- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- অক্টোবর ২২, ২০২৩
মুজতবা আলীর গল্প-গাথা
অভ্যাসবসত আকাশবাণীতে প্রভাতী অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা এবং রূপায়নের দীনতা দেখে মনে পড়ল আজ থেকে অর্ধশত বর্ষ পূর্বে এ অঞ্চলের কথাকার সৈয়দ মুজতবা আলী আসামের দক্ষিণাঞ্চলের জন্য একটি নিজস্ব বেতার কেন্দ্রের সুপারিশ করেছিলেন। সম্প্রতি সরকারি এ প্রচার মাধ্যমে আঞ্চলিক ভাষার অনুষ্ঠানের প্রতি অবহেলার মুহূর্তে এ ব্যাক্তির ‘হতভাগ্য কাছাড়’ নিবন্ধের কথাগুলো নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল। তিনি বলেছিলেন, ‘শিলচরে (এই) বেতার কেন্দ্র নির্মাণের জন্য তীব্র দাবি জানাতে হয়’।.. আরও বলেছেন ‘আসাম সরকার সাহায্য করবেন না। বাধা দিলে আশ্চর্য হব না, দোষও দেব না’। বর্তমানে এ বেতার কেন্দ্রের ক্ষয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া দেখে মনে হয় মুজতবা আলীর স্বপ্নকে আমরা নিজেরাই নিজেদের অবহেলায় ধ্বংস করে দিচ্ছি। এ রকম অবস্থায় আবার দেখলাম এ হেন ব্যক্তির জন্মদিন পালন করতে গিয়ে কতিপয় বিদ্বজ্জন (স্থানীয় এবং আগন্তুক) এই হতভাগ্য ভূমির ভরসার স্থল একটি প্রাচীন সারস্বত সংস্থার প্রতি নির্মম কটুক্তি করে আত্মপ্রসাদও লাভ করছেন। সুরমা উপত্যকার সন্তান, রবীন্দ্র সান্নিধ্যধন্য এ ব্যক্তি কাছাড়ের (বরাক উপত্যকার) বাঙালিদের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা বলতে গিয়ে সমকালীন রাজ্যস্তরের নেতাদের একচোখা নীতির কিছু সমালোচনা, ভাষা আন্দোলনের কথা এবং বাঙালিদের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা বঞ্চনার কথা বললেও এতে কোনও অশিষ্ট ইঙ্গিত পর্যন্ত ছিল না। তাই তো বঙ্গসাহিত্যের একটি ভবনের গায়ে বিশাল প্রতিকৃতি দেখে বাঙালি তো বটেই, অসমিয়া সহ ভিন্নভাষী বিদ্বজ্জন সবাইকেই শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে দেখা যায়। ফি বছর তাঁর জন্মদিনে বরাকবাসী জেলায় জেলায় তাঁকে আন্তরিকভাবে স্মরণও করেন। সম্প্রতি বাঙালি জীবনে, বিশেষ করে আসামে তাঁর চিন্তাচর্চার প্রাসঙ্গিকতা অনুভব করে মনে হল তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা প্রয়োজন। প্রয়োজন আরো একটি কারণেও বটে, তা নিম্নে বর্ণত হবে অবশ্যই।
কিছুদিন আগে সামাজিক মাধ্যমে (সামাজিক তো বটেই, আলী সাহেব বেঁচে থাকলে এ নিয়ে একটা মস্করা করতেন নিশ্চয়ই) মুজতবা আলীকে নিয়ে কিছু কেচ্ছাকাহিনি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেককেই এ সব গেলানো হয়। এরকম একটি কাহিনি হল আলী সাহেবের সরস্বতী পূজা। মাঘমাসের শ্রীপঞ্চমির এক সকালে নদীতীরে (সুরমা, বরাক না গঙ্গা তা অবশ্য স্পষ্ট নয়) জনৈকা প্রৌঢ়া বিচরণশীল এ আলী সাহেবকে বেমক্কা পূজারি ব্রাহ্মণ ভেবে বগলদাবা করে এনে বাড়ির বাচ্চাদের পূজাটি সাঙ্গ করে দিতে আসনে বসিয়ে দিলেন। অবিশ্বাস্য এ চিত্রনাট্যে একটি সম্ভাবনার অবশ্য বাস্তব ভিত্তি আছে, কিন্তু সেটি তো হালের প্রেক্ষিত—সরস্বতী পূজার দিনটিতে পূজারি ব্রাহ্মণ বাড়ন্ত হয়ে যায়, তৎকালীন সময়ে কি এরকম হত ? ধরে নিলাম তাই সই। আসল কথাটি হল পূজার আসনে বসে তিনি খুব নিখুঁত সংস্কৃত উচ্চারণে শাস্ত্রমতে সমস্ত ক্রিয়াকর্ম সাঙ্গ করে দিলেন। কেউ টেরই পেল না, ইনি যে সৈয়দ বংশীয় বিধর্মীর ব্যাটা। কেচ্ছাটি বাজারে খুব খেয়েছে। তা খাক্। এটা পড়ে অনেকে মুজতবা যে মুসলিম কূলে একজন মহৎ ব্যক্তি তা ভেবে যারপরনাই আহ্লাদিতও হলেন। (যেন এ না করতে পারলে আপনি আবার কীসের লিবার্যাল পণ্ডিত হে!) তবে ঘটনাটি নিশ্চিত ভাবে কবে, কোথায় হয়েছিল এ নিয়ে ভেবে কোনও কূল পাইনি।
এটা শেষ হতে না হতেই আরেক কেচ্ছা ছড়িয়ে দেওয়া হল। এবার স্থানটি নিয়ে যাওয়া হল পুরিতে। জগন্নাথ মন্দিরে বিধর্মী বলে নাকি তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আলী সাহেব কি তা-ও জানতেন না যে, খোদ মহাত্মা গান্ধিকে পর্যন্ত ওই মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি ? এ বার্তাটা যে তাঁর কানে পৌঁছোয়নি এটা অবিশ্বাস্য। এমন বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপিত কেচ্ছা এখানেও। এ সৈয়দের ব্যাটা (মুঘল-টুগল নয়তো!) সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ করতেই সবাই দরজা খুলে দিল।
এসব মিথ্যাচারের মধ্যে খুব ভালোমানুষী যে নেই তা অবশ্য বোঝা যায়। এখানে কি মনীষী-অধিগ্রহণ- প্রকল্পের প্রচ্ছায়া নেই? তওবা, তওবা!
তবে তৃতীয় আরেকটি কেচ্ছাও আছে। এ কেচ্ছার মধ্যে কোনও পরিকল্পিত শয়তানী যে দেখতে পায় তার মুখে ছাই। স্থানটি কোনও একটি বোর্ডারে— করিমগঞ্জের সুতারকান্দি বা জকিগঞ্জ বোর্ডার বলেও সনাক্ত করা যায়। যিনি প্রতিবেদনটি খাড়া করেছেন, কথাসাহিত্যে ‘ম্যাজিক রিয়্যালিটি’র বিষয়টি তাঁর বিলক্ষণ জানা আছে তাও বোঝা গেল।
গল্পটি এরকম— আলী সাহেব স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে কিছুদিন পূর্ববঙ্গে (পড়ুন পাকিস্তানে) বসবাস করার মানসে বোর্ডার পেরিয়ে ওপারে যাবেন। সীমান্তরক্ষীরা (সবাই তো আর মুখ্যুসুখ্যু নন) এ বিশিষ্ট লেখককে বিলক্ষণ চিনতেন, তাই এরা পড়লেন বিড়ম্বনায়। লেখকের ঝুলিতে আবিষ্কৃত হল বড়সড় একটি বিলিতির বোতল। ওদিকে খাঁটি ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানে যে আবগারি জিনিস সর্বৈব ভাবে হারাম। চিজটি পাকিস্তানে ঢুকতে দিলে রাম ফ্যাসাদ। এটাকেই বলে ধর্মসঙ্কট।
মুজতবা আলী অবশ্য অবুঝ নন, মুসকিল আসান তার হাতেই ছিল। বোতলটি নিয়ে সামান্য আড়ালে গিয়ে ভিতরের তরল পদার্থটি গলায় ঢেলে ফিরে এলেন। এবার তো দ্রব্যটির পাকভূমিতে প্রবেশে আর বাধা নেই।
কাহিনিটি এখানেই শেষ হলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু তা হবার নয়, কাহিনীকার যে আরও এক কাঠি সরেস। তিনি গল্পটিকে আরও একটু টেনে নিলেন পাকিস্তানের মাটিতে। নৌকা থেকে নেমে কিঞ্চিৎ কম্পিত পদক্ষেপে আলীসাহেব অপেক্ষমান বিবিসাহেবার (ইনি ছিলেন পাকিস্তানের জাঁদরেল ইশকুল ইন্সপেক্ট্রেস) অভিবাদন গ্রহণ করতে এগিয়ে গেলেই ঘটল বিপত্তি: ‘ছিঃ ছিঃ, কী কাণ্ড করে এসেছ ! গাড়িতে বসে আছে ছেলেরা। ওঁরা কী শিখবে তোমাকে দেখে’?
মুজতবা আলী অকুতভয়: ‘আহা রাগছো কেন ম্যাডাম ? এরা শুধু আমার পানদোষই শিখবে ? এদের পিতৃদেব যে ডজনখানেক ভাষা আয়ত্ব করে বসে আছেন এটা শিখবে না’? মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
এটা আমাদের পরম বিষ্ময় আমাদের এ শ্রীহট্ট-কাছাড় ভূমিতে ভগবান (না আল্লা) কী করে এ হেন ব্যক্তির জন্মগ্রহণ সম্ভব করলেন ? তাঁর শৈশবের লীলাভূমি (সিলেট) নানাবিধ অগৌরবের সাক্ষী হওয়া সত্বেও, তিনি উদারতার অভাবণীয় উদাহরণ স্থাপন করেছেন, এ নিয়ে তাবৎ সুরমাভ্যালি গর্বিত। অবশ্য দুর্জনেরা বলে তিনি অবশ্যই ভালো মানুষ, কিন্তু তাঁর ভাই বেরাদরেরা মনুষ্য পদবাচ্যই নয়, এরা ‘লাফ দিয়ে গাছেও ওঠে, ল্যাজ নাই কিন্তু…’ ইত্যাদিও অনেকে বলে। এরা প্রতিবেশি দেশবাসীকে কেবল বাস্তু থেকে উৎখাতই করেনি, নিজ বাসভূমেও এদের জিনা হারাম করে দিয়েছে। হায় হায় ! কে যে কার উপর দোষারোপ করে ! স্বাধীনতা-আন্দোলনে যে ওই মুঘল, সৈয়দ বংশদ্ভূতরাও যে তাদের হিন্দু বেরাদরের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছেন এ ইতিহাস ওরা বেমালুম উপেক্ষা করতে চাইছেন। মোদ্দা কথাটি হল, শুধু মুঘল পাঠানের উত্তরসুরিই নয়, বহু সংখ্যক হিন্দুও যে দেশটিকে দ্বিখণ্ডিত করতে সমান আগ্রহে মাঠে নেমেছিলেন নিজ নিজ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষে (বারান্তরে না হয় বলা যাবে), সিলেটকে (সঙ্গে পারলে কাছাড়কেও) আসাম থেকে কেটে ওপারে চালান করতে আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন এও তো ইতিহাস। যত দোষ…। একতরফা অপপ্রচারে এর অনেকটা ঢেকে দিলেও পুরো ভাজামাছটি ঢেকে দেবার মতো শাক এদের টুকরিতে নেই। অদ্যাবধি দেশভাগের জন্য এই মিঞা, বাঙ্গালগোষ্ঠীকে (ও হো! আলিপুর দুয়ার সীমান্ত পেরিয়ে গেলে তুমি বামুন-কায়েতের ব্যাটাও বাঙ্গালস্য ততধিক বাঙ্গাল) অকথ্য গালিগালাজ শুনতেই হচ্ছে। অবশ্য আজকাল জাত-ধর্ম তুলে গালাগালিতে কোনও রাখঢাকের বালাই নেই। মুসলমান মিঞাগোষ্ঠীকে সাফ করার আস্ফালনে তাবৎ নেতামন্ত্রীরও কোন সঙ্কোচের বিহ্বলতা নেই।
কী জানি বাবা, এই দোষারোপজনিত অপরাধ স্খালন করতেই বুঝি রাজ্যে কিছু ভুঁইফোড় সভা সমিতির মুজতবা পূজন। কথা হল, এ কট্টর বাঙালি (অখণ্ড বাঙালি চেতনায় বিশ্বাসী) মুজতবা আলী একবার দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘অ- হিন্দু মার্গে চলার সময় পরমহংসদেব কায়মনোবাক্যে সেই মার্গে বিশ্বাস করতেন,… তিনি ধুতিখানাকে লুঙ্গির মতো পরে আল্লা আল্লাও করেছিলেন।’ তওবা তওবা। তাই তো বলি কতিপয় বঙ্গসন্তান হঠাৎ চন্দনটন্দন ছিটিয়ে ভিন্ন কিসিমের এ মুজতবা ভজনায় কেন। ভয় হয় এরাও গায়ের চাদর (গাইঞ্চা)খানাকে গামোছা বানিয়ে গলায় চড়িয়ে আধ্যাত্মিক ভাবে উদ্বাহু হয়ে বাঙালিত্বকে পরব্রহ্মে বিলীন করার কোন মতলবে নেই তো? মুজতবার যাবনিক শব্দে ঠাসা বাংলা জবানও তো এদের বিলকুল না-পছন্দ, তাঁর প্রগাঢ় বাঙালিত্বও সঙ্গত কারণে অনেকেরই অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
যাই হোক, লক্ষণটি খারাপ নয় পুরোপুরি, চারিদিকে সাম্প্রদায়িকতার নিরন্তর অনুশীলনের মধ্যেও এটা বিলক্ষণ শুভলক্ষণ নিশ্চয়ই।
ইদানীং একটা বিলাপ শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশে নাকি বাংলাভাষাকে আর বাংলা বলে সনাক্ত করা যাচ্ছে না। এতে নাকি উর্দু শব্দের রাজত্ব। (যেন হিন্দুস্তানের বাংলাভাষায় কোনও বিজাতীয় অনুপ্রবেশ নেই। এই আসাম রাজ্যে বাংলা পাঠ্যপুস্তকেও কি পরিমান ভ্যাজাল ঢুকেছে তা দেখলে চক্ষু চড়কগাছ হবে )। এরা এসব জেনেও জানেন না, যে-শব্দ দেখে এ ধরনের বিলাপ, ওই যাবনিক ফার্সি, আরবি, তুরকি, হিন্দি (খাড়িবোলি) শব্দসমূহ যে বাংলা শব্দসম্ভারে কয়েক শতাব্দীর উত্তরাধিকার।
ভারতচন্দ্রের মঙ্গলকাব্য থেকে থেকে আলালের ঘরের দুলাল, হুতোমের নক্সা, রামপ্রসাদের পদাবলি— সর্বত্র এই যাবনিক স্পর্শদোষ ঘটেছে। কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্যারীচাঁদ মিত্র এমন-কি বিদ্যাসাগর মশাইও (মানুষটা নাস্তিক হলেও সংস্কৃতটা শিখিয়েছেন বাঙালিকে) ওই আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেছেন বিস্তর। শুচিবাইগ্রন্থ পণ্ডিতস্মন্যমনাদের জন্য মুজতবা আলীর ( ‘শহর্-ইয়ার’ উপন্যাসের চরিত্রের মাধ্যমে) একটি বাক্য আছে। উদ্ধার করা যাক্, আজ যদি প্যারীচাঁদ, কালীপ্রসন্ন, বিদ্যাসাগর কলকাতায় নেমে আড্ডা জমান তবে তাই শুনে আপনার হিন্দু ক্লাস ফ্রেন্ডরা (পড়ুন শুচিবাই গ্রন্থ সাহিত্যসেবীরা) ভিরমি খাবেন।’ (ব্র্যাকেটের শব্দগুলো এ অধমের)
তবে এসব পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্ক করার সাহস, ক্ষমতা আমার নেই। মুজতবা আলীই ইউরোপীয় দার্শনিকের ( বার্ট্রান্ড রাসেলের) কথা ভাঙিয়ে পরামর্শ দিয়ে রেখেছেন, ‘জ্ঞানীর সঙ্গে তর্ক করো না, ওদের জ্ঞান আছে, তোমার তা নেই’।
এ সিলেটি, না করিমগঞ্জি (বরাকি) ব্যক্তিটি অবশ্য প্রগাঢ় পান্ডিত্য নিয়ে নিজেই পান্ডিত্যের মুণ্ডচ্ছেদ করে ফেলেছেন। পন্ডিতদের নাকি সবচেয়ে বড় দোষ, ‘ওরা বড় মুর্খ’। তাঁর ভাষায় বলি, ‘পন্ডিতদের সবই গুণ, দোষের মধ্যে এই যে ব্যাটারা বড় মুর্খ’।
মাঘমাসের শ্রীপঞ্চমির এক সকালে এক প্রৌঢ়া বিচরণশীল আলী সাহেবকে পূজারি ব্রাহ্মণ ভেবে বগলদাবা করে এনে বাড়ির বাচ্চাদের পূজাটি সাঙ্গ করে দিতে আসনে বসিয়ে দিলেন । পূজার আসনে বসে তিনি খুব নিখুঁত সংস্কৃত উচ্চারণে শাস্ত্রমতে সমস্ত ক্রিয়াকর্ম সাঙ্গ করে দিলেন । কেচ্ছাটি বাজারে খুব খেয়েছে । এটা শেষ হতে না হতেই আরেক কেচ্ছা ছড়িয়ে দেওয়া হল । এবার স্থানটি নিয়ে যাওয়া হল পুরিতে । তৃতীয় আরেকটি কেচ্ছাও আছে
২
এক্ষণে যা কবুল করার তা হল বরাকবাসীর একটু অতিরিক্ত পক্ষপাত আছে এ ব্যক্তিটির প্রতি (দেশের ভাই শুক্কুর মামুদ আরকি)। শিলচর শহরের প্রবেশপথেই বাঙালি মনীষীদের সঙ্গে মুজতবা আলীরও প্রতিকৃতির কথা তো বলেছি। একবার হল কি, নয়াদিল্লিস্থিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কোনও এক বিশেষ কারণে শিলচরে ঢুকতে গিয়ে ভবনের (ভয়ে বলি, ‘বঙ্গভবন’, উচ্চারণ করার সময় নিতান্ত অবহেলায়ও ‘ভ’- এর উপর চাপ দেবেন না দয়া করে, ভেঙে যাবে বহুকষ্টার্জিত বাড়িটি) সামনে এসে খেলেন জব্বর এক হুঁচোট: ‘আপনারা তো সাংঘাতিক কাণ্ড করেছেন মশাই। আমি সারা ভূভারত ঘুরে কোথাও এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। আপনারা আমার জগৎবিখ্যাত চাচাকে শহরের প্রবেশপথের ভবনটিতে বসিয়ে রেখেছেন। এ তো আমার কাছে পুণ্যভূমি হয়ে গেল’। আবেগাক্রান্ত ব্যক্তিটি আরও কত কথা বলেছেন এর ফিরিস্তি দিতে পারেন বঙ্গসাহিত্যের তৎকালীন সভাপতি (কাছাড় জেলা) তৈমুর রাজা চৌধুরী। বলা বাহুল্য ওই রাষ্ট্রদূত ছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। অলমিতি বিস্তারেন।
এদিকে আনেকের অভিমান ছিল (তিনি নিজেই মনে করিয়ে দিয়েছেন, কেউ অনুযোগ করেনি অবশ্য), মুজতবা আলী একষট্টির ভাষা আন্দোলনের দিনে বেমালুম চুপ ছিলেন।
আসল কথাটি হল, ইতিপূর্বে ইনি যে পূর্ববঙ্গে (পাকিস্তানে) একখানি বোমা ফাটিয়ে এসেছেন। তা হল একটি পুস্তক, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ (১৯৫৬)। বোমা সদৃশ এ বইটিকে ওপারে বাংলাদেশ-আন্দোলনের প্রাণবীজ বলেও অনেকের বিশ্বাস। একটা কট্টর ধর্মীয়-মৌলবাদ শাসিত রাষ্ট্রে শাসকদের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বিজাতীয় ভাষার বিরুদ্ধে মাতৃভাষার (বাংলা ভাষার) সাফাই গাওয়া ঠিক চাট্টিখানি কথা নয়। (উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের আসাম প্রদেশেই নিজভাষার কথা স্বোচ্চারে বলতে পারছেন কয়জনা বলুন তো?)।
তখনও ওপারে আপামর বাঙালি ধর্মীয় উন্মাদনার ঘোর কাটিয়ে উঠে স্থির করতে পারেনি —আমি বাঙালি হইয়া বাঁচিব, না ধর্মীয়-রাষ্ট্রের ধ্বজাধারী উর্দুভাষী হইয়াই মরিব। মোটামুটি যেমন আমাদের এদিকে যে ,’বাংলাভাষী অসমিয়া’ না কি যেন এক বকচ্ছপ মূর্তির কল্পনা। তবে এটা থাক, অনেকে আবার গোঁসা করবেন।
আমাদের এ সিলেটি ভূত (করিমগঞ্জি ভূতও বলতে পারেন) ওপারের জন্য এমন একখানা কেতাব লিখেছেন যা পাঠ করে কট্টর মৌলবাদির সন্তান সন্ততি, নাতিপুতি অদ্যাবধি বেচাল বে-এক্তেয়ার হয়ে আছে। এদের মাথায় ঘুরছে— আমার ভাষিক পরিচিতি আগে, না ধর্মীয় পরিচিতি আগে?
অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে ওপারের বাঙালির এ উত্তরণ ঘটেছিল— আমি প্রথমে বাঙালি, এরপর অন্যকিছু— এবং এর ফলেই কামান বন্দুকহাতে প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এ বাংলার চাষাভূষা, মাদ্রাসা মক্তব, ইশকুল পাঠশালার ছাত্র, আর লীগপন্থী রাজনৈতিক কর্মী, মসজিদের মৌলানা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নাস্তিক, কমিউনিস্ট, কাফের মালাউন (এভাবে মৌলবাদীরা এদের আখ্যায়িত করত,আজও করে), এবং বাংলাভাষী দেশীয় সেপাই, পুলিশ, হোমগার্ড, অফিসার, চৌকিদার, পিয়ন, লেখক-শিল্পী-কলাকুশলী এমন-কি পেশাগত পরম্পরায় যারা খুনে-ডাকাত (মুজতবা আলীই বলেছেন আমি নয়)—এরা সবাই মিলে মিশে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ (গোঁসা করবেন না, এদের মাঝে মাঝেই পদস্খলন হয়— মূর্তিটুর্তি ভেঙে ফেলে, ভিন্নধর্মীর সঙ্গে প্রেমটেমও করে ফেলে, ঠিক যেমন এদিকে সেক্যুলার রাষ্ট্রেও একটু আধটু খুনখারাবি, মসজিদ ধ্বংস, হালকা মাঝারি জেনোসাইড়, সরকারি উচ্ছেদ ইত্যাদিও হয়ে যায়, এর উপর মানুষের হাত নেই) জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলতে পেরেছে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষে জর্জরিত পূর্ব-পাকিস্তানে বসে ধর্মের উপরে মাতৃভাষাকে (যে ভাষা আবার মৌলবাদীর বিবেচনায় একটি ‘হেঁদুয়ানী ভাষা’, যেমন এপারে আরবি-ফার্সি-উর্দু হল যাবনিক ভাষা) প্রতিষ্ঠা দেবার ম্যানিফেস্টো রচনা করতে মুজতবা আলী যে মানসিক শক্তি, দার্ঢ্য– অবশ্যই প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য মিক্সড আপ উইথ কাণ্ডজ্ঞান— প্রদর্শন করেছেন এরপর তিনি-হেন ব্যক্তিরও কিছু দিন বেহাল হয়ে থাকা খুব আশ্চর্য ছিল না। আরও একটি গেরো ছিল, ওই মুহূর্তে তাঁর সহধর্মিনী (সরকারি শিক্ষা আধিকারিক) সন্তানসহ ছিলেন পাকিস্তানে।
সমস্যাটা আলী সাহেব কী করে অতিক্রম করলেন এ্র ফিরিস্তি তিনিই দিতে পারতেন, আমি কিছুই জানি না। তবে এরপরই ওপারের বাস তাঁকে গুটিয়ে তুলতে হল। এপারে এসেই বাড়াবাড়ি শুরু করলে ওদিকে ধর্মীয় রাষ্ট্রটিতে স্ত্রীপুত্রের কী হাল হবে এ চিন্তা হয়তো বা ছিল তাঁর মনের ভিতর। যা করার তা না হয় ধীরে সুস্থেই করা যাবে, এটাও হয়তো ছিল তাঁর অভিপ্রায় (এ আমার কষ্টকল্পনাও ধরে নিতে পারেন, আমি তো তখন কৈশোরও ছুঁইনি)।
পূর্ব-পাকিস্তানে যে-বোমাটি সৈয়দ মুজতবা আলী ফাটিয়ে এসেছেন, এ নিয়ে আমার দুইখান কথা আছে। নব-সৃষ্ট পাক্-রাষ্ট্রে পশ্চিমী প্রভুরা বাংলাকে গুরুত্বহীন করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ফরমান জারি করতেই বাঙালির উৎসাহের বেলুন চুপসে যেতে থাকল। ওরা ভাবতেই পারেননি এখন নিজেদের রাষ্ট্রেই চোখের সামনে সরকারি কাগজপত্র, পোস্টকার্ড, রেলের টিকিট, রেশন কার্ড, জন্মমৃত্যুর নথিপত্র, সাইনবোর্ড, মুদ্রা, ডাকটিকেট সর্বত্র বিজাতীয় অক্ষরের মিছিল দেখতে হবে। শোনা গেল পাঠশালা, মাদ্রাসার নিচু ক্লাসের জন্য বাংলার ছাড় থাকলেও মাধ্যমিক থেকে উচ্চ শ্রেণীতে উর্দুই হবে শিক্ষার মাধ্যম। এ চাপে পড়েই (সঙ্গে আরও অনেক বিষয় আছে) বাঙালির নব চেতনার উন্মেষ। ঠ্যালার নাম বাবাজি। বাঙালি অনুভব করল পুরুষানুক্রমে বাংলায় বাস করে, সর্বক্ষণ বাংলায় মনের ভাব ব্যক্ত করে এখন যদি বাঙালি না-হয়ে নিজ ভূমিতেই অপর একটি জাতি সেজে বেঁচে থাকতে হয়, এ-তো দুঃসহ অভিশাপ। হিন্দুদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে নিজেদের রাষ্ট্র পেয়েও এখন কি উর্দুর গোলামি করতে হবে?
ইতিমধ্যেই ওদিকে আরেক কাণ্ড হয়ে গেল। একদিন এক ব্যক্তি ( ভাষাতাত্ত্বিক ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ) ঢাকার জমায়েতে চিৎকার করে শুনিয়ে দিলেন—‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি’।..
কী বলে রে মোল্লা ব্যটা— টুপি, দাড়ি, লুঙি, আলখাল্লায় ঢাকা, দেখতে তো নিপাট ভালো মানুষ, কিন্তু কথা বলছে বেহেড কাফেরের মতো: ‘মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে ধূতি, লুঙি, মালা-তিলক টিকি দিয়ে তা ঢাকবার জো নেই’।
সেই হল ধর্মোন্মাদ বাঙালির মোহমুক্তির শুরু।এরা পরিত্যাগ করেছিল ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই’ শ্লোগানটি, কিন্তু এখন দেখে কেল্লা ফতে — ‘মুসলিম-মুসলিম ভাই-ভাই’ আওয়াজটিও সর্বৈব অন্তঃসারশূন্য। মাতৃভাষার টান ধর্মের টানের চাইতে বড়— এই অমোঘ সত্যটি পাকিস্তানি-বাঙালির মর্মমূলে ঢুকিয়ে দিয়ে এপারে চলে এসেছেন খান বাহাদুর সৈয়দ সিকন্দর আলীর ব্যাটা, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্ত্রশিষ্য, মুজতবা আলী। ( স্মর্তব্য চন্দনের ছিটা কিংবা তামা তুলসী গঙ্গা জলে শান্তিবারির সংশোধন ছাড়াই হিন্দুশাস্ত্র, বৈষ্ণবীয় তত্ত্ব, বেদ, বেদান্ত, পুরাণে ব্যুৎপত্তি সহ পৃথিবীর তাবৎ ধর্মতত্ত্বে অগাধ পাণ্ডিত্য নিয়েও ইসলামের প্রতি আলী সাহেবের গভীর গভীরতর আনুগত্য একদিনের জন্যও শিথিল হয়নি)।
মুজতবা আলীর মাতৃভূমিতে (ভুলবেন না, করিমগঞ্জ-সহ সিলেট, কাছাড় সেই উনবিংশ শতক থেকে নিজস্বতা নিয়েই আসামের অঙ্গ। লর্ড নর্থব্রুক সাহেব সেদিন ‘বেঙ্গল ল্যান্ড রেভিনিউ রেগ্যুলেশন ১৮৭২’ সিলেট–কাছাড়ের জন্যও বহাল থাকবে এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন) সেই ভাষিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল না। স্বাধীনতার মাত্র তিন মাস পরেই রাজ্য বিধানসভায় জানিয়ে দেওয়া হল ‘বাঙালিরা এখন হীনবীর্য… এদের আর ভয় করার কারণ নেই, অসমিয়ারা এখন মাস্টার্স অব দেয়ার ওন ল্যান্ড…। রাজ্যপাল স্যার আকবর হায়দরির মুখ দিয়ে বাঙালিদের স্ট্রেঞ্জার্স (আগন্তুক) বলে অভিহিত করে বলা হল ‘আনুগত্যের বিনিময়ে’ এদের প্রতি এ রাজ্যে যেন সদয় ব্যবহার করা হয়। (এখন বুঝি সেই আনুগত্য প্রদর্শনের পর্ব)।
যারা রাজা মন্ত্রীদের কৃপাধন্য এরা ফিস ফিস করেও এ কথাটি বলেন নি, আফটার অল এই বাঙালিরাও শ’য়ে শ’য়ে স্বাধীনতা-আন্দোলনে কারাবরণ, শহিদত্ববরণ করেছেন তবেই না স্বাধীনতা অর্জিত হল। আন্দামানের রেকর্ডে নামগুলি দেখেছেন? লজ্জা পেয়ে যাবেন দেখলে। আর কিনা এদের মুখের উপরই শুনিয়ে দেওয়া হল ‘আসাম ইজ ফর অ্যাসামিজ’, আসাম অসমিয়াদের জন্য। এদেরই শোনানো হল, ‘উই ক্যান নট ন্যারিস এনি আদার ল্যাঙ্গুয়েজ ইন দিস প্রভিন্স’ (এ প্রদেশ অন্য কোনও ভাষাকে লালন করতে প্রস্তুত নয়)।
করাচির প্রভুদের ইচ্ছানুশারে পূর্বপাকিস্তানে বাঙালির ভাষার উপর আঘাত আসতেই আমরা প্রত্যক্ষ করলাম পাক-বাংলায় ধর্মীয় পরিচয়কে ছাপিয়ে ভাষিক পরিচয় প্রধান হয়ে উঠল। পাকিস্তানের ধর্মোন্মাদেরা সেদিন কী বি-পাকেই না পড়েছিলেন !
পাছে বাহান্নর রক্তপাতের পর ভাষিক উন্মাদনা স্তিমিত না হয়ে পড়ে তাই মুজতবা আলী পুরো বিষয়টিকে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে একেবারে সাদামাটা ভাষায় পাকিস্তানবাসীর কাছে হাজির করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণকে নিজেদের মাতৃভাষাকে ভুলিয়ে উর্দু শিখিয়ে কেন্দ্রীয় ভাবে এক করে দেবার ‘অসম্ভব প্রকল্প’ সম্বন্ধে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে কস্মিনকালেও এ হেন কাণ্ড ঘটেনি এবং যতবার চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই সে চেষ্টা নিস্ফল হয়েছে’। এ কথাটির উল্লেখ এখানে এজন্যই যে আসামেও দেখা গেছে পূর্বাপর এই একই অসম্ভব কাণ্ডটির বাস্তবায়নের প্রয়াশ বৃহৎ রাজ্যটিকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে। সম্প্রতি যে ক’টি মুষ্ঠিমেয় জনগোষ্ঠী এর সঙ্গে ঝুলে রয়েছেন এর মধ্যে অন্যতম জনগোষ্ঠী বাঙালির উপর এই অসম্ভব প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে চলছে অভিনব ( ওই যে বলে না ‘বেলেগ’) জবদস্তি। তিনি বলেছেন, ‘অসম্ভব কর্ম সমাধানের চেষ্টা করার চেষ্টা করে মুর্খ, বলদকে দোয়াবার চেষ্টা সে-ই করে যার বুদ্ধি বলদের ন্যায়’। গোয়ালপাড়াকে নির্জলা বাংলা-স্কুল-শূন্য করে কিংবা আরও ক’টি জেলার বাংলা স্কুলগুলো শেষ হয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করাটা নির্বোধের পক্ষেই সম্ভব। আর এখন আসাম রাজ্যে কেউ যদি নিজ মাতৃভাষা নিধন-যজ্ঞের মতো অসম্ভব প্রকল্পে স্বেচ্ছায় সামিল হতে চান (যেমন ওপারের উর্দুপন্থী বাঙালিরা করেছিলেন, পরবর্তী কালে যাদের কপালে জুটেছিল ‘রাজাকার’ তকমা), এদের বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে আমি কিছুই বলব না—যা বলার সৈয়দ মুজতবা আলীই বলেছেন।
আমাদের এদিকে একষট্টিতে, এমনকি আশির দশকে অবাস্তব ভাষানীতির বাস্তবায়নে কিছু নিরক্ষর মুসলিম চাষাভূষা (পেছনে কয়েকজন বামুন কায়েতও ঘুঁটি হাঁটিয়েছেন), এবং হাতেগোনা কতিপয় শিক্ষাবিদ, কিছু কবি- সাহিত্যিকেরাও কী সব শ্লোগান তুলেছিলেন, বরাকবাসী ভুলেনি তাদের কুকীর্তি। সাম্প্রতিককালে এদের পুনরুত্থান দেখে আমরা হাসব না কাঁদব !
৩
সূচনায় মুজতবা আলীর প্রতি অভিমানের কথা বলেছিলাম। তিনি একটা কৈফিয়ত দিয়েছেন। দূর থেকে তিনি লক্ষ করেছিলেন ‘ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক রেষারেষি তিক্ততায় রূপান্তরিত হয়েছে, এমন কি (এখানকার মানুষ) কোনও কোনও স্থলে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছে’। তিনি জোরগলায় বলেন, ‘কাছাড়ে কস্মিনকালেও কোনো প্রকারের সাম্প্রদায়িকতা ছিল না’। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই সাম্প্রদায়িকতাই আন্দোলনকে বেহাল করে দেবে। যদি কোনও দিন সেই মহান ভাষা আন্দোলনের আদর্শ বিস্মৃতির দিকে যায়, তিনি ভেবে রেখেছিলেন, তখনই ‘পারি যদি তাকে জাগাবার চেষ্টা করব’। ১৯৬৯ সালে শিলচরে এসেছিলেন তিনি। তখনই হয়তো বাঙালির ভাষা চেতনাকে আবার জাগাবার প্রয়োজন অনুভব করেছেন। ‘হতভাগ্য কাছাড়’ শীর্ষক নিবন্ধটির অভিমুখ তা-ই। তিনি মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন দেশ-বিভাগের ফলে কাছাড়ের সর্বনাশ হয়েছে। বাঙালি আসামে হল নগণ্যাধম মাইনরিটি, এর উপর সেন্সাস নিয়ে কারসাজির ফলে তার যেটুকু ন্যায্য পাওনা ছিল তাও সে পেল না। কাছাড়ের স্থানীয় জমিদার সহ সাধারণ মানুষ (হিন্দু-মুসলিম উভয়ই, বলা মোটেই বাহুল্য নয় এ সদাসয় জমিদারদের মধ্যে এ অধমের পিতৃদেবও একজন) ওপারের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করেনি, কিন্তু আসাম সরকার কাছাড়বাসীর এ উদারতাকে মোটেই প্রশংসা করেননি। তাঁর একটি উক্তি ভুললে কাছাড়ের প্রতি বেইমানী হবে: ‘চৈতন্যভূমি শ্রীহট্টের শতশত ব্রাহ্মণকে কাছাড় আশ্রয় দিয়ে সংস্কৃত চর্চা যে কতখানি বাঁচিয়ে রাখল তার খতিয়ান হওয়া উচিত’। এ কাছাড় আজ যদি বাইরের প্ররোচনায় সাম্প্রদায়িকতার পীঠস্থান হয়ে উঠে, যার লক্ষণ আজ ফুটে উঠছে, তবে কাছাড়ের সুমহান ঐতিহ্যের প্রতি বেইমানি করা হবে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সেদিন আলী সাহেব বলেছিলেন,’আজ যদি অসমিয়ারা কাছাড়বাসীর মাতৃভাষা ভুলিয়ে সেখানে অসমিয়া চালাতে চান তবে কেউ আশ্চর্য হবেন না’। এই ভুলিয়ে দেওয়ার একটি মোক্ষম চালটি হল ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’ এটাকে বীজমন্ত্র হিসেবে কাছাড়ে প্রতিষ্ঠিত করা। এর দায়ভার কার এও একটা বড় প্রশ্ন। শ্রীচৈতন্যভূমির শতশত আগন্তুক ব্রাহ্মণদের পাদস্পর্শধন্য কাছাড়ে যদি ধর্মীয় বিভেদ এবং সে সঙ্গে মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতা প্রাধান্য লাভ করে, তবে মহাপ্রভুর অন্তরাত্মা যেমন কেঁপে উঠবে তেমনি স্বপ্নদর্শী মুজতবা আলীর চিন্তা ও সাধনা বিফলে যাবে। এমতাবস্থায় বাঙালিরা কী করবে এ সিদ্ধান্ত ভাষা আন্দোলনের পুণ্যভূমির বাঙালিকেই নিতে হবে, অন্যরা নয়।
♦–♦♦–♦♦–♦
❤ Support Us