Advertisement
  • খাস-কলম দে । শ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
  • মে ৪, ২০২৫

কে বলে সন্ত্রাসীদের ধর্ম নেই ?

আজমল হুসেন
কে বলে সন্ত্রাসীদের ধর্ম নেই ?

কেন লিখতে হচ্ছে আজ এই বিষয়ে ? এর উত্তর হিসেবেই লেখা শুরু করার আগে নিজের বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে করি। আমি মানুষ, এটাই আমার প্রথম ও শেষ পরিচয়। এছাড়া যে পরিচয়কে ঘিরে আমার যাবতীয় বোধ ও চিন্তা-চেতনা, তা হল আমি আদ্যোপান্ত একজন বাঙালি– যে বাংলায় কথা বলে, চিন্তা করে, বাংলায় আনন্দ বা দুঃখ পেয়ে থাকে, বাংলায় রেগে যায়, বাংলায় ভুল করে, বংলায় ক্ষমা চায়, বাংলাতেই তার যাবতীয় আত্মসমীক্ষা। এর বাইরে আমার সকল পরিচয় ভৌগলিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক এবং আরোপিত। আমার সেসব পরিচয়ও ঠিক ততটা সত্য হলেও সেগুলো নিয়ে আমার কোনো বাড়তি আনন্দ বা দুঃখ নেই, গর্ব বা ঘৃণা নেই। মানবিক মনের বাঙালি হিসেবে আমি নিজেকে চেনার চেষ্টা করি । আমার যাবতীয় বিচার-বুদ্ধি ও ভাবাবেগ এই আমিকে নিয়েই । যে কোনো পরিচিতির নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার, তাদের অকাল অপমৃত্যু আমার এই আমিকে যারপরনাই পীড়া দেয় । এই পরিচিতি আমাকে প্রতিক্রিয়াশীল হতে বাধা দেয়, ভিন্ন মতকে নস্যাৎ করার আগে বারবার ভাবায়, আমাকে বিদ্বেষ-বিমুখ এবং বিশ্লেষণমুখী করে রাখে । এই বিশ্লেষক সত্ত্বাই আমাকে কলম ধরায়।

২০১৯, ১৪ ফেব্রুয়ারি । নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ভেদ করে পুলওয়ামায় বিশাল পরিমাণে আরডিএক্স কী করে পৌঁছেছিল ? চল্লিশ জন জওয়ানকে কার গাফিলতিতে সেদিন অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছিল ? কেন আজও কোনো তদন্ত কমিশন বসেনি? ঘটনার এতবছর পরেও কেন আমরা জানতে পারিনি ঠিক কী কারণে নিরাপত্তার ঘাটতি হয়েছিল ? ওই নাশকতাকে ঘিরে এরকম অজস্র প্রশ্নের উত্তর মেলেনি ! মিলবে কি না, জানা নেই । ২০২৫, ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পৌঁছে এতক্ষণ গুলি চালিয়ে নরসংহার করে পালিয়ে গেল ! কী করে তা সম্ভব হল ? গোয়েন্দা ইনপুট ছিল, তারপরেও পহেলগাঁওয়ে সেনা ছিল না কেন ? ঘটনার পরে সেনার পৌঁছতে দেড়‌ঘন্টা সময় লাগল কেন ? এরজন্য দায়ী কে ? এতজন নিরীহ মানুষের মৃত্যু সত্যিই কি ঠেকানো যেত না ? এসবের উত্তর পাওয়ার মতো দূরাশা আমার নেই।

এমনই দুর্ভাগা এই তথাকথিত সভ্য সমাজ, যে কাশ্মীর কিংবা মণিপুরের নিরীহ মানুষের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাকে কেউ প্রশ্ন করলে তাকে রে রে করে করে তেড়ে আসে । যে সমাজে শাসককে প্রশ্ন করা মাত্রই শাসকের চাটুকাররা আপনাকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেবেন। বলাই বাহুল্য, গত পাঁচবছর ধরে কেন্দ্রীয় শাসিত জম্মুও কাশ্মীরে নিরাপত্তার ভার কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এতবড়ো ব্যর্থতার পর‌ও সরকারকে প্রশ্ন করতে তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজের কীসের ভয় ? অন্য কেউ প্রশ্ন তুললেও তাঁকে ধমকানো চমকানো চলছে ! অথচ আমরা দেখেছি ২০০৮ সালে, মুম্বাইতে ২৬-১১র ঘটনার সময় তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাধ্য হয়েছিলেন পদত্যাগ করতে।

পহেলগাঁওয়ে নারকীয় নরসংহারের পর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় অর্থনীতি। তা জেনেই সেখানকার স্থানীয় মানুষ অপরাধীদের শাস্তি চেয়ে রাস্তায় প্রতিবাদে নামলেন । যে কোনো সুস্থ চিন্তার মানুষেরই এর ইতিবাচক দিকটা চিহ্নিত করে আশার আলো খুঁজতে তৎপর হওয়ার কথা । অনেকেই হয়েছেন । তেমনই সবার পরিচিত এবং আমার অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় একজন সাহিত্যিক, প্রকাশক এবং সংগঠক তাঁর পরিচিত কয়েকজনকে ট্যাগ করে সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টা পোষ্ট করেন। সমর্থনে কেউ কেউ তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানান নিজেদের মতো করে । এক আধজন এসবের বিপক্ষে ছিলেন । তাঁদের মধ্যেই একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক সরাসরি মন্তব্য করলেন, ‘এরা সব দেশদ্রোহী, পাল্টা আঘাতের ভয়ে এখন নাটক করতে নেমেছে।’ তাঁর সমর্থনেও কেউ কেউ দুয়েকটা শব্দ খরচ করলেন। এই সাহিত্যিকেরও নিঃসন্দেহে অজস্র অনুগামী রয়েছেন। তাঁর এরকম আলটপকা মন্তব্য হয়তো অনেকের কাছেই বেদবাক্য। আমরা চিরকাল জেনে এসেছি, সাহিত্য সমাজের চেতনা। সমকালীন সভ্য সমাজে চেতনার রং এমনটাও যে হতে পারে তা না দেখলে বোঝা কঠিন। এই লেখকের কিছু লেখা শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত রয়েছে। বলা বাহুল্য, সামাজিক মাধ্যমে তাঁর এইসব প্রতিক্রিয়াশীলতা শিশু-কিশোরদের মননকেও কমবেশি প্রভাবিত করবে। সাধারণ মানুষের এ ব্যাপারে করারই বা কী আছে ! এভাবেই সংকটকালে অন্ধ ভক্তি এবং অন্ধ বিদ্বেষের উৎসবে মেতে ওঠেন তথাকথিত সভ্যজন।

যে কোনো মর্মান্তিক অপমৃত্যুর ঘটনাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফসল নিজের ঘরে তোলার চেষ্টা করে ক্ষমতাভোগী অথবা তার বিপক্ষে থাকা রাজনৈতিক দল। এই অভাগা দেশে সেসব নিয়ে প্রশ্ন তুললেই আপনি দেশদ্রোহী । শাসককে প্রশ্ন করতে পারবেন না। পহেলগাঁওয়ে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়াকে দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হল, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের পরিচয় জেনে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা, এবং সেটা মিশাইলের মতো গিয়ে আছড়ে পড়ল তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজের মননে। প্রায় একই সময়ে জানা গেল নিহতদের তালিকায় ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষও রয়েছেন। ততক্ষণে সমাজের একাংশে এই ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে হত্যার মতবাদটা প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। খুব কায়দা করে প্রচার করা হল, সাম্প্রদায়িক পরিচয় জিজ্ঞাসা করে করে ভিন্ন সম্প্রদায়ভূক্ত সন্ত্রাসীরা মেরেছে। অথচ নৃশংস সেই হত্যাকান্ডের যাঁরা শিকার, সাম্প্রদায়িক এবং ভাষিক পরিচয়ে তারা বহুমুখী । সেখানে একজন স্থানীয়ও আছেন, যিনি পর্যটকদের রক্ষা করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন । কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন পোশাক খুলিয়ে, ধর্মীয় পরিচয় জেনে নাকি হত্যা করা হয়েছে । পক্ষান্তরে অনেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন এ প্রচার সম্পূর্ণ মিথ্যা ।

যখন হাথ্রসে প্রান্তিক মেয়ে মনীষা বাল্মীকির খুন ও ধর্ষণ হয় কিংবা উন্নাওয়ের মতো নারকীয় ঘটনা ঘটে ? কিংবা আখলাক, জুনেদ, তব্রেজ বা পেহ্লু খানের মব লিঞ্চিং হয় ? এইসব খুনের তেমন কোনো রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড নেই, তাই আরজিকর হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসককে যিনি খুন করেন, তার সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের জন্য বৃহত্তর গোষ্ঠীকে দায়ী করা যায় না, সেটা যদি কেউ করেন তা গর্হিত অন্যায়

সন্ত্রাসীরা নিশানা করেছে পর্যটকদের, দুর্ভাগ্যজনক এই নারকীয় ঘটনায় নিহতদের একজন প্রবাসী বাঙালি । তাঁর স্ত্রী প্রথমে মিডিয়াকে জানালেন যে, সন্ত্রাসীরা নাম জিজ্ঞেস করে, পরিচয় জেনে মারেনি, আড়াল থেকে গুলি চালিয়েছিল । যদিও পরে ঘটনার পরম্পরায় সাম্প্রদায়িক রঙ চড়ানোর কদর্য চেষ্টা করেন কেউ কেউ ।

পৃথিবীর যে কোনো দেশে প্রান্তিক গোষ্ঠিভূক্তদের সামাজিক দুর্দশা অপরিসীম । ভারতেও সেই চিত্রের সার্বিক বদল নেই । পহেলগাঁওয়ে বা পুলওয়ামাতে সন্ত্রাসবাদীরা যখন হামলা চালায়, তখন ঘৃণা ছড়ানো হয় সাম্প্রদায়িক সংখ্যাতত্ত্বের জোরে । বারবার দেখা গেছে – জনা কয়েক সন্ত্রাসবাদী হামলা চালায়, কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষীরা ঘৃণায় বিঁধে দেন নির্বিশেষকে ।একই অবস্থা কি দেখা যায় যখন হাথ্রসে প্রান্তিক মেয়ে মনীষা বাল্মীকির খুন ও ধর্ষণ হয় কিংবা উন্নাওয়ের মতো নারকীয় ঘটনা ঘটে ? কিংবা আখলাক, জুনেদ, তব্রেজ বা পেহ্লু খানের মব লিঞ্চিং হয় ? এইসব খুনের তেমন কোনো রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড নেই, তাই আরজিকর হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসককে যিনি খুন করেন, তার সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের জন্য বৃহত্তর গোষ্ঠীকে দায়ী করা যায় না, সেটা যদি কেউ করেন তা গর্হিত অন্যায় !

পহেলগাঁওয়ের নারকীয় ঘটনার পর কাশ্মীরে জঙ্গি দমনে গিয়ে প্রথম শহীদ হলেন ঝন্টু আলি শেখ । পশ্চিমবঙ্গের সন্তান । সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ফলাও করে অনেকে প্রচার করেছেন বীর বাঙালি ঝন্টু আলি শেখ । ভারতমাতার বীর সন্তান । অর্থাৎ একজন আরবি বা ফারসি নামধারী যতক্ষণ আর পাঁচটা ভালো মানুষের মতো আছেন, ততক্ষণ তাঁর সাম্প্রদায়িক পরিচয় বিচার্য নয়, কিন্তু আরবি নামধারী সন্ত্রাসী হলেই সে ইসলামি সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়। ইসলামি সন্ত্রাসী তো সমাজের প্রায় সর্বস্তরে স্বীকৃত । কিন্তু ইসলামি শহিদ ! সেটা আবার কী ? খায় না মাথায় দেয় ? এখান থেকে মুসলিমদের একাংশের মধ্যে হীনমন্যতা দেখা দেয়, কিছু ঘটনায় তার বহিঃপ্রকাশও ঘটে ।

তেমনই একটা চিত্তাকর্ষক ঘটনা এবারও ঘটতে দেখা গেল ! বাংলায় আরবি নামধারী এক যুবক সামাজিক মাধ্যমে সহসা ঘোষণা করলেন যে, তিনি পহেলগাঁওয়ের হত্যার প্রতিবাদে ধর্ম ত্যাগ করেছেন। তথাকথিত সভ্য সমাজের একাংশ এতে ব্যাপক আনন্দিত হলেন । প্রশংসার হাওয়া ভরে তাঁকে বেলুনের মতো ফুলিয়ে তুললেন। আবার অনেকের বক্তব্য এটাই যে এই যুবক – যিনি কিনা পেশায় শিক্ষক – বারবার নিজেকে প্রচারে আনার সুযোগ পেলেই এভাবে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করে থাকেন। হয়তো ভাবেন, এভাবেই আপাত প্রগতিশীল সমাজের মূলস্রোতে থাকা সহজ হবে । এটাকেই ইংরেজিতে বলে ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’। আরবি নাম থাকলেই কি কেউ কোনো সম্প্রদায়ভূক্ত হয়ে যায় ? আর জন্মাবার পরেই কারো ধর্মীয় পরিচিয় তৈরি হয় না । আরবি নামধারী জঙ্গীদের সঙ্গে ধর্মের যোগ নেই । এরা অধর্মী, ধর্মান্ধ এবং অমানুষ । ধর্মান্ধতাই তো প্রকৃত অর্থে অধর্মের প্রথম ধাপ । ধর্মান্ধতার সঙ্গে ধার্মিকতার কোনো সম্পর্ক নেই । যারা অধর্মী, তাদের মনের খাদ্যে ভেজাল মিশে থাকে । তারা আপাতদৃষ্টিতে দিনে পাঁচবার মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লেও যেমন অধর্মী, তেমনই দিনে দুবার মন্ত্র উচ্চারণ করে পুজো-আর্চা করলেও অধর্মী । একদল ধর্মান্ধ যখন গরিব শ্রমজীবিকে তার খাদ্যাভাসের জন্য, গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে মারে তখন কি তারা ধার্মিক ? এই ঘৃণ্য কাজ করার আগে রামকৃষ্ণ বা বিবেকানন্দকে স্মরণ করে ? নাকি অন্য কোনো ধর্মাবতারের মর্মবাণীকে স্মরণ করে ? অবশ্য ‘জয় শ্রীরাম’ কেউ কেউ বলে । কিন্তু তারস্বরে উচ্চারিত এই ‘জয় শ্রীরাম’ বা ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর’– ধর্মীয় প্রসঙ্গে ধর্তব্য নয়, কারণ এগুলো আজকাল ধর্মের বাণী নয়, ভিনধর্মীর প্রতি বিদ্বেষ চরিতার্থ করতে উগ্র রণধ্বনি হিসেবে উচ্চারিত হচ্ছে । ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষে বিষাক্ত হয়ে ধর্মের সঙ্গে এদের পাট চুকে গেছে, বহুকাল আগে ।

পুলওয়ামার সেনা , পহেলগাঁওয়ের পর্যটক হত্যাকারী, মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে হামলাকারী আজমল কাসব, গান্ধীজির হত্যাকারী নাথুরাম, আফরাজুলকে পুড়িয়ে মারা শম্ভুলাল, গোধরায় অন্তঃসত্বা নারীর পেট চিরে ত্রিশূলে ভ্রুণ নিয়ে আস্ফালনকারী বাবু বজরঙ্গি, বা গোরক্ষার নামে পেহলু খান-জুনেদ-তবরেজের হত্যাকারী সবার একটাই পরিচয়, তারা সন্ত্রাসী। ধর্মীয় পরিচয় বহন করলেও প্রকৃত অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। সন্ত্রাসবাদই তাদের ধর্ম।যাঁরা মূলস্রোতের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও বিদ্বেষ ছড়ায়। এ বিদ্বেষকে পুঁজি করেই বিদ্বেষীরা ত্রাস সৃষ্টি করে। সে ত্রাসের আবহেই কায়েম হয় সন্ত্রাসবাদ। 

উদারবাদী অসাম্প্রদায়িক মহলে একটা কথা বহুল প্রচলিত – ‘সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই ।’ এই ভাবনাকে নস্যাৎ করতে বারবার উঠেপড়ে লেগে যান অতি-শিক্ষিতদের একাংশ । এদের কেউ কেউ আবার ভীষণ বুদ্ধিমান । খুব কায়দা করে বলেন – ‘সব মুসলমান সন্ত্রাসী নয় কিন্তু সব সন্ত্রাসীই মুসলমান’। যাঁদের বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি একটু বেশি তীক্ষ্ণ, তাঁরা হয়তো স্কুল জীবনে পড়া রসায়নবিদ্যার একটা কথার সঙ্গে এমন ভাবনার যোগসূত্র খুঁজে পাবেন। ‘সব ক্ষারই ক্ষারক কিন্তু সব ক্ষারক ক্ষার নয়।’

আমি দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করছি – সন্ত্রাসীদের অবশ্যই ধর্ম আছে । পুলওয়ামায় সেনা , পহেলগাঁওয়ের পর্যটক হত্যাকারী, মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে হামলাকারী আজমল কাসব, গান্ধীজির হত্যাকারী নাথুরাম, আফরাজুলকে পুড়িয়ে মারা শম্ভুলাল, গোধরায় অন্তঃসত্বা নারীর পেট চিরে ত্রিশূলে ভ্রুণ নিয়ে আস্ফালনকারী বাবু বজরঙ্গি, বা গোরক্ষার নামে পেহলু খান-জুনেদ-তবরেজের হত্যাকারী সবার একটাই পরিচয়, তারা সন্ত্রাসী। ধর্মীয় পরিচয় বহন করলেও প্রকৃত অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। সন্ত্রাসবাদই তাদের ধর্ম। মনে পড়ে ? মুম্বাইয়ের তাজে, নারকীয় ঘটনার কারিগর কাসবের সহচর সন্ত্রাসীদের স্থানীয় কবরস্থানে ঠাঁই হয়নি। ধর্মপ্রাণ মানুষ সন্ত্রাসীদের মৃতদেহ সেখানে সমাধিস্থ করার অনুমতি দেননি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রকৃত অর্থে যাঁরা ভিন্নধর্মগোষ্ঠীর তাঁরাও শুধু ধর্মীয় পরচিতির জন্য শম্ভুলাল বা নাথুরামের মতো সন্ত্রাসীদের শ্মশানের মতো পবিত্র স্থানে দাহ করতে দিতেন না বা দেবেন না । সন্ত্রাসবাদ তাদেরও ধর্ম, যারা মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম সহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও বিদ্বেষ ছড়ায়। এ বিদ্বেষকে পুঁজি করেই বিদ্বেষীরা ত্রাস সৃষ্টি করে। সে ত্রাসের আবহেই কায়েম হয় সন্ত্রাসবাদ।

পৃথিবীজুড়ে সন্ত্রাসের ভাগ-বিভাজনটা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক । তথাকথিত সুশীল সমাজের একাংশের হিসেব অনুযায়ী, সন্ত্রাস দুই ভাগে বিভক্ত – প্রথমটা কেবলই সন্ত্রাস আর দ্বিতীয়টা ইসলামি সন্ত্রাস। প্রথমটা তেমনটা চর্চিত নয়। দ্বিতীয়টা সর্বত্র চর্চিত, অনেক বেশি টিআরপি ফ্রেন্ডলি । যেখানে সন্ত্রাসীদের নামকরণে আরবি ভাষা জড়িয়ে আছে, সেখানে জঙ্গিপনার নাম হয়ে যায় ‘ইসলামি সন্ত্রাস’। ইসলামের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্বেও সন্ত্রাসবাদের ধর্মীয় পরিচিতি প্রধান হয়ে ওঠে। ‘ইসলামি সন্ত্রাস’- এই শব্দবন্ধটির জন্য বিশ্বজোড়া ‘শিক্ষিত’ সমাজের একাংশের চিরকাল পাশ্চাত্যের যুদ্ধাস্ত্র ব্যবসায়ী শাসকদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তাঁরাই বিলিতি ভাষায় ‘ইসলামিক টেরোরিজম’বাজারজাত করে সমাজের একাংশের মননে-চিন্তনে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন । নাথুরামকে কেউ ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে সন্ত্রাসী বলবে না, না বলাই উচিত । দাভালকার, গোবিন্দ পানাসারে, কালবুর্গি কিংবা গৌরীলঙ্কেশের খুনিরাও ‘হিন্দুসন্ত্রাসী’ নয় । উলফা কিংবা এলটিটিই কাউকেই কখনো হিন্দু, আহোম কিংবা তামিল সন্ত্রাসী বলা হয়নি, হওয়া অনুচিত । পাশ্চাত্যে যখন তখন ঝাঁকেঝাঁকে মানুষ খুন করা বন্দুকবাজরা কিন্তু ‘খ্রিস্টান খুনিরা’ বলে পরিচিত নয়, হওয়ার কথাও নয় । একমাত্র আরবি নামধারী সন্ত্রাসী, যার প্রকৃত অর্থে ইসলাম ধর্মে আস্থাই নেই, সে কেন ‘ইসলামিক সন্ত্রাসী’ হবে ? নামকরণের এই কৌশলকে ইংরেজিতে বলা যায় –’অবজেক্টিভ নোমেনক্লেচার’! এমনকি পহেলগাঁওয়ে পর্যটক হত্যার পর সাম্প্রদায়িক হিংসার কিছু কিছু কারবারিকে এটাও বলতে দেখা গেছে, ‘সন্ত্রাসবাদ ততদিন, ইসলাম যতদিন।’

আজকের এ সন্ধিক্ষণে অনেক তথাকথিত ভদ্রলোক ও জড়িয়ে রয়েছেন বিদ্বেষ ছড়ানোর পুণ্যকর্মে ! এঁদের মধ্যে আমার নিজের বাল্যবন্ধু, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী এবং প্রাক্তন-বর্তমান সহকর্মীও আছেন । মূলস্রোতের প্রচার মাধ্যমে বিদ্বেষ চাষের ফলস্বরূপ পহেলগাঁওয়ের ‘কাঙ্খিত’ প্রতিশোধ নেওয়া শুরুও হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে উত্তরপ্রদেশে এক বিরিয়ানির দোকানের কর্মীকে দুই গোরক্ষক, নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করে গুলি করে মেরে দাবি করলেন এটা নাকি ‘পহেলগাঁওয়ের প্রতিশোধ’। ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে !’ কালজয়ী বিজ্ঞাপনটার কথা আরেকবার মনে পড়ে, ‘ইউপি মে দম হ্যায়, জুরম ইয়াহা কম হ্যায়।’

দাভালকার, গোবিন্দ পানাসারে, কালবুর্গি কিংবা গৌরীলঙ্কেশের খুনিরাও ‘হিন্দুসন্ত্রাসী’ নয় । উলফা কিংবা এলটিটিই কাউকেই কখনো হিন্দু, আহোম কিংবা তামিল সন্ত্রাসী বলা হয়নি, হওয়া অনুচিত । পাশ্চাত্যে যখন তখন ঝাঁকেঝাঁকে মানুষ খুন করা বন্দুকবাজরা কিন্তু ‘খ্রিস্টান খুনিরা’ বলে পরিচিত নয়, হওয়ার কথাও নয় । একমাত্র আরবি নামধারী সন্ত্রাসী, যার প্রকৃত অর্থে ইসলাম ধর্মে আস্থাই নেই, সে কেন ‘ইসলামিক সন্ত্রাসী’ হবে ? নামকরণের এই কৌশলকে ইংরেজিতে বলা যায় –’অবজেক্টিভ নোমেনক্লেচার’!

একদিন যে-কোনো বিবেকবানের মৃতদেহ, যে-কোনো বীরপুঙ্গবের আনন্দ-উল্লাসের কারণ হতে পারে। তেমন কিছু ঘটলে, এদের কেউ বড়জোর হত্যাকারী বলবে। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে সন্ত্রাসী ? কক্ষনো না ! কারণ, ঘৃণার বাজারে সন্ত্রাসী স্বীকৃতি একটামাত্র সম্প্রদায়েরই প্রাপ্য। হাজার হোক পাশ্চাত্যের দেওয়া নাম। আমরা কোন হরিদাস পাল, যে পাশ্চাত্যের নির্মিত এমন সর্বজনবিদিত ধ্যান ধারনাকে খণ্ডাবো ! কাজেই ‘গো উইথ দ্য ফ্লো’। সন্ত্রাসীদের ধর্ম অবশ্যই আছে।কিন্তু যতক্ষণ সে নিউজিল্যান্ডের মসজিদে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, ততক্ষণ তার কোনো ধর্ম নেই। যতক্ষণ সে শম্ভুলাল বা বাবু বজরঙ্গির মতো ধর্মমোহে বিধর্মীর ঘাতক, ততক্ষণ তার কোনো ধর্ম নেই। ধর্ম আছে কেবল কাসবের মতো সন্ত্রাসীদের ।

কাশ্মীরে আগেও সাধারণ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে জঙ্গিরা। ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা রদ হওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে কাশ্মীরের কুলগাম জেলায় পাঁচজন পরিযায়ী শ্রমিককে নৃশংস ভাবে খুন করে জঙ্গিরা। তাঁদের সবাই ছিলেন এই বাংলার বাসিন্দা। কিন্তু ওই পাঁচজনের ধর্ম পরিচয়ে টিআরপি বলতে কিছুই নেই, কারণ ধর্মীয় পরিচয়ের সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে তারা লঘু। আরবি, ফারসি নামধারী জঙ্গি ভিন্নগোষ্ঠীর মানুষকে মারলে তবেই তাতে টিআরপি আসে, নইলে কাঁচকলা । ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বেছে বেছে হত্যা অবশ্যই ধর্মীয় সন্ত্রাস। সেটা পহেলগাঁওয়ের ক্ষেত্রে যদি সত্য হয়, ওড়িশায় গ্রাহাম স্টেইনের হত্যার ক্ষেত্রেও সত্য, জয়পুর মুম্বই সেন্ট্রাল সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে চেতন সিংএর বেছে বেছে মানুষ হত্যার ক্ষেত্রেও সত্য, পেহুলু-আখলাক-জুনেদদের হত্যার ক্ষেত্রেও সমান সত্য।

৩০ এপ্রিল বনগাঁয় “পাকিস্তান জিন্দাবাদ, হিন্দুস্তান মুর্দাবাদ” লিখে অশান্তি বাধাবার চেষ্টা করতে গিয়ে পুলিশের জালে ধরা পড়ল বিজেপির সক্রিয় কর্মী এবং সনাতনী একতা মঞ্চের সদস্য চন্দন মালাকার ও প্রজ্ঞাজিৎ মণ্ডল। এদের দুজনকেই পাকিস্তানের পতাকা-সহ গ্রেফতার করা হয়েছে। শুক্রবার মুর্শিদাবাদেও ঘটেছে একই ঘটনা । এসব চক্রান্ত থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, তারপর একসময় তা সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। এবার কী বলব ? সন্ত্রাসীদের ধর্ম হয় কি হয় না ? সব সন্ত্রাসী কি কেবল একটাই প্রথাগত ধর্মীয় পরিচিত বহন করে ? উত্তর সবার জানা। কিন্তু নিজেকে দেখার জন্য স্বচ্ছ আয়না কি সবার কাছে আছে ?

পরিশেষে, একটা ইতিবাচক বিষয়ের উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি।মূলস্রোতের মিডিয়ার কিছুটা বিপরীতে দাঁড়িয়ে সামাজিক মাধ্যমে এবারই প্রথম দেখা যাচ্ছে যে, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী বর্বরদের চেয়ে অসাম্প্রদায়িক কণ্ঠস্বর বেশি। রাস্তাঘাটে পুলওয়ামার মতো রগরগে সেন্টিমেন্ট চাগিয়ে তোলা বিদ্বেষী আলোচনা কিছুটা হলেও এখন কম শোনা যাচ্ছে। ব্যাপারটা আশা জাগায়। এই আশাতেই আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই। এই আশাতেই সবুজ মনকে, মনের সুস্থতাকে বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর লড়াই।

♦•♦–♦•♦♦•♦–♦•♦

লেখক পরিচিতি : নৃ-বিজ্ঞানী আজমল হুসেন কলকাতার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!