- এই মুহূর্তে স | হ | জ | পা | ঠ
- জুন ২৪, ২০২৫
বিজ্ঞান গবেষণায়, উদ্ভাবনে পিছিয়ে ভারত! বিনিয়োগের অভাবে, কাঠামোগত দুর্বলতায় থমকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি গঠনের স্বপ্ন দেখছে দেশ। কিন্তু সেই অর্থনীতিকে শক্ত ভিত দেওয়ার জন্য যে গবেষণা ও উদ্ভাবনের প্রয়োজন, তাতে ভারতের বিনিয়োগ এখনও হতাশাজনক। গত এক দশকে খরচ বেড়েছে ঠিকই—২০১০ সালে যেখানে আর অ্যান্ড ডি-তে (গবেষণা ও উন্নয়ন) ব্যয় ছিল প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা, ২০২০ সালে তা পৌঁছেছে ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটিতে। বিপুল সংখ্যা মনে হলেও, দেশের জিডিপির তুলনায় এই ব্যয় মাত্র ০.৬৪ শতাংশ। বিশ্বের গড় যেখানে প্রায় ১.৮ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া বা ইজরায়েল যেখানে ৫ শতাংশের বেশি, সেখানে ভারতের এই পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। গোটা বিশ্ব এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌড়ে নতুন নতুন শিখর ছুঁতে ব্যস্ত, তখন ভারত তার বিশাল প্রতিভা ও প্রযুক্তিগত শক্তি নিয়েও এই দৌড়ে অনেকটাই পিছিয়ে। প্রতিভা আছে, বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করা ভারতীয় বিজ্ঞানীরা তার প্রমাণ। কিন্তু সেই প্রতিভা ধরে রাখার উপযুক্ত পরিবেশ নেই, সদিচ্ছাও নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রশাসনিক জড়তা, পরিকাঠামোর ঘাটতি এবং বিস্তৃত উদ্ভাবনী সংস্কৃতির অভাব।
‘বিশ্ব উদ্ভাবন সূচক-২০২৪’-এ সালে ভারতের স্থান ৩৯তম। যদিও ‘সৃষ্টিশীল উৎপাদন’- এর নিরিখে ভারতের স্থান কিছুটা এগিয়ে, কিন্তু চিন্তার স্বল্পতা বিস্তৃত। দেশের গবেষক ঘনত্ব এই মুহুর্তে মাত প্রতি দশ লক্ষে মাত্র ২৫৫ জন । তুলনায় আমেরিকায় এই সংখ্যা ৪৮০০-এর বেশি, জার্মানিতে ৫৪০০ ছুঁইছুঁই। আর এক আশঙ্কার কথা, দেশের মোট পেটেন্ট আবেদনের প্রায় ৭৫ শতাংশই করে বিদেশি সংস্থা। দুর্ভাবনার আরো দিক—ভারতের মোট গবেষণা খরচের মাত্র ৩৬ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। তুলনায় উন্নত দেশগুলিতে এই হার ৭০ শতাংশের বেশি। কারণ, অধিকাংশ সংস্থাই ঝুঁকি নিতে চায় না। দ্রুত লাভ, প্রযুক্তি আমদানি কিংবা ‘জুগাড়’-ধর্মী ক্ষুদ্র উদ্ভাবনেই তারা সন্তুষ্ট। অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পরিকাঠামো এখনো শুধু পাঠদানে কেন্দ্রীভূত। মৌলিক গবেষণার সুযোগ, তহবিল ও পরিকাঠামো ঘাটতি রয়েছে। এর উপর রয়েছে শিক্ষার রুটিন-নির্ভরতা, মুখস্থের প্রবণতা। শিল্প ও শিক্ষাক্ষেত্রের সংযোগ দুর্বল। তার উপর রয়েছে অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতা, ফাইল টানাটানির সংস্কৃতি। গবেষণার জন্য সময় নেই, পুঁজি নেই, স্বতন্ত্রতা নেই। গবেষকরা সৃজনশীলতা নয়, বরং বাঁচার তাগিদেই প্রশাসনিক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পক্ষেত্রের মধ্যে কোনও কার্যকরী যোগসূত্র গড়ে ওঠেনি। আন্তর্জাতিক উদ্ভাবনী সূচকে এই বিভাগে ভারতের স্থান ৮০ নম্বরের আশপাশে। গবেষণার সঙ্গে শিক্ষার যোগ না থাকলে, উদ্ভাবন আর ‘জুগাড়’-এর গণ্ডিতেই আটকে যায়।
২০২৪ সালে চালু হওয়া ‘ইন্ডিয়া-এআই মিশন’ ভারতকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়েছে। এই মিশনের ৭টি মূল স্তম্ভের মধ্যে ছিল—কম্পিউটিং পরিকাঠামো, উপাত্ত, প্রতিভা, গবেষণা ও উন্নয়ন, পুঁজি, গাণিতিক কৌশল ও প্রয়োগ ক্ষেত্র। শুরুতে সরকার মূলত কম্পিউটিং পরিকাঠামো তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে—যেমন: দশ হাজার গ্রাফিক্স প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্র কেনা, গবেষক ও স্টার্টআপদের চিপস অ্যাক্সেস দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু অনিবার্য প্রশ্ন হল, শুধু যন্ত্রপাতি থাকলেই কি উদ্ভাবন সম্ভব? যেখানে উপাত্ত নেই, যেখানে গবেষণায় স্বাধীনতা নেই, যেখানে মেধা দেশ ছেড়ে যাচ্ছে—সেখানে কি ভারত শুধু প্রযুক্তি কিনে ভবিষ্যতের দৌড়ে টিকে থাকতে পারবে?প্রথম বড় সমস্যা—সার্বিক প্রতিভার ঘাটতি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো, ভারতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক প্রতিভার চাহিদা হু হু করে বাড়ছে। অথচ সেই অনুপাতে প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে না। যদিও তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা খাতে ভারত বিশ্বনেতা, কিন্তু সেই খাতের বহু কর্মীই এখনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক নতুন প্রযুক্তি আত্মস্থ করতে পারেননি।
দ্বিতীয়ত, প্রতিভা ধরে রাখতে পারছে না দেশ। উচ্চমানের মেধাবী গবেষক ও স্নাতকরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এআই গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া বহু ভারতীয় বর্তমানে আমেরিকা বা ইউরোপের শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রতিভা যাচ্ছে, কিন্তু ফেরত আসছে না। তৃতীয়ত, মেধার গুণগত মানের প্রশ্ন। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ প্রকৌশলী পাশ করলেও, তাঁদের বড় অংশ বাস্তব ক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত নন। প্রশিক্ষণ, পুনঃপ্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে ঘাটতি থাকায়, অনেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। চতুর্থত, প্রতিভার সঠিক স্তর বিন্যাস তৈরি হয়নি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিভাকে সাধারণত তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়—শীর্ষ স্তরের গবেষক, মধ্য স্তরের প্রযুক্তি নির্মাতা এবং নিম্ন স্তরের বাস্তবায়নকারী। ভারতের বর্তমান চিত্র—মধ্য ও নিম্ন স্তরে কিছুটা অগ্রগতি হলেও, শীর্ষ স্তরে মারাত্মক ঘাটতি। অথচ বিশ্বমানের উদ্ভাবনের জন্য এই শীর্ষ স্তর অপরিহার্য।
বিশ্বমানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল তৈরি করতে গেলে চাই বিপুল পরিমাণ গুণমানসম্পন্ন দেশীয় উপাত্ত। ভারতে ডিজিটাল লেনদেন, ইন্টারনেট ব্যবহার কিংবা স্মার্টফোনের সংখ্যা অনেক হলেও, সেই উপাত্তের মালিকানা এখনো বিদেশি সংস্থার হাতে। দেশজ ভাষাভিত্তিক বা প্রেক্ষিত ভিত্তিক পরিকাঠামো তৈরি না হলে, ভারতীয় মডেলগুলি কখনোই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। উপরন্তু, মৌলিক গবেষণায় আমাদের পিছিয়ে থাকা মারাত্মক। ওষুধ শিল্প হোক বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—ভারত এখনও মূলত ‘ব্যবহারকারী’, স্রষ্টা নয়। উদ্ভাবনের জ্বালানি যদি গবেষণা হয়, তবে আমাদের ট্যাঙ্ক এখনও প্রায় খালি। দেশের প্রতিভাকে ধরে রাখতে হলে, শুধু টাকা নয়—দরকার আন্তরিকতা, দরকার পাশে থাকবার। গবেষণাকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে হবে, গবেষকদের কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিতে হবে। তাদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের বেতন, পরিকাঠামো ও সম্মানজনক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। স্কুল স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্যক্রমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্তর্ভুক্তি আবশ্যক। শুধু ইঞ্জিনিয়ার নয়, তৈরি করতে হবে নীতিবিদ, পণ্যে ব্যবস্থাপক, উদ্যোক্তা, ডিজাইনার, ভাষাবিদ—একটি পূর্ণাঙ্গ উদ্ভাবনী সংস্কৃতি। সমাজে গবেষণাকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে, বাড়াতে হবে সামাজিক মর্যাদা।
পথ কী? কোনো আশার আলো নেই? আছে। এই অন্ধকারে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছে ইসরো, ডিআরডিও কিংবা জেনেরিক ওষুধ শিল্প। এঁরাই দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতা, নেতৃত্ব ও নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলে কীভাবে বিশ্বকে চমকে দেওয়া যায়, তা দেখিয়েছে তারা। প্রবাসী ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সাফল্যও মনে করিয়ে দেয়, আমাদের প্রতিভায় ঘাটতি নেই। ঘাটতি শুধুই পরিবেশে। এখন দরকার সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতায় একটি সুসমন্বিত কৌশল। প্রতিভা, উপাত্ত, এবং মৌলিক গবেষণায় যদি ভারত অবিলম্বে বিপুল বিনিয়োগ করে, তবে এই শতকের ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নেতৃত্ব’ প্রতিযোগিতায় ভারত পিছিয়ে পড়বে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত যদি বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি খাতে জিডিপির অন্তত ২ থেকে ২.৫ শতাংশ ব্যয় করতে পারে, এবং সেই অর্থ সঠিকভাবে মূল খাতে, যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ করে, তাহলে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন সম্ভব। আর দরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে গবেষণাভিত্তিক করে তোলা, বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প সংযোগকে শক্তিশালী করা, গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে প্রশাসনিক স্বাধীনতা দেওয়া এবং সর্বোপরি, গবেষণাকে সমাজের মূল স্রোতে তুলে আনা জরুরি। আজ যখন বিশ্বজুড়ে কয়েকটি মাত্র দেশ এবং সংস্থা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌড়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তখন ভারতের সামনে দুটি পথ—এক, দর্শক হয়ে থাকা। দুই, সক্রিয় প্রতিযোগী হয়ে নিজস্ব মডেল, প্রযুক্তি ও ধারণা নিয়ে মঞ্চে নামা। দ্বিতীয় পথটিই কঠিন, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী, উজ্জ্বল।
❤ Support Us