Advertisement
  • খাস-কলম
  • জুন ২৭, ২০২৩

গণতন্ত্র: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি

অজয় দাশগুপ্ত
গণতন্ত্র: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তি বেড়েছে বাংলাদেশের । বর্তমান সরকারের কট্টর সমালোচকেরাও জানেন উন্নয়নের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে । এত কিছুর পরও আজ আবার দেশের বাইরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিয়ে যে খেলা চলছে, সে কথা সবার জানা । মূলত পৃথিবীর দুটি প্রান্তের লড়াই আজীবন দেখে আসছি আমরা । এক প্রান্তে আছে উন্নত নামে পরিচিত দেশগুলো । অন্যপ্রান্তে যাদের বলা হয় অনুন্নত বা উন্নয়নশীল তাদের অবস্থান । এখন সমস্যা হচ্ছে যতদিন কোনো দেশ বা জাতি অনুন্নত বলে চিহ্নিত হয়, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে ধৈর্য ধরার উপদেশ দেয়া আর মাঝে মাঝে কিছু খয়রাত দেয়া ছাড়া উন্নত দেশগুলো কিছুই করে না বলা চলে । কিন্তু যখন কোনো দেশ উন্নয়নশীল হয়ে ওঠে বা আরো সামনে এগুতে চায় তখন সেই দেশের পেছনে লাগাটা তাদের স্বাভাবিক কাজ । তারা উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে সমর্থন দেয়, এই কথাটা সবাই জানেন কিন্তু এটাও জানবেন এর পেছনেও তাদের স্বার্থ থাকে।পুঁজির সবচেয়ে বড় সমস্যা সে স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না ।

যে সমাজ বা দেশের শাসকরা এমনটা করেন তাদের সমাজে ছেলে-মেয়ে মা-বাপের কাছ থেকে টাকা নেয়ার সময় বলে, আমাকে ধার দাও। আমি সময়মত ফেরত দিয়ে দেব। যেটা আমাদের সমাজে এখনো ভাবা যায় না। এই যে দেয়া-নেয়া, এর ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে পাশ্চাত্য সভ্যতা। তারা টাকা ধার দেয়, টাকা ফেরত নেয় । কৌশলে নেয়ার নাম বদলে বলে সাহায্য। তারা যে সহায়তা দেয় না সেটা বলি না। তবে শুধু সহায়তা আর নির্ভরতার নাম কি সেটা পাকিস্তানের দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব। যে কথা বলছিলাম বাংলাদেশ যখন তার অতীত ঝেড়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে এবং অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে তখন গাত্রদাহের কারণ থাকবেই। তবে এটাও বলতে হবে আমরা নিজেরাই পরিস্থিতিটা তৈরি করি এবং তাদের হাতে তুলে দিই আমাদের আঘাত করার মতো অস্ত্র। যা দিয়ে আমাদের ভয় দেখানো হয়।

আওয়ামী লীগের আমলে সবচাইতে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে নির্বাচন এবং সে জায়গাটাতেই আমরা আছি বিপদে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দেশ শাসনে আসা দলটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একের পর এক ইতিহাস শুদ্ধি চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় প্রত্যাবর্তনসহ নানাবিধ সংস্কারের কাজ করেছে। এই সময়কালে তার পাশে ছিল মেধাবী তারুণ্য আর বিশাল জনগোষ্ঠী।

কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের কাজ যদি হয় দেশসেবা, তা হলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা হবে তাদের মূল কাজ । সে কাজ না হলে কথা উঠবেই । নির্বাচন ও রাজনীতির ধুম্রজাল সরে না যাওয়া পর্যন্ত এক ধরণের অস্থিরতা বিরাজ করবে 

একের পর এক টার্ম দেশ শাসনে শুরু হলো নানাবিধ অসঙ্গতি আর স্ববিরোধিতা । বলাবাহুল্য সমাধানের পথে না গিয়ে ধামাচাপা দেয়ার প্রবণতা কিংবা সময় সুযোগমতো আপস করার চেষ্টাই এখন কাল হয়ে উঠতে চাইছে । দেশের বাইরে এখন সবদেশেই একেকটা মিনি বাংলাদেশ আছে । এই বাংলাদেশের মানুষগুলো যাদের আমরা প্রবাসী বলি তাদের দেশপ্রেম আর দেশাত্মবোধ প্রবল । এখন এই প্রবাসীদের পাঠানো টাকা বা রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির বড় এক খুঁটি । সে খুঁটির জোর আছে। ফলে তারা টাকা পাঠাবে কিন্তু কিছু বলবে না এটা ভাবা সঠিক নয়। তাদের ভাবনা আর চিন্তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনীতি, যে রাজনীতিতে উস্কানি আর উত্তেজনা অধিক, তার কদর বেশি। হয়তো তাই দেশের চাইতেও বিদেশে এখন রাজনীতি প্রবল।
তারপরও এভাবে সক্রিয় হবার কথা ছিল না। মূলত নির্বাচন বা গণতন্ত্র নিয়েই ঝামেলা। আমাদের মুখে গণতন্ত্র থাকলেও কাজে নেই। সেটা ব্যক্তিজীবন বা সমাজেও দেখি আমরা। বাঙালির পরিবার থেকে সমাজ–সবাই একনায়কতান্ত্রিক। ঘরে পিতা যেটা বলেন সেটাই আইন। সমাজে সমাজপতি বা বিশিষ্টজনেরা যা মনে করেন তাই হচ্ছে নিয়ম। অথচ রাষ্ট্রের বেলায় আমরা চাই পরিপূর্ণ গণতন্ত্র। সেটা চাইলে খোলনলচে পরিবর্তন করতে হবে আমাদের। যার কাজ এখনো শুরু হয়নি।
বলছিলাম উন্নত দেশগুলোর কথা। দীর্ঘ সময় চর্চা, লেখাপড়ার মানসহ নানা কারণে তারা এখন গণতান্ত্রিক। কিন্তু তারপরও তাদের গণতন্ত্র একশো পার্সেন্ট নিরাপদ বা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। হ্যাঁ, নির্বাচনের ফলাফলে গদি পরিবর্তন হয় স্বাভাবিক নিয়মে, কিন্তু সে ধারাবাহিকতার ভেতর ও থাকে নানা ধরণয়ের কেলেঙ্কারি। বেশিদূরে যাবার দরকার নেই, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যা কিছু ঘটেছে সেগুলো বিবেচনায় রাখলেই বোঝা সম্ভব কতটা ঝুঁকি আছে তাদের গণতন্ত্রে। আমেরিকার মতো দেশে একদল বেপরোয়া মানুষ শীর্ষ দালানে প্রবেশ করে সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে। এটা কি শ্রীলঙ্কার চাইতে কম কিছু? তারপরও তাদের কথা বা সবক শোনাই এখনো গণতান্ত্রিক বলে বিবেচনা করা হয়।

আমেরিকা বাংলাদেশে গণতন্ত্র চায়, সঠিক নির্বাচন চায়–এমন কথা বলেই নিষেধাজ্ঞা দিতে ইচ্ছুক । কিন্তু রাজনীতির বাইরে যে আর্থিক উন্নয়ন কিংবা অগ্রযাত্রা সেটা কিভাবে অব্যাহত থাকবে বা কা’রা তা সামনে নিয়ে যেতে পারবে সে বিষয়ে তারা নিশ্চুপ। বাংলাদেশের রাজনীতি ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণে তাৎপর্যমণ্ডিত। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী উদীয়মান শক্তি ভারত। তাদের পাশাপাশি চিন আছে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে। বাংলাদেশের অবকাঠামো এবং দেশজ উন্নয়ন প্রক্রিয়ার আরেক অংশীদার জাপান। এই সব দেশের কথা বিবেচনায় রেখেই চলতে হয় বাংলাদেশকে, সে জায়গায় আমেরিকার সব কথা শোনা বা তাদের উপদেশ পুরোটা মানা কি সম্ভব ? তারা যে আমাদের অগণতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে নিষেধাজ্ঞা চাপাতে চায় সে কাজটি কি তারা চীনের বেলায় করতে পারবে ? চীন তো আগাগোড়া একটি কমিউনিস্ট দেশ, যাদের দেশে বহুদলের অস্তিত্বও নেই । এ নিয়ে আমেরিকার কোনো কথা নেই। বরং এ ব্যাপারে তারা গভীর নীরবতা পালন করে চলেছে। কারণ চিনের কাঁধ আমেরিকার কাঁধ ছুঁয়েছে অনেক আগে। সে জন্যই বলছিলাম আমাদের যেটুকু ভাবমূর্তি তা কোন দেশ বা সরকারের কল্যাণে বা আশীর্বাদে হয়নি। হয়েছে দেশের মানুষের এবং দেশের বাইরের অবস্থানকারী বাংলাদেশীদের মেধা ও অক্লান্ত শ্রমে। দেশের নেতৃত্বের কারণে। সে জায়গাটা নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। এমন কোনো শক্তিকে আহ্বান করা যাবে না, যারা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করবে।

যে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের কাজ যদি হয় দেশসেবা, তা হলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা হবে তাদের মূল কাজ । সে কাজ না হলে কথা উঠবেই । নির্বাচন ও রাজনীতির ধুম্রজাল সরে না যাওয়া পর্যন্ত এক ধরণের অস্থিরতা বিরাজ করবে । যখন তা কেটে যাবে তখন আবার আমরা সামনের যাত্রা সুসংহত হতে দেখব। এই সময়কাল তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষের চাহিদা, আশা ও ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতি তার আপন পথে চললে অনেক সমস্যার জট খুলতে বাধ্য। এখন ডিজিটাল মিডিয়ার কারণে দেশের সঙ্গে বিদেশে অবস্থানের কোনো ফারাক নেই। সব কিছু হাতের মুঠোয়। ফলে সাবধানতা আর নিয়ন্ত্রণ যেন হাতছাড়া না হয়।

বহুকষ্ট ও শ্রমে যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে তা একবার হারিয়ে ফেললে আবার ফিরে পাওয়া হবে কঠিন । বাংলাদেশের ভাগ্যে বহুবছর পর যে সৌভাগ্যের হাতছানি দেখা যাচ্ছে, তাকে নিজেদের কাজে লাগানো যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখন অপরাজনীতি ও অন্যদের চোখ রাঙানি বন্ধের জন্য কাজ করাই হবে দরকার । সেটা শুরু হলে অনেক অপস্রোত নিজে থেকেই হারিয়ে যাবে । বাংলাদেশের জয় হোক এটাই বিশ্ব বাঙালির চাওয়া ।

 

♦–♦♦–♦♦–♦

লেখক পরিচিতি: সিডনিতে কর্মরত, পেশাদার ইংরেজি ভাষার শিক্ষক । ছড়াকার, প্রাবন্ধিক এবং কলাম লেখক । প্রকাশিত হয়েছে একাধিক গ্রন্থ।

সৌজন্য: বিডি নিউজ ২৪ 


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!