- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৪
পাখির মতো জীবন
অলঙ্করণ: দেব সরকার
এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট যখন দিল্লির মাটি ছুঁল তখন বেলা বেশ গড়িয়ে গেছে। প্রেমা আর নীল অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে। দিনটা শনিবার দেখেই টিকিট কাটা হয়েছিল। ওইদিন প্রেমা নীল মানে মেয়ে-জামাই দুজনেরই ছুটি। কলকাতা থেকে শনিবার ভোর সাড়ে ছ‘টার ফ্লাইটে রওনা হয়ে বেলা সাড়ে নটা আন্দাজ দিল্লি পৌঁছেনো যাবে। তারপর সেখানে রবিবারটা থেকে ফের সোমবার কলকাতায় ফেরার ফ্লাইট ধরা হবে। এমন একটা সংক্ষিপ্ত টুরের প্ল্যান করা হয়েছিল। কিন্তু যা পরিকল্পনা করা হয় সবসময় তা মেলে না। শীতের শুরুয়াতেই ইউ পি র আকাশে ঘন কুয়াশা। প্লেন ল্যান্ড করতে না পেরে খানিক ঘুরপাক খেয়ে নামলো জয়পুর। সেখান থেকে প্রায় ঘন্টাদুই পরে ফের উড়ান। দিল্লি পৌঁছোতে বাজলো দেড়টা। নীলের সঙ্গে প্রেমা অবশ্য তখনও অপেক্ষায়। সেক্টর থার্টির সুসজ্জিত ফ্ল্যাটটায় নিয়ে যাবে মা বাবাকে।
খবর এসেছিল নীল আর প্রেমার নাকি সেপারেশন হচ্ছে। তারা নিজেরাই নিয়েছে এই সিদ্ধান্ত। সংগতভাবেই প্রজ্ঞার পছন্দ হয়নি বিষয়টা। যদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিরস্ত করা যায়….যদি কোনো ভুল বোঝাবুঝি ভাঙিয়ে ছেঁড়া সম্পর্ক জোড়া লাগানো যায় নতুন করে। তাই ফোনে নয় দুজনের সঙ্গেই একটু মুখোমুখি বসে কথা বলার জরুরি প্রয়োজনেই হাতে মাত্র দুটি দিন নিয়ে তড়িঘড়ি চোদ্দশো কিলোমিটার পথ উড়ে মেয়ের কাছে এসেছে সোহম আর প্রজ্ঞা।
কয়েকমাস আগেই একবার এসেছিল। দিনদশেক থেকেওছিল। কিন্তু সেবারকার দিল্লিভ্রমণের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিল না প্রজ্ঞার। সামান্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হতেই বিশ্রীভঙ্গিতে সোহম অপমান করেছিল প্রজ্ঞাকে। তারপর যে কটাদিন বাধ্য হয়েই থাকতে হয়েছিল প্রেমার বাড়িতে আগাগোড়াই বাক্যালাপ বন্ধ ছিল স্বামী-স্ত্রীর। নেহাত হপ্তাখানেক পরে রিজার্ভেশন কনফার্ম ছিল রাজধানী এক্সপ্রেসে নাহলে প্রজ্ঞা একাই ফিরে আসতো। সোহমের আসা না আসার পরোয়া করতো না। এই কারণে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল প্রজ্ঞা জীবনেও আর সোহমের সঙ্গে কোত্থাও যাবে না ।
সোহম -প্রজ্ঞার দাম্পত্যের তিরিশ বছর কেটে গেছে। প্রজ্ঞা যথেষ্ট স্বনির্ভর, তবু আজও কেন যে সংসারের বন্ধন ছিঁড়ে বেরোতে পারলো না…..। দীর্ঘ তিরিশ বছরে বলতে গেলে কোনো সাংসারিক দায়িত্বই পালন করেনি সোহম। নিজের আনন্দ নিজের ভালোলাগা নিয়ে নিজের জগতে থেকেছে। কতো অপরিণত ছিল তখন প্রজ্ঞা। নিজের অধিকারটুকু বুঝে নিতেও শেখেনি। সেই ভুল জমতে জমতে আজ পাহাড়। বলতে গেলে তিস্তা যদি প্রজ্ঞার জীবনে না আসতো তাহলে বুঝি কোনোদিন সোহমের এই নীরব বঞ্চনার ছবিটা প্রজ্ঞার চেতনায় ধরাই পড়তো না।
না। সোহম তো গায়ে হাত তোলেনি কখনও প্রজ্ঞার। মাঝেমাঝে কথা কাটাকাটির মুখে কোনো রূঢ় বা কটু শব্দের উচ্চারণ….. এতো স্বামী-স্ত্রী তে হতেই পারে। অথচ এর চেয়ে কতো সামান্য অপমানেই মেয়েরা আজকাল অবলীলায় স্বামী-শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করে। সমাজের ভয়ে লোকলজ্জার ভয়ে সবকিছু মুখবুজে মেনে নিয়ে কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করে দিনের পর দিন নিষ্ফল সংসার করার দিন চলে গেছে। তার কারণ প্রথমত বেশিরভাগ মেয়েই আজকাল স্বনির্ভর। দ্বিতীয়ত মেয়েরা নিজেদের স্বাধীন স্বকীয় অস্তিত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। বহু ব্যাপারেই মেয়েরা শুধু আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বীই নয় নিজেদের অবস্থান সম্পর্কেও সজাগ। এই তো প্রেমাকেই দেখছে প্রজ্ঞা। বিয়ের মাত্র পাঁচ বছর হয়েছে কি হয়নি নীলকে ছেড়ে যেতে চাইছে। প্রথম যখন ফোনে প্রেমা জানালো “মা নীলের সঙ্গে আমার এডজাস্টমেন্টের অসুবিধা হচ্ছে….” হঠাৎ যেন কেমন দিশেহারা লেগেছিল প্রজ্ঞার। পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠেছিল। গোটা দুনিয়াটা দুলে উঠেছিল চোখের সামনে।
প্রজ্ঞাও শিল্পসৌন্দর্য নান্দনিকতাহীন একটা সংসার করে চলেছে সুদীর্ঘকাল গতানুগতিক জরাজীর্ণ অভ্যাসের মতো। বহুবার শত অপমান সত্ত্বেও সংসার ছাড়তে গিয়েও ছেড়ে উঠতে পারেনি সে । নিতে পারেনি কঠিন সিদ্ধান্ত। কেন পারেনি? সে কি একা হয়ে যাবার ভয়? আত্মবিশ্বাসের অভাব?
নীলকে তো আদ্যন্ত খুব ভালো ছেলে বলেই মনে হয়। একেবারে আদর্শ সংসারি ছেলে। তার মতো আইডিয়ালের সঙ্গেও যদি প্রেমা এডজাস্ট করতে না পারে তো দুনিয়ার কারুর সঙ্গেই তো পারবেনা।
প্রেমাকে এখন কী জিগ্যেস করবে প্রজ্ঞা? মানে মা হিসেবে তার কি জিগ্যেস করা উচিত? তাহলে কি নীলের মধ্যে এমন কিছু প্রেমা লক্ষ করেছে যা আবিষ্কার করার পর তার সঙ্গে আর থাকা যায় না এমন ভাবছে? এসব ক্ষেত্রে সব মা মানে আগের প্রজন্ম যা ভাবে প্রজ্ঞাও কি সেই চেনা ফর্মূলাতেই ভাববে? মানে প্রেমাকে বোঝাবে? বিয়ে-সংসার এসব ছেড়ে যাওয়া ভালো নয় সেই বস্তাপচা কথাটা বলবে ? মেয়ে গোঁয়ার্তুমি করে স্বামীর বাড়ি ফিরতে না চাইলে কি জোর করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে সেখানে ফেরত পাঠাবে?প্রজ্ঞার কেমন অসহায় লাগে।
একটা দাম্পত্য শেষ হয় পরস্পরের অসহযোগিতায়। বিশ্বাসভঙ্গের কারণে। কিন্তু নীলকে দেখে তো তেমন কোনোদিন মনেই হয়নি।তবে কী এমন উপলব্ধি হলো হঠাৎ যে এতোবড়ো সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজন ঘটলো ? ডিগ্রিকোর্সের নতুন সিলেবাসের টেক্সট “শেষের কবিতা”পড়াতে গিয়ে একটা লাইনে কতোবার যে চোখ আটকে গেছে প্রজ্ঞার…”দাম্পত্য একটা আর্ট। তাকে প্রতিদিন ঠিকমতো লালন করতে হয়…”
নাহ নিজের জীবনে এই আর্টের মর্ম কোনোদিনই প্রায় অনুভব করেনি প্রজ্ঞা। তার নিজের অনেক কিছুই বেশ আর্টিস্টিক। কিন্তু নিজের দাম্পত্যে অন্তত আর্ট বা এসথেটিক্সের বালাই নেই। বিয়ে সংসার এসব একটা বয়সে মানুষকে করতে হয়, প্রায় সব মানুষই করে থাকে এমন একটা ভাবনা থেকে প্রজ্ঞাও শিল্পসৌন্দর্য নান্দনিকতাহীন একটা সংসার করে চলেছে সুদীর্ঘকাল গতানুগতিক জরাজীর্ণ অভ্যাসের মতো। বহুবার শত অপমান সত্ত্বেও সংসার ছাড়তে গিয়েও ছেড়ে উঠতে পারেনি সে । নিতে পারেনি কঠিন সিদ্ধান্ত। কেন পারেনি? সে কি একা হয়ে যাবার ভয়? আত্মবিশ্বাসের অভাব?না কি অভ্যাসের কঠিন গ্রন্থিতে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছে যে সে গিঁট খুলে বেরোনো ভারি কঠিন।
প্রজ্ঞা এখন তাকে অভ্যাস বলেই মেনে নিয়েছে।গতানুগতিকতার মধ্যে নতুনত্বের সন্ধান করাটা যে চরম ভুল পরম বোকামি তা যে কোনো মানুষই বোঝে। তাহলে কী ছাইভস্ম লিখলেন রবিঠাকুর? দাম্পত্য আর্টিস্টিক না হয়ে হয়ে গেল নিত্যনৈমিত্তিক কিছু আচরণ
প্রেমা যখন ছোট ছিল বেশ কিছুদিন সোহমের থেকে পৃথক থেকেছিল প্রজ্ঞা। তখন বয়েস কম। মনের জোরও বেশি। ছেড়ে থাকার অভ্যাসটাও ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল একার সংসারে। চার/পাঁচ বছরের ছোট্ট প্রেমা আর একজন মাঝবয়সি কাজের মেয়ে নিয়ে একলাই জীবনযুদ্ধে লড়াইএর ময়দানে নেমেছিল প্রজ্ঞা। কিন্তু মাত্র কটাদিন। সমর্থন করেনি কেউ প্রজ্ঞার এই একলা চলার সিদ্ধান্ত। শ্বশুর শাশুড়ি প্রতি সপ্তাহে হানটান করতেন তাদের জেদি অবাধ্য বৌমাটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। সোহমও মেয়েকে দেখার অছিলায় আসতো প্রায়ই। বৌ শিশুকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে নিজস্ব আস্তানায় চলে গেছে এ কম বড়ো সামাজিক অসম্মান নয়। হয়তো সেই অসম্মান থেকে বাঁচতেই তাঁরা একটা প্রায় ভেঙে পড়া সম্পর্ককে কোনোরকমে জোড়া দিতে চেয়েছিলেন সমবেতভাবে। পৃথক সংসারে প্রজ্ঞার কেটেছিল প্রায় বছর দুই। কিন্তু তারপর? খুব বেশিদিন আর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি প্রজ্ঞা। ঘর বার নিকট আত্মীয় পরিজন সক্কলের এক নাগাড়ে জোরালো অনুরোধ কাকুতিমিনতির কাছে দুর্বল হয়ে মাথা নত করেছিল শেষপর্যন্ত । সোহমের সঙ্গে ফের থাকতে শুরু করেছিল। কিন্তু তাতে আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধব খুশি হলেও প্রজ্ঞা কি সত্যিই খুশি হয়েছিল? বাইরের লোকের হাতে একটা শতচ্ছিন্ন সম্পর্ক জোড়াতাড়া দিয়ে সেলাই করে মেরামত করে ফের নতুন করার চেষ্টায় প্রজ্ঞার কি সত্যিই ভেতর থেকে সমর্থন ছিল? সে কি আনন্দ বা স্বস্তি পেয়েছিল তার জীবনে সোহমের পুনরাগমনে? চারপাশের বেশ কিছু মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল বাইরের এই ছবি দেখে যে প্রজ্ঞা আর সোহমের বিয়েটা টিঁকে গেল এ যাত্রা। যেন দাম্পত্যকে যে কোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রাখাটাই বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের একমাত্র লক্ষ্য। সেই থেকেই তো একভাবেই চলছে। প্রজ্ঞা আর সোহমের মাঝে বেশ কিছু সাংসারিক টানাপোড়েন, চিন্তা চেতনার বিস্তর ফারাক সত্ত্বেও এক হাঁড়ি-পাতিলের সংসারে এক ছাতের তলায় তারা রয়ে গেছে বছরের পর বছর। প্রজ্ঞা এখন তাকে অভ্যাস বলেই মেনে নিয়েছে। যেমন যে কোনো অভ্যাস তা মন্দ হলেও মানুষ বিনা প্রশ্নে তার অনুষ্ঠান করে চলে। গতানুগতিকতার মধ্যে নতুনত্বের সন্ধান করাটা যে চরম ভুল পরম বোকামি তা যে কোনো মানুষই বোঝে। তাহলে কী ছাইভস্ম লিখলেন রবিঠাকুর? দাম্পত্য আর্টিস্টিক না হয়ে হয়ে গেল নিত্যনৈমিত্তিক কিছু আচরণ? দৈনন্দিন অভ্যাস? অথচ প্রেমার ক্ষেত্রে…কী এমন কারণ ঘটলো যে অল্পেই স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে ফাটল ধরলো ? নীলের সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ কী সমস্যা দেখা দিল যে প্রেমা বাসস্থান আলাদা করার কথা ভাবছে?
প্রথম যখন শুনেছিল ভারি অদ্ভুত লেগেছিল। নীল তো সত্যিই খুব চমৎকার মানুষ। পুরুষমানুষ মাত্রেরই যে প্যাট্রিয়ার্ক্যাল ইগো থাকে,সেন্স অফ সুপ্রিমেসি থাকে সেসব তো নীলের মধ্যে কখনও কেউই দেখেছে বলে মনে হয়না। আপাতভাবে দেখে মনে হয় নীল প্রেমা পরস্পরকে গভীরভাবে ভালোওবাসে। তাহলে এতো পজিটিভিটির মধ্যেও কী নেগেটিভিটি এলো যে একে অন্যের থেকে আলাদা হতে চায়? প্রেমার কাছে গোটা ব্যাপারটাই যেন অবিশ্বাস্য জটিল ধাঁধার মতো মনে হয়। তবে একেই কি বলে জেনারেশন গ্যাপ? টেলিফোনে সবটুকু শুনে হতভম্ব প্রজ্ঞার সাময়িকভাবে মনে হয়েছিল দাম্পত্য একটা অদ্ভুত রহস্য। মনে এসেছিল জীবনানন্দের কবিতা “ প্রেম ছিল আশা ছিল /বধূটিও শুয়েছিল পাশে /তবু সে দেখিল কোন ভূত/ ঘুম কেন ভেঙে গেল তার/অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল /লাশ কাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার/ কোনোদিন জাগিবেনা আর/জানিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম ভার সহিবেনা আর…”
প্রেমার কাছে ফোনে এই বিচ্ছেদ পরিকল্পনার কথা শুনে প্রজ্ঞা বিহ্বল দশা কাটিয়ে জিগ্যেস করেছিল ব্যাকুলভাবে…”কী সমস্যা হলো হঠাৎ বাবু তোমাদের? আদর করে একমাত্র মেয়েকে “বাবু” বলেই ডাকে প্রজ্ঞা।
শান্ত ধীর প্রেমা উত্তর দিয়েছিল “ কিচ্ছু হয়নি মা। জাস্ট এ ব্রেক। আমাদের মধ্যে কোনো ডিফারেন্স অফ ওপিনিয়ন নেই। উই আর এক্সট্রিমলি হ্যাপী উইথ ইছ আদার ”।
“আশ্চর্য! তাহলে কেন এই ধরণের কথা বলছো ?কী ভাবছো দুজনে ? তোমরা কি দুজনেই এরকম ভাবছো ?না কি শুধু তুমি একাই ভাবছো।নীল কি তোমার সঙ্গে সহমত?”একটু ঝাঁঝিয়েই কথাগুলো বলে ফেলে প্রজ্ঞা।
“মা আমরা দুজনেই ভেবেছি…..আমি একা নই”….প্রেমা বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে।
“কী যে বাবা আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতিগতি বুঝিনা…। দুজনের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই। ঝগড়াঝাঁটি নেই,মতান্তর মনান্তর নেই। দুজনেই ভালো চাকরি-বাকরি করছো। চারহাতে প্রচুর রোজগার করছো। যখন খুশি প্লেনে চড়ে বেড়াতে যাচ্ছো। জামাকাপড় শখের জিনিস ইচ্ছেমতো কিনছো।রেস্টুরেন্টে খাচ্ছো…তাও বলছো আলাদা হবে? এ কেমনধারা ভাবনা আমার মোটে বোধগম্য হচ্ছেনা…” প্রজ্ঞা বলে।
“মা এগুলো মানুষের জীবনের খুব প্র্যাগম্যাটিক চাহিদা…কিন্তু এর বাইরেও কতো মানুষের কতো রকম ইচ্ছে কতো রকম স্বপ্ন থাকতে পারে তুমি কি তার সবটুকু বুঝতে পারবে বাইরে থেকে?” প্রেমা বেশ আন্তরিকতার সঙ্গেই বলে কথাগুলো।
“না বাপু আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। আমি জানি মানে এতোদিন জেনে এসেছি দুজন মানুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যে সংসার তৈরি হয় তা এক কথায় ভেঙে ফেলা উচিতও নয় সঠিকও নয়। এই সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে স্বামী স্ত্রী সন্তানের মধ্যে আমৃত্যু এক ধরণের বন্ধন তৈরি হয়। যার কেন্দ্রে থাকে পারস্পরিক দায়িত্ববোধ প্রেম ভালোবাসা মায়ামমতা।”
“তোমার আর বাবার দাম্পত্য জীবনে তো এগুলোর কোনোটাই নেই মা । না আছে সহযোগিতা না আছে দায়িত্ববোধ।প্রেম-ভালোবাসাও তো আছে বলে মনে হয় না আছে। যা আছে তা শুধু অভ্যাস। আর তোমরা এগুলো খুব ভালো করেই জানো যে এক চরম শূন্যতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে তোমাদের দাম্পত্য। তবু তোমরা একসঙ্গে এখনও আছো। কেন কে জানে? আসলে তোমরা বিচ্ছিন্ন হতে ভয় পাও।” প্রেমা বলে।
“হয়তো তাই…আমরা আগের যুগের মানুষ। আমি তোমার বাবাকে ছাড়বার আগে তোমার কথা ভেবেছি। তোমার সোশ্যাল পজিশন। তুমি কতোটা নিতে পারবে এই বিচ্ছেদ….এমন অনেক কিছুই ভাবতে হয়েছে আমাকে।” প্রজ্ঞা বলে।
“এতোসব ভাবতে গিয়ে নিজের জন্য ভাবতে ভুলে গেছো মা। এখন সেজন্য কতো ব্যাপারে কতো আফশোস তোমার।” প্রেমা বলে।
“আমি তোমার জন্য ভেবেছি বাবু। তুমি আমার একটিমাত্র সন্তান। বাপ মা রা সন্তানের জন্য ভাবেন।মা রা একটু বেশিই ভাবেন। স্যাক্রিফাইস করেন তাঁরাই বেশি।যেহেতু সন্তানকে ধারণ করেন তাঁরা। কষ্ট করে জন্ম দেন”। প্রজ্ঞা বেশ গর্ব করেই বলে।
“তাহলে ঘরে ঘরে এতো বিচ্ছেদ কেন মা? এতোদিন ভাবতে ইস্ অমুকের ছেলে বৌএর ডিভোর্স হয়ে গেল,কী কষ্ট!!…অমুকের মেয়ে স্বামীকে ছেড়ে বাপের বাড়িতে ফিরে এলো, কী কষ্ট !!! …এখন তোমার বাড়িতেই একই ঘটনা ঘটতে চলেছে বলে কি খুব অপ্রস্তুতে পড়ে গেলে মা?”
“না তা কেন ভাববো? বিয়ে করা মানে তো আর দাসখৎ লিখে দেওয়া নয় যে…..লাথি ঝাঁটা মারধোর অপমান অসম্মান সয়েও থাকতে হবে লোক দেখানো সাজিয়ে রাখা মেকি দাম্পত্য আঁকড়ে? সম্পর্ক যদি টেঁকার না হয় তো জোর করে তাকে টিঁকিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু বিচ্ছেদের একটা সংগত কারণ থাকতে হবে তো?”প্রজ্ঞা বলে।
“মা বিচ্ছেদের যে কারণগুলো তুমি বললে সেতো সব বাইরের কারণ। তার থেকেও আলাদা তার থেকেও সূক্ষ্ম কিছু ভেতরের কারণও তো থাকতে পারে….যেটা একমাত্র যাদের জীবনের ঘটনা তারাই জানে। বাইরের কারুর পক্ষে সে তিনি মা-বাবা-প্রেমিক বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু যে ই হোন জানাটা সম্ভবই না।”খুব শান্ত গলায় কথাগুলো বলে প্রেমা।
কী জানি কবে এতোবড়ো হয়ে গেল প্রেমা? মেয়ের মুখের দিকে হাঁ করে থাকিয়ে থাকে প্রজ্ঞা।কতো অবলীলায় কথাগুলো বলছে প্রেমা। আর যতোবার বলছে তিরের ধারালো একটা ফলা যেন একবারে গেঁথে যাচ্ছে হৃৎপিন্ডটার গভীরে । ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত করে দিয়ে চলে যাচ্ছে ভেতরটাকে।
নীলের মা যেদিন চলে গেলেন মা-মরা ছেলেটাকে সেইদিন থেকে মাএর সবটুকু স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছিল প্রজ্ঞা। যেদিন প্রথম জেনেছিল একমাত্র কন্যা প্রেমা আর নীলের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ভালো লেগেছিল বললে কম বলা হবে। অনেকটা নিশ্চিন্ত লেগেছিল। বিদেশবিভুঁইয়ে একটা ভরসা করার মতো বন্ধু পেয়েছে প্রেমা। বছর চারেক মেলামেশা করার পর তাদের চারহাত এক করে দিতে পেরেও কম স্বস্তি তৃপ্তি পায়নি দুই পরিবার। কিন্তু এ সবই যে তাৎক্ষণিক ভাবনা এর কোনোটারই যে তেমন স্থায়িত্ব নেই তা ভাবেনি প্রজ্ঞা। সোহমও ভাবেনি নিশ্চয়ই। ভাবেননি নীলের বাবা দিদি কেউই। এখন কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই বৈবাহিক ব্রতকে অস্বীকার করে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে এরা। পাখির মতো একলা স্বরাট স্বাধীন জীবন চাইছে।
এই তো সেদিনও দেখছিল প্রজ্ঞা জানলার সানশেডের পেছনে বাসা বাঁধল পায়রারা। তার মধ্যেই একদিন একজোড়া ডিম দিল মেয়ে পায়রা। তারপর রোজ চলতে লাগলো ডিমে তা দেওয়া। ডিম ফুটে পায়রার শাবক হলো একদিন। তাকে খাওয়ানো উড়তে শেখানো সব কর্তব্য করলো পায়রা দম্পতি। তারপর একদিন বাসা ছেড়ে উড়াল দিল সবাই। দূর আকাশে। বৃহৎ পৃথিবীতে। কেউ কি কারো খোঁজ রেখেছে? তাদের কাছে তখন একমাত্র সত্য শুধু মহাকাশের মহাশূন্য আর এই মহাপৃথিবী। হয়তো ক্লান্ত ডানা জিরোবার জন্য কখনও কোনো উঁচু কোনো গাছের ডাল।
ফোনে প্রেমার কথা শুনে এক বুক উদ্বেগ নিয়ে তড়িঘড়ি ছুটে এসেছিল প্রজ্ঞা আর সোহম। মাঝে মাত্র কটা দিন। বাসা ভাড়া করা হয়ে গেছে প্রেমার। আর হপ্তাখানেক পরেই সেই আলাদা বাসায় শিফ্ট করে যাবে । নীল থাকবে তার আগের বাসাটিতে।
কী অদ্ভুত আয়রনি। সোহমের সঙ্গে আজকাল আর একটা প্রহরও কাটাতে ইচ্ছে করেনা প্রজ্ঞার। সারাজীবন ছলনা করে গেলো সোহম প্রজ্ঞার সঙ্গে। প্রজ্ঞার শ্রম, ধৈর্য,সহ্যের বিনিময়ে আজ সোহম এর নামডাক পরিচিতি খ্যাতি প্রতিপত্তি। প্রজ্ঞা তো তা চায়নি। নির্ভর করার মতো বিশ্বাস করার মতো একজন ভালো বন্ধু চেয়েছিল । বন্ধুর বদলে সে পেল শোষক। যে সংগোপনে শোষণ করে নিজের স্ত্রীকে। স্ত্রীকে সারাজীবন আর্থিক অনিশ্চয়তার উদ্বেগে রেখে দেয় । বাহ্য কথার রংচং এ বাহার দিয়ে সে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করে। ভাষার যাদুতে বাকপটুত্বের ভাঁজে সুকৌশলে লুকিয়ে রাখে তার আসল ব্যক্তিত্ব। আসল সত্তা চাপা পড়ে যায় জেল্লাদার জৌলুসি বাকচাতুরির চকমকিতে।
সোহমের সঙ্গে এয়ারপোর্টে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল প্রজ্ঞা…কেমন নিখুঁত সাজানো একটা মেকি দাম্পত্য নিয়ে একজন ভুল মানুষের সঙ্গে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিল সে। সবাই দেখলো কী প্রতিভাবান মানুষ এই সোহম ঘোষ। কতো লেখা। কতো বক্তৃতা। সভাসমিতির কতো অজস্র বরণমাল্য । কেউ কি জানলো নিজের ভরণপোষণ চালানোরও সম্বলটুকু নেই সোহম ঘোষের? আজ প্রজ্ঞা বসু না থাকলে সেলিব্রিটি হওয়া হোত সোহম ঘোষের? কিন্তু প্রজ্ঞা সমাজের কাছে কখনও বুঝতেই দিল না কিছু। কেউ জানতেই পারলো না সোহম ঘোষের খ্যাতির পিছনে ঠিক কার কতোখানি ভূমিকা ? কে নিজের জীবনকে বাজি রেখে পথের সমস্ত খানাখন্দ অন্ধ কানাগলি পার করে সমাজের চোখের সামনে পরিশীলিতভাবে দিনের পর দিন উপস্থাপন করে চলেছে সোহম ঘোষকে। সোহমকে ছাড়বার সিদ্ধান্ত নিয়েও যে আজ পর্যন্ত তাকে ছাড়তে পারেনি প্রজ্ঞা সে কি তার দুর্বলতা? সমাজের চোখের সামনে সুখী স্বামীস্ত্রী হিসেবে নিজেকে সাজিয়ে রাখার লোভ ? একলা চলতে গেলে ঝুঁকি নিতে হয়। প্রজ্ঞা বসুকে সবাই জানে সে যেমন আধুনিক তেমনিই সাহসী। তবে কি তারও মনে মনে একা হয়ে যাবার ভয়? সমাজ কী বলবে… বাঁকা চোখে চাইবে…এসব সাতপাঁচ ভেবেই কি সোহমের হাজার অন্যায়কে মেনে নিয়ে মুখ বুজে থাকে সে? তাহলে সেও তো কম ভন্ড নয়…
প্রেমা আর নীল কোনো নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে আলাদা হতে চাইছে। ওরা আজকালকার ছেলেমেয়ে। নিজেদের ভালোলাগা গুলোর মূল্য গৌণ করে পরে অনুশোচনা করে লোকের কাছে সস্তা সান্ত্বনা কিনতে চায়না। বরং সমাজ লোকলজ্জা সমালোচনা এসবের মুখ সপাটে বন্ধ করে ছোট্ট এই জীবনটা নিজেদের মতো করে নিজেদের ছোটখাটো সুখদুঃখ ভালোবাসা ভালোলাগা আনন্দ গুলো দু’হাতে চেটেপুটে নিয়ে বাঁচতে চায়। সংক্ষিপ্ত জীবনটা সফল করতে চায়।
দিল্লি এয়ারপোর্টটা মস্ত বড়ো। সিকিউরিটি চেকিং এর লম্বা লাইনে দাঁড়ালো একপাশে প্রজ্ঞা অন্যদিকে সোহম।বোর্ডিং পাস আগেই করিয়ে রেখেছিল প্রেমা। এবার গেটে পৌঁছোতে হবে। পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাঁটা শুরু করলো । দুদিনের জন্য মেয়ে জামাইএর বাড়ি এসে মোটে ব্যায়াম করা হয়নি। পা টনটনিয়ে উঠছে। কোমরেও ইদানিং বেশ ব্যথা অনুভব করে প্রজ্ঞা। সোহমের এ ব্যাপারে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কোনোকালে ছিলোও না। একিউট আর্থ্রাইটিসের পেশেন্ট প্রজ্ঞা। কতো রাত কতো দিন কতো যন্ত্রণা সয়েছে সে। সংসারের কাজ করতে করতে ব্যথায় কোমর টনটনিয়ে উঠলেও কখনও একটু ভলিনি নিয়ে এগিয়ে আসার মন হয়নি সোহমের। আগে আগে এসব নিয়ে অভিমান হোত। এখন কেমন যেন সয়ে গেছে সবকিছু। অনুরাগ -অভিমান অবশিষ্ট নেই কিছুই।
এবারের সংক্ষিপ্ত দিল্লিযাত্রায় হঠাৎ করে খানিক টাকা খরচ হয়ে গেল। কিন্তু প্রেমার কাছে প্রজ্ঞা শিখলো অনেক কিছু। প্রেমা মা কে বুঝিয়ে দিলো স্বামী স্ত্রীর পৃথক হতে গেলে সবসময়ই কিছু না কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবেই এমন কথা নেই। বরং যেখানে ঘটনার ক্রমাগত ঘর্ষণে সব অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায় সেখানে তারাই পারেনা পুরোনো জায়গার পুরোনো অভ্যাস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। আর যারা একঘেয়ে অভ্যাস থেকে বেরিয়ে বিচ্ছিন্ন থাকে হয়তো তাদের সম্পর্কে বৈচিত্র্য আসে। সেক্ষেত্রে কিছু নবীকরণও ঘটতে পারে সম্পর্কের।
পুরোনো অভ্যাস ত্যাগ আর হয়তো নবীকরণের আকর্ষণেই প্রজ্ঞা এগিয়ে চলে একলা।কোমর আর হাঁটুর ব্যথা অগ্রাহ্য করেও নিজের লাগেজটুকু নিয়ে একাই এগিয়ে যায়। সোহমকে অনেক পেছনে ফেলে পৌঁছে যায় সে একচল্লিশ নং গেটের রানওয়ের কাছে।
♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦
❤ Support Us