Advertisement
  • অনুবাদ কবিতা
  • জানুয়ারি ৩০, ২০২২

জেরার দ্য নেরভালের সনেট

সৈয়দ কওসর জামাল
জেরার দ্য নেরভালের সনেট

অলঙ্করণ: দেব সরকার

 

জীবনীকার জি ফেরিয়র যাঁকে বলেছেন ফরাসি প্রতীকবাদের আত্মিক সূচনাকার, মার্সেল প্রুস্তের মতে যিনি উনিশ শতকের তিন-চারজন লেখকের মধ্যে একজন, বোদলেরের কাছে যিনি ছিলেন প্রাঞ্জল লেখক, আঁদ্রে ব্রতঁ-র কাছে যিনি স্যুররেয়ালিস্তদের পূর্বসূরি এবং আঁতোন্যাঁ আর্তো-র ধারণায় যিনি হোল্ডারলিন নিৎসে ও ভ্যান গগের মতো স্বপ্নদ্রষ্টার সঙ্গে উচ্চারিত হওয়ার যোগ্য— তিনি জেরার দ্য নেরভাল (১৮০৮-১৮৫৫)। একজন পাঠকের নেরভালের কাব্যজগতে প্রবেশ করে মনে হতে পারে যে তিনি গভীর প্রজ্ঞা, স্বপ্ন ও কল্পনার কবি, মিথ ও অভূতপূর্ব ব্যক্তিগত প্রতীকনির্মাণের কবি। কিন্তু নেরভালের কাব্যের ধ্বনি সামঞ্জস্য, সংগীত-সুষমা, দূরাগত চিত্রকল্প, ফর্মের নিখুঁত ব্যবহার ইত্যাদিতেও আমরা মুগ্ধ হতে পারি। আর গভীর অধ্যয়নে ধরা পড়ে মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে নেরভালের চিন্তা, তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক প্রকাশভঙ্গি, নিজের ‘অপর’কে বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে মানবজীবনের মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্জগতকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা—এ সব কিছুই রোম্যান্টিক সময়কালের কবি নেরভালকে আধুনিক বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল করেছে।
অনূদিত কবিতাগুলো নেরভালের সনেটগ্রন্থ Les Chimères, (১৮৫৪) থেকে গৃহীত।

 

উত্তরাধিকারহীন
(El Desdichado)

আমি সে বিষণ্ণতার—শোকগ্রস্ত—সান্ত্বনাবিহীন,
ধ্বংসপ্রাপ্ত দূর্গের ভিতরে আকিতেন রাজকুমার।
আমার নক্ষত্র মৃত; নাক্ষত্রিক আমার গিটার
বহন করেছে বিষণ্ণতার কালো সূর্য।

কবরের অন্ধকারে তুমিই আমাকে দিলে আলো
আমাকে ফিরিয়ে দাও পসিলিপো, ইতালি সাগর
আর ফুল যা বিদীর্ণ করেছিল আমার হৃদয়
সেই কুঞ্জ যেখানে গোলাপ ও আঙুর বন্ধু হয়ে ছিল
আমি কি ইরস, কিংবা ফোবিয়্যুস? …ল্যুসিয়াঁ বা বিরঁ?
রানির চুম্বনে লাল হয়ে আছে আমার কপাল
স্বপ্ন দেখি গুহায় জলপরিরা কাটছে সাঁতার…

আর আমি আশেরন পেরিয়েছি দুবার, গৌরবে
স্বর ওঠানামা মেনে অর্ফিয়ুসের বাঁশিতে বাজাই
সন্তের দীর্ঘশ্বাসগুলি আর পরিদের স্পষ্ট কান্না।

 

মায়ারতো
(Myrtho)

তোমার কথাই আমি ভাবছি, মায়ারতো, স্বর্গের মায়াবিনী,
সুউচ্চ পসিলিপোয় আছো সহস্র অগ্নির উজ্জ্বলতাসহ,
তোমার কপালে অগ্নিবিভা প্রতিবিম্ব যেন প্রাচ্যের আলোর,
আর কালো আঙুরেরা আটকে আছে তোমার সোনার কেশবন্ধে।

প্রথম মদমত্ততার স্বাদ আমি পেয়েছি তোমার পেয়ালাতেই,
আর তোমার চোখের হাস্যময়তার এক চকিত ঝলকে,
যখন ইকাউসের পায়ের নীচে বসে আমি প্রার্থনা করেছি,
কারণ আমাকে দেবী তৈরি করেছেন এক গ্রিসের সন্তান।

আমি জানি পুনরায় আগ্নেয়গিরিটি কেন জেগেছে ওখানে…
কারণ ওখানে কাল তোমার পায়ের ক্ষিপ্র ছাপ পড়েছিল,
আর দিগন্ত ঢেকেছে অঝোর বৃষ্টির মতো নেমে আসা ছাই।

নরম্যান ডিউক এক ভেঙেছিল যেদিন তোমার মাটির দেবতাদের,
ঠিক সেদিন থেকেই, ভার্জিলের লরেল বৃক্ষশাখার নীচে,
ফ্যাকাসে হাইড্রাঞ্জিয়া আর সবুজ মার্টল একত্রে বেড়েছে।

 

ওরয়্যুস
(Horus)

যখনই দেবতা নেফ কেঁপে উঠলেন গোটা ব্রহ্মাণ্ড কাঁপিয়ে;
তাঁর মাতা আইসিস বিছানাতে সোজা হয়ে উঠে বসেছেন,
ঘৃণাভরা চোখে তাঁর ইঙ্গিত উঠেছে ফুটে বন্য স্বামীর দিকে,
আগের দিনের মতো সবুজ দুচোখ অগ্নিগর্ভ, বলেছেন:

‘বৃদ্ধ ব্যভিচারী, দ্যাখো, পুত্র তোমার মৃত্যুর কাছাকাছি প্রায়
পৃথিবীর সমস্ত জমাট হিম তার মুখের ভিতরে নামে
বক্র দু’পা শিকলে বেঁধেছে, দুচোখ বিভ্রান্তিকর, অস্তমিত
আগ্নেয়গিরির দেবতা সে, আর রাজা এক শীতের দেশের

‘হার্মেস ও ওসিরিসের প্রেমজাত সন্তানকে এইবার ডাকো
তার জন্য নিজেকে সজ্জিত করি দেবতা-মা সাইবেলের বেশে
ঈগল উড়েছে আগে, নতুন আত্মার ডাক শুনতে পাই আমি!’

দেবীও গেছেন চলে ইতিমধ্যে বাহন সোনালি শঙ্খে চড়ে
সমুদ্র ফিরিয়ে দিল আমাদের কাছে তাঁর পূজিত ছবিটি
এবং আকাশ হল প্রজ্জ্বলিত আইরিসের রামধনু রঙে।

আঁতেরো
(Antéros)

আমাকে জিজ্ঞাসা করো কেন এত ক্রোধ আমার অন্তরে
আর কেন তার নমনীয় কাঁধে আমার অবাধ্য মাথাখানি;
সত্যি হল আমি গর্ববোধ করি আন্তেউস বংশজাত হয়ে,
আমি ছুড়ে মারি তারই তীর জিতে আসা দেবতার দিকে।

হ্যাঁ, আমাকে প্রাণিত করেছে সেই প্রতিশোধকামী,
রাগান্বিত ঠোঁট দিয়ে সে রেখেছে ছাপ তার আমার ভুরুতে,
আবেল-এর পাণ্ডূরতার নীচে, হায়, রক্তচিহ্নমাখা,
কখনও কখনও আমি ক্ষমাহীন ক্যেন-এর রক্তবমি করি!

জেহোভা! অন্তিম দেবতাও পরাভূত তোমার এ প্রতিভায়,
নরকের অতল গভীর থেকে চিৎকার করেছে, ‘অত্যাচার!’
তিনিই আমার পিতা দাজন অথবা পূর্বপুরুষ বেলাস…

কসিটাসের জলে ওরা আমাকে ডুবিয়েছিল তিনতিনবার;
এখন আমার মাতা আমালেকাইট একমাত্র রক্ষাকর্তা,
প্রাচীন সে দাজনের দাঁত করেছি পুনর্বপন তার পায়ে।

♦−♦♦−♦♦−♦


❤ Support Us
Advertisement
error: Content is protected !!