- ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
- সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩
গুচ্ছ কবিতা

চিত্র: রবীন মণ্ডল। রাজা। ১৯৭৫
মেঘের মধ্যে অন্ধ শিল্পীর আঁকা এক হাঁস
যে কোনো দৃষ্টিগাহ্য, শ্রুতিযুক্ত-শিল্প আমাদের যাপন, অপযাপনের সময় তার নিঃসময়কে ছুঁয়ে যায় কখনো অজান্তে, কখনো ভাগ্যদোষে, কখনো বা সজ্ঞানে। এসবের রাশি চিহ্ন সবচেয়ে বেশি গাঢ় আর রহস্যময়তার নিবিড় আলাপে; নিভৃতে, নিঃশব্দও অধিকতর ধরা পড়ে লোকগানে, চিত্রলিপি আর কবিতায়। ছবি আর কবিতা আর আবহমানের লোকগীতি পূর্বপ্রস্তুতি কিংবা কোনোরকম অনুশীলন ছাড়াই একে অন্যের সমগোত্রীয় সহযাত্রী হয়ে ওঠে। সৎ আর বিশুদ্ধ শিল্পে কার জোর বেশি ? যুক্তি না স্থিতধী ভাবাবেগের ? স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহের অবস্থান কী এখানে ? নৈরাজ্য না শৃঙ্খলার ? আমাদের ধারণা, শিল্পীর মগ্ন চেতনা রসদ খোঁজে না, পেয়ে যায়, পূর্ব পরিকল্পিত চিন্তার দ্বারস্থ হতে হয় না শুদ্ধ শিল্পকে, শিল্প শর্তের শাসনকেও সে মানতে চায় না, লিখতে লিখতে, আঁকতে আঁকতে তার কবিতা, তার ছবি মূর্তিরূপ ধারণ করে। কিউবিস্ট রবীন মন্ডল বলেছিলেন, ফিগার আঁকার কৌশল আমার জানা নেই, ক্যানভাসে তেল রং অথবা জল রং ছড়ালেই আদিম মানব-মানবীর মুখ, চোখ, নাসিকা আর নির্বাক চরিত্র এসে জড়ো হয়ে যায়, একক আচরণেও তীর্যক ভঙ্গিমায় মেতে ওঠে তারা।
মালার্মে-ব়্যাবোর কবিতা, ছয় শতকের দুঃসাহসী আরব-কবি ইমরাউল কায়েস, কবিতার পরম পুরুষ জন ডন কিংবা নির্জনতার নির্মোহ সাধক জীবনানন্দ, অথবা বিনয় মজুমদারের ধাতস্থ উন্মাদনা, এমন কি যুক্তি-পিয়াসি টি এস ইলিয়টকে কতটা নিয়ন্ত্রিত করতে পারত শব্দ আর বিষয়ের যুক্তি রেখা ? স্বাস্থ্যময়, অগোছালো কোনো শিল্পী অথবা একান্ততায় নিবেদিত বিশুদ্ধ কবিকে যুক্তির অনুশাসন, ভাষাতত্ত্বের নিদের্শিত ব্যাকরণ কখনো লাগাম পরাতে পারেনি, ভবিষ্যতেও বলা আর ভাবনার অকপট স্রোতের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করে জেগে থাকবে কবিদের চিত্রীদের শিল্পস্বভাব। যা বিমুক্ত, শৃঙ্খলানুসারী হয়েও শৃঙ্খল-বিরুদ্ধ।
সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার অন্যতম বিশুদ্ধ, ক্রমাগত উর্ধারোহী গোলাম রসুল-এর কবিতা নিয়ে বলবার প্রস্তাবনায় এত কথা বলতে হচ্ছে আমাদের, কারণ তিনি বিরল মেধার স্বভাব কবি। ঐতিহ্যের অনুশাসন, ব্যাকরণের হিসেব-নিকেশ, সংলগ্ন, যুক্তিগ্রাহ্য বাক্য বিন্যাসকে গুড়িয়ে দিয়ে, তার স্বশাসিত ভাষারাষ্ট্রে, শব্দ প্রয়োগে, ব্যক্ত-অব্যক্ত অনুভূতিতে যে-ঘ্রাণ তৈরি করছেন- ছড়িয়ে দিচ্ছেন প্রাতিষ্ঠানিকতার ভেতরে, বাইরে, তা বেনজির বললে, এরকম বলবার হেতু নেই বুঝি?
গোলাম রসুলকে নিয়ে আমাদের ভেবে দেখা দরকার। প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার মোহ কতদিন শব্দের অন্ধকারে বন্দী করে রাখবে উন্নাসিকের দৃষ্টিকে? যান্ত্রিক উদাসীনতা কি ভারী হতে থাকবে ক্রমশ।
বাহার উদ্দিন। ২৪.৯.২০২৩

চিত্র: রবীন মণ্ডল। ১৯৭৩
যেখানে কেবল রহস্যরা বেঁচে থাকে
নক্ষত্ররা কি সেই অর্থ বহন করে যা রক্তশূন্য আকাশে খুঁজে বেড়াই
বর্শাবিদ্ধ কারবাঙ্কলটি ভীষণ ভাসে
নির্গত হয় তরল
পৃথিবীর ওপরে নঙর করা দুটি হাত টেনে নিয়ে যায় পর্বতের দিকে
আর পর্বত কেঁপে ওঠে অসীম শূন্যের মাপ যন্ত্রের মতো
হঠাৎ মস্তক হাতে আমরা জেগে উঠি
লাঙলের ফলার মুখে নক্ষত্ররা উঠে আসে
যে অভিকর্ষে গ্রামগুলোর সাথে আকাশের যোগাযোগ রক্ষা
আর দৈববাণীর মতো আমরা গর্ব করে বলি দেশ কাল সমাজ সংসার
নক্ষত্রধৃত সে হাতের স্থিতিতে উদ্বোধন হয় জীবন
দেবতাদের অসহায় রাস্তা
সূর্যের পেছনে প্রাচীন মাটির দেয়াল
রক্ত রুটি আর কবরের সংমিশ্রণে শন শন বাতাস
সমুদ্র উপকূলে জলের আশা
আমরা ছুঁড়ে দিই আরও একটি লোমহর্ষক নৌকা
ফিরে আসে ফিকে হয়ে আসা রঙ রেখা
যেখানে কেবল রহস্যরা বেঁচে থাকে
মেঘ উড়েছিল
মেঘ উড়েছিল একটি প্যারাসুটে করে
লক্ষ্য ছিল ঝর্ণা থেকে মেয়েদের পুতুল আর গয়না গুলো তুলে আনা
গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা সোনা
দাঁড় আর লাঙলের ফলা গুলো সূর্যাস্তের দিকে যাচ্ছে
সন্ধ্যা নামছে সমাধিস্থ হয়ে
তারপর একটি উড়াল রাত পেরিয়ে গেছে নক্ষত্রদের অভ্যাস এবং অভিজ্ঞান
স্থির নিবদ্ধ দৃষ্টির নীরবতা
সেখানে ছত্রাকের আক্রমণ মনে করিয়ে দেয় জীবনের অপচয়রাশি
সমুদ্রকে বাঁধা দিচ্ছে একটি লতাপাতা
আর সব কিছু অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার মতো
তখনও মেঘের মধ্যে অন্ধ শিল্পীর আঁকা এক হাঁস
তার অনিন্দ্য ডানার ঝাঁপটায় আমরা ছিটকে পড়ছিলাম অজানা গ্রীস্মকালের পেছনে
এন্ড্রয়েড মানুষ
বন্ধুরা আমার নস্টালজিয়া
মানুষ এন্ড্রয়েড
সাইরেন বাজছে
আমাকে জন্মের তথ্য দিতে হবে
বলতে হবে আমার দেশের নাম
পাত্রটি থেকে গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামে মনে হয় আমি জন্মেছিলাম
রেডক্রস মোরগের ছুরি আমাকে ডাকে
প্রতিটি ভোরের জন্যে
খ্রিস্টোফার কলম্বাসের রান্নার কুক সূর্য
হাত বাড়িয়ে রয়েছে তুলোভর্তি নৌকাগুলোর দিকে
ধু ধু ইমিগ্রেশন অফিস
বইগুলোর মধ্যে ফুটো শহর
স্টিলের আলমারি
স্কুলের জানালা দিয়ে সিমেন্টের শিশুরা দেখছে রাজপুত্র ঘোড়ায় করে সূর্যে যাচ্ছে
বিধ্বংসী দিনের সব কটা আঙুল চেপে ধরে রয়েছে পাথর
নিহত নক্ষত্ররা দোলা খাচ্ছে সবুজ কাঁচের বোতলে
আর চায়ের পেটিতে ভরা আন্দোলন
সিল্কের রুমাল শোভাবর্ধন করছে রামধনুকে
আমি মনে করছি আমি যাত্রা করেছি পাথর আর জলে
পাখিদের ডানায় আমার তাঁবু
কঠিন পরিশ্রমের পর আমি যখন বিশ্রামের জন্য চিৎ হয়ে সাঁতার কাটছি আমার পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া বিশাল গুঁড়িগুলোর বেহালার তার তাদের অরণ্যকে বাজিয়ে চলে যাচ্ছে
একটি প্রবল দ্রাঘিমা রেখা
বিশাল ডাইনোসরের পুনরুভ্যুত্থান
দুহাজার বছরের পুরনো সাপ
প্রাচীন বেগুনী রঙের হালকা আভা
প্রতিটি বৃহত্তম মৌসুমী বায়ু
যখন
তামা
সোনা
রূপো
দাউ দাউ করে জ্বলছে
তখন সব কটা ধাতুকে আমি নিভিয়ে দিয়েছি আমার অশ্রু দিয়ে
আর একটি অস্পষ্ট বিন্দুতে শেষ করছি মহাবিশ্বের প্রসারতাকে
♦—♦♦—♦♦—♦
❤ Support Us