- এই মুহূর্তে স্মৃ | তি | প | ট
- এপ্রিল ২৯, ২০২৩
থমকে গেল রণজিৎ গুহের পথ চলা। অভিভাবকহীন নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা। শোক মুখ্যমন্ত্রীর, স্তব্ধ গবেষক আর অধ্যাপকেরা
অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, রণজিত গুহ বিশ শতকের সেরা সৃজনশীল ভারতীয় ঐতিহাসিক ।
চিত্র : সংবাদ সংস্থা
বিহঙ্গ নয়, পতঙ্গের দৃষ্টিতে দেখতে হবে ইতিহাসকে। অতীতচর্চার চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল এনে সাবল্টার্ণ হিষ্ট্রির অন্যতম কারিগর হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসবেত্তা রণজিত গুহ। তিনি আর নেই। শনিবার ভোর তিনটেয় ঘুমের মধ্যে থমকে গেল তাঁর ইহজাগতিক যাত্রা শতবর্ষ পূর্তির চব্বিশ দিন আগে, অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনার বাসভবনে। ইতিহাসচর্চার অঙ্গনের এই নক্ষত্রপতনের খবরে মূহ্যমান অগণিত শিক্ষার্থী-গবেষক ও অধ্যাপকরা। শোক প্রকাশ করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিদগ্ধ সমাজের বহু সদস্য। তিনি যাঁদের শিক্ষক, গবেষণার আদর্শ এবং নতুন চোখে ইতিহাসে দেখবার মহৎ অবলম্বন।
১৯২৩ সালের ২৩ মে বরিশালের বাখরগঞ্জে তাঁর জন্ম। প্রাথমিক বিদ্যাপাঠ শেষ করে কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কমিউনিষ্ট পার্টির সংস্পর্শে চলে আসেন। সুশোভন সরকার, অমলেশ ত্রিপাঠীর মতো ইতিহাসবিদের দৃষ্টিপাত তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। মুক্তমনা অশীন দাশগুপ্ত তাঁর সমসাময়িক। অশীন বাবুর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে রণজিৎ গুহের মতের অমিল কখনো বন্ধুত্বের বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং যুক্তিপ্রবণতা উভয়ের মনন চর্চাকে সমৃদ্ধ করে। ১৯৪৭ সালে প্যারিসে বিশ্ব ছাত্র সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন রণজিৎ গুহ। পরে দলের প্রতিনিধি হয়ে সাইবেরিয়া, উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া ও চিন সফর করেন। ১৯৫৫ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারেননি। সিপিআই-এর সঙ্গে মতানৈক্য তৈরি হয় এবং কমিউনিষ্ট পার্টি থেকে দূরে সরে গেলেন। ১৯৫৯ সালে দেশ ছেড়ে যোগ দিলেন ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অফ সাসেক্স-এ। ওখানেই তাঁর ইতিহাস চর্চার দিগন্ত বদল শুরু । ইতিহাসের সঙ্গে আর দর্শনের অধ্যয়নও তাঁর পাঠ্য হয়ে উঠল। অ্যান্টোনিও গ্রামশির প্র্যাক্সিসের দর্শন তাঁকে আকৃষ্ট করে। তখনই নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা তাঁর গন্তব্য হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে তিনি শুধু গবেষক নন, সমাজবিজ্ঞান আর দর্শনের ভিত্তিতে ইতিহাসকে নতুন করে দেখার অন্যতম জনক হয়ে উঠলেন। তাঁর মননের সমৃদ্ধি কখনো শিকড়চ্যুত হয় নি। সাল-তারিখের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যবহার রীতির বাইরে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা, সাধারণ ঘটনা তাঁর গবেষণার অপরিহার্য বিষয় হয়ে ওঠে। ইতিহাসপাঠের এই ধারা আকৃষ্ট করে দীপেশ চক্রবর্তী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, শহিদ আমিন, গৌতম ভদ্র এবং গায়ত্রী চক্রবর্তীর মতো তখনকার উদীয়মান প্রজ্ঞাকে। সে অর্থে রণজিৎ গুহ এঁদের সবার শিক্ষক।
বহু গ্রন্থের প্রণেতা আর ব্যতিক্রমধর্মী ইতিহাসচর্চার এই মনীষাকে ইতিহাস মনে রাখবে। দুটি কারণে। এক, নিম্নবর্গের যাপন ও রাজনীতির সঙ্গে অতীত আর বর্তমানের ঘটনাকে মিলিয়ে দেখা। দুই, দর্শনকে ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে ভাবনা-চিন্তা জাগিয়ে তোলা। এখানেই তিনি একজন দার্শনিক যাঁর সংগৃহীত তথ্য সাধারণের মাঠ থেকে উঠে এসে খাড়া করে ব্যবহারিক তত্ত্ব। সম্ভবত একারণেই রণজিত গুহকে ‘বিশ শতকের সেরা সৃজনশীল ভারতীয় ঐতিহাসিক’ বলেছিলেন কল্যাণপ্রসূ অর্থশাস্ত্রের আধুনিকতম উদ্ভাবক অমর্ত্য সেন।
❤ Support Us