Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • মে ১১, ২০২৫

ভাঙা দেওয়ালের আয়না

পাতাউর জামান
ভাঙা দেওয়ালের আয়না

অলঙ্করণ: দেব সরকার

 
চারটেই ঠ্যাং আকাশকে দিকে উঁচিয়ে, আকাশকে তাচ্ছিল্য করে লাথি দেখিয়ে তেমাথায় বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে আছে। মাথাটা বাম দিকে কাত হয়ে গেছে। কাত হয়ে বলা ভুল হবে, ফটো ফ্রেমে যেভাবে ছবি কাগজের সাথে চিপকে থাকে, ঢালাই রাস্তাটার সাথে ধড়টাও তেমনি সেঁটিয়ে আছে। যাদের ঘরদোর এখনো মা-গঙ্গার গ্রাসে মিলিয়ে যায়নি, এই কিছুদিনের মধ্যে যাবে, যারা আগাম সতর্কতায়, যদি কিছু বাঁচানো যায় যদি – এই ভাবনায় ইঞ্জিনভ্যান ভর্তি করে বাড়ি ভেঙে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল মিলকি সড়কের দুধারে খাশ জমিতে কিছু বন্দোবস্ত করতে, তাদেরই কোনো ভ্যানের চাকায় পিষে গেছিল ইঁদুরটার মাথা বাদে ধড়টা।
 
ডাক নাম বা ভালো নাম, কোনো নামই ছিল না। পাশের বাড়ির ইটগুলো তখন নীল-কালো ঘ্যাসে গাঁথা হচ্ছিল। তিন বাই ছয় চেম্বারে পড়ে গেছিল বছর তিনেকের ছেলেটি। আটানব্বই-এর বন্যা আর ভাঙনে – ওর সব কেড়ে নিয়েছিল। বাপ মা ঘুমিয়ে ছিল, মা-গঙ্গা হাঙরের মতো হাঁ করে এক গ্রাসে যে তিন চারটে ঘরকে খেয়ে নেবে, কে জানত ! ও তখন হ্যাললাতে ঝুলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দোল খাচ্ছিল। মা-গঙ্গা মা বাপ কেড়ে নিলেও ওর অন্তত একটা নাম দিয়েছিল। মা বাপ হারা ছেলেকে এ-ও খাইয়ে রাখে, আর খিচ্চা বলে ডাকে। যেন নেড়ি কুত্তা- আ তু তু। এই খিচ্চা তু তু, আয় আয়, এই নে পান্তা নে, বিসস্কুট খা, এই খিচ্চা তু তু। আসলে সবই এক, বাচ্চা ছেলে মানে খিচ্চা। কিন্তু ঘ্যাসে চেম্বারে পড়ার পর খিচ্চা থেকে ঘ্যাসু নাম হয়েছিল। ভোটার আর আধার কাডে ফাস্ট ও লাস্ট নাম ওই একটাই – ঘ্যাসু। ওই নামে ব্যাঙ্কে বই করতে গেছিল, কিন্তু হয়নি। ফাস্ট নাম, লাস্ট নাম এক হলে চলবে না ! ঘ্যাসু আর ও পথ মাড়াইনি। বউ-এর নামে করিয়ে নিয়েছিল পরে, কারণ, যদি সরকারি ঘর পাওয়া যায় নেতাদের ধরে, তাহলে সমতেল ঘর বানাবে।
 
সেই ঘ্যাসুর ছেলে এখন ছয়।ওর ফাস্ট ও লাস্ট নাম আছে এবং আলাদা। ঘ্যাসুর টাকা হলে ওর নামে ব্যাঙ্কের খাতা খুলতে কোনো অসুবিধে হবে না।
 
যে কোনো সময় বিপদ হতে পারে ভেবে ঘ্যাসুর মনটা আগ্নেয়গিরির মতো কেঁপে উঠেছিল। ছেলেকে গম্ভীর স্বরে ঢাকতে পারে না, কিন্তু মনে উৎকণ্ঠা নিয়ে ডাক দেয়, ‘চলে আয় খিচ্চা। যে কোনো সময় মা-গঙ্গার হাঙর খেকো হা খুলে যেতে পারে !’
 
ছেলে বলেছিল, ‘যাই বাপ। একটু আয়নাটা খুলে নিই দেওয়াল থেকে। তা না হলে নতুন ঘরে আমি কার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে কাঁকুই দেব ?’
 
কমলতিপুর আর গোপালপুর চাঁচল থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার ভেতরে, গঙ্গার ধারে। চাঁচল থেকে মালদা টাউন আবার ষোলো কিলোমিটার দূরে, ইস্টিশনের ধারে। ওই স্টিশন থেকে কলকাতা দিল্লি যাওয়া যায়। কিন্তু কলকাতা দিল্লি থেকে কেউ কমলতিপুর আর গোপালপুরে আসে না। আশপাশের কারো বাড়িতে কুটুম আসলে এক বার এদিকে বেড়াতে আসে। ভাঙা গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলে। তখন মা-গঙ্গা শান্ত, নতুন বউ-এর মতো, লজ্জায় ঘোমটা টেনে নেয়। মুখ ঝামটা কেবল আমরাই খাই। ঘ্যাসুর এমন ভাবনাতে মন আর্দ্র হয়ে গেলেও ঠোঁটের বা চোখের কোণায় কোনো কিছুর রেখা দেখা বা চিক চিক বিন্দু যায় না। শুধু এক চোখ স্বপ্ন, কবে একটা ওর পাকা ঘর হবে মিলকির সমতলে। ঘরের চারিদিকে বিয়াড়া ঝুড় তৈরি করবে। যাতে বিয়াড়া ঘাসের শিকড় মাটির একেবারে পাঁজর অব্দি গেঁথে থাকে।
 
ওর মনে থাকবার কথাও নয়, যারা যারা ওকে পালন করেছিল তারা তারা ওকে বলেছিল কিছু কিছু ঘটনা। মোফাজ্জেল মাস্টারের কাছে কিছু দিন ছিল পেট-ভাতের অলিখিত চুক্তিতে। বিনিময়ে গোরুর জাবনা কাটা, ছাগল দেখভাল করা, আমবাগানে ঘোরাঘুরি করা।
 
মাস্টার বলেছিল, বুঝলি ঘ্যাসু, সেটা ছিল উনিশো আটানব্বই এর সাল। এমন বন্যা আর ভাঙন এদিকের লোক জীবনে দেখেনি। তুই তো দেখবি না। একবার মা-গঙ্গা হাঁ করলে তিন চারটে বাড়ির কমে পেট ভরে না। তুই ভাগ্য করে এসেছিস রে ঘ্যাসু। না হলে জুব্বারের আস্ত পরিবার আর জিতেনের তিন ভাই-সহ বুড়ি মা, আলাদা আলাদা ঘরে শুয়ে ছিল। পাড় থেকে ঘর এক রাস্তার ফারাক ছিল। এক রাতে চোরা গোপ্তা শিকারির মতো শিকার করবে, কেউ কী ভাবতে পেরেছিল। ভাগ্যিস তোদের হেতনের কোণায় আমগাছটা ছিল। ভাগ্যিস আমগাছের ডালে তোর হ্যাললাটা আটকে গেছিল, ভাগ্যিস মিনার মা ভোর বেলায় ফাঁকায় বের হয়েছিল। তা না হলে তুই কোথায় আর আমি কোথায় !
 
ঘ্যাসু এই কথাটা অনেকের কাছ থেকে অনেক রকম ভাবে শুনেছে। ভাগ্যে ঘ্যাসুর কোনো আস্থা নেই। ‘ভাগ্য আবার কী ? মা বাপ যাওয়ার পর ওর শরীরে খেটে তবেই সব হয়েছে। আর ফজলির গাছটা দেবদূত এসে বসাইনি। বাপ নিজের হাতে বসিয়েছিল’। ঘ্যাসু শুনেছিল, ওর বাপ মাস্টারের বাড়িতে একদিন খেটে যে রোজ পেয়েছিল, তার প্রায় সবটাই দিয়ে ভালো জাতের ফজলিটা বসিয়েছিল।
 

মা গঙ্গা থেকে ফুট কুড়ি দূরে বউ আর সে মিলে মাটি ছেনে খড়কুচি মিশিয়ে কনচির দেওয়ালের দুদিকে সেই মাটি লেপে চারটে দেওয়াল তুলেছিল। সামনে কিছুটা হেতনে। হেতনে পরেই কমলতিপুরের রাস্তাটা মিলকির দিকে এগিয়েছে। বাবুরা ঘ্যাসুর বাড়ি দেখে বলে গিয়ে ছিল, বিয়াড়া ঝুড়ের পাঁচিল লাগিয়ে দে বাড়ির চারপাশে। মাটি আরো শক্ত হবে। আর ভাঙবে না। বিজ্ঞানের কথা মিলে গেছিল। কমলতিপুরের দিকটায় গেল দশ বছর মা-গঙ্গা হা করে খেতে আসেনি

 
মা-গঙ্গা যেমন করে হাঁ করে খেয়ে খেয়ে সরে আসে, ঘ্যাসুও তেমনি বাঁশের খুটি, দরমার বেড়া আর মাটির টালি খেপে খেপে সরিয়ে নিয়ে আসছিল। নদীর পাড়ে বাড়ি করতে এর থেকে বেশি কিছু লাগবার কথাও নয়। তবে সেবার ঘ্যাসুও ছেলের জন্য একটা ফজলির চারা লাগিয়েছিল, যেবার কলকাতা থেকে মালদার স্টেশনে বিশেষ একটা ট্রেন এসেছিল। বাবুরা সাদা সাদা গাড়ি চড়ে এসেছিল। নৌকায় চড়ে লগি দিয়ে গঙ্গার তলা মাপবে। ঘ্যাসু তখন বাইশের সদ্য বিবাহিত পুরুষ। হাতের কবজি, পায়ের দাবনা পাথরের থেকেও শক্ত। দৈনিক তিনশো টাকার মজুরিতে লগিমারা কাজটা পেয়ে গেছিল। টানা সাত দিন। ঘ্যাসুর সেকি আনন্দ। ‘এক সাথে অনেক টাকা’। বাবুদের সাথে থাকতে থাকতে ঘ্যাসু অনেক কিছু জেনেছিল। বাবুদের কথা থেকে এটা বুঝেছিল যে আগামী দশ পনেরো বছর অন্তত এদিকটা আর ভাঙবে না। ‘পলির লেয়ার নাকি সে কথা বলছে। না হলে বিজ্ঞান ফেল !’ সেই প্রথম ঘ্যাসুর বিজ্ঞান শব্দের সাথে পরিচয়। পরে অবশ্য চার দোকানের আড্ডা থেকে জেনেছে, বিজ্ঞান মানে, যারা ভগবান আল্লা মানে না।
 
ঘ্যাসু বিজ্ঞানের হয়ে সংসারের জন্য বাজি লাগিয়েছিল। রাস্তার ডান দিকে, মা গঙ্গা থেকে ফুট কুড়ি দূরে বউ আর সে মিলে মাটি ছেনে খড়কুচি মিশিয়ে কনচির দেওয়ালের দুদিকে সেই মাটি লেপে চারটে দেওয়াল তুলেছিল। সেই প্রথম মাটির দেওয়াল তুলে টালি দিয়ে ছাওয়া ঘর। সামনে কিছুটা হেতনে। হেতনে পরেই কমলতিপুরের রাস্তাটা মিলকির দিকে এগিয়েছে। রাস্তার ওপারেই কিছুটা ছেড়ে মা-গঙ্গা। বাবুরা ঘ্যাসুর বাড়ি দেখে বলে গিয়ে ছিল, বিয়াড়া ঝুড়ের পাঁচিল লাগিয়ে দে বাড়ির চারপাশে। মাটি আরো শক্ত হবে। আর ভাঙবে না। বিজ্ঞানের কথা মিলে গেছিল। কমলতিপুরের দিকটায় গেল দশ বছর মা-গঙ্গা হা করে খেতে আসেনি। ঘ্যাসুর নিজের হাতে লাগানো ফজলিটা বয়স দশ বছর পরেও ভরে ভরে আম দিচ্ছিল। বউ নিজে হাতে আপ পেড়ে স্টিলের ফুলকাটা থালায় আম-মুড়ি মাখিয়ে ছেলেকে, ঘ্যাসুকে দিয়ে নিজে খেত।
 
আটানব্বই-এর বন্যা গেল, পরে গেল করোনা। বন্যায় মা বাপ গেল। অতিমারির বছর খানেক আগে বিয়ে করা বউ হলো। বউ আর ঘ্যাসু ঘরটাকে তেমন করে সাজাতে পারেনি। মা-গঙ্গার হাঙুরে গ্রাসে যাওয়ার আগ অব্দি চারটে দেওয়াল ছিল নেকো মাটিতে ন্যাপা, তক্তপোশর তলায় জামাকাপড়, হাড়িকুড়ি আর বাসি খাবার-দাবার রাখার জন্য আড়া থেকে ঝোলানো তাড়া। বিয়েতে কিছুই পাইনি। দেবেই বা কী করে। চালচুলো হীন ঘ্যাসুকে মেয়ে দিয়েছিল, এটাই যথেষ্ট। শ্বশুর বলেছিল, দেখ বাপ তোমার আর আমার দুজনের খুব মিল। তুমিও প্রত্যেক ভাঙনে, ঘর সরিয়ে সরিয়ে নিয়ে আস, আমিও তাই করি। যাও এই তিন নম্বর মেয়েকে তোমাকে দিলাম। আর দিলাম এক খান বড়ো আয়নার কাঁচ, মাটির দেওয়াল হলে গেঁথে দিও। মেয়ে আমার আয়নাতে মুখ দেখতে ভালোবাসে। এর বেশি কিছু দিতে পারব না।
 
বউ প্রথম প্রথম ওটা দড়ি বেঁধে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখত। আর মা-গঙ্গার গ্রাসে যাওয়ার আগে যখন ওরা সরে সরে আসত, ঘ্যাসু দেখত বউ আগে ওই আয়নাটা সরিয়ে রাখছে। ঘ্যাসু একদিন জানতে চাইলে বলেছিল, ‘বাপের দেওয়া একটাই স্মৃতি, ওটা ছেড়ে আসি কী করে!’
 
মাটির দেওয়ালের ঘর হওয়ার সময়, যে দেওয়ালটা মা-গঙ্গার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে ছিল, তার সামনের দেওয়ালে ঘ্যাসু নিজে হাতে আয়নার কাঁচটা মাটির দেওয়ার গায়ে পুরোপুরি সেঁটে দিয়েছিল। আর চারধারে একটা মাটির বর্ডার দিয়ে ছিল ‘দেখতে ভালো লাগবে’ বলে। ঘ্যাসুর বউ করেছিল কী – দেওয়াল শুকিয়ে গেলে সেই বর্ডারের উপর জুঁই আলতার ছোটো ছোটো ফোটা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘দ্যাখো আরো সুন্দর লাগছে না’!
 
ঘ্যাসু নিজের বেলায় একের বেশি এগোয়নি। এনে কী আর করবে ? কোথায় থাকবে ? ওর নিজের শরীর ছাড়া আর কোনো জমিজমা যে নেই ! প্রথমেই ছেলে হয়েছে, বংশের ওয়ারিশ এসেছে, আর কি চাই। দুজনেই বাজা করে নিয়েছিল। তাতে লাভ কী ? এক জনেই তো করতে পারত ? সরকারি হাসপাতালে মেয়ের ক্ষেত্রে হাজার আর ছেলের ক্ষেত্রে দেড় হাজার। ওই টাকায় একটা পাকা শিরিশ কাঠের তক্তপোশ, একটা মিটশেফ হয়ে গেছিল। বউ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ঘরে এসে কী খুশি। আগের বাঁশ-বাখারি দিয়ে তৈরি করা শোয়ার মাচা নেই। ওখানে একটা পাঁচ বাই সাতের তক্তপোশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। ঘ্যাসু সেদিন রাতেই একটা মোটা শক্তপোক্ত দড়ি নিয়ে শাবল দিয়ে ফজলি গাছটার দিকে দেওয়ালে দড়ি গলার মতো ছোট্টো ফুটো করে একটা মুখ আম গাছের গোড়ায় আর একটা মুখ তক্তপোশের পায়াতে বেঁধে দিয়েছিল। যাতে মা-গঙ্গা হা করে খেতে আসলে, এক গ্রাসে না-খেতে পারে।
 
ঘ্যাসুর ছেলেটা এখনো লেগে আছে আয়নার কাঁচটা তুলতে। আজ দিন সাত হলো দেওয়ালটা এভাবেই পড়ে আছে। ঘ্যাসু ভাঙতেই চেয়েছিল। প্রধান এসে ভাঙতে দেয়নি। বলেছিল, এভাবে পড়ে থাক। অফিসাররা এসে ছবি তুলবে, ওটা দেখালেই নতুন ঘর পাবি। তা না হলে, তোর যে ঘর তলিয়ে গেছে, সেটা তোর মুখের কথায় প্রমানিত হবে না। নেতা আঙুল দেখিয়ে বলেছিল, যদি কেউ বলে গঙ্গার দিকে আঙুল তুলে, ওখানে আমার ঘরছিল। নতুন লোক এসে বিশ্বাস করবে তো ?
 
ঘ্যাসু কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিল না, সেদিনের ঘটনার পর। ‘না-বিশ্বাসের কি আছে ! মানুষ যদি মানুষকে না-বিশ্বাস করে, তাহলে কাকে করবে !’ মা-গঙ্গাকে ঘ্যাসু কোনো দিন বিশ্বাস করে না। ‘কাজ দেয় বটে, আবার সময় পেলে পুরোটাই ফেরত নেয়’।
 
কিন্তু চার পাঁচ দিনের মাথায় সবাই কিছু না কিছু সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। খোলাটা, ব্যাড়াটা, হাড়িটা কড়াটা আর কত দিন খোলা আকাশে পড়ে থাকবে!  মা-গঙ্গা সরে আসছে, মা-গঙ্গা সরে আসবে – এটাই নদীর নিয়ম। শুধু পাড় মানুষরা সরে সরে পিছিয়ে যাবে এটাই রীতি। নিয়ম আর রীতির দ্বন্দ্বে নিয়মকেই জিততে হয়। কারণ নদী প্রকৃতি, নদী শক্তিশালী।
 
ছেলেকে এবার কঠোর হয়ে ঢাক দেয়, ‘চলে আয় খিচ্চা। চলে আয় বলছি’।
 
ঘ্যাসু হুড় মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারছে না। হাড়ভাঙা খাটুনির পর পেটে ভাত পড়লে রাতে শরীর মড়া হয়ে যায়। সেদিন রাতে তাও কেন জানি ছেলের ডাকে জেগে গেছিল। ঘ্যাসুর কানে ‘মা’ ‘মা’ ডাকটা হাল্কা থেকে ক্রমশ মোটা হচ্ছিল। ঘ্যাসু নিজের মড়া শরীরটাকে জাগিয়ে তুলে দেখেছিল, ছেলেটা তক্তপোশে উঠে বসে মাকে ডাকছে।
 
ঘ্যাসু জাগাতে চায়নি বউকে। সারাদিন যা খাটে মেয়েটা। ছেলেকে বলেছিল, ‘কী হয়েছে খিচ্চা ?’
 
ছেলে বলেছিল, ‘ফাঁকায় যাবো।’
 
ঘ্যাসু বলেছিল, ‘আচ্ছা চল।’
 
বালিশের পাশ থেকে টর্চটা তুলে নেয় হাতে। ছেলেকে ঘরের পেছনে যে ফাঁকা জায়গাটা আছে, ওখানে বসিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘হাগ এখানে ।’ ঠিক সেই সময় হুড়মুড় শব্দটা হয়েছিল। আম গাছের গোঁড়ায় বেঁধে রাখা দড়িটা দেওয়ালের ভেতরে থাকার ফলে মাটির রসে পচে যেতে পারে – এ বুদ্ধি তখন ঘ্যাসুর মাথায় আসেনি। ছেলের চিৎকার শুনেছিল, ‘মা, আমার মার কী হলো ?’
 
ঘ্যাসু মা-গঙ্গার হাঙুরে হা জানত। তাই বলে এত বড়ো। এক লহমায় রাস্তার ওপাড়ের জমি, রাস্তা, রাস্তার এপারে হেতনে, হেতনের পরে কোনা কুনি করে তিনটে দেওয়াল গিলতে পারে, জানা ছিল না। ছেলেবেলা থেকে ঘা খেয়ে এত কঠোর হয়ে গেছিল, ঘ্যাসু নিজেই বুঝতে পারেনি। পাঁজরের ভেতরে সব দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, তাও মুখে রা কাটেনি, যেন পাথর।
 
একটাই দেওয়াল আয়না বুকে সাজিয়ে নিয়ে মা-গঙ্গার দিকে লাথি দেখিয়ে, দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ঘ্যাসুর ছেলেটা মানুষ মানুষের শরীর থেকে যেমন খাল খিঁচে নেয়, যেভাবে পশুর শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেয়, তেমন করে আয়নার কাঁচটা তুলতে চেষ্টা করছে। ‘সামান্য মাটিরই তো দেওয়াল, বালি সিমেন্টের নয়, এই সামান্য কাজটুকু না-পরলে, সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে, তখন লড়াইটা করবে কীভাবে ?’
 
ঘ্যাসু এবার আদেশের সুরে হাঁক দেয়, ‘হলো ? মা-গঙ্গা কিন্তু হাঁ করে বসে আছে খিচ্চা। তাড়াতাড়ি শেষ কর।’
 
ওরা ঘর সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বলে ইঞ্জিনভ্যানটা ধোঁয়া ওগরাতে ওগরাতে চলে যায়। ঘ্যাসু ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। নজর ঘোলা হয়ে আসছে ঠিকই।কিন্তু দ্যাখে ইঁদুরের যে অবশিষ্ট মুণ্ডুটা অক্ষত ছিল, এবার ইঞ্জিনভ্যানের চাকায় পিষে সেটাও রাস্তার সাথে খবরের কাগজের মতো প্লেন হয়ে গেছে।
 

♦•♦–♦•♦♦•♦–♦•♦


 লেখক পরিচিতি :
পাতাউর জামান পেশায় অধ্যাপক। মননে জাত-লেখক। শূন্য দশকের, সচেতন গল্পকার। হয়ে ওঠা গ্রামে। গ্রামীণ সারল্যকে, নাগরিক উচাটনকে আরেক ভাষায়, অন্যচোখে দেখতে যারা আগ্রহী – ষাটের দশকের সেই সেরা লেখক, বাসুদেব দাশগুপ্তের উত্তরাধিকারকে স্পর্শ করে জেগে আছেন পাতাউর।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!