- খাস-কলম
- জানুয়ারি ২৫, ২০২৪
রবিন্দ্র সদনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর
বিমল মিত্র সার্থক কথাশিল্পী বলব না কারণ তাঁর অধিকাংশ গল্পে আছে চমক। চমক আলুলায়িত বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে স্থায়ী হয়না কিন্তু তাঁর ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘একুশ দশক শতক’ ইত্যাদি বড় বড় উপন্যাসগুলি বাংলায় ও সারা ভারতে সমাদৃত । উপন্যাসিক হিসেবে তিনি খ্যাতিমান। সেই বিমল মিত্র প্রায়শই বলতেন লেখক এবং যে কোনও সৃজনশীল ব্যক্তির উচিত নিয়ম করে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনা। তাতে মনের মধ্যে আরো উন্নত কিছু সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি হয়। প্রকৃষ্ট উদাহরণ কবি জয় গোস্বামী। যখন তিনি যাদবপুরের সেন্ট্রাল পার্কে ছিলেন, পরপর রোববার গিয়ে দেখেছি একজন তরুণ সেতার শিল্পীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলোচনাসহ সেতার শোনায় মগ্ন। আমার জিজ্ঞেস করার আগেই জয়দা ব্যাখ্যা করলেন ‘আসলে বেশিদূর পড়াশুনো করিনি তো তাই এখন একটু একটু শিখছি এসব ভাল জিনিস।’ আর একবার ১লা বৈশাখে বীজেশ সাহার বাড়িতে বইঘরের আড্ডা থেকে হঠাৎই উঠে পড়লেন: ‘বাড়ি যাই একটু একটু ‘কুন্দেরা’ পড়ব।’ এই সময়ের প্রধান কবির এই যে একটু একটু ক্লাসিক সাহিত্য পড়া বা একটু একটু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শোনা হয়তো তাঁকে তৈরি করেছে একজন সেরা পাঠক হিসেবে গড়ে তুলতে। তিরিশ বছর আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেন: ‘তোমার গুরু কে ? মানে কোন্ কবির কবিতা তোমাকে কবিতা লেখায় উদ্বুদ্ধ করে ?’ আমার উত্তর দেওয়ার আগে জয়দা নিজেই বললেন: ‘অরুণ মিত্র।’ একেবারেই সত্যি কথা। আসলে প্রবীণ এবং সমসাময়িক কবি কে কী লিখেছেন এবং লিখছেন তাঁর নখ দর্পনে। এতটাই তাঁর পড়া এবং খোঁজ রাখার অভ্যেস। অন্তত কবিতার এমন মহাপাঠক আর দেখিনি।
কিন্তু অনেকের মতো আমার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনার সুযোগ হয়নি। আবার একদম শুনিনি যে তা নয়। নব্বই দশকের গোড়ায় রবীন্দ্রসদনে শুনেছি সারারাতব্যাপী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। প্রথমে ছিল আলি হোসেনের সানাই। মোহিত হওয়ার মতোই বিষয়। ভোররাতে ছিল অরুণ ভাদুড়ির ভৈরবী রাগে কন্ঠ সঙ্গীত। তার আবেশ এমনই যে হরিশ মুখার্জি রোড ধরে হেঁটেই আলিপুর চলে গেছি, রাস্তায় বাস বেরিয়েছিল কিনা খেয়াল নেই। পরে ফোনে আমার মুগ্ধতার কথা জানিয়ে অরুণ ভাদুড়িকে অনুরোধ করি: ‘আমার বাৎসরিক সাহিত্য সভায় এসে কি একবার কন্ঠসঙ্গীত শুনিয়ে যাবেন ?’ একটু সময় নিয়ে বললেন: ‘আমার সাম্মানিকের বিষয়টা যদি বাদই দিই ,আমাকে কি এক ঘন্টা সময় দেওয়া যাবে, ভেবে বলুন।’ আগে কাউকে কাউকে রাগ সঙ্গীতের জন্য ৪০/৪৫ মিনিট সময় দেওয়াতে অনেকেই অখুশি একজনকে এতটা সময় দেওয়ার জন্য। তাই আমার ফোন আর যায়নি। আপশোষ রয়ে গেছে । তার কিছু পরে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে শুনেছি রবিশঙ্করের সেতার। সেদিন তিনি অবশ্য বেশি সময় দিয়েছেন কন্যা অনুষ্কাশঙ্করকে। অসাধারণ রবিশঙ্কর, আর উজ্জীবনে অনুষ্কাশঙ্কর। মনে পড়ল একবার গিয়েছিলাম পাথুরিয়াঘাটার খেলাত ঘোষের বাড়িতে দুর্গোৎসবে। এই সেই খেলাত ঘোষ যাঁর ভাগলপুর এস্টেটের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের চাকরি নিয়েছিলেন পথের কবি বিভূতিভূষণ। খেলাত ঘোষের বাড়িতে গিয়ে আমি তো অবাক! সারা দেয়াল জুড়ে ছবি সহ বিবরণ কোন্ বছর বাংলা ও ভারত বিখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পীদের কে কবে তাঁর বাড়িতে এসে পারফর্ম করে গেছেন। তার হদিস আগে পাইনি তবে কিছু ভাগ্যবানের খোঁজ পেয়েছিলাম যাঁরা খেলাত ঘোষের বাড়িতে বাৎসরিক সুর সুধা পান করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন যেমন সদ্য প্রয়াত ছড়াকার ও পেঁচা সংগ্রাহক দীপ মুখোপাধ্যায় যাঁর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা ছিল দীর্ঘদিন অথচ ভুলবোঝাবুঝি হয়নি একদিনও।
বছর দুই আগে বেহালায় শুনেছি মাঝরাত পর্যন্ত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত । হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে সবাই ভেসে গেলাম শুধু নয় সারাক্ষণ বাংলাভাষায় রসিকতা করে পেটে খিল ধরিয়ে দিলেন।
ডোভারলেন মিউজিক কনফারেন্সে কখনও যাইনি, প্রথমে সিংহি পার্কের কাছে রাস্তায় হত, কলকাতায় নতুন আসা রাশিদ খানকে এই সময় অবজ্ঞা করা হয় তাঁর পরিচয় ছিল না বলে। পরে যখন নিমন্ত্রণ পান তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল: ঐদিন তাঁর প্যারিসে অনুষ্ঠান আছে, উড়িয়ে আনতে পারলে অন্য একদিন পারফর্ম করবেন ( সূত্র: বৌধায়ন মুখোপাধ্যায় )। রাস্তা ছেড়ে পরে বড় পরিসরে হতে থাকে রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়াম হলে। তারও পরে বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পেয়ে এখন হয় তাঁদের নিজস্ব তৈরি বাড়িতে। তাঁদের সঙ্গীত সম্মেলন হয় জানুয়ারির শেষে।
গত রোববার ২১-৯১-২০২৪ তারিখে ভাবলাম বইমেলায় প্রচন্ড ভিড়, রবীন্দ্রসদন একতারা মঞ্চে বরং রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর আয়োজিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলনের শেষ দিনে যাই। গিয়ে দেখি হাজারের বেশি আসন একটাও খালি নেই। বাঁদিকে চলছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীদের জীবনী নিয়ে চমৎকার প্রদর্শনী। চোখ রইল প্রদর্শনীর দিকে, কান মঞ্চে। চারজনের মধ্যে প্রথমে খেয়াল গাইলেন ওয়াসিম আহমেদ খান, তবলায় পন্ডিত সমর সাহা। আগে বেলাহার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলনেও দেখেছি আন্তজার্তিক তবলা শিল্পী সমর সাহার উজ্জ্বল উপস্থিতি। এদিন সারেঙ্গিতে ছিলেন সারওয়ার হোসেন। হারমনিয়ামে গৌরব চ্যাটার্জি।
দ্বিতীয় উপস্থিতি: সরোদ বাদনে পন্ডিত পার্থসারথি চৌধুরী । রাগ মুসলতানী পরে রাগ কিরবানী। তবলায় পন্ডিত সন্দীপ ঘোষ এবং তানপুরায় মৌসুমী দত্ত। তৃতীয়জন বিদুষী শুভ্রা গুহ। তাঁর কন্ঠসঙ্গীতে ছিল টপ্পা ও ঠুংরি। হারমোনিয়ামে রূপশ্রী ভট্টাচার্য।
শেষ শিল্পী সেতারে পন্ডিত কুশল দাস( ছবিতে লাল জামা)। রাগ গোরোককল্যাণ পরের রাগও গোরোককল্যাণ। তবলায় পন্ডিত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী, তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, বিক্রম ঘোষ, তন্ময় বোস, দেবজ্যোতি বোস এবং কে নয় ? সেদিনের সুর মুর্ছনা হৃদয়ে রয়ে যাবে আরো কিছুদিন, বুঝি অথবা না বুঝি…
❤ Support Us