Advertisement
  • স্মৃ | তি | প | ট
  • জানুয়ারি ৩০, ২০২২

আমার আড়ালে আমি

আমাদের পরম বন্ধু, আমৃত্যু হিতাকাঙ্খী আন্তর্জাতিক খ্যাতির চিত্রশিল্পী ওয়াসিম কাপুরের প্রয়াণে আমরা মর্মাহত । তাঁর স্মৃতিতে ২০০৯ সালের আরম্ভ উৎসব সংখ্যায় প্রকাশিত আত্মকথা পুনর্বার পরিবেশিত হল

ওয়াসিম কাপুর
আমার আড়ালে আমি

ও য়া সি ম  কা পু র

তুলসিরামের নাতি

আমি কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। বাংলা আমার মাতৃভাষা নয়, ধাত্রীভাষা। অতএব, নিজেকে বাঙালি বলতে ও ভাবতে আমার খুবই ভালো লাগে। বাড়িতে বাংলায় কথা বলি, বাংলা বই পড়ি, বাংলার ঐতিহ্য ছুঁয়ে ছবি আঁকি। তবে, বংশপরম্পরায় আমরা পাঞ্জাবি। আমার ঠাকুরদা তুলসীরাম কাপুর ছিলেন পাঞ্জাবের বাসিন্দা। নিষ্ঠাবান হিন্দু; প্রবল বন্ধুবৎসল এবং সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। অবসর সময়ে, বিশেষ করে রাতে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা, গান আর কবিতা পাঠের আসরে তিনি (মুশায়েরা) মেতে থাকতেন। একজন প্রতিবেশী —মির্জা সাহেব ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। মির্জাকে বাদ দিয়ে ঠাকুরদা কোনো মহফিলেই যেতেন না। তখনকার দিনে গড়গড়া থেকে তামাক খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। যে কোনো অনুষ্ঠানেই শ্রোতা-দর্শকরা সঙ্গে এই সেবনপাত্র নিয়ে যেতেন। একদিন এক গানের অনুষ্ঠানে মাতোয়ারা মির্জা সাহেব বেখেয়ালে তাঁর গড়গড়ার নলটা ঠাকুরদার হাতে ধরিয়ে দিলেন। ঠাকুরদা তখন গান শুনতে মত্ত। অজান্তে মির্জার নল মুখে দিয়ে গড়গড়া টানতে লাগলেন। পাশে অনেকেই ছিলেন। ঘটনাটি তাঁদের নজর এড়াল না। ঠাকুরদাকে তাঁরা চেপে ধরলেন, এ কী করলে তুলসীরাম! মুসলমানের এঁটো নলে হুঁকো টানলে? তোমাকে সবার সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। ঠাকুরদা গোঁ ধরে বসে থাকলেন। তাঁকে তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠী ‘জাতিচ্যূত’ করে দিল। ঠাকুরদা অভিমানে মুসলমান হয়ে গেলেন। কিন্তু বংশচিহ্ন বদলালেন না, আমার বাবাও নিজের ক্ষেত্রে, আমাদের ভাইবোনদেরও নামের পরে কাপুর পদবি বহাল রাখলেন।

tulshi-riaz-kapoor

ঠাকুরদা তুলসীরাম কাপুর

 

ধর্ম বদলেছে, পরিচয় বদলায়নি

ইসলাম গ্রহণের পর কাপুর পরিবারের ধর্ম বদলেছে, ধর্মীয় অভ্যাস বদলেছে, কিন্তু জাতি-পরিচয় কিংবা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান খুব একটা বদলায়নি। বরং দু-ধর্মের রেওয়াজ ও রাতিনীতিতে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি। আজও মিশ্র বিবাহ, মিশ্র সংস্কৃতি আমাদের জড়িয়ে আছে ।

ধর্মান্তরিত তুলসীরাম তাঁর জন্মাঞ্চল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। জীবিকার তাগিদে তাঁকে পাঞ্জাব ছেড়ে সপরিবারে লক্ষ্মৌ চলে আসতে হয়েছিল। লক্ষ্মৌতে আমার বাবা বড়ো হয়েছেন। ওখানেই তাঁর লেখাপড়া, ওখানেই তাঁর কবিতা লেখার হাতেখড়ি, ওখানেই ব্যবসারও আরম্ভ। খাতায় কলমে তাঁর নাম এস আর কাপুর। কিন্তু কবি হিসেবে ভারতে, পাকিস্তানে তিনি সাবলিক লক্ষ্মৌয়ি বলেই পরিচিত। আমার মা-ও লক্ষ্মৌ-র লাগোয়া শহর বড়াবাঁকির মেয়ে। দাদা শামিম কাপুর আমার চাইতে এক বছরের বড়ো। লক্ষ্ণৌতেই তাঁর জন্ম ১৯৫০-এ, আমার ১৯৫১ ।

 

লক্ষ্মৌ থেকে কলকাতায়

দেশজুড়ে দেশ ভাগকে ঘিরে তখন প্রবল অস্থিরতা। মুসলিমরা দলে দলে দেশ ছাড়ছেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শূন্য-অশূন্য স্থানে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন হিন্দু উদবাস্তুরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লক্ষ্ণৌতে আমাদের পারিবারিক ব্যবসা সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়ল। কলকাতার সঙ্গে বাবার পূর্ব পরিচয় ছিল। পড়াশুনো সেন্ট জেভিয়ার্সে। সহপাঠি ও বন্ধুবর্গের অভাব ছিল না। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই আমাদের দুভাই আর মাকে নিয়ে বাবা কলকাতায় চলে এলেন। বদলে গেল আমার শহর। এরপর থেকেই আমরা এ শহররে স্থায়ী বাসিন্দা। লক্ষ্ণৌয়ের সঙ্গে সরাসরি আর কোনো যোগাযোগই থাকল না। বাবার কবিতাচর্চার ভাষা উর্দু বলেই ওখানকার কবিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বজায় থাকল। অনেকেই কলকাতায় এলে আমাদের বাড়ি আসতেন—বৈঠকখানায় কবিতা পাঠের আসর বসত। শৈশবেই আমি কায়ফি আজমি, মহম্মদ ফায়েজ, আয়ান রশিদ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়-এর মতো বড়ো বড়ো কবির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পাই। যদি শারীরিক একটি অঘটন না ঘটত, তাহলে হয়তো, আমিও বাবার পদাঙ্ক ছুঁয়ে কবিতার পেছনে ছুটতাম।

 

খাট থেকে পড়ে যাওয়ার পর

আমরা তখন ৫ সাগর লেনের বাসিন্দা। সবে লক্ষ্মৌ থেকে এই শহরে এসেছি। ঘিঞ্জি বস্তি। ঘরেও জায়গার অভাব। সারাদিন ব্যবসার কাজে বাবাকে বাইরে থাকতে হয়। সংসার আর দু’সন্তানকে একাই সামাল দিতে হয় মাকে। আমার বয়স তখন বড়ো জোর সাত মাস। আমাকে বিছানায় শুইয়ে রেখে মা তখন অন্য কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ আমি খাট থেকে পড়ে গিয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম। মা ছুটে এলেন। কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যে কান্না থেমে গেল। মা আশ্বস্তবোধ করলেন। বাড়ি ফিরলে বাবাকে বললেন, কোনো অঘটন ঘটেনি বলে বাবাও আমল দিলেন না। কিন্তু ঠিক আড়াই বছর বয়সে জানা গেল, আমার কোমড়ার হাড়ে হেয়ার লাইন ফ্র্যাকচার। হাঁটতে পারি না, উঠতে-বসতেও পারি না। ভয়ঙ্কর অসুখ। উদবিগ্ন মা-বাবা। চোখের সামনে সবসময় শুয়ে আছে সন্তান। বুক থেকে পুরো ডান পা এবং হাঁটু পর্যন্ত পুরো বাঁ পা প্লাস্টারবদ্ধ, অসাড়। দাদা স্কুলে যায়। প্রতিবেশী সমবয়স্ক শিশুরা দলবেঁধে ছোটে। খেলতে যায়। আমি অসহায়, শুয়ে থাকি, জানলা দিয়ে শুধু দেখি। অল্পবয়সে তিনবার অপারেশন করা হল। তিনবারই প্লাস্টারের চেহারা বদলাল, কিন্তু উপশম হল না। ছোট্ট একটি দুর্ঘটনা আমার শৈশব বদলে দিল। শরীরটাকে বদলে দিল। বদলে দিল জীবনটাকেও। ১৪ বছর পর্যন্ত একই অবস্থা কখনও বাড়িতে, কখনও হাসপাতালে পড়ে থাকতে হত। বাবা-মা, দাদা যথাসম্ভব সঙ্গ দেন। তবু আমি নিঃসঙ্গ।

 

অচল দেহ, হাতে স্কেচ পেনসিল

আমি তখন ৬ বছররে বালক। তখনকার সুপরিচিত চিকিৎসক ডাঃ এস.আর.চন্দ আমার অপারেশন করলেন। অপারেশনের পর দাদা স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই আমাকে দেখতে যেত। আর ক্লাসে ওর আঁকা ছবি আমাকে দেখাত। অনুপ্রাণিত বোধ করতাম। প্লাস্টার বাঁধা শরীর। পা, কোমড় নাড়তে পারি না। কোনোমতে অনেক কষ্টে হাত নাড়াই। দাদার খাতায়, দাদার পেনসিল দিয়েই অচল শরীরকে ডিঙিয়ে ধীরে ধীরে ছবি আঁকতে শুরু করলাম। হাসপাতালে শায়িত সন্তানের ড্রয়িং দেখে বেদনার্ত বাবার সামনে, ঘোর অন্ধকারেও হঠাৎ যেন ঝলসে উঠল একটুকরো আলো। আমি প্রায় প্রতিদিনই দাদার আঁকা ছবি দেখে আঁকি। বাবা এসে দেখেন। উৎসাহ দেন। হাসপাতালেই আমার দুরারোগ্য অসুখের যন্ত্রণা জয় শুরু হয়ে গেল। বাবা স্টেটসম্যান পত্রিকায় ‘আঁকা শেখানোর শিক্ষক চাই’ বলে একটি বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপন সাড়া দিয়ে আমাদের বাড়ি এলেন একজন শিল্পী। নাম অমর নন্দন। ইস্টার্ন রেলের কর্মী। বাবাকে বললেন, আমাকে শেখাতে ওঁর অসুবিধা হবে না। আর হলেও উনি সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন। অসাধারণ শিক্ষক। অল্পদিনের মধ্যেই আমার বন্ধু হয়ে উঠলেন। প্লাস্টিকে বাঁধা, প্রায় বাঁকা আমার শরীর। ঠিকমতো দাঁড়াতে পারি না। উনি আমার সুবিধা-অসুবিধা খতিয়ে দেখে অদ্ভুত একটি ইজেল তৈরি করালেন। ছবি আঁকতে গিয়ে দেখি, দিব্যি আঁকছি, আঁকতে পারছি—যন্ত্রণাবোধ নেই, নেই অন্য কোনো অস্বস্তিও। অল্পদিনের মধ্যেই অঙ্কনবিদ্যার প্রাথমিক শর্ত আমার আয়ত্তে চলে এল। খুশি আমার মাস্টারমশাই। খুশি বাবাও।

 

স্ট্রেচারে আর্ট কলেজ

প্রথাগত লেখাপড়া যে হবে না, মা-বাবা, আঁকার স্যার সবাই জানতেন। আমিও জানতাম। কিন্তু আঁকার ঝোঁক এবং প্রাথমিক সাফল্য দেখেই মা-বাবা ঠিক করলেন বাড়ির কাছে সরকারি আর্ট কলেজ, ওখানেই ভরতি করে দেবেন। প্রথম শিক্ষাগুরু অমর নন্দও সায় দিলেন। ব্যস, আমাকে আর্ট কলেজে ভরতি করানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। কিন্তু বেঁকে বসলেন কলেজের কয়েকজন শিক্ষক। বললেন, হাঁটতে পারে না, দাঁড়াতেও পারে না, কলেজে কী করে আসবে ? কী করে ক্লাসে বসবে? ভাস্কর বিপিন গোস্বামী তখন কলেজ অধ্যক্ষ। নরম স্বভাবের মানুষ, কিন্তু জেদি। বললেন, সমস্যা হবে না। আমি সব ব্যবস্থা করব। কাজের মানুষ আর আদর্শ শিক্ষক। কথা আর কাজে কোনো ফারাক নেই। দ্রুত আমার ভরতির ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। কলেজে আসতে যেতে অসুবিধা হচ্ছিল। ট্রামে-বাসে উঠতে পারি না। গাড়িতেও ওঠার শক্তি নেই। স্ট্রেচারে কলেজে পৌঁছে দিতেন বাবা। নিয়ে যেত দাদা। আমার পঠন পর্বের শুরু এইভাবে। এইভাবেই তার সমাপ্তি। ১৯৭১, বয়স তখন ২০। কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করি। হ্যাঁ, অসুখের বিরুদ্ধে, প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে, অবাক দৃষ্টি, কৌতূহল, হয়তো-বা উপেক্ষারও বিরুদ্ধে আমাকে বিস্তর লড়তে হয়েছে। কিন্তু কোনো লড়াই বৃথা যায়নি। বড়াই করছি না, লড়াকু জীবন আজও আমার নিত্যসঙ্গী। আজও ক্র্যাচের ওপর ভর দিয়ে হাঁটতে হয়, আঁকতে হয়। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। দাঁড়িয়ে আঁকতে গিয়ে ব্যাথায় অনেক সময় কাতর হয়ে পড়ি। বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিই। কিছুক্ষণ বাদেই আবার শুরু হয় ক্যানভাসে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ।

 

আমার বাবা কিংবা একজন কবি

আমি সাধারণত রাতে ছবি আঁকি। দিনে সকাল ১১টা পর্যন্ত ঘুমোই। দুপুরে, বিকেলে, সন্ধ্যায় আড্ডা, সিনেমা দেখা। বই পড়া। কখনো-সখনো অনুষ্ঠানে যাই। মিছিলেও হাঁটি। মিছিলও আমার লড়াইয়ের অঙ্গ।
বলা বাহুল্য, আমার আঁকাবাঁকা শরীর আমাকে লড়াকু বানিয়েছে; এক্ষেত্রে আমার বাবার অবদানও অসামান্য। তিনি আজীবন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। অবিভক্ত পার্টির নেতারা যখন পুলিশের তাড়া খেয়ে আত্মগোপন করতে বাধ্য হচ্ছেন, তখন জ্যোতি বসু থেকে জ্যোতির্ময় বসু, মহম্মদ ইসমাইল পর্যন্ত বহু নেতাকে আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে দেখেছি। বাবা তাঁদের সঙ্গ দিয়েছেন, আদর্শে উদবুদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু কখনও কারও নাম ভাঙিয়ে আত্মগৌরবকে বড়ো করার চেষ্টা করেননি। পার্টি করেছেন। ব্যবসাও করেছেন। ব্যবসার সঙ্গে তাঁর পার্টিসত্তাকে কখনও জড়াননি। দীর্ঘদিন পার্টির উর্দু মুখপাত্র অবসর-এর সম্পাদক ছিলেন। বয়স যখন বাড়ল দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন, পার্টি ছাড়েননি। ব্যবসার স্বার্থের সঙ্গে পার্টিকে যেমন কখনো জড়ানোর সুযোগ দেননি বা খোঁজেননি, তেমনি তাঁর কবিসত্তা ও রাজনৈতিক পরিচয়কেও একাকার করে দেননি। আদর্শগত দায়বদ্ধতা বজায় রেখেই তাঁর কবিতা নান্দনিক শর্তকে কখনও লঙ্ঘন করেনি।

 

ক্যানভাসের ভাষায়

১৯৩৬ সালে যে ৮ লেখক-কবি মিলে প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলেছিলেন, বাবা তাঁদের অন্যতম। অতএব, লড়াই ও আদর্শবোধ তাঁর আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য দুই মুখ। সম্ভবত, বাবার কাছে আমিও এই শিক্ষা গ্রহণ করেছি। আমি তাঁর মতো পার্টি সদস্য নই। নিছক একজন সমর্খক। কিন্তু যখন আঁকতে বসি, তখন উগ্র রং, প্রোপাগান্ডা, যান্ত্রিক আদর্শবোধ আমাকে কাবু করার সুযোগ পায় না। বিমূর্ত ছবি আঁকি। বিষয় অথবা শরীরসর্বস্বতা কখনও গ্রাস করে না। ক্যানভাসের, রঙের নিজস্ব ভাষা আছে। আমি তাকে অস্বীকার করি না। কখনও করব বলে মনে হয় না। আমি সরল মনেই বিশ্বাস করি—শিল্পী অবাধে শিল্প গড়বেন। তাঁর নির্মাণের উৎস, উপাদান, মাধ্যম যাই হোক না কেন, নির্মিতকে অতি অবশ্যই শিল্পিত হতে হবে। অর্থাৎ শিল্প আর প্রোপাগান্ডার লক্ষ্যে ঐক্যের চেয়ে অনৈক্য অনেক বেশি। শিল্প শাশ্বত আবেদন দাবি করে। প্রোপাগান্ডা চায় তাৎক্ষণিক সাফল্য। শিল্প প্রবেশ করতে চায় গভীরে, অন্তরের অন্তরে। তাৎক্ষণিক সাফল্য। শিল্প প্রবেশ করতে চায় গভীরে, অন্তরের অন্তরে। তাৎক্ষণিকতার মধ্যেই প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়ে যেতে পারে। আবার দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে তার ভূমিকা। প্রোপাগান্ডাকে হেয় করছি না। এরও সামাজিক মূল্য আছে। কিন্তু প্রোপাগান্ডার পক্ষে শিল্প-ধর্ম পালন সম্ভব নয়। শিল্পকর্ম অতি অবশ্যই প্রোপাগান্ডার, সমাজ গঠনের, আদর্শ প্রচারের সহযোগী ও সহায়ক হতে পারে। যে কোনো মাধ্যমের যে-কোন মহান সৃষ্টিই মানুষের হৃদয়ের, মানুষের অতীতের, মানুষের অভিষ্যতের সঙ্গী। অর্থাৎ তাৎক্ষণিকতাকে অস্বীকার করাই তার প্রাথমিক ও সর্বশেষ লক্ষ্য। সম্ভবত এজন্যই প্রশ্নহীন আনুগত্যে সায় দেয় না শিল্পীর মন। স্বতন্ত্র বলেই সে প্রশ্ন তোলে । অন্যকেও জিজ্ঞাসায় উদবুদ্ধ করে।

 

মতান্তর মানি, মনান্তর মানি না

আগেই বলেছি, রাজনৈতিক পরিবারে, রাজনীতির ছত্রছায়ায় আমি বড়ো হয়েছি। পরিবারের ধর্মীয় পরিচয়ও ছিল। আজও আছে। কিন্তু আচারসর্বস্বতা কখনও আমাকে বা আমার পরিবারকে স্পর্শ করতে পারেনি। তেমনি রাজনৈতিক সংকীর্ণতা আমাদের অভ্যাসের ভেতরে বা বাইরে কখনও আমল পায়নি। কমিউনিস্ট বাবার সঙ্গে বহু অকমিউনিস্টের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁদের কেউ লেখক, কেউ কবি। কেউবা সমাজকর্মী অথবা ব্যাবসায়ী। মতান্তরকে বাবা মনান্তরে পরিণত হওযার প্রশ্রয় দেননি। আমিও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করি।

kaesor-jahan-salik-lakhnavi

চিত্রির মা কায়সার জাহান এবং পিতা কবি সালিক লখনউয়ি

 

 

মায়ের মতো মা

বাপের বাড়ি খাস লক্ষ্মৌতে। মায়ের মতো মা ছিলেন আমাদের জননী। অসাধারণ রান্না করতেন। ইদের দিনে তাঁর হাতে তৈরি বিরিয়ানি খেতে অনেকেই আসতেন। রীতিমতো মহফিল বসে যেত। বিরক্তির চিহ্ন নেই। দিনভর অতিথি সেবায়ও ক্লান্তি নেই। সংযমী, মিতব্যয়ী। কথাও কম বলতেন। কোনো ধরনের গোঁড়ামিকে কখনও প্রশ্রয় দেননি। আমি মায়ের বহু স্বভাব পেয়েছি। এই যেমন বন্ধুপ্রীতি, পরিবারমগ্নতা আর পরধর্মসহিষ্ণুতা। দাদা শামিমকে বিয়ে করে শীলা আমাদের বাড়ি এলেন। মা তাঁকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিলেন । তাঁর পিতৃপরিচয়, তাঁর ধর্ম নিয়ে কখনও অস্বস্তি দেখা দেয়নি। শীলাও অদ্ভুত মহিলা। নির্বিরোধ মাছের মতো সংসারের স্রোতে মিশে গেলেন। শামিম আর আমি বন্ধুর মতো বড়ো হয়েছি। শামিমকে বিয়ে করে আমাদের বাড়িতে শীলাও আরেক বন্ধু হয়ে উঠলেন। ৮০-র দশকে হঠাৎ শামিমের মৃত্যু হয়। মা শামিমের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। তিনিও আচমকা চলে গেলেন। মায়ের শূন্যতা পূরণ করলেন শীলা। ভরাট করে দিলেন শামিমের জায়গা। আক্ষরিক অর্থেই তিনি এখন বাড়ির অভিভাবক, গৃহকর্ত্রী । শীলা বিয়ের আগে ছবি আঁকতেন। বিয়ে করে সংসার দেখতে গিয়ে ছেদ পড়ল। শামিমের মৃত্যুর পর আবার ক্যানভাসে ডুবে গেলেন। বেশ কয়েকটি বড়ো বড়ো ছবি আঁকলেন। সক্রিয় রাজনীতির শরিক হয়ে ছবির সঙ্গে ইদানীং তাঁর আড়ি চলছে। জাত শিল্পী, আমার বিশ্বাস শীলা আবার রং ও তুলি হাতে স্বজগতে ফিরে আসবেন। দায় আমারও। আমি ওঁকে ফেরাবই।

 

স্বভাব অথবা নিঃশব্দ প্রস্তুতি

হঠাৎ-হঠাৎ শূন্যতাবোধ, হঠাৎ আঁকা ছেড়ে রং তুলি সরিয়ে চুপচাপ বসে থাকা অথবা অন্য কাজে মেতে ওঠা শিল্পীদের স্বাভাবিক ধর্ম। এটাকে আমি বলি নিঃশব্দ প্রস্তুতি। আমাকে প্রায়ই এ অবস্থায় বিরাজ করতে হয়। যখনই কোনো সিরিজ আঁকি—অর্থাৎ নানা অঙ্গে, নানা ব্যঞ্জনায় একই বিষয় ফিরে আসে, পরপর, তখন আঁকার আগে কিংবা পরে কিছুদিন নিজের মধ্যে গুম হয়ে যাই। ডিপ্রেশন ঘিরে ধরে। প্রতিদিনই ঘুম ভাঙার পর অথবা সন্ধ্যায় নেমে আসে মেঘলা আকাশ। আমি এমনিতেই বেদনার্ত মানুষ। আশৈশব এর সঙ্গে আমার বসবাস। হঠাৎ যখন কোনো ঘটনা কিংবা বিষয় ঘা দেয়, নাড়িয়ে দেয়, তখন বেদনার ভেতর দিয়ে জেগে উঠি এবং একটানা ছবি আঁকতে থাকি। এর মনস্তাত্ত্বিক কারণ আমি জানি না—কখনও খতিয়ে দেখিনি—কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে ভূতগ্রস্তের মতো রাতভর ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। আঁকি। আঁকতেই থাকি। অর্থাৎ একেকটি ঘটনা, কখনও সামান্য, কখনও অসামান্য আমার ভেতরে ওলট-পালট কাণ্ড ঘটিয়ে দেয় আর এরই রেশ ধরে আমার আবেগ, আমার ভাবনা ছবিতে বিমূর্ত হতে থাকে।

 

আঁকার আগে এবং পরে

ছবির উৎস কখনও ব্যক্তিসবর্স্ব অভিজ্ঞতা, কখনও-বা বিষয় আশয় একান্তভাবে নৈর্ব্যক্তিক বা তাৎক্ষণিক কোনো কোনা ঘটনা বিশেষ পরিধি নিয়ে, ব্যাপক বিষয় হয়ে ক্যানভাসে আসতে থাকে। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। বোঝানো হয়তো সহজ হবে।

 

এক
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। রাতে বাড়িতে বিছানায় বসে আছি। হঠাৎ হইচই শুনে জানলায় মুখ রেখে দেখি, একজন মহিলাকে কয়েকজন পুলিশ কর্মী বেধড়ক পেটাচ্ছে। তিনি একা। আশেপাশের লোক দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না। আমি নিরুপায় দেখে গেলাম। বাইরে বেরুব, প্রতিবাদ করব, চলার শক্তি নেই। মারধোর করে ও পুলিশ তাঁকে রেহাই দেয়নি। তুলে নিয়ে গেল। পরে খবর নিয়ে জানলাম, মহিলা একজন যৌনকর্মী। এটাই তার একমাত্র অপরাধ। এই ঘটনা আমাকে বিমূঢ় বানিয়ে দিল। দিন কয়েক গুম হয়ে বসে থাকলাম বেদনায়, অব্যক্ত ক্ষোভে। দিন কয়েক পরেই ক্যানভাসের মুখোমুখি দাঁড়াতে শুরু করলাম। শুরু হলো একটানা আঁকা। তৈরি হল ‘বন্দী সিরিজ’ । এরপর বোরখা সিরিজ। দুই সিরিজেরই বিষয়ে অবরুদ্ধ নারী, শোষিত নারী, ভাষাহীন নারী। এই দুই সিরিজে কয়েকশো ছবি এঁকেছি। প্রায় প্রতিটি ছবি দেশে-বিদেশে সমাদৃত। সবই এখন আমার নাগালের বাইরে, নানা জায়গায়, সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত।

wasim-painting-burkha

ক্যানভাসে বুরখা সিরিজ

 

দুই

৮০ ও ৯০-এর দশকে দাঙ্গার পর দাঙ্গায় মানুষ মানুষকে খুন করতে শুরু করল। দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ার আন্তর্জাতিক রাজনীতির লেজ ছুঁয়ে হিংসায় উন্মত্ত হয়ে উঠল পৃথিবী। সম্ভবত আতঙ্ক স্পর্শ করল আমাকেও। দ্রুত, অতি দ্রুত শান্তির প্রতীক হয়ে আমার ক্যানভাসে নেমে এলো যিশু। ছোট-বড় মিলিয়ে যিশুর কয়েক হাজার ছবি এঁকেছি গত কয়েক বছরে। এখনো যিশু আমার সঙ্গী।

 

Wasim-Kapoor-Jesus-series

ক্যানভাসে যিশু

 

তিন

পুনঃনির্দেশ অথবা ফরমায়েশে আঁকতে পারি না। আঁকি নিজের তাগিদে। ভেতরের তারনায়। সুচিত্রা সেন আর ওয়াহিদা রহমান এর অভিব্যাক্তি শৈশবে চঞ্চল করে তুলত। ওই স্মৃতি সঙ্গ ছাড়েনি। বছর কয়েক আগে, না বলা বাণীর ঘন যামিনীকে ঘিরে নারীর বহুমুখী ভঙ্গিমা নিয়ে ক্যানভাসে আবির্ভূত হতে থাকলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের নায়িকারা। এখানেও বুঁদ হয়ে একের পর এক নারীদেহ, নারীমুখ এঁকেছি। এক্ষেত্রে আমি সফল না অসফল খতিয়ে দেখিনি। ভেতরে ঝড় বইছিল, তাই একটানা এঁকে গেছি।

 

চার

আমার ‘রিকশা সিরিজের’ পেছনে ও একই ধরনের অভিজ্ঞতা। একই গল্প। রিকশোয় পা তুলে বসে আছে নির্বিকার মানুষ। আর মানুষের হাত তাকে টানছে। তার ঘাম ঝরছে। সে হাঁপাচ্ছে। টানতে পারছে না, তবুও টানতে হচ্ছে। সভ্য সমাজের উদাসীনতার, উৎপীড়নের এ এক নৃশংস দৃষ্টান্ত। সামন্তবাদ কিংবা আধা সামন্তবাদের শিকার এখনও আমরা। রিকশা সিরিজ সামন্ত চেতনার প্রতীক। উৎপীড়িতের প্রতীক।

 

স্পর্শকাতর, নিরপেক্ষ নই

আমার ছবি অবশ্যই স্পর্শকাতর। অবশ্যই পক্ষপাতদুষ্ট। যান্ত্রিক নিরপেক্ষতায় আমার বিশ্বাস নেই। মনে হয় বেঁচে থাকার তিনটি পথ আছে। এক, বিপর্যয় দেখেও, ক্রন্দন শুনেও চুপচাপ বসে থাকতে হবে। প্রশ্ন তুলব না। নড়ব না। দুই,নড়ব, প্রশ্ন তুলব। অঘটনের বিরোধিতা করব। তিন, অঘটনকে সমর্থন করে ক্রমাগত বলতে হবে, কে বলেছে, রাজা ন্যাংটো? মোটেই ন্যাংটো নয়।
নিরপেক্ষ সেজে নিঃশব্দ বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। রাজা ন্যাংটো নয়—একথাও বলা অসম্ভব। অতএব বলতে হবে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলতে হবে। আমার ছবি বিমূর্ত। কিন্তু প্রশ্নহীন নয়। ছবির বিষয় অনেকসময় অস্পষ্ট—কিন্তু লক্ষ্যহীন নয়। ছবিতে বিশেষ কিংবা নির্বিশেষের বেদনা আঁকি। যন্ত্রণা আঁকি। যন্ত্রণার ভেতরেও খুঁজে ফিরি শান্তি। তাই যিশুর মাথায় ফুটে ওঠা কাঁটার মুকুট। তার কপালেও কণ্টকের মালা। ক্ষতবিক্ষত দেহেও শুধু পেরেক আর পেরেক। তবু তিনি প্রশান্ত। আকাশের মতো উদার, এবং উন্মুক্ত।

 

দিনরাতের ওয়াসিম

বন্ধুরা বলেন, কঠিন অসুখ নিয়েও আমি আমার বয়স লুকিয়ে রেখেছি। হয়তো ভুল বলেন না। বয়স নয়, আমি আড়াল করি আমার আমিকে । অবাধে চলতে পারি না। বিছানায় শুয়ে, বসে দিন কাটাই।দিনে ঘুমোই আর রাত যত বাড়ে, ততই আমার স্বভাব জেগে উঠতে থাকে। মোদ্দা কথা, দিনের ওয়াসিম পোশাক-আবৃত, একটি আচ্ছাদিত মানুষ। আর রাতের ওয়াসিম সম্পূর্ণ আলাদা। যে নিজের সঙ্গে দেখা করে; ক্যানভাসে দেখে নিজেকে। নিজের মগ্নতাকে। আর আত্ম-আবিষ্কারের মুহূর্তে ওয়াসিম তিরস্কার করে ওয়াসিম রিয়াজ কাপুরকে।

♦−♦♦−♦♦−♦


❤ Support Us
error: Content is protected !!