- খাস-কলম
- জুলাই ১৬, ২০২১
কুমিরকে সাদরে আহ্বান করেছি ঘরের ভেতর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
১৪ মে, কলকাতা। এক রাজনৈতিক তাণ্ডবে বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হল। ঘটনাটি শুধু নিন্দাজনকই নয়, একটি আসন্ন নৈরাজ্যের সংকেত। সুবিধাবাদীরা যে যার নিজের লাভের অঙ্ক কষে ঘটনাটিকে নিজেদের মতো ব্যবহার করে আখেড় গোছাবেন। কিন্তু তারা যে আসন্ন নৈরাজ্যের কথা ভাবেন না, তেমনি কেন এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে তার কারণ গুলি খোঁজার উদ্যোগও নেবেন না। ফলে এমনতর ন্যক্কারজনক ঘটনা ক্রমাগত ঘটছে। যেভাবে বছর ছয়েক আগে কলেজস্ট্রিটেই প্রেসিডেন্সি কলেজে কিংবা তারও আগে বিধানসভায় ভাঙচুরের ঘটনা।
সংস্কৃতির চর্চার মতোই বাংলার রাজনীতির জগৎ সমগ্র ভারতর্ষের প্রেক্ষিতে অনেকটাই স্বতন্ত্রধর্মী ছিল। বিশ্বায়নের প্রভাব সেখানেও থাবা বসিয়েছে। যে সংবেদনশীল বিষয়গুলিতে বাংলার রাজনীতি সচেতন ভাবেই উদাসীন থেকেছে, অগ্রাহ্য করেছে। সেগুলিকেই আজ আমরা অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলছি।
ঘটনার প্রাথমিক দায় কার, বিতর্ক চলবে। কিন্তু আসল কারণ রাজনীতি, এ নিয়ে। বিবাদ নেই। সাম্প্রতিক বাংলায় যে অসভ্যতা এবং অনাচার চলছে তারই একটি সার্থক দৃষ্টান্ত এ ঘটনা। যারা মূর্তিটি ভেঙেছে, তারা হয়তো জানেও না মূর্তিটা কার, কে ছিলেন বিদ্যাসাগর, আধুনিক ভারতে শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান, বাংলার সমাজ জীবনে অনস্বীকার্য প্রতিষ্ঠার কথা। মজার বিষয় এই ঘটনার প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রাজ্য তথা দেশের আনাচে-কানাচে যেসব কর্মকাণ্ড হবে তাতে অংশগ্রহণকারী সাবাই কি বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় কীর্তি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। কিছুদিনের মধ্যেই হয়েতো ভাঙা মূর্তির জায়গায় বিদ্যাসাগরের আরও দামী মূর্তি বসবে, ঘটা করে উদ্বোধন হবে, বাংলা ও বাঙালি নিয়ে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বৃহদাকার, অনেক অসার, ক্লিশে হয়ে যাওয়া কথাও হবে; কিন্তু এই অসভ্য হিংস্রতা থামবে না, তাৎক্ষণিকতায় মগ্ন পাব্লিক আবার নতুনতর ঘটনায় উদ্বিগ্ন বা ক্ষুব্ধ বা উল্লসিত হবেন।
বিদ্যাসাগর হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মণ-সন্তান, মুসলমান নন। তিনি সন্তবাদী বা কুপোমুন্ডুক কোনো মতাদর্শবাদী ছিলেন না।মারাও গেছেন এক শতাব্দীর ওপর; তাহলে এই আক্রমণ কেন?
যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা এ উত্তর দিতে পারেব না। কারণ ঘটনাটি একটা চূড়ান্ত উশৃঙ্খলতার ফল, যা কোনো দার্শনিক মতাদর্শ বা সুপরিকল্পিত সক্রিয়তার দ্বারা পরিচালিত নয়। সংস্কৃতির চর্চার মতোই বাংলার রাজনীতির জগৎ সমগ্র ভারতর্ষের প্রেক্ষিতে অনেকটাই স্বতন্ত্রধর্মী ছিল। বিশ্বায়নের প্রভাব সেখানেও থাবা বসিয়েছে। যে সংবেদনশীল বিষয়গুলিতে বাংলার রাজনীতি সচেতন ভাবেই উদাসীন থেকেছে, অগ্রাহ্য করেছে। সেগুলিকেই আজ আমরা অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলছি। আমরা সাম্প্রদায়িক নই-এটা প্রমাণ করতে গিয়ে আমরা বহুক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছি। রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক করে রাখার কৌশল বর্জন করে কুমিরকে সাদরে আহ্বান করেছি ঘরের ভেতর।
এসব কথা বলার ঝুঁকি অনেক; কায়ই চিরকালই সংখ্যালঘুরা সমাজে বিপন্ন, অসহায়, সত্যিকারের সংখ্যালঘুরা তো আর কোনো ধর্মের ধ্বজাতলে নেই। তারা যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তার ধারক বাহক হতে চায়।