- দে । শ প্রচ্ছদ রচনা
- জুলাই ১৩, ২০২৪
অন্ধ্রে ১১ বছরের বালিকা পরিণত ক্রীতদাসে।দেশজুড়ে অর্থে বিকোচ্ছে শৈশব, কী পদক্ষেপ প্রশাসনের ?

অর্থের বিনিময়ে শিশু বিক্রি । গত কয়েকমাসে, দেশ জুড়ে এমন এঘটনা প্রায় রোজনামচায় পরিণত । ক্রমশ সক্রিয় হচ্ছে শিশুপাচার চক্র । অর্থের বিনিময়ে শৈশব কিনে, তাদের পরিণত করা হচ্ছে ক্রীতদাসে ।
জুলাইয়ের ৮ তারিখ, সুলতানপুরি পুলিশ স্টেশনে খবর আসে, একটি এক বছরের ছেলে কৃষাণ বিহারের কাঞ্ঝাওায়ালা রোড থেকে ৬ জুন রাত সাড়ে দশটা থেকে নিরুদ্দেশ । রাজধানীর পুলিশ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ছেলেটিকে ‘এস’ আদ্যক্ষরের একজন মহিলা তুলে নিয়ে গেছে । অসংখ্য সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ এবং সন্দেহভাজনদের ফোনকলের বিশদ বিশ্লেষণ করার পরে, শিশুটিকে অপহরণ করার জন্য অভিযুক্ত মহিলাকে দিল্লির কৃষাণ বিহারে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল । নিরন্তর জিজ্ঞাসাবাদে, সে পুলিশকে জানায় যে সে অভিযোগকারীর কাছ থেকেই দেড় লক্ষ টাকায় শিশুটিকে কিনে অন্য মহিলার কাছে ২ লক্ষ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে ।
পরবর্তীকালে পুলিশের জালে ধরা পরে সেই মহিলাও । জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, সে ইতিমধ্যে ওই শিশুকে মথুরায় এক দম্পতির কাছে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে । দিল্লি পুলিশের একটি দল মথুরায় রওনা দেয়। পুলিশের আধিকারিকেরা ওই শিশুকে উদ্ধার করে । ওই দম্পতিকে আটক করা হয়। পাশাপাশি পুলিশের জালে অন্য এক মধ্যস্থতাকারী মহিলাও ধরা পড়ে।
ধৃত দম্পতির মধ্যে অর্পিত নামের ব্যক্তি জানান , তাঁদের নিজেদের কোনও সন্তান নেই । তাই তাঁরা একটি সন্তান লালন-পালন করতে চান । পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত নারীদের একজন ওই দম্পতির আত্মীয় । তবে এখনই তদন্ত বন্ধ করেনি পুলিশ । তাদের অনুমান এই চক্রের জাল বহুদুর বিস্তৃত ।
তথ্য ঘাঁটলে উঠে আসবে এমন অনেক নির্মম তথ্য । ভারতের মেট্রো শহর গুলির সারাদিনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে এরকম অনেক ঘটনা ছড়িয়ে থাকে এই দুই মেট্রো সিটির অলিতে গলিতে । দিন এখানে রাতের চেয়েও অন্ধকার । আর রাত রহস্যের অতলে । মানব পাচার চক্রের পান্ডারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে কখনও সাধারণের ছদ্মবেশে, কখনও কর্পোরেটের সাদা কলারের আড়ালে । পানশালা , বার, বিভিন্ন হোটেল কিংবা সিগন্যাল সর্বত্রই এই ঘোর বাস্তবতার সঙ্গে ঘর করে এই দুই মায়ানগরী । স্বপ্ন দেখতে আসা মানুষের প্রতিটি দিন এখানে দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে যায় ।
প্রতিদিনের এক দৃশ্য, সিগন্যালে গাড়ি থামা মাত্রই এক বা একাধিক শিশু পঙ্গু, খঞ্জ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভিক্ষার ঝুলি এগিয়ে দেবে আপনার সামনে। আপনি এড়িয়ে গেলেও, তাকে তার সারাদিনের পুঁজি তুলে দিতে হবে কোনও একজন ওস্তাদকে । টাকার অংক কম হলে জুটবে অমানুষিক শাস্তি । এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায় । মৃত্যু । তবে সবার অদৃষ্ট সমান নয় । কখনও কখনও ধরা পড়ে মানব পাচার বা শিশু পাচার চক্রের এক একজন চাঁই । তবে তদন্তে দেখা যায়, তারা নেহাতই চুনোপুঁটি । চক্রের মূল চাবিকাঠি দুবাই , কিংবা আরব দুনিয়া কোনও দেশ, কখনও অন্য কোথাও । শুধু ভিক্ষাবৃত্তি নয়, পৃথিবীর আদিমতম পেশা অর্থাৎ শরীর বিক্রিতেও নারীশিশুর বিপুল চাহিদা । শারীরিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ , বিশেষ করে কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গেও এমন পাচারের ঘটনার যোগসূত্র কিছু কম নয় । ধরপাকড় হয় । ক্ষনিকের জন্য পুলিশি তৎপরতা বাড়ে, তারপর আবার নিজের গতিতে ফিরে যায় শহর । শুধু কি পথে, শহরের একাধিক হাসপাতালে ছড়িয়ে আছে এমন বহু পাচারচক্রের চক্রীরা। শিশু ভূমিষ্ঠ হয়ে তার মায়ের প্রথম স্নেহের স্পর্শ পাওয়ার আগেই হাত বদল হয়ে চলে যাচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে ।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার শিশু অপহৃত হয় । শিশুকন্যা পাচারের সংখ্যাটা আরও ভয়াবহ । সেখানে প্রতি বছর ১২ হাজার থেকে ৫০ হাজার শিশুকন্যা পাচার হয়ে থাকে । কারোর গতি হয় শিশু শ্রমিক রূপে, ভিক্ষার পেশায়, যৌনপল্লীতে , কিংবা পানশালায় । দেশের শৈশব এইভাবে ধুলোয় লুটোচ্ছে । অথচ কঠিন আইন থাকলেও এই অপরাধ মুছে ফেলা যায়নি । দেশে প্রতি বছর মেয়েদের অধিকার রক্ষায় একাধিক আইন, একাধিক রায় ঘোষণা হলেও , আসলে মূল বেঁচে অধিকারটাই সরকার নিশ্চিত করতে পেরেছে কি?
সিনেমা, উপন্যাস, গল্পে এমন একাধিক উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে । তবে বাস্তব উপন্যাসের থেকেও ভয়াবহ । পথচলতি মানুষের ভিড়ে যেমন এই মানব পাচারকারীরা লুকিয়ে থাকে, তেমনই নিজের সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান বলে গণ্য কোনও আত্মীয়ের বাড়িতেও ঘাপটি মেরে থাকে এই নির্মম বাস্তবতা । যেমন – অন্ধ্র প্রদেশে গরমের ছুটিতে মাসির বাড়ি ঘুরতে গিয়েছিল যে ১১ বছরের বালিকা, সে স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল কি যে তার মাতৃসমা আত্মীয়া তাকে নিজের ধার মেটানোর জন্য ৩৫ হাজার টাকায় তার বাড়িওয়ালার কাছে বিক্রি করে দেবে ? ১০ জুলাই পুলিশের তৎপরতায় সে উদ্ধার পেলেও ভুলেও কি সে আর কোনও আত্মীয়ের বাড়ি গরমের ছুটি কাটানোর কথা চিন্তা করবে ! বাড়িওয়ালা তাকে দিয়ে নিজেদের গৃহস্থালির কাজকর্ম করাত । স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পড়াশোনা , হাসি ঠাট্টায় জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তার নিজের জীবন হয়ত অন্য খাতে বইত । তবে সৌভাগ্যবশত তা হয়নি । তার মা জুন মাসে বোনের বাড়ি ঘুরতে গিয়ে তাঁর সহোদরার অপকীর্তি আবিষ্কার করেন । পুলিশ তাঁর বোন ও বাড়িওয়ালাকে গ্রেফতার করেছে ।
গত বছরের জুলাই মাসে, পশ্চিমবঙ্গে এক দম্পতি তাদের আট মাসের শিশুটিকে ২ লক্ষ টাকায় বিক্রি করেন । দম্পতির প্রতিবেশী সন্দেহ প্রকাশ না করলে হয়ত এই রহস্যের যবনিকা পতন হতনা। পুলিশকে খবর দেওয়া হয় এবং খড়দহ এলাকার এক মহিলার কাছ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। প্রিয়াঙ্কা ঘোষ নামে ওই মহিলাকেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
মে মাসে হায়দ্রাবাদে পুলিশ এমন একটি চক্রকে আবিষ্কার করে যারা অর্থের বিনিময়ে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে শিশু বিক্রয় করত । তবে সবার তো আর প্রতিপালক জোটে না । কারোর অদৃষ্টে জোটে আরও মারাত্মক কোনও ভবিতব্য ।
❤ Support Us