- ক | বি | তা
- ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪
কবিতার মনোবাসীর খোঁজে। পর্ব ১১
চিত্রকর্ম: তপন কুমার দাস
ভেতরে, আরো ভেতরে অপূর্ব, খুবসুরত ঘোড়া
ভবঘুরে, উদ্দাম, অগোছালো, আপসহীন হয়েও বাংলা কবিতার অন্যতম ঘোড়া কিংবা অশ্বারোহী কমল— কমল চক্রবর্তী— অত্যন্ত নিপুণ, শানিত আর বর্নিত এমন এক প্রতিভা, যাঁকে আমরা অনায়াসে, আমরা, ফরাসি রোমান্টিকদের অনুকরণহীন উত্তরাধিকারী বলতে পারি, ভাবতেও পারি যে, তাঁর বলবার কৌশল কেবল নিজস্ব নয়, নিজস্বতা থেকেও খানিকটা দূরো এবং তাঁর বিষয়-আশয়, ভাবনা চিন্তা খ্যাপামির ঘর-গেরস্তি নয়, তাঁর গভীর আর গম্ভীরকে, তাঁর আনন্দ আর বেদনাকে স্পর্শ করে বুঝতে পারি, জন্মের আগে, মাতৃগর্ভেই তিনি হাত বুলিয়ে কবিতা আঁকতেন, ছবি লিখতেন, গল্পে-গদ্যে, অন্যরকম কাহিনির নির্মাণে। পাঠকের ভালো পাহাড়ে, মন্দ পাহাড়েও হয়তো বা কমল এক রহস্যময় কবিতা, যাকে দেখা, ধরা যায় না, অধরা হয়ে থাকাই তার নিয়তি। বাইরের রূপ দেখে ভেতরের মূর্তি দর্শন কি সম্ভব; কমল সমগ্র দেখতে হলে, পড়তে হলে তাঁর নির্জনতার, তাঁর হৈচৈ-এর, তাঁর উচ্চারিত, অনুচ্চারিত আত্মলিপির সহমর্মী হয়ে-ওঠা খানিকটা- প্রত্যাশিত। আমাদের কেউ কেউ দেখেছি তাঁর প্রতিস্পর্ধা, তার বিষ ও বাষ্প পান, যার দৃষ্টিগ্রাহ্যতা প্রশ্নহীন, যার খাপছাড়া স্বভাবের বাইরে ও ভেতরে বাস করে হৃদকমলের উল্লাস, আর একক ও একাকিত্বের সংগঠিত, হিসেবি বেপরোয়াপনা । কমল নকশা কাটা এমন এক প্রাচীন ও নবীন প্রবাহ, যাঁকে খারিজ করা দুঃসাধ্য। তাঁর, কমলের পোস্টার, হাতচিঠি ডানা মেলে, গান গায় প্রবাহমানের পংক্তি থেকে পংক্তিতে; আমাদের সবুজে, পড়ন্ত হেমন্তে, শরতের ডগা থেকে ডগার ভেতরে, আরো ভেতরে।
কেমন আছ কমল?
সম্পাদক। ২৫/২/২০২৪
কবিতার বিমূর্ত-বর্ণমালা
♦ কবিতার মুহূর্তে কি খুব অস্থির হয়ে ওঠেন ?
না, কোন অস্থিরতা, কবিতা নির্মান মুহূর্তে নেই। কখন আসে টের পাই না।
♦ ভেবেচিন্তে লেখেন, না স্বতঃস্ফূর্তভাবে ?
আপনি আসে, কোন পদধ্বনি বা আরম্বর নেই।
♦ কখনো কি মনে হয়, কেউ আপনাকে ভেতর থেকে লিখিয়ে নেয়, এমন কোনো মনোবাসী ?
ওভাবে কেউ আমার হৃদকমলে বসে নেই। বা কখনও সাড়া পাইনি। অথবা অনুভব। সত্যি সত্যি আমার কোন মনোবাসী বা প্রানবাসী নেই। খুব জোর বেঁচে গেছি ! না হলে, তাকেও লালন পালনের দায়িত্ব।
♦ একটানা লেখেন, না থেকে থেকে লিখতে হয় ?
দীর্ঘ কবিতা, অনেক সময়, টানা। কারণ ৩০/৪০ পূঃ নাগাড়ে সম্ভব নয়। আবার- ছোট কবিতা— হ্যাঁ যেমন, গত মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল, কবিতার তাড়নায়, উঠে, অনেকটা নির্মান। সকালে বাকিটা।
♦ লেখার আগে কি মনে মনে পংক্তি আওড়ান ?
না, ওভাবে কখন কচিৎ, আওড়ানো। রেগুলার কোন নেশা নেই।
♦ অন্তমিল, মধ্যমিল কি কবিতায় ফেরাতে চান ?
অন্তমিল, মধ্যমিল, অমিল, গদ্য যাবতীয় পদ্ধতিতেই কবিতা, আমার পক্ষে। এই মিশে ঝুলেই, ষাট বাষট্টি বছর। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে যে গড়মিল হয় না, তা তো নয়। হয়। তবে ওই এক ছাদের নিচেই। তারপর দীর্ঘ দিন, এক সঙ্গে থাকতে থাকতে, কিছু ভালোবাসা বাসি, কিছু অনুরক্ত এবং ঝগড়াঝাটি।
♦ ছন্দের ওলট পালট বা ভাঙচুর কতটা পছন্দ ?
ছন্দ, অনিবার্যভাবেই ভাণ্ডার। ‘ছন্দ’ নির্মান ও ভাঙা কবির মহত্বম কর্ম। কেবল শব্দ সাজিয়ে, ইতিউতি, কবিতা, হয় না ! আর ‘ছন্দ ভাঙা’ যে অনেকে বলেন, খুবই ভুল। কবিতার আত্মা ‘ছন্দ’। ইদানিং কিছু কবি, ‘সংবাদপত্র’ [সুর করে উচ্চারণ] কবিতা বলে চালান। হায় ! অন্তমিল না থাকলেও, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ, সমর সেন বা আরও অনেকের কবিতা, কখনও কি ‘ছন্দ ছাড়া’ ?
চিরকালই কবিতার পাঠক কম। ফলে, একদল, নাটক, কথকথা, ছোট গল্পকে ‘বিখ্যাত’ হবার লোভে, ‘কবিতা’ যা কিনা পৃথিবীতে, মানুষের, শ্রেষ্ঠতম, সৃজন, চালাবার অপচেষ্টা। আত্মার, নিবিড়তম, বিমূর্ত, উচ্চারণ, কবিতা। এতো, লঘুমতি, লোভি, দুবৃর্তের আত্ম মৈথুন, নয়।
ফলে, চিরকালই, একদল, ‘অপরাধী’ শব্দ ও সৃজনের ধার ধারেন না, ক্রমাগত ছাপা অক্ষরে, সভা সমিতি, মঞ্চ ও রাজ আনুগত্যে, কিছু দিন মাতলামি করেন। জোঁকের মতই এরা, খ্যাতি ও পুরস্কার ‘রক্ত’ শোষন শেষে, ঝরে, নিপাত।
দিনের শেষে, কবিতা এক, অমোঘ, স্বতন্দ্র ভুবন ও সাধনা। পৃথিবীর অপূর্ব-বর্ণমালা ! ভালোপাহাড়।
দাও প্রভূ,দাও !
গাঢ় দাও প্রভু, গুঢ় দাও !
তোমার অম্লান থেকে, অসীম অনন্ত অনিমেষ !
অগোচর থেকে
নাভিশ্বাস,হতশ্বাস মীয়ানো নিশ্বাস !
ঘরে ঘরে বিকশিত দাও
বাঁজা মেয়ে মানুষের স্তনে অফুরান দুধ
বিষাদে প্রদীপ শিখা, বেদনায় কাস্তেচেরা,
ফ্ল্যামিংগো,শঙ্খচিল !
আমাকে তেঁতুলবন,গাব গাছে বসা টুনটুনি
শবর সঙ্ঘের বাটে, নাম টুকে টুকে
প্যানকার্ড, উদো কলমচি !
আমাকে টইটুম্বুর দাও, মধুরেন সমাপয়েত
দিয়োনা কখনও, দিয়েনা মনো বীনা হৈ চৈ !
যাদুঘরে কতিপয় দিও !
নক্সাকাটা প্রাচীন খারিজ,
সৃজনের ভরাডুবি, মদনের ছেঁড়া চন্দ্রহার !
যাদের আকুল ছিল
ভরা নদী,আয়েলা,আমফান,
তাদের ও নৌকো দাও
কাগজের তৈরী ওরিগামী !
আমাকে হরতাল দাও
যেন বন্ধ করে দিতে পারি অম্লজান !
১১/১১/২০২৩
টাটার পথে ম্যাক্সে বসে
আমার কৃত্তিবাস
হে ক্রুরমতি অক্রুর দত্ত লেন
মনে পড়ে, এখানে কৃত্তিবাস ছিল
গণেশ লাইনো, ডিমাই, হাফটোন
সাহিত্যের পসরা
গীটার, সেতার, ইউনিভক্স, কান্ট্রি সং
একোডিয়ান ভি.বালসারা।
নক্ষত্র,গ্রহের জমায়েত
সালভাদর, জীবনানন্দ, মাতিস
বিষ্ণুদে, কানকাটা ভ্যানঘক
দারুন মস্করা !
বিখ্যাত জুয়ারী থাকতো,
ক্যাসিয়াস ক্লে
ঘুঁসি মেরে মূর্তি ভাঙতো
কাটামুন্ডু হেসে উঠতো
রক্তে ডোবা ট্রে।
বেজেছে বালসারা বাঁশি
কতিপয় যত দূর কুপোকাৎ!
কেন অনন্য নেই, কেন অনাময় নেই
কেন দেবাঞ্জলি নেই, চিৎকার করেছি সারারাত।
শ্যামল,শঙ্কর, দেবাশীষ বন্দ্যোঃ
পরপর এসে ধরেছিল পোঁ !
সুনীল,শক্তি, বরুণ, শ্যামল, সন্দী
ভাসমান বিচারক ডানা
গড়াতো প্রেমের গাড়ি,
কেটি বন্দুকগলি,
বিলিতি কারন।
এক মাত্র গেজুরে দীপক
ছিঁড়ে ফেলতো জামা জুতো
সাহিত্যের ঠুঁটো!
আমরাও গেয়েছি সূচিশুভ্র অরুন্তুদ
আকাশে বাতাসে ঠোঁটে
কবিতার খাতা।
কবিতার গলিগলতা
ঢাকা থেকে জোনা/হুড্রু
ফ্লেক্স, পোস্টার, হাতচিঠি,
উড়িয়ে দিয়েছি ঝরাপাতা ,
কেটি, বন্দুকগলি ভাঙচুর করে,
আমি ও পৃথ্বীশ গট মট।
কবিতার ডানা মেলে গান গায়
অক্রুর দত্ত,রানী ছায়ানট।
১৩/১০/২০২৩
হাওড়া-ঘাটশিলা লোকাল ট্রেনে বসে
আমার ভালোপাহাড়
ভালোপাহাড় হলো কেরানীর পাহাড়
নেড়ী কুকুরের নেকা ভৌ ভৌ
গঞ্জেরহাটে এক কোণে বসা
পাড়াতুতো বৌ,
ঘসা দুয়ানি।
ভালোপাহাড় হলো আদিম পাহাড়ি
বুনো জলঝারি, মদির কানন
সপ্তপর্নী,ফলসা, নিবিড়
আলেয়া আনন ।
ভালোপাহাড় হোল,বন্যার পরে
বাড়ি ফেরা হুহু,শূন্য হদিশ
মুছে যাওয়া ধূ ধূ,ফিরে আসা ঝিঁঝিঁ
বুনো আচমনে, বেপথু খরিস।
ভালোপাহাড় হোল, ভোঁদড়ের টানা শাল
পাতা নাও, বেজীর ক্যাবারে
গোয়ালের চালে আকাশি জারুল,অদুরে
পারুল,তিতির,ডাহুক,দুয়ারে ।
ভালোপাহাড় হোল,জোস্না ফানুস
চাঁদনী অবুঝ,লুটোপুটি বোকা জোনাকি
হতাশায় মরু,নীল, ঝুরুঝুরু
নেচে হেসে ধুম শেঁফালি ।
ভালোপাহাড় হোল,কুলিন বাড়ির
রাঙা বউমনী
যত ফুল ফোটে,তার চেয়ে ও বেশি কামিনি,হাস্নুহেনা
বিত্তবানের ধোঁয়া ওঠা চা
মধ্যবিত্তের আলুনি।
ভালোপাহাড় হোল,স্বপ্ন কুহক
জল ঝরা রাত,ঢেউ ভরা হাওয়া,
উল্লাস ভরা ফুলদানী
পাতা মন্দিরে, দ্রুমদল শোভা
এলোকেশি বিভা জামদানী।
২৮/১০/২০২৩
ভালোপাহাড়
♦—♦—♦♦—♦—♦♦—♦—♦
❤ Support Us