ভাবনার সংশয়কে অতিক্রম করে বহুত্বের ভারত, নির্বিশেষের ভারত যে ইমারত গড়ে তুলবে, তা সারকি রাজাদের মিশ্ররীতির বাবরি স্থাপত্যের চেয়ে অনেক উচুঁ, অনেক প্রশস্ত ও সাঙ্কেতিক হয়ে উঠবে। বাবরি হত্যায় সাম্প্রদায়িকতা আর সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাসের যে উগ্রতা ভারত দেখেছে, তাকে ভষ্ম করে, রাজনীতির বাইরে স্বতন্ত্র সত্তা তৈরির প্রস্তুতিতে ভারত আজ নিঃশব্দে মগ্ন

তৃণমূল কংগ্রেস তার রাজনীতিক বাধ্যবাধকতা কিংবা স্বাভাবিক ভাবাবেগের বশবর্তী হয়ে পূর্বভারতে প্রায় একা লড়ে যাচ্ছে। কংগ্রেস আর বামপন্থীদের লড়বার শক্তি কি ক্ষয়িষ্ণু? স্বাভাবিক প্রশ্ন। বাবরি ধ্বংসের সন্ত্রাস ভারতের চিরায়ত সত্তায় এবং আধুনিকতার নির্মীয়মাণ স্বপ্নে যে আঘাত দিয়েছে, সে আঘাতের চিহ্ন শুকোতে সময় লাগবে।

মৃত, নিহত বাবরি মসজিদ নিয়ে, তার শোক বুক নিয়ে যাঁরা রাজনৈতিক পরিসর খুঁজছেন, তাঁদের দিশাহীনতার সঙ্গে সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী কয়েকযুগের সামাজিক মিল অস্বীকার করা অসম্ভব। মুঘল রাজশক্তির পতনকে অবক্ষয়মুখী মুসলিম নেতৃত্ব গোটা সমাজের বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। পরিণামে দিকভ্রান্ত সমাজ পিছিয়ে পড়ল। বাবরি ধ্বংসকেও সামাজিক সত্তার ওপর তীব্র আঘাত ভেবে বাবরির লাশ নিয়ে একধরণের নেতির রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাঁরা। এটা এক ধরণের প্রতারণা আর প্ররোচনা। এর বিরুদ্ধশক্তি প্ররোচনায় ইন্ধন জুগিয়ে গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক ঐক্য দাবি করছে। এভাবেই তিনদশকের রাজনীতিতে ছড়িয়ে দেয় কাঙ্খিত অভিপ্রায়। সংস্কৃতির রূপান্তর আর পুঁজি সঞ্চয়ের কৌশলেও সহযোগিতার অভিপ্রায় চাপিয়ে দিচ্ছে। একমুখী সংস্কৃতির অগ্রাসন বনাম বহুত্বের লড়াইয়ে নেতির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। মাঝখানে, উদ্ভট, মুন্ডহীন কালচিত্রে ভারতীয় সমাজের যে ম্লান মুখ, যে রুগ্ন দেহ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা সমাজের বিবেককে ভাবিয়ে তুলছে। টিএস এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ এর ধূসর, নির্মম ভাঙন ফুটে উঠেছে মননের প্রতিভাসে। এই ছবি স্থায়ী হবে না।এ ছবির উদ্বেগ দুষ্পাঠ্য নয়। ভাঙন আর ভাবনার সংশয়কে অতিক্রম করে বহুত্বের ভারত, নির্বিশেষের ভারত যে ইমারত গড়ে তুলবে, তা সারকি রাজাদের মিশ্ররীতির বাবরি স্থাপত্যের চেয়ে অনেক উচুঁ, অনেক প্রশস্ত ও সাঙ্কেতিক হয়ে উঠবে। বাবরি হত্যায় সাম্প্রদায়িকতা আর সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাসের যে উগ্রতা ভারত দেখেছে, তাকে ভষ্ম করে, রাজনীতির বাইরে স্বতন্ত্র সত্তা তৈরির প্রস্তুতিতে ভারত আজ নিঃশব্দে মগ্ন। এ মগ্নতার প্রকাশ ঘটবে আগামী কয়েক দশকে। হতাশার রাজনীতি, উগ্রতার ক্ষমতামত্ততা আর আরোপিত বিচ্ছিন্নতা হাঁটতে হাঁটতে যাদুঘরে আশ্রয় নেবে।

 পড়ুন: ক্ষমতার স্বার্থ আর বাবরি ভাঙার রাজনীতি, নেপথ্যে আদবানির কৃতিত্ব: দেবাশিস ভট্টাচার্য

 


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!