- খাস-কলম
- ডিসেম্বর ১১, ২০২৩
সমরেশ বসু সম্পর্কে আমরা যা জানি এবং জানি না
আজ কথা সাহিত্যিক সমরেশ বসুর জন্মশতবার্ষিকী শুরু । এতদিন তাঁকে নিয়ে যা হয়েছে, তা বাদ দিন, এখন আশা করি দুই বাংলায় এবং বর্হিবিশ্বে বাঙালির মধ্যে তাঁকে নিয়ে আলোচনা, লেখালেখি ও চর্চা চলতে থাকবে । তাঁকে নিয়ে যে দুটো স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল তার একটি হল, গত শতাব্দীর আশির দশকের গোড়ায় তাঁর সম্পাদনায় ‘মহানগর’ সাহিত্য পত্রিকার আর্বিভাব । শ্যামবাজার অঞ্চল থেকে প্রকাশিত আকারে, আয়তনে ও লেখায় সমৃদ্ধ এতবড়ো পত্রিকা দেখে মনে হয়েছিল ‘অমৃতবাজার’ গোষ্ঠীর ‘অমৃত’ পত্রিকা তো বন্ধ হয়ে গেল, এটা তার বিকল্প বা তার থেকে বেশি কিছু । আমাদের দুর্ভাগ্য যে বেশিদিন মহানগর প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি । দ্বিতীয় স্মৃতি, কলকাতা বইমেলায় লেখক-পাঠক সমাবেশে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। খোলামেলা পরিবেশে বহু প্রখ্যাত কবি ও লেখকের মধ্যমণি হয়ে পাঠকদের কাছ থেকে আসা প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিতে কোনোদিন ভুলে যাওয়ার নয় ।
কেবল ভাষাশিল্পী ছিলেন না, বুঝেছিলেন পাপে পুণ্যে হেজে মজে গাঁজিয়ে ওঠা জীবনকে সাষ্টাঙ্গে সাপটে ধরতে হলে শুধু জীবনশিল্পী হলেই চলবে না, হয়ে উঠতে হবে জীবন শিকারী। অস্থির প্রাণের আবেগ নিয়ে অমৃতকে বিষের পাত্রে ধরতে চেয়ে সাহিত্য কর্মের জটিল ও অবিচ্ছিন্ন ধারাকে সামনে রেখে আগাগোড়া তিনি একক প্রচেষ্টায় সাহিত্যের পথ তৈরির কাজে ব্রতী ছিলেন আমৃত্যু
ঢাকার রাজনগরে জন্ম, শৈশব কাটে বিক্রমপুরে এবং কৈশোর অতিবাহিত করেন নৈহাটির আতপুরে। দারিদ্রের মধ্য দিয়ে বস্তির জীবন অতিবাহিত উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা-কাকার থেকে পেয়েছিলেন ছবি আঁকার নেশা, বাবা মোহিনীমোহন বসুর কাছে গানের গলা এবং মা শৈবালিনীর কাছে গল্প বলার টেকনিক। আর নিজের ছিল অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতা। শ্যামলা রঙের সুদর্শন যুবক বাঁশিতে ফুঁ দিলে তাঁকে দেখাত স্বয়ং কৃষ্ণ যেন নেমে এসেছেন মর্তভূমে । ছোটবেলা থেকে তাঁর ছিল অদম্য সাহস । সংসারের অভাব ঘোচাতে তাঁকে বহু বিচিত্র পেশায় যুক্ত হতে হয় । ফেরিওয়ালা, কখনো বা পরাধীন ভারতে সাহেবদের কোয়ার্টারে কোয়ার্টারে ডিম সরবরাহ, কখনো জুট মিলের কর্মী, কিছুদিন ঢাকেশ্বরী কটন মিলেও কাজ করেছেন । ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত চাকরি করেছেন ইছাপুর কামাল ফ্যাক্টরিতে । তার আগেই আগস্ট আন্দোলনের বছর বিয়ে করেন তাঁর থেকে চার বছরের বয়সে বড়ো কাঁঠাল পাড়ার মেয়ে গৌরী মুখোপাধ্যায়কে । ইন্টার- কাষ্ট বিয়ে । খাঁটি কায়স্থ বাঙাল বিয়ে করলেন বাল্যবিধবা ব্রাহ্মণ মেয়েকে প্রেম করে । এই সময় পর্যন্ত তাঁর নাম ছিল সুরথনাথ বসু । বাবার দেওয়া এই নাম নিয়ে তিনি কোনও লেখা প্রকাশ করেননি । বাল্যবন্ধু ও শ্যালক দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের দেওয়া সমরেশ ( বিষ্ণুর অবতার ) নাম নিয়ে তিনি গল্প ও উপন্যাস লিখতে থাকেন একের পর এক । “কালকূট’ ছদ্মনাম নিয়ে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’। আনন্দবাজার পত্রিকা তাঁকে পাঠায় কুম্ভ মেলায় । কুম্ভমেলার অজ্ঞাত পর্ব, তাঁর মতো মনোরম ও আবিস্কারের ভঙ্গিমায় আর কেউ লিখতে পারেননি আজ পর্যন্ত । সমরেশ বসু আবার আনন্দ বাজার কতৃপক্ষ কে জানতে দেবেন না বলে ‘ভ্রমর’ ছদ্মনামে অন্তত তিনটি উপন্যাস লিখেছেন ‘প্রসাদ’ পত্রিকায় । উপন্যাস তিনটির নাম: ‘যুদ্ধের শেষ সেনাপতি’, ‘প্রভু কার হাতে তোমার রক্ত’ এবং ‘প্রেম -কাব্য- রক্ত’ । ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর আস্থা ছিল চরৈবতি মন্ত্রে কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য হিসেবে সক্রিয় থাকাকালীন তিনি শিখেছিলেন কাকে বলে ডিসিপ্লিন । ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ পেয়ে পার্টি নেতৃত্বের প্রতি এবং পার্টির প্রতি অত্যন্ত অনুগত ছিলেন । নিজের হাতে পোস্টার লিখে দেয়ালে দেয়ালে ,গাছের গুঁড়িতে সেঁটেছেন। স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে তাঁকে ১৯৪৯- ১৯৫০ সাল পর্যন্ত জেল খাটতে হয় । জেলে থাকাকালীন লেখেন উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ । ২১ বছরে লেখেন প্রথম উপন্যাস ‘নয়নপুরের মাটি’ । জেলে বসেই মনে মনে বিশ্লেষণ করেন পার্টির হালহকিকত । তাঁর নজরে এসেছে বহু পার্টি কর্মীর স্বার্থপরতাসহ নানা নেতিবাচক দিক । তাই সিদ্ধান্ত নিলেন পার্টি ত্যাগ করে লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন কিন্তু রাজনৈতিক চেতনাপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেনা কখনোই । যদিও তাঁর ‘বিবর’ উপন্যাসে অশ্লীলতার গন্ধ পেয়ে পার্টি তাঁকে বহিষ্কার করলে কাকাবাবু মুজফফর আহমেদের কাছে কেঁদেছিলেন । পরিতাপের বিষয় এই যে, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন পরিচয় পত্রিকার দায়িত্বে, সমরেশ বসুর একটি গল্প তিনি বাদ দিয়ে দেন । এক সময় দেখা গেল সমরেশ বসুর মতো সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও কমিউনিস্ট দল থেকে বহু যোজন দূরে । আসলে হয়তো রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার থেকে একজন লেখক হওয়াই ছিল সমরেশ বসুর নিয়তি বা ভবিতব্য ।
সমরেশ বসু কেবল ভাষাশিল্পী ছিলেন না, বুঝেছিলেন পাপে পুণ্যে হেজে মজে গাঁজিয়ে ওঠা জীবনকে সাষ্টাঙ্গে সাপটে ধরতে হলে শুধু জীবনশিল্পী হলেই চলবে না, হয়ে উঠতে হবে জীবন শিকারী। অস্থির প্রাণের আবেগ নিয়ে অমৃতকে বিষের পাত্রে ধরতে চেয়ে সাহিত্য কর্মের জটিল ও অবিচ্ছিন্ন ধারাকে সামনে রেখে আগাগোড়া তিনি একক প্রচেষ্টায় সাহিত্যের পথ তৈরির কাজে ব্রতী ছিলেন আমৃত্যু । তাই ‘গ্রেট কলকাতা কিলিং’ এর বছরেই তাঁর নির্মাণ ‘আদাব’ গল্প । গল্পটি যদিও ঢাকা শহরে দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে । এ গল্পে প্রবল হয়ে উঠেছে শ্রমজীবী মানুষের হৃদয়বান ঐক্যের প্রবণতা । সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নাটকীয় পরিবেশে আটকে পড়ে দুজন শ্রমজীবী মানুষ । দাঙ্গা প্রতিরোধে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর হৃদয়হীনতা অসাধারণ দক্ষতায় ভাষা পেয়েছে গল্পে । শেষ পর্যন্ত গল্পে প্রধান্য পেয়েছে শ্রমজীবী মানুষের ধর্ম নিরপেক্ষ জীবনলিপ্সা । এত বিচিত্র বিষয় ও ভাবনা নিয়ে তার খুঁটিনাটিসহ বিবরণ বাংলা সাহিত্যে উঠে আসেনি এর আগে । ১৯৪৬ সালে পরিচয় পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় তাঁর প্রথম গল্প ‘আদাব’ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক সমাজ বিশেষ করে কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে বাংলা ভাষায় একজন প্রতিভাধর সাহিত্যিকের আর্বিভাব হয়েছে । যদিও তাঁর পড়াশুনো অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত । বাঙালির মননকে নাড়িয়ে দেওয়া তাঁর অসংখ্য গল্পের মধ্যে যদি ‘শুভবিবাহ’ গল্পটির কথাই প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি ? কিছু রিক্সাওয়ালা ঠিক করেছে, তাদের এলাকার এক ভিখারির সঙ্গে বিয়ে দেবে এক ভিখারি মহিলার । বিয়েতে প্রথম গররাজি ছিল ভিখারিনি । পরে রাজি হয় এই শর্তে যে বিয়ের পর সে আর ভিক্ষে করতে পারবে না শুধু নয়, স্বামী যদি ভিক্ষে করে চাল আনে সে চালের ভাত সে খাবে না । সে কেবল গৃহিনীর মতো সংসারের কাজ করবে । সে ক্ষেত্রে রিক্সাওয়ালাভাইদের কিছু কাজ পাইয়ে দিতে হবে তার বরকে । এ গল্প তো অবশ্যই এক মহান বার্তা দেয় সমাজকে এবং সরকার ও সমাজ ব্যবস্থাকে…।
❤ Support Us