- খাস-কলম
- অক্টোবর ২৫, ২০২৫
‘থিংতাম’ আতঙ্ক ! মুষিক বিপ্লবে ত্রস্ত মিজোরাম
১৯৫৯ সালে ‘মাউতাম’ নামে একই ধরনের দুর্ভিক্ষে মিজো পাহাড়ে অনাহারে প্রাণ হারিয়েছিলেন শতাধিক মানুষ । বাঁশফুল ফোটার পর ইঁদুরে ফসল খেয়ে ফেলেছিল, তারপর গোলার শস্য । দুর্ভিক্ষে চরম হতাশায় জন্ম নিয়েছিল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট-এর বিদ্রোহ
মিজোরামের পাহাড়ি জনপদে ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ছায়া। বাঁশফুল ফোটা এবং তার ফলে ইঁদুরতাণ্ডব—‘থিংতাম’ প্রান্তিক কৃষিজীবনকে নতুন করে আতঙ্কের মুখে ফেলেছে। সরকারি হিসাবে, রাজ্যের প্রায় ১১টি জেলায় ইতিমধ্যেই ১৫০টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত, প্রায় ৪,৭৫৬ টি পরিবার হঠাৎ করে খাদ্য ও আয়ের সংকটে পড়েছে। প্রায় ৭,০০০ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে প্রায় ২ হাজার হেক্টর (১,৯৮৮.৩৪ হেক্টর) ফসল ইঁদুরের তাণ্ডবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

‘থিংতাম’ হলো সেই বিরল প্রাকৃতিক ঘটনা, যা প্রতি ৪৫–৪৮ বছর অন্তর ঘটে। বিজ্ঞানীদের মতে, বাঁশের বিশেষ প্রজাতি ‘বামবুসা তুলদা বা ‘রাউথিং’ ফোটা মাত্র ইঁদুরের প্রজনন চক্রকে উস্কে দেয়। ফল খাওয়ার পর ইঁদুরদের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ে, ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই তাদের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। খাবার শেষ হয়ে গেলে, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের চাষের ফসল ও গোলার শস্যে। এই মুহুর্তে, মিজোরামের পাহাড়ি জনপদে চলছে ইঁদুরবিপ্লব। ফসলখেকো সেই দঙ্গল এখন হানাদারের মতো নেমে এসেছে রাজ্যের মাঠেঘাটে। ধান, ভুট্টা, আদা, মরিচ, কুমড়ো, রেহাই পাচ্ছে না কোনো ফসলই। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেরছিপ, মামিত, লুংলেই ও সাইতুয়াল জেলায়। কৃষি দপ্তরের আধিকারিকদের দাবি, ইঁদুরের দল একের পর এক গ্রাম পেরিয়ে পাকা ফসল গিলে ফেলছে। এ রাজ্যের কৃষকরা যাঁরা ‘জুম’ বা ঝুম চাষের ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। মামিত জেলাতেই ৭৬৯ জন জুমচাষি ইতিমধ্যেই সর্বস্ব হারিয়েছেন। বহুচর্চিত ‘থিংতাম’ ১৯৭৭ সালে শেষবার দেখা গিয়েছিল।
দুর্গম অঞ্চলে যোগাযোগের অভাব ও অর্থাভাবের কারণে সরকারি সাহায্য অনেক জায়গায় পৌঁছচ্ছে না। মিজোরামের কৃষিমন্ত্রী পি.সি. ভানলালরুয়াতা ইতিমধ্যেই ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদের কাছে বিশেষ আর্থিক সহায়তার আবেদন জানিয়েছেন
রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই ১৮৬ কেজির বেশি রাসায়নিক ইঁদুরনাশক— ‘ব্রোমাডিওলন’ ও ‘জিঙ্ক ফসফাইড’ বিতরণ করেছে। তবে স্থানীয় মানুষের বড়ো অংশ এর বিরোধিতা করছেন। তাঁদের বক্তব্য, বিষ দিয়ে ইঁদুর মারলে পরিবেশের ভারসাম্য ও অন্যান্য প্রাণীর ক্ষতি হতে পারে। তাই তাঁরা ভরসা রাখছেন ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে, বাঁশের তৈরি ফাঁদ ‘ভাইথাং’, ‘মাংখাওং’ ও ‘থাংচাপ’-এর ওপর। অন্যদিকে, কৃষি দফতর ইঁদুরনাশনের জন্য গণ-অভিযানের ডাক দিয়েছে। দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘ইঁদুর একসময় একই ফাঁদ বা খাবার এড়িয়ে যায়। তাই ফাঁদ ও রাসায়নিক পদ্ধতি পর্যায়ক্রমে বদল করতে হবে।’ তবে সমস্যা হল, দুর্গম অঞ্চলে যোগাযোগের অভাব ও অর্থাভাবের কারণে সরকারি সাহায্য অনেক জায়গায় পৌঁছচ্ছে না। মিজোরামের কৃষিমন্ত্রী পি.সি. ভানলালরুয়াতা ইতিমধ্যেই ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদের কাছে বিশেষ আর্থিক সহায়তার আবেদন জানিয়েছেন। রাজ্য সরকার কৃষকদের জুম চাষ থেকে বেরিয়ে এসে ফলচাষ ও দীর্ঘমেয়াদি ফসল— যেমন, আনারস, আঙুর, পান সুপারি চাষে উৎসাহ দিচ্ছে।

তবে প্রবীণরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন অতীতের আতঙ্ক। ১৯৫৯ সালে ‘মাউতাম’ নামে একই ধরনের দুর্ভিক্ষে মিজো পাহাড়ে অনাহারে প্রাণ হারিয়েছিলেন শতাধিক মানুষ। বাঁশফুল ফোটার পর ইঁদুরে ফসল খেয়ে ফেলেছিল, তারপর গোলার শস্য। দুর্ভিক্ষে চরম হতাশার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট-এর বিদ্রোহ, যা প্রায় দুই দশক ধরে চলেছিল। ১৯৮৬ সালের শান্তিচুক্তির পর সেই বিদ্রোহের অবসান ঘটে, আর জন্ম নেয় বর্তমান মিজোরাম রাজ্য। আজ, প্রায় ৬০ বছর পর, সেই পুরনো আতঙ্ক যেন ফের ফিরে এসেছে পাহাড়ি রাজ্যে। বাঁশের ফুলে আবারও জেগে উঠেছে ইঁদুরের রাজত্ব। আর তার সঙ্গে কৃষকদের আশঙ্কা— যদি ফের দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ!
❤ Support Us








