- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
গান্ধর্ব পান্ডু

দৃশ্য ১
সম্পর্কটা যে টিকবে না, সেটা আগে থেকেই জানান দিচ্ছিল। তবু তাকে জোড়াতালি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখার চেষ্টা দুজনেই করেছিল। অথচ টিকল না ! কেউ কাউকে যেন আর সহ্য করতে পারল না। নির্ভরতার চারপাশে একটা তেঁতো গন্ধ ঘুরে বেড়াতে লাগল।
লংশর্ট ১
আজ রাতে ঘটনাটা ঘটল। বাড়িভর্তি লোক। কালিপুজো। শোয়ার জায়গার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। শীতের আমেজ এসে গেছে। সারারাত জাগা। পরদিন পটকা আর ক্যাপ ফাটিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেটেছে। ক্লাস এইট। দশটা নাগাদ খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমটা জাঁকিয়ে এল। মাঝরাতে লেপের ভেতর একটা হাত। নুক্কুটা ধরে চটকাচ্ছে। কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। প্যান্ট ভিজল। চটচটে কিছু একটা। তারপর আবার ঘুম। ভোরবেলায় হিসি পেল। লেপ ছেড়ে বাইরে আসতে চোখ গেল পাশে শুয়ে থাকা লোকটির দিকে! ছোট পিসেমশাই!
২
রবিনের মেসে গেছি। বেনিয়াটোলা লেনের একটা মেসে থাকে। পরদিন সকাল সকাল মৌলালি পৌঁছতে হবে। চাকরির পরীক্ষা। রাতে খাওয়া দাওয়া করে ওর খাটেই শুয়ে পড়লাম। সকাল সকাল স্নান সেরে রওনা দিলাম। সোজা শিয়ালদহ ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। এককাপ চা খাওয়ার ইচ্ছে হল। পার্সে হাত দিয়ে দেখি দুশো টাকার মধ্যে একশো টাকা নেই । তন্নতন্ন । খুঁজেও পেলাম না। কোথায় গেল ? আজও সন্দেহ !
৩
খুব খিদে পেয়েছে। সারাদিন কিছু জোটেনি। পকেট ফাঁকা। মেডিক্যাল কলেজের হেলথ ইন্সপেক্টর তপনদা আসেনি। ছুটি নিয়েছে। তপনদার কাছে গেলেই খুব খাওয়ায়। আজ সেই সুযোগও নেই। পকেটে পঁচিশ পয়সা। একটা মাত্র বিস্কুট হবে। চাও জুটবে না। ব্যাগে উচ্চমাধ্যমিকের সাঁতরার বায়োলজি বইটা আছে! জিব শুকিয়ে যাচ্ছে। খিদে চাগার দিচ্ছে। অগত্যা পুরনো বইয়ের দোকানে বইটা বেচে দিলাম। কফি হাউজের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে। মোগলাই আর ব্ল্যাক কফি। সিগারেটে সুখটান।
দৃশ্য ২
সৃজনশীল মানুষের জীবন খুব জটিল। এবং সেই সৃজনশীল মানুষটি যদি কবিতা লিখিয়ে হয়, তাহলে আর রক্ষে নেই ! কারণ কবিতা লিখে কিছু হয় না। টাকা রোজগার হয় না। বাড়ি-গাড়ি হয় না ! আর তুমি তো ওই ছেঁদো পত্রিকাগুলোতে লেখো।উল্টে পকেট থেকে টাকা দিতে হয়। কত কষ্ট করে পত্রিকা করে, একটু আধটু সাহায্য করা দরকার। কবি ! বালের কবি ! রোজগারপাতি নেই কবিতা মারাচ্ছে ! লজ্জাও লাগে না ! সেদিন আমাকে না বলে ব্যাগ থেকে দুশো টাকা নিয়ে ড্যাঙড্যাঙ করতে করতে চলে গেলে কবি সভায়। সেলফি হলো, সেগুলো ফেসবুকে দেওয়া হলো, সন্ধ্যা নাগাদ উনি টলতে টলতে কাব্য মাড়িয়ে ঘরে এলেন। তারপর রাতে জেগে উঠল। দিতেই হবে। না দিলে ওনার ঘুম আসবে না।
দৃশ্য ৩
– অনিলদা কেমন আছো ?
– এই চলছে ভাই। তুমি ?
– আমারও চলে যাচ্ছে দাদা। বলছিলাম “জাগো পৃথিবী” পত্রিকার জন্য লোক নিচ্ছে। শুনলাম তুমি ওখানে দায়িত্বে আছো। একটু দেখো দাদা !
– সে নয় দেখলাম। কাজটা কে করবে ?
– আমি আর আমার অপমান !
দৃশ্য ৪
জয়িতার ফ্ল্যাট থেকে মালপত্র গুছিয়ে কোথায় যাব তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। উত্তরপাড়ার অনিলদা বলেছিল, আমার এখানে চলে আয়। আমি একা মানুষ বিয়েশাদি করিনি অসুবিধা হবে না। তাই অন্য কোন উপায় না পেয়ে সোজা অনিলদার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। সঙ্গে একটা ট্রলিব্যাগ, সামান্য কিছু বইপত্র। বাকি বইপত্র একমাসের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। না নিলে ওজন দরে সব বেচে দেবে। ক্ষোভ নেই, মনখারাপ নেই, চিনচিনে ব্যথা আছে। কবিতার ব্যথা !
মন্তাজ
– স্মৃতি আর শ্রুতিই দুই সতেজ চক্ষু। রোমন্থন তাকে পিছনে ফেরায়নি। এগিয়ে দিয়েছে আরো সামনের দিকে।
– বাবা চলে গেলেন নব্বই সালে। শাসন করার আর কেউ রইল না !
– জীবন তলিয়ে যেতে যেতে কোথায় থামে ? হলুদ রঙা পাখি আমার মা !
ফ্রেম
কোনও মানুষকে পছন্দ হলেও ‘গ্রেসেক্সুয়াল’রা আগে যৌন সম্পর্কের কথা ভাবেন না। আগে সেই মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করেন।
এমনও হতে পারে যে যৌন সম্পর্কের প্রত্যাশা না রেখেই সম্পর্কে সঙ্গীর সঙ্গে জড়িয়েছেন।
বিপদের সময় পাশে থাকেন। কথা বলার সঙ্গী হয়ে ওঠেন। যৌনতা ছাড়াও নিশ্চিন্তের ছোঁয়ার বুঝিয়ে দেন পাশে রয়েছেন।
যৌনতা এঁদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেটাই সব নয়। কাউকে পছন্দ হলে কাছে আসেন এঁরা। তাও সব সময় নয়। নির্দিষ্ট সময়েই যৌন চাহিদা জাগতে পারে।
“আমি” বলতে আমরা কাকে বোঝাই ? ” এই দেহটাই আমি”– একথা ঠিক নয় সব সময়। বরং এটাই সত্যি যে দেহটা আমার। আমি মরে গেলে সব শেষ। কিন্তু আমার চেতনার অনুভব উজ্জীবন সব কিছু জায়মান। এই যে এতক্ষণ একটা কিছু লেখার বা বলার ঢ্যামনামি করলাম সেটাই আমার বেঁচে থাকা। আমি আমার যে বন্ধুটিকে নিয়ে যৌন আকর্ষণ অনুভব করি, আমি জানি সেও করে। অথচ বলে না । বলতে চায় না। তথাপি আমার প্রতি তার প্রাখর্যের অনুশীলন আছে। স্বাভাবিক ভাবেই সে মৌনতার ধ্রুবকে আমাকে প্রবিষ্ট করায়। ছিটকে যেতে যেতে আটকে যাই। আসলে এই জীবনটাই ছিটকে যেতে যেতে আটকে যাওয়ার উদাসীনতা। যেখানে আমি আপনি এই কাহিনীর চরিত্ররা কৃতকার্যের সমাচ্ছন্ন গান্ডু। বেঁচে থাকার ধূসরতা। অ্যাবট্রাকশন। ইতিহাস থেকে আমরা শিখেছি ক্ষমতা-শীর্ষে অবস্থানকারীরাই অ্যাবট্রাকশন নিয়ে এ্যাত মাতামাতি করেন। একে এ্যাতটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়ে থাকে কারণ তা ক্ষমতাশালীকে অন্যদের একীকৃত করে ফেলতে সাহায্য করে এবং এভাবেই প্রান্তিকদের আরো দূরে ঠেলে দেয়। তাই কারো যদি ক্ষমতার রাজত্বে অন্তর্ঘাত ঘটানোর প্রচেষ্টা থাকে তাহলে অ্যাবট্রাকশনের পথ ধরে তা কি সম্ভবপর হবে ? আমি বলছি, হবে। কারণ আমরা বড্ড বেশি প্রতারণা প্রিয়। গ্ৰিকদের কাল থেকে চলে আসা একটি অসামান্য প্যারাডক্স, যা খ্যাত সোরাইটিস প্যারাডক্স নামে। আমি যদি বন্ধু হই, আমি বন্ধুই।প্রেমিক হতে পারবো না। প্রেমিক হওয়ার দিকে দু’পা এগোলেও আমি বন্ধু। এখানে প্রেমিকের হাহাকার থাকলেও বন্ধুত্বের অস্তিত্বে আমি এগিয়ে।
তুমি যদি পদার্থ বিজ্ঞানের সিংগুলারিটি অর্থাৎ মহাকর্ষীয় সিংগুলারিটির কথা বলো তাহলে এটা হলো মহাবিশ্বের স্থান কালের এমন একটি বিন্দু, যেখানে মহাকর্ষ বলের মান অসীম এবং যেখানে সময়ের অস্থিত্ব নেই। উদাহরণ স্বরূপ কোনো কৃষ্ণ গহ্বর অর্থাৎ ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্র। এছাড়া মনে করা হয় এরকম এক সিঙ্গুলার বিন্দু থেকেই বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে
প্রণয় আর পরিণতি কখনো এক হতে পারে না। বরং উল্টোটাই ঘটে। যে মানুষ যাকে পেলে ভাবে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেবে অনায়াসে, পরবর্তী সময়ে ছন্দ কেটে যায়। আবার কারও কারও ছন্দ থেকে সুর তৈরি হয়। নির্ভরতার সুর ! আমার জীবনে সেই সুর কেটে গেছে। এখন অভ্যাস আর কর্তব্যের নিরিখে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া । আজকাল মনে হচ্ছে সেটার খুব প্রয়োজন নেই। ডলি বড় হয়েছে। পড়াশুনো শিখেছে। চাকরি পেয়েছে। এর থেকে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। দীপা ডলির কাছে ভালো আছে। আমাকে তার খুব একটা প্রয়োজন নেই। পৃথিবীতে কত কিছুর প্রয়োজন থাকে না।
– আচ্ছা তুমি সিঙ্গুলারিটির গান গাইতে পারো ?
– সেটা আবার কি বস্তু কমলদা ?
– তুমি যদি গণিতের সিংগুলারিটি র কথা বলো তাহলে গনিতের ভাষায় বললে সিগুলারিটি হলো এমন একটি বিন্দু যেখানে প্রদত্ত গাণিতিক অবজেক্টটি সংজ্ঞায়িত হয় না বা “ভাল আচরণ করে না” উদাহরণস্বরূপ ‘অসীম।’
– এই মরেছে। বেশ ভজোকটো ব্যাপার ।
– কিছুই ভজোকটো ব্যাপার নয়। আমাদের জীবনটাও কি তেমন নয় ?
– হবে হয়তো। জীবন নিয়ে এ্যাত গভীর ভাবে কবে আর ভাবলাম বলো ?
– কিন্তু তুমি যদি পদার্থ বিজ্ঞানের সিংগুলারিটি অর্থাৎ মহাকর্ষীয় সিংগুলারিটির কথা বলো তাহলে এটা হলো মহাবিশ্বের স্থান কালের এমন একটি বিন্দু, যেখানে মহাকর্ষ বলের মান অসীম এবং যেখানে সময়ের অস্থিত্ব নেই। উদাহরণ স্বরূপ কোনো কৃষ্ণ গহ্বর অর্থাৎ ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্র। এছাড়া মনে করা হয় এরকম এক সিঙ্গুলার বিন্দু থেকেই বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে।
– একেবারে চাপ খাইয়ে দিলে। টকিং টোকিও লুকিং লন্ডন। আমি টেরিয়ে গেলাম।
– এটাই তোর সমস্যা । সব কিছুর মধ্যে ফাজলামি। এই জন্য তোর বউ প দিয়ে পোছে না তোকে।
– আমার বউ পোছে না তো পোছে না। তোমার কি সমস্যা।
– না না ভাইয়া। আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি পরিবার নিয়ে আনন্দে থাকো ভালো থাকো এটাই চাই।
– প্রাণিত হলাম দাদা। ভালো থাকবেন।
– তুমি প্রাণিত হলে না অনুরণিত হলে সেটা জেনে আমার লাভ নেই।
– হা হা হা হা ! সেন্টু খেয়েছো। বুঝেছি ।
– আচ্ছা এস্কিমোদের ঘর দেখেছিস ? মানুষ গুলো কেমন হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকে ! পুরুষ মানুষের জীবনটাও ওরকম। নিজের বাড়িতে নিজের বউ ছেলেমেয়েদের কাছে একটা বয়েসর পর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়।
– ভালো বলেছো কমলদা। আমি একেবারেই সহমত।
– আজ তাসের আড্ডায় আসছিস তো ?
– না গো। আসছি না।
মনে মনে বলি, আজকাল আমি একা একা খেলি কমলদা। একা একা তাস খেলার নাম পেসেন্স। আমার খেলায় আমি খুব একা। কোনো ওভারট্রাম নেই। তবে তোমার এক্সিমোদের উপমা মনে থাকবে। আমি খুব একটা সিঙ্গুলারিটি বুঝিনা। প্ল্যুরালিটি বুঝি যে এমনটাও নয়।
জাদু বাস্তবতা
মানুষই হল একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যার যৌন উত্তেজনার সঙ্গে স্তনের সম্পর্ক রয়েছে। অন্য কোনও প্রাণীর ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না।
এরপরও তুমি বলবে আমি কি কারণে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। এই তাকিয়ে থাকাটা প্রতিটি পুরুষের সহজাত। প্রত্যেক মানুষেরই একটা Song of Innocence এর পর্যায় আছে। অবশ্য এই বিষয়টাকে তুমি খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবো না।
যদিও আমি এসব কিছু টের পাবো না । বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে থাকবো । এলোমেলো হাওয়ায় একটা গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ শোনা যাবে। বিকট শব্দ। গাছের পাখিরা কিচির মিচির শব্দে এদিক ওদিক উড়ে বেড়াবে । ভোরের ফার্স্ট প্যাসেনঞ্জার হর্ন বাজিয়ে স্টেশনে ঢুকবে । যেন ঘটমান বর্তমান । যেন নির্ধারিত চিত্রনাট্য। কিন্তু এরপর ? এরপর কি হবে ? গান্ডু আত্মহত্যার পথটাই বেছে নেবে ? নাকি করুণাকে আঁকড়ে ধরে গান্ধর্বের স্বমেহন করবে ?
♦·♦♦·♦♦·♦–♦·♦♦·♦♦·♦
❤ Support Us