- পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- মে ২২, ২০২২
স্বযুগের শাশ্বত পাঠক
এলবার্ট হলে প্রফুল্লচন্দ্রের সভাপতিত্বে সম্বর্ধনায় সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, 'আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে'।

৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টে নজরুল তখন সৈনিক
কাজী নজরুল ইসলামের স্বল্পস্থায়ী লেখনকাল এবং তার সমান্তরালে চলা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনার ঘনঘটা এক বিরল সমাপতন। ঠিক সেই সময়খণ্ডে আপাত শান্তির সহজ গতি হারিয়ে ক্রমশ অস্বাভাবিক বাঁক নিতে থাকে সময়। এইসব বদল ঘটে কোথাও ক্ষমতার বেলাগাম দুরাশা, পুঁজির নতুন বিন্যাস খোঁজার ব্যগ্রতা আর তার ফলে অন্যান্য শক্তির কেন্দ্রে সামাল দেবার বাধ্যবাধকতায়। সব মিলিয়ে আশ্চর্য এক মহাঅস্থিরতা পৃথিবী ছেয়ে ঘন হয়ে আসে। ইংরেজশাসিত ভারতের দশা আরও অসহায়, তাকে বাইরে নানা ভাবে অশান্ত ঘূর্ণিতে জড়িয়ে পড়তে হয়, আবার ঘরে শাসকের আশ্বাস ও প্রত্যাখ্যানের আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে হোঁচট খেতে হয়। অগ্নিগর্ভ সেই সময়ের সারণিতে নজরুলের সৃজন ও স্বাতন্ত্র্য যে সরণরেখা বেয়ে চলেছে, সেখানেই তাঁর আসল পরিচয় পাওয়া যেতে পারে।
কেমন জীবন হতো নজরুল ওরফে দুখু মিয়ার? বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া ব্লকের চুরুলিয়া গাঁয়ের স্থানীয় মক্তবে পড়ার মাঝে মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেছিলেন, হয়তো পরে বাবার পথে ইমাম হতেন। বাবা অকালে গত হওয়ায় মক্তবে পড়ানো শুরু করেন নয় বছর বয়সে। সাথে অন্যান্য কাজ। কিন্তু পিতৃবিয়োগ তাঁকে সে কাজে আর টেনে রাখতে পারে না। অভাবের সাথে পাওয়া স্বাধীনতার সুযোগে রাঢ় অঞ্চলের ভ্রাম্যমাণ গীতপ্রধান নাট্যদল লেটো-য় যোগ দেন। ইসলামীয় মৌলিক আচার সম্পর্কে জানার পরে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত খুব বড়ো এক পদক্ষেপ বলা যায়। নাটকের জন্য গান ও কবিতা লেখার মাধ্যমেই তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু। এই প্রেক্ষিতেই বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যের সাথে পুরাণ পড়া চালু হয়। এই ১৯০৯-১০ সালে মিন্টো মর্লি সংস্কারের মাধ্যমে ভারতীয় বিত্তবান শ্রেণি প্রশাসনে অতি ধীরে যুক্ত হতে শুরু করে। তার বছর চারেক আগের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও স্বদেশি কাজকর্ম ছিল এর পটভূমি। প্রতিবাদ ও বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধের মাঝে এই শাসনপ্রবাহে অংশ নেওয়া নতুন পরিসর তৈরি করে, যার ফলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিবেশ জেগে উঠতে থাকে। অন্য দিকে বঞ্চিত নিচুতলার মানুষ আরও বেশি করে বৈষম্য ও অত্যাচারের সামনে পড়ে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভীতি তৈরি করে, তার ফলে উগ্রতা দেখা দেয়, যা ক্রমে পরে চরমপন্থার জন্ম দেবে।
লেটোর দলে গান লেখার সূত্রে এই সময়ে সমসাময়িক নানা সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ছোঁয়া পেতে থাকেন নজরুল। সেখানে তাদের অভিনীত পালায় চাষার সঙের সাথে মাইকেল মধুসূদনের বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধও থাকে। অর্থাৎ নজরুল অতি দ্রুত নিজের গণ্ডি ছাড়িয়ে চলতে থাকেন। নানা দিকে নজর যায় সাধারণ মানুষের সাথে নিয়মিত মেলামেশার সুযোগেও। ১৯১০ সালে আরেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফের পড়াশোনা শুরু করেন পরপর দুই স্কুলে। তাঁর জীবন নতুন খাতে বইতে থাকে। বিদ্যার সাথে সাহিত্যচর্চায় দিকনির্দেশ পেতে থাকেন। এই পর্বে্ শিক্ষক হিসেবে অনেকের মাঝে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের ভালোবাসা ও পরামর্শ কাজে লাগে।
এর পরে তাঁকে অভাবের জন্য সব ছেড়ে কঠিন কর্মজীবনে ফিরতে হয়, সেখানে বেছে নেওয়ার উপায় ছিল না। রোজগারের চেষ্টায় অন্য কবিদলে যাওয়া, খানসামার চাকরি বা চা-রুটির দোকানে কাজ আরেক অভিজ্ঞতার জগৎ মেলে দেয় সামনে। এই নতুন দলে নতুন করে ঘুরে এবং পরে কায়িক শ্রমের অভিজ্ঞতায় তৎকালীন ভারতের পরাধীনতার চেহারা আরও বেশি স্পষ্ট টের পান তিনি। এই সময়ে বঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আনুষঙ্গিক কারণে কলকাতা থেকে রাজধানী সরিয়ে দিল্লিতে নেওয়া হয়। পূর্বাঞ্চলের অর্থনৈতিক সমীকরণ নীরবে বদলে দিতে থাকে ইংরেজ। দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ’র সাথে নজরুলের পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তাঁর প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। একেবারে আলাদা পরিবেশে তৃতীয় দফার এই শিক্ষাও কিন্তু শেষ নয়, বছর ঘুরতেই আবার রানিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই চার দফার শিক্ষার আশ্চর্য দোলাচলে প্রথাগত যোগ্যতার শংসাপত্র না জুটলেও জীবনের যে মস্ত বড় পাঠ মিলল, তা তাঁর পরবর্তী সময়ের পরিক্রমাকে চিহ্ণিত করে দেয়।

১৯১৬, কৈশোরের নজরুল। বয়স মাত্র ১৭, মাধ্যমিকের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে
আঁকাবাঁকা চলার পথে এবার সবচেয়ে বড় ঢেউ এসে লাগে। সৈনিকের জীবন তাঁকে বিশ্ববীক্ষার স্রোতে টেনে নেয়। তত দিনে তিন বছর ধরে চলা প্রথম মহাযুদ্ধ বিপন্ন করেছে পৃথিবীকে। জার্মানির উন্মত্ত সাবমেরিন আক্রমণে আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে নামে। তুরস্ক অস্বীকার করে বার্লিন চুক্তি। ইংরেজ দখল করে বাগদাদ। এদিকে রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটে যায়। লক্ষণীয় যে অনিশ্চিত দিনযাপনের কোনো পর্যায়েই নজরুলের লেখা বন্ধ হয়নি। করাচিতে সেনাসূত্রে পাওয়া খবরে মহাযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি জেনে তিনি এমনভাবে গল্প এবং অন্যান্য লেখা লেখেন যে মনে হতে পারে যে মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপের অকুস্থল থেকে তা লেখা।
প্রথম মহাযুদ্ধের আগে প্রায় সারা মধ্যপ্রাচ্য বা আরব দেশগুলো ছিল অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের মধ্যে। তুরস্কের সুলতান ছিলেন ইসলামের শেষ খলিফা, অথচ এই তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে মেসোপটেমিয়ায় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাকে লড়তে হয়েছিল। জার্মানি ও তুরস্কের পরাজয়ের পর ১৯১৯ সালের ভার্সাই সন্ধি অনুসারে তুরস্ক সাম্রাজ্যের মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় অঞ্চল কেড়ে নেওয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন আরব দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশের উপনিবেশে হয়ে পড়ে। প্রথম মহাযুদ্ধে পৃথিবীর মানচিত্রে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের এই পরিবর্তন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামকে গভীরভাবে মর্মাহত করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্ভব তাঁকে গভীরভাবে উদ্দীপিত করেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বিশের দশক থেকে ভারত ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রাম শুরু হয়। অন্য দিকে প্রায় সমগ্র মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল। ঘটনাক্রমে মধ্যপ্রাচ্যের আরব ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ মুসলমান-অধ্যুষিত। নজরুলের বিশের দশকের বিভিন্ন রচনায় আন্তর্জাতিক বিশ্বের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি প্রতিফলিত হতে থাকে।
শুধু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত, যুদ্ধের পটভূমি, ভিন দেশের বিদ্রোহী নায়কের উল্লেখ নয়, নজরুলর ভাষা ও চিত্রকল্পও বদলে যেতে থাকে। কবি কুমুদরঞ্জনের দেখা লাজুক ছেলেটি করাচির রেজিমেন্টে পাঞ্জাবি মৌলবির কাছে ফার্সি ভাষা, সহসৈনিকদের কাছে বিদেশি বাজনা ও গান শিখে এবং হাফিজ পড়ে তখন অন্য মানুষ। বৃহত্তর জগতের স্বরূপ ও ক্ষমতার সংঘাতের সম্পর্কে জেনে এক সজাগ শিল্পী হয়ে উঠেছেন। শুরু হয় খাস কলকাতায় বাস করার সূত্রে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাথে সরাসরি পরিচয়। লক্ষ করার বিষয় হলো মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় লেখা শুরু করার পরে কেমন করে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর সৃজনের পরিসর। মুজফফর আহমদের সাহচর্য ও মোহিতলালের লিখিত প্রশংসা পরিচিতি দেওয়ার ফলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সাহিত্যিকমণ্ডলী তো বটেই, বিখ্যাত গজেনদার আড্ডা আর ভারতীয় আড্ডায় তাঁর প্রবেশ ঘটে। খুব অল্প সময়েই সাহিত্য ও সঙ্গীত জগতের দিকপালদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হতে থাকে।
পরের বছর, অর্থাৎ ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করার পর থেকে দুই প্রতিভার বন্ধন অটুট ছিল। এই পর্বে নজরুলের জীবন প্রায় রূপকথার মতো, সর্বত্র সমাদর পেয়ে যেমন উল্লেখযোগ্য চরিত্র হয়ে ওঠেন, তেমনই অজস্রধারায় সৃষ্টির অভিমুখ খুলে চলে। সাংবাদিকতা ও সভাসমিতি সরাসরি পু্ষ্টি যোগায় বাস্তব অভিজ্ঞতায়। তাঁর পালাগানের দলের অতীত অর্জন পরিণতি পেতে থাকে। একের পর এক শানিত লেখায় তার পরিচয় মেলে। আর এই সময় থেকেই নজরুল অনন্য হয়ে উঠতে থাকেন, কেবল কাজের জগতে নয়, ব্যক্তিগত জীবনের নানা সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রেও। এটা ঠিক যে নবযুগ পত্রিকায় “মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে” প্রবন্ধ লেখার জন্য পত্রিকার শাস্তি হয়, নজরুলের ওপরে নজরদারি চলে। কিন্তু সাধারণভাবে তাঁর অন্যান্য রাজনীতিঘেঁষা প্রবন্ধ ও সমাজ-সচেতন গল্প কবিতার জন্য তিনি শাসকের সন্দেহের তালিকায় ছিলেন। অন্যান্য অনেক কবি ও লেখকের মতো গা বাঁচিয়ে চলেন নি। তা ছাড়া তখন একাধিক বার কুমিল্লা গিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের নানা সভা ও শোভাযাত্রায় যোগ দিয়ে নিজের গান গেয়ে পুরোপুরি রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকা পালন করেন। হরতালেও নামেন। অথচ অন্ধ অনুগামীর মতো তিনি অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলনে আ্স্থাশীল ছিলেন না। ভারতে সশস্ত্র আন্দোলনের পথে ও তুরস্কে আতাতুর্কের নব্য তুর্কি বিদ্রোহে তাঁর বিশ্বাস ছিল। তবু বিরল বোধের পরিচয় দিয়ে এদেশে দুই সম্প্রদায়ের মিলিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে তখনকার পরিস্থিতিতে সমর্থন করেন। জনতার মাঝে থাকার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী ‘বিদ্রোহী’ এবং ‘ভাঙার গান’ প্রকাশিত হয়েই আলোড়ন তোলে। পরের দিকে এমন আরও কাজে তাঁর স্পষ্ট ও বাস্তবমুখী অংশগ্রহণ, লেখা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় তা বোঝা যাবে।
অন্য দিকে প্রকাশক আলী আকবর খানের ভাইঝির সাথে বিয়ের আখত-পর্বের পরে দৌলতপুরে ঘরজামাই থাকার শর্ত দেওয়ায় স্বাধীনচেতা নজরুল তৎক্ষণাৎ বিয়ের আসর ছেড়ে চলে আসেন। ক্রমশ কবি এক ঝড় হয়ে উঠতে থাকেন। মিলিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম স্তিমিত হয়ে এলে তিনি নিজে পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন, ধূমকেতু নামেই যার চরিত্রের পরিচয় মেলে। তাই অচিরে তা আদতে সশস্ত্র বিপ্লবীদের মুখপত্র হয়ে ওঠে। নবযুগ পত্রিকার অভিজ্ঞতা তাঁকে দমাতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী ধারণ করে একের পর এক সময়োপযোগী চিন্তা ধূমকেতুতে প্রকাশ পেতে থাকে এবং মাত্র তিন মাস পরেই বোঝা যায় তাঁর ভূমিকা শাসককে কতটা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশের জন্য ধূমকেতুর সংখ্যাটি ও তার পরেই ‘যুগবাণী’ প্রবন্ধের বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। কুমিল্লা থেকে কবিকে গ্রেফতার করে কলকাতায় আনা হয়। নিজের অনমনীয় দৃঢ়তা বজায় রেখে আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে যা বলেন, সেই ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ কেবল সাহিত্য নয়, তাঁর অনন্য অভিজ্ঞান হয়ে ওঠে। সচকিত শাসককে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিতেই হয়। গ্রাম থেকে ঘটনাচক্রে উঠে আসা কোনো স্বদেশি লেখক ও কবির এমন দ্রুত নজরবিন্দুতে চলে আসা কেবল রূপকথা নয়, তাঁর সঠিক অবস্থান ও সাহিত্যে যথাযথ অবদান রাখার প্রমাণ।
এই সময়কালে শুধু নজরুলের লেখার বিষয় নয়, তাঁর বেছে নেওয়া নানা নাম, যেমন ‘যুগবাণী’, ‘ধূমকেতু’, ‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিদ্রোহী’ এবং ‘ভাঙার গান’ বাংলা সাহিত্যের তৎকালীন সুরটিকে সজোরে নাড়া দেয়। এবং লক্ষণীয়, এই যে দাসত্বকে অস্বীকারের ঢেউ, তা তিনি টানা উত্তাল করে গেছেন সমস্ত শক্তি দিয়ে। কেউ আঁতকে উঠেছেন, অন্যরা অন্য রকম সমালোচনা করেছেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি নজরুলকে ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেন ও তাঁর কিছু বিস্মিত, ভক্ত কবিকে বোঝান যে ‘… যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য’। কারার ভেতর থেকে সহজ প্রাণের আনন্দে ভেসে আসে কৃতজ্ঞতার সুর: আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে! প্রখ্যাত প্রবীণ ও নবীন কবির এই আত্মিক যোগ পরাধীন দেশে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই রাজবন্দিদের প্রতি জেল অধ্যক্ষের অমার্জিত আচরণের বিরুদ্ধে নজরুলের অনশন সার্বিক অসন্তোষ তৈরি করে। শরৎচন্দ্রসহ সমস্ত সচেতন সাহিত্যিক ও কবি প্রতিবাদ জানালেও কারা কর্তৃপক্ষ সমস্যা সমাধানে আগ্রহ দেখাননি। অনশনের চল্লিশতম দিনে রবীন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে কর্তৃপক্ষ রাজবন্দিদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
প্রতি পদক্ষেপে এই ধরনের কার্যকরী কৌশল নেওয়া নজরুলের আরেক গুণ সামনে আনে। তাঁর নেতৃত্ব দেবার এই ক্ষমতা কংগ্রেসে গুরুত্ব পায় না। চৌরিচৌরার ঘটনার পরে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার গান্ধিজির গ্রেফতার ঠেকাতে না পারায় দল পেছনের পায়ে যায়। হতাশ নেতারা বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন। তাদের একাংশের সাথে সুভাষচন্দ্রও নজরুলের লেখা ও কার্যকলাপের অনুরাগী হয়ে ওঠেন। তা ছাড়া মুক্তির পরে নজরুল ব্যক্তি হিসেবেও নায়ক হয়ে উঠে জনমনে সাড়া ফেলে দেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, মেদিনীপুর শাখা তাদের একাদশতম বার্ষিক অধিবেশনে জনপ্রিয় কবিকে সম্বর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই খবর জানার পরে দ্রুত আরও কয়েকটি সংস্থা মেদিনীপুরে তাঁকে সম্মান জানান। মেদিনীপুর কলেজে শুধুমাত্র মহিলারা কবিকে প্রকাশ্যে সম্বর্ধনা জানান। এরপরে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক আসতে থাকে।
বন্দিদশার শেষ দিকে আরেক উল্লেখযোগ্য কীর্তি তাঁর প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক কবিতার প্রথম সংকলন ‘দোলনচাঁপা’র প্রকাশ। প্রতিবাদ বিদ্রোহ ছাড়াও রোমান্টিক চেতনার পরিচয় তাঁকে বহুমাত্রিক সম্পূর্ণতা দিতে থাকে। বিয়ের ক্ষেত্রেও উদাহরণ হলেন তিনি। ব্রাহ্মসমাজের মেয়ে প্রমীলার সঙ্গে বিয়েতে শাশুড়ি গিরিবালা ছাড়া পরিবারের অন্য কারও সমর্থন ছিল না। আ্শ্চর্য এই যে সেই পর্যায়েও তাঁর লেখায় আগুন ঝরানো সাময়িকভাবেও স্তিমিত হয়নি। ফলে ‘বিষের বাঁশী’ ও ‘ভাঙ্গার গান’ দুটি বই ই বাজেয়াপ্ত হয়।
এই সময়ের পটভূমি নজরুল সঠিকভাবে বুঝতে পারেন। স্বাদেশিকতার সাথে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে জোয়ার ওঠে। রাজনীতির ভাষারও স্থানীয়করণ হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ ও প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রভাবে দেশপ্রেম জোরালো হয়, যা কিছু পত্রিকায় গুরুত্ব পেতে থাকে। নতুন মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হতে থাকে। তার ফলে কেবল রবীন্দ্র-পরবর্তী সাহিত্যের ধারাই নয়, উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের প্রভাব স্তিমিত হয়ে আধুনিক যে বাংলা আমরা আজ দেখি, তার সূচনা হয়। এই বিশের দশকে মেয়েদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এগিয়ে আসার ফলে চরিত্রের পবিত্রতা তথা সতীত্বের সংজ্ঞা বদলাতে থাকে। নজরুলের লেখায় এই পরিবর্তনের চিহ্ন ধরা পড়ে। বিয়ের পরে তিনি যখন দুই সম্প্রদায়ের কাছেই সমালোচিত হন, তখন আরও জোরালোভাবে সামাজিক-ধর্মীয় সংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লিখতে থাকেন। এই পর্ব সাময়িক ধাক্কা খায় ১৯২৫ এর ১৬ জুনে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে। তাঁর কলমে চলতে থাকে অসহায় জনতার পক্ষে সওয়াল। ‘দারিদ্র’ এবং ‘বারাঙ্গনা’ চমকে দেয় পাঠককে। এই প্রথম কেউ বারাঙ্গনাকে মা বলে ডাকেন।
১৯২৫-এ এইচ এম ভি নজরুলের গানের রেকর্ড করে হরেন্দ্রনাথ দত্তের কণ্ঠে আর তিন বছর পরে তাদের সাথে কবি নিজে যুক্ত হলে তাঁর আরেক জগৎ খুলে যায়। এক দিকে সভা-সমিতিতে স্বদেশি গান, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগদান, লাঙ্গল নামে প্রথম বাংলা শ্রেণিসচেতন পত্রিকা প্রকাশ করে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করা, অন্য দিকে কৃষ্ণনগরে থাকাকালীন বাংলা গানে নতুন ধারা হিসেবে গজল ও গণসঙ্গীত শুরু করা চলে। তা আরও ঝোড়ো চেহারা নেয় সাপ্তাহিক গণবাণীর জন্য কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ও রেড ফ্ল্যাগ অনুসরণে ‘জাগো অনশন বন্দী’ ও ‘রক্তপতাকার গান’ লেখার মাধ্যমে। অভাব, রোগ, শোক তাঁকে কোনো ভাবে দমাতে পারেনি। শনিবারের চিঠি, ইসলাম দর্শন বা মোসলেম দর্শন পত্রিকার সমালোচনাও নয়। টানা স্বরলিপি লিখে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশে আরেক প্রবাহ তৈরি করে চলেন।
কবিজীবনে ঢাকা শহরের অবদান কম নয়। পরপর তিনবার গিয়ে সেখানে যেমন প্রভাব ফেলেন, তেমনি নিজেও উজ্জীবিত হন। তারপরই ১৯২৯- এ বেতার ও মঞ্চে যোগ দেন। গ্রামোফোন সংস্থার সঙ্গীতকার ও প্রশিক্ষক হবার ক্ষেত্রেও তিনি পিছিয়ে আসেননি। যে দিকে পা বাড়িয়েছেন, সাড়া জাগিয়েছেন। মনোমোহন থিয়েটারে শচীন্দ্রনাথ তাঁর রক্তকমল নাটক নজরুলকে উৎসর্গ করেন। নজরুলের আটটি গান নিয়ে মন্মথ রায়ের কারাগার নাটক টানা ১৮ অভিনয়ের পরে নিষিদ্ধ হয়। এলবার্ট হলে প্রফুল্লচন্দ্রের সভাপতিত্বে সম্বর্ধনায় সুভাষচন্দ্র বলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে’।
আবার আঘাত হানে ছেলে বুলবুলের মৃত্যু। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের সঙ্গে প্রকাশ পায় প্রলয়শিখা, যার জন্য মামলা ও পরোয়ানা জারি হয়। চন্দ্রবিন্দু হয় বাজেয়াপ্ত। নাট্যনিকেতনে অভিনীত আলেয়া নাটকে ২৮টি এবং মন্মথ রায়ের সাবিত্রীর জন্য ১৩টি গান লেখেন অদম্য নজরুল। আরেক জোয়ার আসে তাঁর চলচ্চিত্রে যোগ দেওয়ার ফলে। সঙ্গীত রচনা, অভিনয়, সুরারোপ থেকে পরিচালনায় ব্যাপকভাবে অংশ নিয়ে অবাক করেন সকলকে। নতুন এই মাধ্যমে যোগ দিতে যখন অনেকে ভীত ছিলেন, নজরুল সেখানেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
এভাবে উত্তাল সময়ের নিরিখে নজরুলের জীবনের মাইলফলক দেখার উদ্দেশ্য যে তিনি কেমনভাবে শুরু করে কোথায় পৌঁছে ছিলেন তা বোঝা নয়, প্রতিটি সুযোগ তিনি কেমন অসম সাহস ও প্রতিভায় কাজে লাগাতে পেরেছিলেন সে কথা স্মরণ করা। বাংলা সাহিত্য জগতে আর কেউ এমন আগেপিছে না ভেবে সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন নি। তীব্র অসুস্থতা ও জেলের অত্যাচার সয়ে তাই হয়ত মূক হয়ে যেতে হয় তাঁকে। ভারতীয় উপমহাদেশে তখন এক বিরল বিস্ফোরণের কাল। নানা দিক থেকে ধৈর্যের সীমা পার হয়ে অস্থিরতার নানা চিহ্ণ ফুটে উঠছে। অনিশ্চয়তা আর অত্যাচার উগ্রতার দিকে জনমতকে ঠেলে দিয়েছে। তিন বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তত দিনে নড়বড়ে করে দিয়েছে শক্তির ভারসাম্য। নীতি আদর্শ বিশ্বাস হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ছে। ব্যাটল অব মিডওয়ে এবং স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধ পাল্টে দিয়েছে নির্মমতার সংজ্ঞা। অসংখ্য মৃত্যুর চাপে নুইয়ে পড়েছে সভ্যতা। কান্না শোনার কান নেই কোথাও। না চাইতেও ভারতীয় সেনাকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং সাতাশি হাজার মারাও গেছে। মিত্র বাহিনীর এশিয়া-চৈনিক রণাঙ্গনের কম্যাণ্ডার হিসেবে চিয়াং কাই শেক ভারতে এসে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের সাথে আলোচনা করছেন। কারণ যে কোনও সময়ে জাপান বার্মা আক্রমণ করতে পারে। হলোও তাই। রেঙ্গুন আক্রান্ত হল। ভারতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে ক্রিপস্ কমিশন ছুটে এল।
ওয়ার্ধার বৈঠকে কার্যকরী সমিতি ফের ব্রিটিশের ভারত ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত পাকা করে। কমিশনের শর্ত প্রত্যাখ্যাত হয়। তারপরেই ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয় ব্যাপক বিস্তার নিয়ে। আইন অমান্য শুরু হতেই গান্ধীজি গ্রেপ্তার। বহু নাগরিক মৃত ও বছর শেষ হবার আগেই অন্তত ষাট হাজার কারাবন্দি। ।১৯৪২ সাল সেটা। স্নায়ুর অসুখে স্তব্ধ হয়ে যান নজরুল। কিন্তু সেই সময়ে তাঁর সৃষ্টি ও অবদানকে কাজে লাগানো হয় কি? যে মানুষটি সারা জীবন কথায় কাজে বিপদ মাথায় নিয়ে, সময়ের সঠিক পাঠ নিয়ে, সমস্ত যুগচিহ্নকে প্রকাশ করেন, তাঁকে ক্রমশ আড়ালে রেখে দেওয়া হয়। আরও বিস্ময়ের এই যে নজরুল গবেষক বলছেন, পঞ্চাশের দশক থেকে তাঁর চর্চা কমিয়ে দেওয়া হয়। যে প্রতিভাকে ডব্লু বি ইয়েটস্-এর সাথে তুলনা করা হয় মুসলিম জগতের সাহিত্যে উত্থানের জন্য, কামাল পাশা, কাশিম,আলি,উমর ও মহম্মদের চিত্রকল্প ও প্রতীকী সৃজনের জন্য, যাঁর বীরত্বময় ভাষা মিলটন ও টেনিসনের কথা মনে পড়ায়, তাঁকে কাজে লাগাতে পারিনি আমরা। যাঁরা যুগের আগুনে পুড়িয়েছেন নিজেদের, সরাসরি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে লড়াই করেছেন, তাঁদের অনেককেই এভাবে ঠেলে দেওয়া হয় অন্তরালে।
♦–♦♦–♦♦–♦
❤ Support Us