Advertisement
  • খাস-কলম
  • নভেম্বর ৪, ২০২৫

বুক পেতে দাঁড়ান ঋত্বিক

ইমরাজ হাসান
বুক পেতে দাঁড়ান ঋত্বিক

‘ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো’ — নিশ্চয় শতদ্রু, স্মৃতিবিস্মৃত বাঙালি আজ গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসেছেন। আরেকটু ভাবনা এলে বুঝি উত্তরণ হয়। ভুল বললাম হয়তো, অশতীপর বাঙালি হন্নে হয়ে খুঁজে যাচ্ছেন ভোটের কাগজ, নাগরিকত্বের দায়, অস্তিত্বের নাভিকুণ্ডল। পদ্মায় এখন উল্টোস্রোত, গঙ্গা-যমুনা তেহজিবে ঢুকেছে সাগরের লোনা জল। আর এই মুহূর্তে, এই অমোঘ ভাসানের রাতে সীমান্তে বুক পেতে দাঁড়িয়ে আছেন ঋত্বিক, ঋত্বিক কুমার ঘটক। জন্মশতবর্ষের আদেখলা বাঙালির দিকে মিটি মিটি হাসছেন। নবারুণ বলেছিলেন, ‘ঋত্বিকের সিনেমা তাঁর সময়কালে চলেনি। বাঙালি সেদিনও তাঁকে গ্রহণ করতে পারেনি, আজও পারেনা আর ভবিষ্যতেও পারবে না।’

সিনেমার গ্রামার ভাঙছিলেন লোকটা, তৈরি করছিলেন নতুন এক গ্রামার। উদ্ধত দুর্নিবার হাতে আর আগ্নেয় চোখে উৎখাত করে দিচ্ছিলেন সীমান্ত রাক্ষসের থাবা। দেশভাগ ! নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে ঋত্বিকই টোবা টেক সিং। খ্যাপা, নির্মাণ আর ধ্বংসের বাঁশি, মহাকালের ডমরু। এটুকু আমরা জানি। তাঁর সিনেমা, গল্প, নির্মাণ, মাতলামো, পাগলা গারদ, সাংসারিক জীবনে প্রবল ঝড় কিংবা ‘মানুষ থাকবে না কাজ থেকে যাবে দূর্গা’-এর মতো সৃষ্টির ভেতরে থাকবার অমর চাহিদা। আজ এ নিয়ে আলোচনা হয় প্রবল, ক্লান্তিহীন ঋত্বিক প্রেমীরা আঁকড়ে আঁকড়ে ধরেন শীর্ণ লোকটাকে। পাখা ঝাপটায়, মুক্তির আশায় সীমান্ত থেকে সীমান্তে, যুদ্ধ পারাবারের ক্ষত-পুঁজ মেখে পাখা মেলে ঘামে ভেজা, রক্তে ভেজা পোশাক।

কিন্তু এর বাইরে ! একমাথা বজ্র নিয়ে আনাগোনা মেঘের মাঝে, তারাদের প্রবল বিষ্ফোরণে, অ্যাকাডেমিকের নিরস কপচানির বাইরে, খোলা মাঠে, ধুলো ওরা লালমাটির সড়কে, উত্তাল সময়ের ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে গলিতে ঋত্বিক একার্ণব। মহাভারতের বার্বারিক। হাতে তাঁর সৃষ্টি আর ধ্বংসের তীর, কাঁধে ঝুলছে বিধ্বস্ত তূণীর। ফ্যানা গড়াচ্ছে কস বেয়ে, মুণ্ডু খুলে রেখে দিতে হবে নান্দনিক অভিঘাতের পায়ে। সূবর্ণরেখার তীরে, তিতাসের তীরে উদ্বাস্তু ভগীরথ। বিশ শতকের মধ্যভাগে, স্বাধীনতার উল্লাস আর দেশভাগের দুঃসহ বর্তমান, এগিয়ে আসেন, ছুটে চলেন, নির্মাণ ক্রোধে জ্বলে ওঠেন ঋত্বিক।

‘উদ্বাস্তু কারে কয় ? যে কেবল ভূমিচ্যুত হয়, না কি সেও, যার ভাবনা অতলে তলিয়ে গেছে। যাকে নিল না কেউ !’ ভূমিচ্যুত হয়ে, অভিজ্ঞতা আর অন্তরের বিশাল আকাশ মেলে চিন্তা আর চলচ্চিত্রভাষার ভীষ্ম আমাদের ঋত্বিক, কেবল বাঙালির নয়, সীমানা ছাপিয়ে আপামর বিশ্বের নাগরিক ঋত্বিক। লেনিনের ঋত্বিক, হো-চি মিনের ঋত্বিক, রামকিঙ্কর-রবীন্দ্রনাথের ঋত্বিক, সাঁওতাল পরগণার ঋত্বিক। ক্ষুধা আর যন্ত্রণার, নির্মান আর বির্নিমাণের, আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের, কাল আর মহাকালের, সমকাল আর ভবিষ্যতের কারিগর ঋত্বিক। দেশভাগ যার কাছে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিচ্ছেদ নয়, সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। যেখানে ভেঙে যায় মানুষের ইতিহাস, পরিচয় ভেঙে যায়, ভেঙে যায় আত্মার ভিতর পর্যন্ত। তাঁর “দেশভাগ ত্রয়ী”—মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কমলগান্ধার (১৯৬১), ও সুবর্ণরেখা (১৯৬২) বিপর্যয়ের বহুমাত্রিক প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রের নয়, মানুষের ইতিহাস রচিত হয় যেখানে। ব্যক্তিগত ক্ষয় মিশে যায় জাতিগত ট্র্যাজেডিতে। তাঁর কথায়, ‘দেশভাগ একদিনের ঘটনা নয়, এটি প্রতিদিন বাঙালি মানুষের ভিতরে পুনরাবৃত্ত হয়।’ আজও হয়ে চলেছে তাইই। বাঙালি না বাংলাদেশি প্রমাণে ব্যস্ত, ত্রস্ত মলিন জনপদ।

আইপিটিএ— যে সংগঠন শিল্পকে জনগণের সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে দেখত, ঋত্বিক স্বাভাবিক প্ররোচনায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন ওই জলে। এই অভিজ্ঞতা তাঁর শিল্পদৃষ্টিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। নাটক, সিনেমা, গল্পে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের সামাজিক ভাঙন আর শোষণের অব্যক্ত কথন ছাপিয়ে প্রবল রাজনৈতিক বোধ প্রবাহিত। সমাজতান্ত্রিক দুর্নিবার হাওয়া বইছে ধমনীতে। তাঁর কাছে শিল্প ছিল ‘সত্য প্রকাশের’ উপায়, কোনো ভোগ্যপণ্য নয়। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি মূলধারার চলচ্চিত্রকে প্রত্যাখ্যান করে তৈরি করেন এক বিকল্প ভাষা— যেখানে বাস্তবতার সঙ্গে মিথ, সঙ্গীত, লোকসংস্কৃতি এবং প্রতীক বাঁধ ভাঙা জোয়ারে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

এখানেই ঋত্বিক ভারতীয় চলচ্চিত্র-ইতিহাসে, নাগরিক ইতিহাসে, প্রান্ত-প্রান্তরে অনন্য। সিনেমাকে কেবল দৃশ্যমান শিল্প হিসেবে না দেখে সংস্কৃতিচিন্তার মাধ্যম, সমাজের সম্মিলিত ব্রেনে ঘটক হয়ে ওঠেন সাম্যবাদী অনুঘটক। আয়না দেখাতে দেখাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন না, এতটুকু হাত কাঁপছে না, চোখ স্থির। এখানে বুদ্ধের ভারতবর্ষ ঢুকে পড়ে। পুরাণ ও মিথ জীবন্ত হয়ে ওঠে। শাশ্বত বাংলার উপকথা, মঙ্গলকাব্য ঢুকে পড়ে। বেজে ওঠে এসরাজ। ধবনিত হয় মানুষের ভিতরের অন্য জগত, হন্যে হয়ে থামাতে চাওয়া অন্দরের কলিঙ্গ-যুদ্ধ। বাঙালির সাংস্কৃতিক স্মৃতি পুনরুদ্ধার হয়। আধুনিকতার প্রবল ঢেউয়ে ঐতিহ্যের সুর মেখে যিনি নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকেন, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন উদ্বাস্তু কলোনির দিকে তাঁকে কী বলা যায় ? চলচ্চিত্র পরিচালক? বুদ্ধিজীবী ? মেধাবী বঙ্গসন্তান ? না কি হাতে দধীচির হাড় নিয়ে দাঁড়ানো ভারত? গোটা এক দেশ ?

ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের থেকে আলাদা, স্বদেশীয় নন্দনতত্ত্বের দিকে ধাববান লাল ঘোরা। রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারী আবার মার্কসেরও, বুদ্ধের পুনর্জন্ম আবার চার্বাকের কবিও। তাঁর ভিতরে চর্চার চারণ, নজরুলের ঝংকার আবার মাঠের রাখাল, থিয়েটারের রণজয়। যাকে ধরা যায় না, বাঁধা যায় না, কেবল উল্লসিত নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আশঙ্কা আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দাঁড়ানো যায়। চলচ্চিত্র নির্মাতা ছাড়াও তিনি শিক্ষক। ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া-তে তাঁর অধ্যাপনা ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার দুর্বার ধারায় মৌলিক ভূমিকা রেখেছিল। তাঁর ছাত্ররা—কুমার সাহানি, মণি কৌল, জন আব্রাহাম প্রমুখ— যারা তাঁর চিন্তাভাবনাকেই বহন করে নিয়ে যান নতুন শিল্পভাষায়। এতকিছু ‘থাকা’র পরেও, সব হারানো সর্বহারা ঋত্বিকের বহমান সাংস্কৃতিক উদ্বেগ। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা আমাদের গান ভুলেছি, আমাদের নদীর নাম ভুলেছি, আর সেইসঙ্গে নিজেদের ভুলেছি।’ সিনেমার বাইরে গল্পে-কথায় নরক-গুলজারের দৃশ্য দেখান, কানে ঢেলে দেন তরল সীসা। এই আত্মসমালোচনাই তাঁকে বিশ্বনন্দিত শিল্পী নয়, বরং করে তোলে এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবী।

তাঁর সিনেমা যতটা দুঃখময়, ততটাই আশাবাদী। তাঁর চরিত্রেরা ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে থেকেও এক অনির্বচনীয় মুক্তির দিকে তাকিয়ে থাকে। নীতার ‘দাদা, আমি বাঁচতে চাই’ কেবল ব্যক্তিগত চিৎকার নয়, একটা সমগ্র জাতির বেঁচে থাকার আর্তনাদ। ট্র্যাজেডির মধ্যেই নিহিত রয়েছে ইউটোপিয়া, এক এমন সমাজের স্বপ্ন, যেখানে সংস্কৃতি আবার মানবিকতার আশ্রয় ফিরে পাবে। তাঁর সিনেমায় এই দ্বৈততা— বেদনা ও আশা, মৃত্যু ও পুনর্জন্ম, তাঁকে শুদ্ধ মানবতাবাদীর আসনে বসায়। তিনি ফকিরের বেশ ধরে ছুঁড়েও ফেলেন। বলে ওঠেন, ‘তোমরা সম্পূর্ণ ভাবে মিসগাইডেড।’

জীবন অন্তহীন সংগ্রাম। মৃত্যুর পর কাজ ফিনিক্স হয়ে ফিরে এল বাঙালির কাছে। আধুনিক চলচ্চিত্রতত্ত্বে হয়ে উঠলেন ‘ঔপনিবেশিক উত্তর স্বতন্ত্র দৃষ্টিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার’। সংস্কৃতির টানাপোড়েনকে যিনি চলচ্চিত্রভাষায় প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পিটার ওয়োলেন, অ্যান্ড্রু রবিনসন প্রমুখ সমালোচক তাঁর কাজকে ‘cinema of displacement’ ব্যাখ্যা দিলেন। অথচ সংস্কৃতিকে দেখেছিলেন আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম হিসেবে। ইতিহাসের ক্ষত ঢেকে ফেলা নয়, তাকে অবিনশ্বর স্মৃতিতে রূপান্তর করার কর্মকার তিনি। আজ সে প্রশ্ন আবার উঠছে—‘আমরা কারা?’ শিকড়ের খোঁজে আজ আবার নেমে পড়েছে আপামর বাঙালিসত্তা, আঁকড়ে ধরতে চাইছে হাতের সামনে যা পাওয়া যায় তাই। কাঁটাতাঁর আবার জ্বলজ্বল করে উঠছে, ফুটে উঠছে পুরনো ক্ষতের দাগ। এই সকরুণ সময়ে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের দিকে ধাবমান ছুটতে ছুটতে বাঁ-পাশে তাকাতেই দেখি ঋত্বিকও ছুটছেন, ছুটেই চলেছেন মেঘের আড়ালে ধ্রুব তারার খোঁজে ।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!