Advertisement
  • খাস-কলম প্রচ্ছদ রচনা
  • আগস্ট ১২, ২০২২

অসমে বাংলা ব্যানারে কালো চিহ্ন! নীরব কেন বুদ্ধিজীবিদের একাংশ?

বহুভাষিকতা আর সংস্কৃতির বহুত্বকে বাঁচাতে হবে । না হলে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে, পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়তে থাকবে। এসব মারাত্মক সংক্রমণ ও আরোপিত অসুখকে রুখতে হলে দরকার সামগ্রিক ঐক্যের মজবুত বিস্তার ।

বাহার উদ্দিন
অসমে বাংলা ব্যানারে কালো চিহ্ন! নীরব কেন বুদ্ধিজীবিদের একাংশ?

চিত্র সংগৃহীত

অসমে জাতিবিদ্বেষ ক্রমাগত চওড়া হচ্ছে। বাংলা নাম ফলকে, ব্যানারে কালো ছড়িয়ে দেওয়ার কদর্য ঘটনা বাড়ছে। এমন উগ্রতার বিস্তারে ক্রুদ্ধ, শঙ্কিত বহু মানুষ। শঙ্কার কারণ, বিভাজনের ঘৃন্ন ছক আর একভাষিকতার সন্ত্রাসের কবলে পড়তে পারে বহুজাতির, বহুভাষিকের বৃহত্তম রাজ্য। এখানে-ওখানে মৃদু প্রতিবাদের গুঞ্জন উঠেছে। কিন্তু এখনও কোনও রাজনৈতিক দল অথবা বৃহত্তম সামাজিক সংগঠন তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বিস্ময়করভাবে নীরব। বরাকের শিলচরে অসমিয়া ব্যানারে কালি ছিটিয়ে যাঁরা বহুস্তরে নিন্দিত হয়েছিলেন, এবার সে বরাক উপত্যকা ডেমক্রেটিক ফন্টের নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, উজান ও মধ্য অসমে বাংলা ব্যানার আর নাম ফলকের ওপর যে উগ্রতার, যে অন্ধ আক্রোশের বিস্তার দেখা যাচ্ছে, তাতে সরকার ও বুদ্ধিজীবিদের একাংশ নীরব কেন? প্রতিবাদ আর আইনের কঠোর স্বর কোথায়?

বরাক ডেমোক্রেটিক ফন্টের জনভিত্তি প্রশস্ত নয়। প্রায়ই তাঁরা বিভিন্ন ইস্যুতে সরব হচ্ছেন। সম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, রাষ্ট্রীয় ও সংগঠিত সন্ত্রাসের মোকাবিলায় তাঁদের তৎপরতা, একভাষিক অধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও তাঁদের তর্জনির গর্জন আশাব্যঞ্জক।

বেশ কয়েকমাস আগে, শিলচরের তারাপুর রেল স্টেশনের, মেহেরপুর পেট্রোলপাম্পের কাছাকাছি এলাকায়, অসমিয়ায় লিখিত পোস্টারে, বেরং ছড়িয়ে তাঁরা জনসমক্ষে চলে আসেন। হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। নিন্দা বইতে থাকে উজান, মধ্য অসম ও দক্ষিন অসমে। অন্যভাষায় লিখিত বিজ্ঞাপন বিবর্ন করে তোলার ধৃষ্টতা বরাক মেনে নেয়নি। সরকার বরদাস্ত করেনি। ডেমোক্রেটিক ফ্‌ন্টের মুখ্য আহবায়ক প্রদীপ দত্ত রায়কে জেলে যেতে হয়।
প্রদীপ একসময় কংগ্রেস করতেন। প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির শিষ্য। পরে কংগ্রেস ছেড়ে, অগপ আমলে অল কাছাড় ছাত্র সংস্থা (আকমা) গড়ে তুললেন। সল্পায়ু হলেও সংগঠনটি জনভিত্তি পেয়েছিল, জাতীয়তাবাদী মহন্ত সরকারের একপেশে ভাষানীতি , করিমগঞ্জে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ছাত্রহত্যা, বরাকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে জোরদার ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব– তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। প্রদীপের ওই জনপ্রিয়তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অগপ জমানার অবসানে কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল তাঁকে কোনঠাসা করে দেয়।

এরপর একদল ছেড়ে আরেক দলে তাঁর যাওয়া-আসা শুরু। এভাবেই আত্মঘাতী রাজনীতি তাঁকে জনবিছিন্ন করে তুলল। অসমে বি.জে.পি-র দ্বিতীয় সরকারের ভাষানীতি আর সাম্প্রদায়িকতাকে ইস্যু করে কিছু সংখ্যক যুবককে জড়ো করে আরম্ভ হল প্রদীপের তৃতীয় উৎত্থান। গড়ে তুললেন বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্‌ন্ট। ফ্‌ন্টটি কতদিন টিকবে, প্রদীপ আর তার অনুগামীরা টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি না, সংশয় আছে। কারণ, হাওয়া প্রতিকুল। কারণ, সংগঠনের দুর্বল গনভিত্তি। কিন্তু এই মুহুর্তে তাঁদের প্রাসঙ্গিকতা উড়িয়ে দেওয়া– অস্বীকার করা অসঙ্গত। এই যেমন, বাংলা নাম ফলকে, নিখিল বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ব্যানারে কুরুচির হামলাকে তাঁরা সহ্য করেননি। সরকার যেখানে নীরব, অখন্ড বুদ্ধিজীবিদের একাংশ যেখানে নিঃশব্দ, স্তব্ধ– অভিন্ন বাঙালি যেখানে দ্বিধাগ্রস্থ, সেখানে ডেমোক্রেটিক ফন্টের ক্ষুব্ধ কোলাহল অবশ্যই আমাদের ভাবিয়ে তুলবে।

বাংলা ব্যানারে, নাম ফলকে কালো হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে , ‘লাচিত সেনা’ নামক একটি ভুইফোঁড় সংগঠনের নাম উঠে আসছে। যাঁর নাম নিয়ে এই সংগঠন বুজরুকি জাহিরে ব্যস্ত,  সে মহতপ্রাণ লাচিত বরফুকন ছিলেন একজন কালোত্তীর্ন অসমিয়া, অপ্রতিরোধ্য দেশপ্রেমিক

গত কয়েকদিন আগের কথা। বুলডোজার সন্ত্রাস চাপিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল মধ্য অসমের মরিগাঁও জেলায়, ধর্মীয় শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ, সন্ত্রাস উৎপাদনের আঁখড়া হয়ে উঠেছে এ অঙ্গন। এই ঘটনার উৎস কী? নিছক রটনা, না ভিত্তি তার বাস্তব, আমাদের জানা নেই তা। কিন্তু এইভাবে কোনও বিদ্যালয়কে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া, বিভাজনের রাজনীতিকে সংক্রামক করে তোলার মনোভাব বিপজ্জনক। এ বিপদকে, বিপদের অন্যায়কে সহ্য করা আরও বড়ো অন্যায়। বুলডোজার ইস্যুতে সুপরিচিত উদার মুখের, গঠনশীল রাজনীতি এবং বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চি্দ্র নৈঃশব্দ প্রকারন্তের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকেই সমর্থন জোগাচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পঠন-পাঠনে একালের চেয়ে সেকালের গুরুত্ব বেশি। যা, সমাজের অভ্যন্তরে সংশয় ও শূন্যতাকে বাড়িয়ে তোলে। গোটা বিশ্বজুড়ে ধর্মায়তনিক শিক্ষার অতীতমুখিতা সমস্যা হয়ে উঠছে। কিন্তু জঙ্গি তৈরির আস্তানা বলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে গায়ের জোরে নির্মূল করে দেবার প্রচেষ্টা হচ্ছে, তা অযৌক্তিক। অগণতান্ত্রিক। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একধরনের উসকানি। যা অযুক্তির মেদ আর ভেদাভেদকে ইন্ধন জোগাবে। সমাজের যুক্তিহীন জেদের কন্ঠস্বরকে জড়ো করে পেছন দিকে তাকাতে কিংবা আলোড়িত হতে বাধ্য করবে। অসমের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সরকারি প্রশ্রয়ে বুলডোজার হামলার সমবেত নিন্দা দরকার। দরকার বিবেকাশ্রিত বুদ্ধির তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ। দুর্ভাগ্য, মরিগাঁওয়ের ঘটনা নিয়ে সৌভাগ্যবান সেকুলারিষ্টদের নির্দিষ্ট অবস্থান ধোঁয়াটে হয়ে রইল। হ্যাঁ, বি.ডি.এফ. হাইলাকান্দি শহরে, সংবাদ সম্মেলন ডেকে, মরিগাঁও এর বিদ্যাঙ্গনকে গুঁড়িয়ে দেবার নিন্দা করেছে। সুতীক্ষ্ণ কন্ঠে। তাঁদের এই ইতিবাচকতা বিলকুল অবজ্ঞার বিষয় নয়। ঠিক তেমনি, (আগে যা খানিকটা বলা হয়েছে) উজান অসমের বাঙালি অধ্যুষিত তিনসুকিয়ায়, নিখিলবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ব্যানারে, গুয়াহাটির খ্রিষ্টান বস্তিতে সরকারি বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং-এ, অন্য আরও কয়েকটি জায়গায় বাঙালা হরফে কালো ছড়িয়ে দেবার উসকানি নিয়েও বিডিএফ-এর প্রতিবাদ আর ক্ষোভের কারণ ভেবে দেখা জরুরি। তারা প্রশ্ন তুলেছে, সরকার নীরব কেন? সঙ্গত প্রশ্ন।

বাংলা ব্যানারে, কিংবা নাম ফলকে কালো হামলার সঙ্গে জড়িত সন্ধেহে, ‘লাচিত সেনা’ নামক একটি ভুইফোঁড় সংগঠনের নাম উঠে আসছে। কে প্ররোচিত করছে, জাগিয়ে তুলছে, তাদের, জানা নেই আমাদের। যাঁর নাম নিয়ে এই সংগঠন বুজরুকি জাহিরে ব্যস্ত, কিংবা অঙ্গসঞ্চালনে সক্রিয়, সে মহতপ্রাণ লাচিত বরফুকন ছিলেন একজন কালোত্তীর্ন অসমিয়া, অপ্রতিরোধ্য দেশপ্রেমিক। মুঘল আক্রমণ রুখে দিয়ে দেশপ্রেম আর সর্বপ্রেমের অনন্য দূষ্টান্ত হয়ে আছেন। নিজের মামাকে মুন্ডচ্ছেদ করতে দ্বিধাবোধ করেন নি। কারণ, কী, যুদ্ধের মুহূর্তে কর্তব্যে গাফিলতি! ভিন্ন ভাষা আর অন্যের মাতূভাষার হরফকে বিবর্ণ করে দেওয়ার যে কদর্য, যে সংক্রামক, অপ্রেমের হাওয়া বইয়ে দিতে চাইছে ‘লাচিত সেনার’ হঠকারিতা, তা বীর লাচিত বরফুকনের অপমান। অসমিয়া জাতিসত্তার অপমান। অসমের বহুভাষিকতার অপমান। এ অপমানের ভার কেন সহ্য করছে বৃহত্তর সমাজ ? কেন কন্ঠহীন, স্বরহীন সমাজের বাঙময় অংশ।

বাঙালি নেতৃত্বের মেরুদণ্ডে বহুদিন থেকে ঘুণ পোকারা ঢুকে পড়েছে। সম্প্রদায়িক স্বার্থ নিয়ে তারা চিন্তিত, বিভাজিত। দেশভাগের অনেক আগেই এই অশুভ প্রক্রিয়ার শুরু। দ্বিখন্ডিত জাতিসত্তার স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক পরিচিতির পরস্পর বিরোধিতা— প্রতিষ্ঠিত শাসকের রাজনীতিকে রসদ যুগিয়েছে এবং ক্রমাগত বিপন্ন করেছে বাংলাভাষীদের। এ সঙ্কট থেকে, আত্মঘাতী বিড়ম্বনা থেকে, আরোপিত সত্তাবিসর্জন থেকে বাঙালির মুক্তি কোথায়? ঘেরাতর বিপদেও তারা এক হতে পারে না। ১৯৬০ এর বাঙাল খেদা, ৬১র ভাষা আন্দোলন, ৭২ এর উদ্বাস্তু খেদাও, ৬৯-৮৫-র বিদেশি বিতাড়ন— এরকম এমন একটি ইস্যু নেই, যেখানে বাঙালির সংযত ঐক্য আর সমকন্ঠ উচ্চারিত হওয়ার অবকাশ পেয়েছে। সুযোগ এসেছে, আর সে সুযোগকে ঘোলাটে করেছে তাদের ক্ষুদ্রচিন্তা অথবা শাসকের বিভাজননীতি।

বরাক উপত্যকায় বাঙালির ঘনবসতি আর সমগোত্রীয়তা অপেক্ষাকূত বেশি। সে বরাকেও ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে তারা এক হতে পারে না, প্রায়ই ধর্ষকামিতা আর অনৈক্যের শিকার হয়ে পড়ে। বরাকের বঙ্গসন্তানদের এই অনৈক্য নিয়ে একসময়, নির্মম অথচ যুক্তিসঙ্গত মন্তব্য করেছিলেন অবিস্মরণীয় কথাসাহিত্যিক আর সত্যনিষ্ঠ কলমচি হোমেন বরগোহাঞি। তাঁর প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণের বিস্তার সম্ভবত আরও বহুদিন, বহু বছর উজান, মধ্য আর দক্ষিণ অসমের বাঙালিকে ছোঁয়াচে অসুখের মতো ছুঁয়ে থাকবে। এ অসুখ নিরাময়হীন নয়। নেতূত্বের দূরদূষ্টি, বাস্তববোধ আর বহুত্বময়তাই একমাত্র উত্তর-পুর্বের ভাগ্যহত বাঙালির নিয়তিকে বদলে দিত পারে। এরকম জমনুখী, কল্যানমুখী ও গণ আদৃত ব্যক্তিপ্রতিভার উদ্ভাস কোথায় ?


❤ Support Us
error: Content is protected !!