- ন | ন্দ | ন | চ | ত্ব | র প্রচ্ছদ রচনা
- ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৩
নতুন ৬ বই নিয়ে বই মেলায় আরম্ভ। মোড়ক খোলার মুহুর্তে বইমানুষের সংযত, দৃপ্ত উচ্চারণ

আলোকচিত্র: শামিম মন্ডল
৬ ফেব্রুয়ারি, সন্ধ্যা ৬টা। ৪৬তম আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলার মৃণাল সেন মঞ্চে আরম্ভ পাবলিশার্সের নতুন ৬ বই নিয়ে হাতে দাঁড়িয়ে প্রচেত গুপ্ত, অমিতাভ গুপ্ত, ইমানুল হক, হেদায়েতউল্লাহ, চিত্রকর দেবাশিস মল্লিক চৌধুরী, সারফউদ্দিন, দেব সরকার, সঞ্জয় চক্রবর্তী, অমিত মুখোপাধ্যায়, দেবপ্রিয় চক্রবর্তী প্রমুখ । পাশে উপবিষ্ট প্রবীন লেখক সম্পাদক আদিত্য সেন, স্বাগতা বোস, রক্তিম ইসলাম এবং প্রকাশনার প্রধান সম্পাদক বাহারউদ্দিন সহ আরম্ভ প্রকাশনার সহযোদ্ধারা । মঞ্চের সমানে স্রোতার প্রতিটি চেয়ার পূর্ণ । মঞ্চের, ব্যাকড্রপে হাসছেন শতবর্ষের ‘পদাতিক’ মৃণাল । কয়েক মিনিটের স্তব্ধতা, দ্রুত একে একে খুলে গেল প্রকাশিত ছয় বইয়ের মলাট । মলাটে নবীন প্রত্যাশা, সূর্যাস্তে সূর্যোদয়ের ইঙ্গিত । স্তব্ধতা ভেঙ্গে দিলেন প্রকাশক লালন বাহার । বিশেষ ভণিতা নেই । সোজাসুজি উসকে দিলেন প্রশ্ন, বই কি শুধু লেখকের ? না, তার সৃষ্টি আর নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে লেখক, বর্নসংস্থাপক, ভ্রম সংশোধনকারী, সম্পাদনার কর্মী, মুদ্রণকর্মী, বাইন্ডার, কাগজ সরবারহকারী সহ অসংখ্য পরিশ্রমী হাত? সরাসরি প্রশ্নের সরাসরি উত্তর ছড়িয়ে দিলেন জনপ্রিয় মননশীল লেখক প্রচেত গুপ্ত। বক্তব্য সংক্ষিপ্ত। বললেন, বইয়ের এপারের মানুষের সঙ্গে ওপারের অসংখ্য মুখের সঙ্গে সেতু গড়াই আমার কাজ। সেকাজে আমি সফল না ব্যর্থ তা দেখা আমার কাজ নয়। আমার লেখার মধ্যে পাঠক যখন নিজেকে দেখতে পান, খুঁজে পান সেটাই একজন লেখকের সার্থকতা । পাঠককের মননকে স্পর্শ করতে পারাই্ আমাদের আসল লক্ষ্য। বহু বছর পরে একটি বইকে যদি পাঠক স্মরণ করে তার কাছে ফিরে আসেন, তখনই আক্ষরিক অর্থে বইয়ের এপারের আর ওপারের মানুষ এক হয়ে হয়ে ওঠেন বইমানুষ বইয়ের মানুষ।
সেইসূত্র ধরেই কবি অমিতাভ গুপ্ত বললেন, একটি সামাজিক সম্পর্ক, সেতু তৈরির চেষ্টার শুরু ২০ হাজার বছর ধরে চলছে। সেই সেতু সংযোগের। আর এই কাজটি করে একটি বই । প্রায়ই এই কথাটি চর্চিত হয়, বই এখন আর কেউ পড়ছে না। এপ্রসঙ্গে একটা কথা বলি, রবীন্দ্রনাথ, কমলকুমার কিংবা আখতার উজ্জামান ইলিয়াসের জীবিতকালে তাঁদের লেখা যতটা পড়া হয়েছিল, এখন সেই পড়ার প্রবণতা অনেক বেশী । আরম্ভ প্রায় দুদশক ধরে তাদের নিজের কাজ দিয়ে নিজেদের ব্যতিক্রমী পরিচয় গড়ে তুলেছে । মুদ্রণের পাশাপাশি ডিজিটাল মাধ্যমেও তারা বই এবং পত্রিকা প্রকাশ করে বইয়ের এপারের আর ওপারের মানুষের মধ্যে সংযোগের কাজ করে চলেছে । প্রাবন্ধিক মইলুন হাসান তাঁর বক্তব্যে বলেন, বইমেলাকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষ আসছেন । এই বিচিত্র ক্ষুব্ধ সময়ের বিপরীতে স্রোত গড়ে তুলতে আরও বেশী বইয়ের কাছাকাছি আসতে হবে মানুষকে, বই পড়ে, বই উপহার দিয়ে বইয়ের মানুষ হয়ে ওঠার আহ্ববান জানিয়েছেন তিনি । ড. হেদায়েতুল্লাহ তাঁর বক্তব্যে বলেন, প্রকাশনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনার, একজন সম্পাদক লেখকের লেখনি সত্ত্বাকে আবিষ্কার করে, তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে পাঠকের কাছে মেলে ধরেন।একটি বই বা লেখা সার্থক হয়ে ওঠবে তখনই যখন বইয়ের সামনে বসে থাকা মানুষটি নিজেকে খুঁজে পাবেন সেই দুই মলাটের মধ্যে। কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিকদের পাশাপাশি বইয়ের আরেক মানুষ চিত্রশিল্পী।যাঁরা তাঁদের স্বপ্ন ঢেলে সাজিয়ে তোলেন প্রচ্ছদ, বইয়ের ভেতরের নান্দনিক রূপ, অলঙ্করণ।
এই প্রসঙ্গে চিত্র শিল্পী দেবাশিস মল্লিক চৌধুরী বলেন, যখন ক্রামাগত প্রচারিত হচ্ছে বই বিমুখ হচ্ছে মানুষ, সেখানে বইমেলার মতো আয়োজনে মানুষের ঢল এসে প্রমাণ করে দিচ্ছে, বইয়ের নানা বর্ণের সজ্জার যে ভালোবাসা, যে আকর্ষণ, তাকে অস্বীকার করতে, এড়িয়ে যেতে পারছেন না তারা। মানুষ আবার বইমুখী হয়ে উঠছে । আর কবি সাহিত্যিক, প্রকাশকদের সঙ্গে চিত্রিদের সম্পর্ক অনেকটা খামের গায়ে ডাক টিকিটের মতো । একে অন্যের পরিপূরক। অক্ষরে লেখেন কবি, সাহিত্যিক আর তাকে রঙে রেখায় ফুটিয়ে তোলেন চিত্রকররা । আরম্ভ পাবলিশার্সের বেশ কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদ এবং ওয়েব পোর্টাল aramva.co এর রবিবর্ণ বিভাগের অলঙ্করণের গুরুভার যাঁর কাঁধে, সেই চিত্রশিল্পী দেব সরকার বই পড়ার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, একজন প্রচ্ছদ শিল্পী বা অলঙ্করণ যিনি করেন, তাঁর প্রধান কাজ বিষয়টিকে পড়া, অনুধাবন করা । পড়ার নিয়মিত অভ্যাস ছাড়া কোনো ধরনের প্রকাশনার শিল্পকর্ম পাঠকের চিত্তকে স্পর্শ করতে পারেনা । পাশাপাশি বইয়ের বাণিজ্যিক দিকটায় মাথায় রাখা জরুরী ।
এদিনের আলোচনার বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে অধ্যাপক ইমানুল হক বলেন, নতুন প্রজন্ম বই বিমুখ একথা সত্য নয়, তরুণরা যেভাবে বই পড়ছেন, পুরনো বই নিয়ে ঘাটছেন, চর্চা করছেন, তাতে এটা পরিষ্কার বই পড়ার অভ্যাস নষ্ট হবেনা । অঙ্গিক হয়তো বদলাবে কিন্তু বইয়ের আকর্ষণ কমবে না । পাশাপাশি আরম্ভ প্রকাশনার প্রথম বই বাঁশি আর রণতূর্যেরও পুনঃপ্রকাশের কথাও তিনি বলেন। কয়েকটি প্রেমের গল্পের লেখক দেবপ্রিয় চক্রবর্তী বলেন, বইয়ের সঙ্গে একজন লেখকের সম্পর্ক সন্তান আর অভিভাবকের মতো । সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার আগে একজন পিতা বা মাতার যে উৎকন্ঠা জড়িয়ে থাকে, বই প্রকাশের প্রাক মুহূর্তগুলোও লেখকের কাছে তেমনি । একই সুরে তাল মেলালেন কবি গোলাম রসুল, সঞ্চয় চক্রবর্তী । পাশাপাশি লেখকের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারের প্রসঙ্গে মতামত ব্যক্ত করেন লেখক অমিত মুখোপাধ্যায়। আরম্ভ প্রকাশনা থেকে এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে, তার রাজনৈতিক উপন্যাস মসনদের গহন পথে।
❤ Support Us