Advertisement
  • খাস-কলম ন | ন্দ | ন | চ | ত্ব | র
  • জানুয়ারি ৩০, ২০২৫

রোহিত ভেমুলার ভারতবর্ষ

শমীক ঘোষ
রোহিত ভেমুলার ভারতবর্ষ

 
৩০ জানুয়ারি রোহিত ভেমুলার জন্মদিন। জীবনের একমাত্র ও শেষ চিঠিতে নিজের জন্ম প্রসঙ্গে ভেমুলা আর্তনাদের স্বরে লিখেছিলেন, ‘আমার জন্মই, আমার প্রাণসংশয়ী দুর্ঘটনা।’ অনাদরের শৈশবে জাতিবৈষম্যের শিকার, অনন্য লড়াইয়ের জেদ।  উচ্চশিক্ষার যাত্রা, তবু কি কিছু পাল্টায়, কিছু বদলে যায় ? পুরাণ থেকে রামায়ণ – শোষণব্যবস্থার জয়গানে পিষে যায় শূদ্র ও দলিত মানুষ। ২০১৬ সালে ১৭ জানুয়ারি হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের দলিত গবেষক আত্মহত্যা করে দেশের বুকে এঁকে দেয় রক্তমাখা উপাখ্যান। যেখানে রোহিত আলাদা কোনো অস্তিত্ব নয়, বরং অত্যাচারে দীর্ঘ ইতিহাসের স্বয়ম্ভূ। একবিংশ শতকের ভারতবর্ষে জাত-পাত ও বর্ণে বিভক্ত সমাজে দলিতদের উপর অত্যাচারের ভাষ্য লেখবার একমাত্র উপায় কি তবে এই ? রোহিত চেয়েছিলেন কার্ল সাগানের মতো বিজ্ঞান লেখক হয়ে উঠতে, বিজ্ঞান ও প্রকৃতির মিশে যেতে। মৃত্যু-পরবর্তী গালগল্পে, ভূত-প্রেতে তাঁরা বিশ্বাস ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন আমরা নক্ষত্রজাত, নক্ষত্রের গুঁড়ো দিয়ে আমাদের নির্মাণ। ছায়া থেকে নক্ষত্রের যাত্রায় ফিরে ফিরে আসেন বারবার, কখনো নাটকে, শিল্পে, গানে–কখনো বা রাজপথে বিষণ্ণ স্লোগানে।  

আশ্চর্য এক চিঠি লিখে ফুরিয়ে গিয়েছিলেন রোহিত ভেমুলা। প্রায় এক দশক আগে। ২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারী। আর দশটা সুইসাইড নোটের থেকে খুব আলাদা ছিল সেই চিঠি। অসামান্য ইংরাজি গদ্যে রোহিত লিখে রেখে গিয়েছিলেন জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণার কথা। জানিয়েছিলেন, আসলে একদিন কার্ল সাগানের মতো কল্পবিজ্ঞানের লেখক হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, মানুষ আসলে নক্ষত্রেরই সন্তান।

সেই চিঠিরই সার্থক বিনির্মাণ অশোকনগর নাট্যজনের ‘ভেমুলার রামায়ণ।’ নাটককার অংশুমান কর নাটকের সংলাপেই জানিয়ে দেন সে কথা। আসলে এ যেন এক প্রিজমের মতো। যার ভেতর থেকে দেখা যায় অনেক কিছুই। আর অংশুমানের সেই বিনির্মাণের পরতের পর পরত বুনে চলেন অনতিতরুণ নাট্যনির্দেশক অভি চক্রবর্তী।
নাটকের শুরু একটি কথোপকথনের ভেতর দিয়ে। রোহিতের ছায়াসঙ্গী, বাল্যবন্ধু রিয়াজের কাছে রোহিতের কথাই জানতে এসেছে এক তরুণী সাংবাদিক। তাদের কথার মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো ফুঠে উঠছে রোহিতের জীবন, তার দর্শনের কথা। আর পরক্ষণেই বদলে যাচ্ছে স্টেজ। কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে নাটক চলে যাচ্ছে প্রাচীন ভারতবর্ষের মিথে। শম্বুকের কাহিনীতে। সেই শম্বুক, শুদ্র হয়ে তপস্যা করার অপরাধে যাকে হত্যা করেছিলেন আর্যাবর্তের রাজা রাম।

পণ্ডিতেরা বলেন শম্বুক হত্যার এই কাহিনী নাকি ছিল না বাল্মীকীর রামায়ণে। সেই গল্প পরে যুক্ত হয় রামায়ণে। কিন্তু সেই যুক্ত হওয়াও বলে দেয় এই দেশের প্রাচীন সমাজের কথা। যেন মনুবাদী ধারণাকে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র প্রথিত করে দেয় ভারতবর্ষের প্রাচীনতম এপিকে। পাকাপাকি গেঁথে দিতে চায় আপামর ভারতবাসীর কৌমচেতনায়। তাদের শ্রুতি ও স্মৃতিতে।

এই নাটক যেন পুনর্নির্মাণ করতে চায় শম্বুককে। এই নাটকে সে হয়ে ওঠে রাক্ষসদের বংশধর। পরাজিত এক জাতির প্রতিনিধি। হান্টার-গ্যাদারার জনগোষ্ঠীর একজন, যে চাষ করতে জানে, পশুপালনে দক্ষ, আর্যদের কাছে হারতে হারতে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছে অরণ্যের গোপনে।

আর্যদের যুদ্ধ করে হারাতে চায় প্রতিস্পর্ধী শম্বুক। ফিরে পেতে চায় মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার। কিন্তু তার কথায় কান দেয় না তার গোষ্ঠীর লোকেরাই। বরং বাঁচার প্রবল তাগিদে তারা রপ্ত করে নিতে চায় আর্যদের রীতিনীতি, তাদের ধর্ম বিশ্বাস।

প্রাচীন ভারতের এই পরাজিত জনগোষ্ঠীর পোশাক পরিকল্পনায় অভি ব্যবহার করেন বারবার মূল ধারার বিনোদনে ‘জংলি’ জনগোষ্ঠীর আবরণ। তাদের জোর করে ‘অসভ্য’ প্রমাণ করবার জন্য অবমানবসুলভ আচার-আচরণ। ইচ্ছাকৃতভাবেই। আসলে যেন খুব নিরুচ্চারে অভি যেন আঘাত করতে চান দর্শককে। বুঝিয়ে দিতে চান, তার অচেতনে লুকিয়ে থাকা ‘সভ্য’ হওয়ার ভ্রান্ত দর্পের কথা। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূর্তিমান ‘অপর’-এ পর্যবসিত করার যূগ যূগ ধরে চলে আসা রীতির কথা। যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তার কালেক্টিভ কনশাসনেসে গেঁথে গিয়েছে।

আবার একই ভাবে শম্বুকের দৃশ্যে ঘুরে ফিরে আসে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’-এর সুর। কলি। কিন্তু বহুচেনা এই গানের, জেতার তীব্র প্রত্যয়ের কথা ঘোষণা করতে চান না অভি। বরং বারবার তাতে উঠে আসে এক মনখারাপের ইঙ্গিত। তীব্র বিষণ্ণতা।

এই গানের ব্যবহারেও আবার তার মুনশিয়ানার পরিচয় দেন অভি। যেন বোঝাতে চান, বর্তমান সমাজের কথাই। যেখানে দিন বদলের গভীর প্রত্যয়গুলোও শেষ অবধি হারিয়ে যায় পরাজয়ের তীব্র বিষণ্ণতায়।

সুইসাইড নোটে রোহিত লিখেছিলেন, এই সমাজ মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে না। গ্রাহ্য করে না নক্ষত্রের গুড়ো দিয়ে নির্মিত ঐশ্বর্যময় এক প্রাণ হিসেবে। সত্যিই তো তাই। বিজ্ঞান বলে, আসলে নক্ষত্রের ভেতরের তেজস্ক্রীয় ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াতেই একদিন তৈরি হয়েছিল এই ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত মৌল পদার্থ। তারপর রসায়নের নিয়ম মেনে একদিন সৃষ্টি হয়েছিল প্রাণের। মানুষ সেই প্রাণীজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই আসলে সত্যিই নক্ষত্রের গুড়ো দিয়েই তৈরি মানুষ।

আবার মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কাহিনীতে বিশ্বাস করে। বহুমানুষের এক কাহিনীর প্রতি অগাধ বিশ্বাসই তাকে গোষ্ঠীবদ্ধ করে। তার কৌমচেতনার নির্মাণ করে। রাষ্ট্র কিংবা ধর্মের মূলেও তাই কাহিনীই থাকে। সেই কাহিনীতে যত মানুষ বিশ্বাস করবে ততই তার সাফল্য। ক্ষমতা তথা রাষ্ট্রযন্ত্র আসলে চায় তাদের সুবিধের কাহিনীতে মানুষ বিশ্বাস করুক। অন্ধ হয়ে সেই কাহিনীর মধ্যেই বাঁচুক। আর রোহিতের মতো যাঁরা সেই কাহিনীকে প্রশ্ন করে, তাদেরই রুদ্ধ করে দিতে চায়। মুছে দিতে চায় চিরতরে।

অংশুমান কর কবি। তাই কবিসুলভ দক্ষতায়, এই নাটকে নক্ষত্রের গুড়ো থেকে তৈরি ঐশর্যমণ্ডিত মানুষের ধারণার পাশে অংশুমান দাঁড় করিয়েছেন ক্ষমতার আখ্যাননির্মাণের কৌশলগুলোকে। দেখিয়েছেন কীভাবে বিজিতকে চিরকাল দমিয়ে রাখবার জন্য কাহিনীর নির্মাণ করে জয়ী। কীভাবে মুছে দেয় বিজিতের নিজস্ব কাহিনীগুলোকে। তাই কোনও বিচ্ছিন ঘটনা নয় রোহিত ভেমুলা। সে আসলে শম্বুকেরই পুনরাবৃত্তি। যেমন পুনরাবৃত্তির অনেক ঘটনাই এই দেশের ইতিহাসে, মিথের লুকিয়ে আছে। যাদের সব চেয়ে বড় দোষ ক্ষমতার চোখে চোখ রাখা। ক্ষমতাসীনের সমান হয়ে ওঠার বাসনা। তাই শম্বুকের মতোই ক্ষমতা আসলে বধই করে তাকে। বাধ্য করে মরে যেতে।

একাঙ্কের নাটক। তার সীমিত পরিসরের মধ্যেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় অনেক। সেটাই এই নাটকের সার্থকতা। কিন্তু ছুঁড়ে দেয় বলেই বোধহয় অপ্রাপ্তিও থেকে যায় অনেক। নাটকটা দেখতে দেখতে বারবার মনে হয়, আসলে রোহিত ভেমুলার এই ঘটনাকে একটা প্রিজমের মতো ব্যবহার করলেও তার সাতরঙা ছটা যেন ধরা পড়ে না পুরোপুরি। বরং এই উপমহাদেশের, ভারত রাষ্ট্রের নির্মাণ-বিনির্মাণের বহু কথাই যেন উঠে আসতে পারত এই নাটকে। ঢুকে পড়তে পারত তার পরতে পরতে। দর্শক হিসেবে অপ্রাপ্তি থেকে যায় যেন। পরমহূর্তেই মনে হয়, সীমিত পরিসরে সেই অপ্রাপ্তির বোধই বোধহয় এই নাটকের সব থেকে বড় গুণ। তার অনুচ্চারিত লেয়ার।

আশাবাদের অলীক ইঙ্গিত নয়, এই নাটক আসলে আমাদের সমকালকেই দেখায় ইতিহাসের এই মূর্ত ধারাবাহিকতা হিসেবে। প্রশ্ন করে ক্ষমতা আর রাষ্ট্রের চিরায়ত বয়ানগুলোকে।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!