- ন | ন্দ | ন | চ | ত্ব | র স্মৃ | তি | প | ট
- জুলাই ২৪, ২০২৫
অনুরণনই হোক শ্রদ্ধাঞ্জলি
গতকাল ভোরে যৌথখামার নিশ্চুপ। ভারতের রঙ্গমঞ্চের বাকি আলো সব নিভে গেছে। কেবল একখানি ফোকাস বাতি এসে পড়েছে এক প্রবীণ ব্যক্তির উপর, নিঃশব্দ বিদায়ের শেষ অঙ্কে তখন তিনি মাতোয়ারা। উত্তর-পূর্ব ভারতীয় আখ্যানের প্রান্তিকীকরণের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে, সাংস্কৃতিক পরিচয়ের তীব্র দাবি, শেষ একবার রক্ত পতাকার মতো মানচিত্রে উড়িয়ে দিচ্ছেন নাট্যনির্মাতা, ‘থিয়েটার অব রুটস’ আন্দোলনের অগ্রদূত, যৌথখামারের মাটি, রতন থিয়াম।
শোক জানানো কঠিন। বিশেষত যখন শোক কেবল একজন মানুষের প্রয়াণে নয়, বরং এক ভাষ্যের, এক দর্শনের, এক নাট্যবোধের প্রস্থানও, তখন শব্দেরা নিজেরাই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জলে পাতা পড়বার মতো আন্দোলনে, গভীরে উঠে আসে কটা শব্দ, প্রয়াত রতন থিয়াম ! শিকড়-নাটকের অন্যতম পথিকৃৎ, মণিপুরের আত্মা ও মঞ্চের আত্মজ, ভারতীয় নাট্যভাষার অনন্য নির্মাতা আর নেই। তাঁর অনুপস্থিতি আমাদের আরও স্পষ্ট করে চিনিয়ে দেয় তাঁর নির্মাণের কাদামাটি রং, বিস্মৃতির ইতিহাস। থিয়ামের নাম উচ্চারিত হলেই, মনে আসে ‘চক্রব্যূহ’, ‘উত্তর প্রিয়দর্শী’, ‘ঋতুসংহার’, কিংবা ‘কর্ণভারম’-এর মতো রচনার কথা। যেখানে পৌরাণিক গাঁথা হয়ে উঠেছে সমকালীন যন্ত্রণার প্রতিরূপ। ছত্রে ছত্রে সাজানো দর্শনের গভীরতা, শিকড়ের সন্ধান, ভাষার শরীর, দেহের চেতনা। আর এক তীব্র রাজনৈতিকতা, উচ্চারিত না হলেও শূন্যতায় গর্জে ওঠে। নিগূঢ় চেতনার থিয়ামও কি শেষ দশকে কোথাও হারিয়ে গেলেন ? কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার–এর যে ক্যানভাস একসময় মাটি, মানুষ আর মননের সুরে আঁকা ছিল, সেখানে কি এখন কেবল আলো, শব্দ আর ডিজাইনের চমক ? শেষদিককার ‘উরুভঙ্গম’ বা ‘ম্যাকবেথ’ প্রযোজনাগুলি যেমনই কুশল হোক, দর্শকদের মন ধরে রাখতে পারছে না। মঞ্চে চরিত্র থাকে, শরীর থাকে, কিন্তু কণ্ঠস্বর যেন নেই। ভাষা যেন উচ্চারিত হলেও, তা বোবা হয়ে যায়। শব্দ নেই দাগে, সংলাপ নেই অর্থে। দায় কি শুধু থিয়ামের ? না, আরো গভীরে যেতে হয়। রাষ্ট্রের সংস্কৃতিনীতির কেন্দ্রীকরণ, রাষ্ট্রায়ত্ত উৎসব-সংস্কৃতির একচক্ষু দৃষ্টি, প্রান্তের কণ্ঠকে ভিজ্যুয়াল-প্যাকেজে পরিণত করার প্রবণতা—এ সবই মঞ্চ আর মানুষে গভীর দূরত্ব তৈরি করেছে। থাংতা, সংকীর্তন, চার লেইমারেনবি, সব কিছু দর্শনযোগ্য পণ্য হয়ে গেছে। প্রান্তিক উচ্চারণ গিয়েছে নিঃশব্দে নির্বাসনে।
এ কথা ভুললে চলবে না যে রতন থিয়াম নিজেই ছিলেন প্রান্ত থেকে উঠে আসা এক কণ্ঠ। মণিপুরের যন্ত্রণাকে, আদিবাসী সংস্কৃতির অন্তরীণের শক্তিকে, লোকসংগীত ও দার্শনিক পাঠে শব্দ জারিত করে, তিনি তৈরি করেছিলেন এক অন্তর্লীন থিয়েটার, ‘রুট থিয়েটার’। থিয়াম মঞ্চকে বলতেন ‘উপাসনার স্থান’। সেই উপাসনায় আজ অনেকেই গড়িমসি করে। অথচ যৌথতার যে পাঠ দিয়েছেন তিনি, ত্যাগের পাঠ দিয়েছিলেন, প্রান্তজনের বেবাক সত্য এনেছিলেন সভ্যতার আলোকমঞ্চে, তা আজও, আজও অবিনশ্বর, মেধাবি প্রজ্ঞা। আজকের দিনটি তাই দ্বৈতবোধে পূর্ণ। একদিকে রতন থিয়ামের প্রয়াণে ভারতীয় নাট্যক্ষেত্রে গভীর শূন্যতা তৈরি হল। অন্যদিকে, সেই মৃত্যুই আবার আমাদের বাধ্য করছে ভাবতে—কে এই থিয়াম? তিনি কাদের ভাষা মঞ্চে এনেছিলেন? আজ সে ভাষা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে?
ভারতীয় থিয়েটারে আধুনিকতার মোড়কে তিনি মেলে ধরেছেন প্রাচ্য ঐতিহ্যের গভীরতম সুর। মণিপুরের ঐতিহ্য, লোকসংস্কৃতি, আধ্যাত্মবাদ, দার্শনিক প্রজ্ঞা এবং দৃশ্যগত কবিতার সম্মিলনে রতন নির্মাণ করেছিলেন এমন এক নাট্যভাষা, যা শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বে থিয়েটারকে নতুনভাবে চিনতে শেখায়। ১৯৭০-এর দশকে যখন ভারতীয় থিয়েটার নতুন ভাষা ও কাঠামোর সন্ধানে , তখন রতন থিয়াম তার ‘থিয়েটার অফ রুটস’ দর্শনের মাধ্যমে মঞ্চে নিয়ে এলেন মণিপুরের মার্শাল আর্ট ‘থাং-তা’, সংগীত, লোকনৃত্য ও পৌরাণিক বয়ান। বাদল সরকার, হাবিব তানভীর, কে.এন. পানিক্কর, শাঁওলি মিত্রের মতো নাট্যচিন্তকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রতন থিয়ামও থিয়েটারের জন্য নির্মাণ করেন এক বিকল্প ভাবনা ও অনুশীলনের পথ। তাঁর থিয়েটারে লোকজ মিথ, অন্তর্মুখী দর্শন ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ একই সূত্রে গ্রথিত। যুদ্ধ, সহিংসতা, বিচ্ছিন্নতা, মানবিকতা এবং আত্মানুসন্ধানের সংকেত তার নাট্যচরিত্রদের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে প্রবাহিত হয়। ১৯৭৬ সালে ইম্ফলে গড়ে তোলেন ‘কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার’। সেটি শুধু একটি থিয়েটার দল ছিল না, বরং ছিল মণিপুরের মাটি ও মানুষকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে ওঠা এক নাট্যগ্রাম। যেখানে পেশাদার থিয়েটারকর্মীদের বেঁচে থাকার জন্য তৈরি করা হয় উৎপাদনমুখী এক জীবনব্যবস্থা: মাছচাষ, শস্যচাষ, তাঁত, কুটির শিল্প; যার সবটাই যুক্ত ছিল থিয়েটার ও জীবনের টিকে থাকার লড়াইয়ের সঙ্গে। এ ধারণা পরে ভারতের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমেও কল্লোল ভট্টাচার্য ও উল মুখোপাধ্যায় গড়ে তোলেন অনুরূপ নাট্যগ্রাম।
থিয়ামের ‘মহাভারত ত্রয়ী’—‘উরুভঙ্গম’ (১৯৮১), ‘চক্রব্যূহ’ (১৯৮৪), ও ‘কর্ণভারম’ (১৯৮৯)—ছিল পুরাণকে নতুন চোখে দেখার প্রয়াস। অভিমন্যু, দুর্যোধন, কর্ণের মতো তথাকথিত ‘প্রান্তিক’ চরিত্রদের কেন্দ্রে রেখে তিনি তৈরি করেন নতুন পৌরাণিক পাঠ: যেখানে রাজনীতি, সহিংসতা ও মানবিকতা এক গভীর অস্তিত্ববাদী প্রশ্নে পরিণত হয়। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় একে বলেছেন, ‘অ-নায়কদের নায়ক করে তোলার মাধ্যমে থিয়াম মূলধারার পৌরাণিক নির্মাণকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিলেন।’ রতনের থিয়েটার ‘সাইকো-ফিজিক্যাল থিয়েটার’ নামেও পরিচিত, যেখানে শরীর ও চেতনার যোগসূত্রের মাধ্যমে নাট্যশিল্পী হয়ে ওঠে এক ধ্যানমগ্ন অনুসন্ধানকারী। তাঁর সব প্রযোজনার মধ্যে নাটক, সংগীত, মণিপুরি নৃত্য, থাং-তা মার্শাল আর্ট—সবকিছুর সমন্বয়ে রতনের থিয়েটার হয়ে ওঠে এক কাব্যিক জাগরণ। তাঁর মত ছিল, ‘নাটক করতে গেলে স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়… এখানে কোনো স্টার ইমেজ নেই, পপুলারিটি নেই, কোনো ইন্ডাস্ট্রি নেই… এটা একটা নান্দনিক অনুসন্ধান।’ তিনি সভ্যতার কৃত্রিম মুখোশকে সরিয়ে ‘আদিম সত্য’ ও ‘শিকড়ের ভাষা’তে নাট্য নির্মাণে আস্থা রেখেছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—‘সভ্যতা বলতে যন্ত্র নয়, বরং শিকড় ও চেতনার কাছে ফেরা। আদিবাসী সংস্কৃতিকে জানার মধ্যেই আমাদের পরিত্রাণ।’
এমন এক বহুমাত্রিক শিল্পী থিয়াম কবিতা চর্চাও করেছেন। মণিপুরি ভাষায় লেখা তাঁর ২ টি কাব্যগ্রন্থ ‘তালাপামেল নাহাকসু’ ও ‘সনাগী থম্বাল’ থেকে নির্বাচিত কবিতাগুলি বাংলায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় উঠে আসে যুদ্ধ, সহিংসতা, আদিবাসী জীবনের টানাপোড়েন ও অস্তিত্ববাদী প্রশ্ন। তাঁর কাজ শুধু ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ নানা দেশে মঞ্চস্থ হয়েছে তাঁর প্রযোজনা। তিনি ছিলেন জাতীয় নাট্যবিদ্যালয়ের পরিচালক (১৯৮৭–৮৮) ও পরে চেয়ারম্যান (২০১৩–২০১৭)। তাঁর শিষ্যরা আজ ভারতের বিভিন্ন নাট্যভূমিতে থিয়েটারের গুরুত্বপূর্ণ মুখ। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৭), পদ্মশ্রী (১৯৮৯), কালিদাস সম্মান (২০০৫), সঙ্গীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ (২০১২) এবং ফ্রান্সের লা গ্র্যান্ডে মেডাইল (১৯৯৭) সহ বহু আন্তর্জাতিক সম্মান। গত বুধবার ৭৭ বছর বয়সে থিয়াম প্রয়াত হন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায়। তাঁর প্রয়াণে শুধু মণিপুর বা ভারতের নয়, গোটা এশিয়ার নাট্যজগত হারালো প্রান্তিক আলোকবর্তিকাকে।
প্রত্যেক শিল্পীই সময়ের সন্তান। রাষ্ট্র তাঁকে ব্যবহার করে, উৎসব তাঁকে সাজিয়ে রাখে, দর্শক কখনও তাঁকে স্মরণ করে, কখনো বা নির্দ্বিধায় ত্যাগ করে। কিন্তু শিল্পীর মৃত্যুর পরও থেকে যায় তাঁর চেতনা আর কাজের সংলাপ। প্রশ্ন করে। থিয়ামের প্রস্থানে দুঃখ নয়, এক রাজনৈতিক বোধও ফিরে আসে—প্রান্তের কণ্ঠ কীভাবে কেন্দ্রীয় দর্শনীয়তায় পরিণত হয়, কীভাবে হারিয়ে যায়! আমরা থিয়ামের প্রয়াণে শোক জানাই, কিন্তু শুধু তাই নয়। আমরা তাঁর ভাষাকে, নাট্যদর্শনকে আবার খুঁজে নেওয়ার দায়ও স্বীকার করি। ‘গুডবাই থিয়েটার’ নয়, বরং ‘পুনর্পাঠ থিয়েটার’। রতন থিয়াম, চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর নাট্যভাষা, মঞ্চের অন্তঃক্ষরণ, সেই ‘সহজ’ দর্শনের জটিল আবেদন—তা থাকবে আমাদের মধ্যে, অনুরণনের মতো। এই অনুরণনই হোক শ্রদ্ধাঞ্জলি।
❤ Support Us








