Advertisement
  • খাস-কলম
  • মে ২৫, ২০২২

অগ্রগতির গতি বাড়ল। পদ্মার বুকে সেতুর মতো সেতু ।

বাহার উদ্দিন
অগ্রগতির গতি বাড়ল। পদ্মার বুকে সেতুর মতো সেতু ।

স্বপ্ন এবার অক্ষরে অক্ষরে বাস্তব হয়ে উঠবে । ২৫ জুন, মনোহর অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে ভূপৃষ্ঠে, জলের ওপরের শূন্যতাকে তুচ্ছ করে সফর শুরু করবে ‘পদ্মা নদীর সেতু’। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর পরিবার অথবা অন্য কোনও ব্যক্তির নামেও নয়, পদ্মা নদীর নামেই সেতুটি নামাঙ্কিত হবে। বাংলাদেশের সড়ক ও পরিবহণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুটি প্রস্তাব পেশ করি। উদ্বোধনের দিনক্ষণ ২৫ জুন এবং স্বপ্নময় সেতুর নামকরণ। দিনক্ষণে সায় দিয়েছেন দেশনেত্রী । দ্বিতীয় প্রস্তাব নিয়ে যথাসম্ভব সংযত ভাবাবেগ ব্যক্ত করেছেন তিনি—পদ্মা নদীর নামেই পদ্মাসেতু চিহ্নিত হোক। স্থিতধী প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সব মহল খুশি। সেতু উদ্বোধনের প্রস্তুতি জোর কদমে আরম্ভ হয়ে গেল। গনকণ্ঠে ব্যাপক চর্চা। খরচ, প্রযুক্তি, সেতুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, প্রস্তুতি প্রক্রিয়া, ব্যয় সংকোচন এবং কাঠামো নিয়ে প্রশংসায় সোচ্চার সংবাদ মাধ্যম। উদ্বোধনে বহুদেশীয় সাংবাদিকরা আমন্ত্রিত হবেন কি না, জানা যায়নি । নিজের উদ্যোগে কোনো কোনো দেশ তাঁদের প্রতিনিধি পাঠাতে পারে।

দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশ প্রাচ্যের আরেক জাপান হয়ে উঠবে। ভুল বলেন নি। নির্মাণ, উন্নয়ন আর দেশের ভেতরে সংযোগ বিস্তার, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যপ্তি আর রপ্তানির রসদ বাড়িয়ে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যার অন্যরকম প্রতিশোধ নিচ্ছে প্রতিস্পর্ধী বাংলাদেশ।

পাকিস্তানে ‘কল্যাণ প্রসূ’ গণতন্ত্রের প্রবক্তা জেনারেল আইয়ুব খান নদীময় পূর্বপাকিস্তানে একনদীর সঙ্গে  আরেক নদীকে জুড়ে দিতে চেয়েছিলেন । জলে স্থলে। এই উদ্যোগ পাকিস্তানের উভয়াংশে হয়তো তাঁর আধিপত্য  কায়েম করার  এটি ছিল তাঁর অন্যতম  কৌশল । আইয়ুবের পরিকল্পনার খবর পেয়ে আঁতকে উঠেছিলেন পিকিংপন্থী জননেতা মৌলানা আব্দুল হামিদ খান  ভাসানি।  বঙ্গবন্ধুকে ডেকে পাঠিয়ে বলেছিলেন, মুজিব সাবধান! আইয়ুব খানের পরিকল্পনা সফল হলে আমরা কখনও স্বাধীন হতে পারব না । জবাবে শেখ মুজিব কী বলেছিলেন,  জানা নেই। পাক আমলাদের ভুল পরামর্শের খেসারত  দিতে হয়েছিল সরকারকে। কট্টর সামরিক প্রশাসন, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগীদের অহেতুক দেশদ্রোহিতার মামলায় জড়িয়ে দেওয়া, বুদ্ধিজীবীদের মুক্ত চিন্তাকে সন্দেহ নজরে দেখা, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা, বাংলাভাষার ধর্মীয়করণ —ইতিহাসের বিকৃতি—এরকম নানা কারণে গণমনের অসন্তোষ তীব্র, তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। আইয়ুব খান নাস্তানাবুদ। বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের এক এলাকার সঙ্গে আরেক এলাকার সংযোগ স্থাপনে তাঁর প্রয়াস বাস্তব থেকে অনেক দূরে পড়ে রইল। কর্ণফুলি নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি এবং চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকায় কৌশলপূর্ণ গুটি কয়েক প্রকল্প রূপায়ন নিয়েই তাঁকে সন্তুষ্ট থাকেত হয়। এরকম সন্ধিক্ষণে জন্ম নেয় চাকমা সমস্যা।  হাজার হাজার উপজাতি ভিটেবাড়ি হারিয়ে ভারতের মিজোরাম, বরাক, পরে নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ারে এসে আশ্রয় নিলেন। এ আরেক দুরূহ উদ্বাস্তু ইস্যু। রাজনীতিকে যা বহুবছর প্রভাবিত করেছে। আজও করছে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব আর রাজনীতির উত্থানে সমস্যা লঘু হল বটে, কিন্তু তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর জিয়া এরশাদের নীতিগত বিভ্রান্তির খেসারত দিতে হল চাকমাদের। দেশছাড়ার পথ ছেড়ে তারা সন্ত্রাসের আত্মঘাতী পথকে বেছে নিলেন। এরাশদের ক্ষমতাচ্যুতি, বিএনপি-র পতন এবং নবকলেবরে আওয়ামি লিগের উত্থানে নতুন অভিমুখ তৈরি হল, পাহাড় থেকে সমতলে। শেখ হাসিনা পার্বত্য এলাকায় শান্তির সাদা পায়রা ওড়ালেন। ভারতীয় জঙ্গিদের আশ্রয়স্থল ভেঙে দিলেন মুজিবকন্যা । সন্ত্রাসবাদী আলফা কুপোকাৎ। ত্রিপুরি জঙ্গিদের বাংলাদেশ প্রবেশও রুদ্ধ হয়ে গেল। ধর্মীয় ভাবাবেগের অপব্যবহার করে উত্তর থেকে দক্ষিণে যারা সন্ত্রাস চালাত, তাদের ‘আদম ব্যবসা’, জনসেবা বা স্বাস্থ্যসেবার আড়ালে সন্ত্রাসের আমদানি রপ্তানিও চুপসে যায়। দেশের নবায়নে, পুনর্গঠনে, সামাজিক সংস্কারে মনোযোগ স্থাপন করল নির্বাচিত সরকার। এটাই বাংলাদেশের অগ্রগতি আর উন্নয়নসূচক অভিমুখের পশ্চাদপটের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত। গপ্পের আরও অনেক মুখ রয়েছে।  আছে বিদেশে কর্মরত লক্ষ লক্ষ বাঙালি শ্রমিক-কর্মীদের উপার্জনের বূহৎ অংশের স্বদেশগমণ এবং পুণর্গঠনে সরকারি, বেসরকারি বিন্যাস। দুর্নীতি অন্যতম, অনতিক্রমণীয় ফ্যাক্টর হলেও, শেখ হাসিনার জেদ আর অঙ্গীকার, গঠনমূলক সত্যপ্রিয়তা, কঠোর শাসন প্রক্রিয়াই দূর-নিকটের অন্ধকারকে ভেদ করে অগ্রগতির দ্রুতগামী সড়ক দিয়ে ছুটতে বাধ্য করল বাংলাদেশকে। । এই সাফল্য শুধু ব্যক্তির নয়, দলের নয়, তার উদীয়মান অর্জনের কৃতিত্ব সমাজের সব অংশের। এরকম পরিপ্রেক্ষিতে পদ্মা ব্রিজ অবশ্যই সাম্প্রতিক বাংলাদেশের উন্নয়ণ দৌঁড়ের শক্তিমান, সুদূঢ় প্রতীক। জলজ বিচ্ছিন্নতা উচ্ছেদেরও সরব প্রতিমা। এই প্রতিমা পূজো দাবি করে না, দাবি করে আঞ্চলিক বৈষম্য হত্যার সৃজনশীল উল্লাস ।

বাংলাদেশে ঘুরতে গিয়ে উদ্বোধনমুখী সেতুটির নির্মাণের প্রস্তাব, প্রস্তুতি, প্রযুক্তি, দেশীয় শ্রমিক শক্তির ব্যবহার নিয়ে গল্পের পর গল্প শুনেছি। গল্প হলেও এসব সত্য। বানিয়ে বলা সত্যের মহিমা আর মাধুর্যকে অবজ্ঞা করার শক্তি কোথায়? আমরা কল্পলোকে আজ যা দেখছি, যা ভাবছি, সুদূর কিংবা নিকটস্থ ভবিষ্যতে তা সত্যের চেহারা নেয়। বিজ্ঞান সত্যকে অবধারিত, অপরিহার্য করে তোলে।

যমুনায় দীর্ঘ ব্রিজ হবে, ঢাকা ফ্লাইওভারে ছেয়ে যাবে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অসম ছুঁয়ে অরুণাচল পর্যন্ত ব্রক্ষ্ণপুত্রের ওপরে ৯.১৫ কিলোমিটারের সেতু কালোত্তীর্ণ গায়ক ভূপেন হাজারিকাকে প্রতিদিন সেলাম জানাবে, স্মরণ করিয়ে দেবে তাঁর নিঃসময়ে সুর আর কন্ঠকে, মহারাষ্ট্রেও গড়ে উঠবে আরেক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিজ, বা চিনের ইয়াংসি নদীর ওপর ১৬০.৮কিলোমিটার দৈর্ঘের বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু তৈরির সাফল্য অবাক করে দেবে বিশ্বকে —তা কি আমরা ভাবতাম? জানতাম জলের ওপর বিজ্ঞানের আশু বিজয়ের বাস্তবতা অনিবার্য। এরকমই এক কষ্টকল্পিত বাস্তবতাকে এবার বিক্রমশীল পদ্মার ওপর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘ সেতু গড়ে অন্য এক অসম্ভবকে হার মানতে বাধ্য করল বঙ্গীয় সমতটের চিন্তা, আবেগ, নিহিত স্বপ্নের রূপকারদের অপরাজেয় অভিপ্রায় ।পদ্মাব্রিজ প্রতিবেশী ও ভারতকে নিঃসন্দেহে গর্বিত এবং উপকূত করবে।উত্তর-পূর্বাঞ্চাচলের বাণিজ্য আর উন্নয়নে আলোর নাচন লাগবে ।

দেশের টাকায় দীর্ঘ সেতু, মানিক বন্দোপাধ্যায়-এর (পদ্মানদীর মাঝি) স্বদেশিদের অর্জিত পরিশ্রম আর নিষ্ঠায় নির্মিত এ ব্রিজ দক্ষিণ এশীয় বাঙালির অর্থনৈতিক সত্তাকে, সত্তার বহুমাত্রিক নির্মাণকে, আশা করি আরও ঋদ্ধ করবে।

 

ভাবতে আর বলতে বুক চওড়া হয়ে উঠছে যে, ব্যক্তির নামে নয়, অঞ্চলের নামেও নয়, ব্রিজের নামকরণ হবে পদ্মা নদীর সেতু। চমৎকার, ঐতিহ্যবাহী সম্বোধন। বাহ্ বাংলাদেশ । বাহ্ গরিয়সি পদ্মা। জল পেরিয়ে, জলজ বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করে যে-ভাবে সে মাথা তুলল, শূন্যতার ওপর ছড়িয়ে দিল প্রযুক্তিযুক্ত গতির তীব্রতা, একদা অনুভূত ও অনুমিত, বিশ্বাস্য চিন্তাকে অধিকতর উঁচু করবে পদ্মার বাস্তব ছোঁওয়া আর সামাজিক চরিত্রায়ন। চেহারা আর সম্বোধনে, পদ্মা নদীর মাঝিদের মঙ্গলবোধ আর সংগ্রামকে দীর্ঘাঙ্গ, স্থায়িত্ব দিয়েছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ঠিক তেমনি আজ ব্রিজ নির্মাণের বাস্তবতা খোদ পদ্মাকে দীর্ঘায়ু দান করল। এখানেও আনন্দ অমূল্য।


❤ Support Us
error: Content is protected !!