Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪

পার্সেল

সোমা দত্ত
পার্সেল

 
বৌদি তোমার পার্সেল এসেছে গো। দরজাটা খুলে রূপা ফের মায়ের ঘরের দিকে চলে গেল। হাতে পার্সেল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বছর কুড়ি বাইশের একটি ছেলে। সাধারণত আগে ফোন করে তারপরেই ডেলিভারি দিতে আসে এরা। একটু অবাক হল শ্রুতি। অবশ্য চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল। ফোন আসলেও হয়তো শুনতে পায়নি। পার্সেলটা হাতে দিয়েই দ্রুত চলে গেল ছেলেটি। শ্রুতি ভেবেছিল ওর বা সায়কের দেওয়া কোনো অনলাইন অর্ডার হয়তো। সে ক্যাশ অন ডেলিভারি মোডে অর্ডার করে। সায়ক অবশ্য অনেক সময় আগেই পে করে দেয়। শ্রুতি পার্সেলটা উল্টেপাল্টে দেখে  কোথা থেকে এসেছে তার কোনো ঠিকানা লেখা নেই। একদিকে শুধু শ্রুতির নাম আর ঠিকানাটা লেখা রয়েছে। কিন্তু সেও সম্পূর্ণ ঠিকানা নয়। ফ্ল্যাট নম্বর বা অ্যাপার্টমেন্টের নামটাও লেখা নেই পর্যন্ত। প্রাপকের নাম, রাস্তার নাম, অঞ্চলের নাম আর পিন কোড লেখা আছে।

 

প্যাকেটটা ছিড়ে ফেলল শ্রুতি। ভিতরে আরও একটা কাগজের প্যাকেট। তার ভিতরে একটা বই। বই কে পাঠাল তাকে–!  নিশ্চই তার নামে সায়কের কোনো পার্সেল আসবে না। তাছাড়া বইপত্রের সঙ্গে সায়কের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। খবরের কাগজটাও রাখে না বাড়িতে। খবরাখবর রাখার জন্য ইন্টারনেটকে যথেষ্ট বলে মনে করে। সবথেকে বড় কথা হল, সায়কের কোনো ডেলিভারি থাকলে আগে থেকেই ও ফোন করে দেয়। সুতরাং নিশ্চিত যে এ সায়কের পার্সেল নয়।

 

বইটার নামটিও বড় অদ্ভুত।  ‘আত্মরক্ষার দশটি উপায়’। লেখকের নাম অভিমন্যু। পাতা ওল্টালো শ্রুতি। কবিতার বই মনে হচ্ছে দেখে। বাংলা কবিতা সেই কবে স্কুলে থাকাকালীন পড়েছে সে প্রায় কিছু মনেই নেই শ্রুতির। সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল। মা পড়াত এবং খুবই নম নম করে পাশ করত এটুকু মনে আছে। আজকাল ফেসবুকের দৌলতে অবশ্য কয়েকজন কবির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার। বাংলা কবিতাও পড়ছে সে মাঝেমধ্যে। বেশ ভালো লাগছে। তাই বলে এইরকম অ্যামেচার ব্যাকগ্রাউন্ডের কাউকে কবিতার বই কেউ কেন পাঠাবে ! শ্রুতি বইটা ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখল।

 

প্যাকেজিং এর ছেঁড়া প্যাকেটটাও ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখল। কোথাও ঠিকানা লেখা নেই। তাহলে ভুল জায়গায় চলে এসেছে কী পার্সেলটা– সন্দেহ হয়।কাছাকাছির মধ্যে শ্রুতি ঘোষ আর কে আছে। তেমন তো কাউকে মনে পড়ছে না। বইটা উল্টে পাল্টে ভালো করে দেখতে থাকে শ্রুতি । আরও একটা জিনিস চোখে পড়ে। বইটার মধ্যে বুকমার্ক রাখা আছে। একটা নয়, দশটা বুকমার্ক রয়েছে। আশ্চর্য তো ! দশটা বুকমার্ক কেন দিয়েছে ? ভুল করে একটা দুটো বেশি চলে আসতে পারে। তাছাড়া বুকমার্কগুলোর মধ্যে এক, দুই করে দশ পর্যন্ত মার্ক করে দেওয়া। দশটা বুকমার্ক কেন কেউ ভুল করে পাঠাবে !

 

প্রত্যেকটার ডিজাইন তীরের ফলার মতো। ফলার উপরের লম্বা অংশে এক,দুই করে নম্বর দেওয়া।

 

শ্রুতি পাতা উল্টে দেখল প্রতি দশটি পাতা অন্তর একটা করে বুকমার্ক রাখা। তারমানে প্রেরক খুব বুঝেশুনেই দশটি বুকমার্ক রেখেছে। কৌতূহলে গলা শুকিয়ে আসছে। টেবিল থেকে বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে গলায় বেশ কিছুটা জল ঢালল শ্রুতি। তারপর বইটা নিয়ে বসল ফের। দশ নম্বর পাতায় প্রথম বুকমার্ক। তারপর কুড়ি নম্বর পাতায়, তারপর তিরিশ। মোট বেয়াল্লিশটা কবিতা রয়েছে বইটায়। শ্রুতি অবাক চোখে দেখতে থাকে বুকমার্কগুলো। নিশ্চই অর্থবহ কিছু একটা রয়েছে এর মধ্যে যা সে বুঝতে পারছে না। বইটা ফের ছেড়া প্যাকেটের মধ্যে ভরে রাখল শ্রুতি। পরে হাত খালি হলে মনোযোগ দিয়ে দেখবে। এখন চা বসাতে হবে একটু। মায়ের বিকেলের খাবারটাও করা হয়নি।

 

জীবনের রোমান্টিক দিকগুলো বহুদিন হারিয়ে গেছে । সেই কবেকার এক প্রেম কলেজ জীবন থেকে শুরু হয়ে কয়েক বছর পরে যুগের প্রতিযোগিতায় হারিয়ে গেছিল । শতকরা সত্তরজন বাঙালি মেয়ের বিবাহিত জীবনের মতো চর্যা বহাল রয়েছে তার জীবনে । দায়িত্ব, কর্তব্য, ঘুরতে যাওয়া সবই রয়েছে, কিন্তু সেই বনকলমি লতার গন্ধটা

 

শ্রুতির কাছে সবথেকে সুবিধার সময় হল রাত। ওইসময় কোনো কাজ, কর্তব্যের চাপ নেই, চিন্তা নেই। নিজের মতন করে থাকা যায়। অবশ্য সেটাও সবে এই ছ’মাস হল পাওয়া যাচ্ছে। ছেলেকে কোটায় পড়তে পাঠানোর পর, ওর ঘরটা দখল করা গেছে তাই। নাহলে এ বাড়িতে সর্বমোট তিনটে ঘর। একটাতে শাশুড়ি, একটা তার আর সায়কের, একটা ছেলের। ছেলে থাকাকালীন তার ঘরে যখন তখন এন্ট্রি ছিল না কারও। শাশুড়ি মা আজ পাঁচবছর হল প্রায় শয্যাশায়ী। তাকে দেখভাল করে রূপা। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত থাকে। রাতটা শ্রুতির দায়িত্ব। বাসনমাজা, ঘর ঝাড়পোছের আলাদা লোক রয়েছে। একটা সংসারের কাজ কম নাকি। বিশেষ করে একজন মানুষ যদি বিছানায় থাকে। শ্বশুরমশাই চলে যাওয়ার একবছরের মধ্যেই মায়ের সেরিব্রাল স্ট্রোক হল। তারপর থেকে তো বিছানাতেই প্রায়। একটা দিক প্রায় অসার।  রূপার সাহায্যে বাথরুম পায়খানা আর স্নানটা কোনমতে বাথরুমে সারেন। বিকেলবেলায় লাগোয়া ব্যালকনিতে মিনিট পনেরো বসেন। তারপরেই ঘরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কতক্ষণে গিয়ে শোবেন। একটা টিভি আছে ঘরে। তাতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যত সিরিয়াল হয়ে যায়, একটিও বাদ পড়ে না। মায়ের ওষুধপত্র, জামাকাপড় ধোয়া কাচা, ঘর পরিষ্কার সবই রূপা করে। কিন্তু ওই মায়ের ঘরেই যা করবার করে। ওই ঘরের বাইরে রূপা একটি কাজও করবেনা মায়ের খাবার দাবার, সময়ে ফলের রস, চা ইত্যাদি শ্রুতিকেই করতে হয়। তাছাড়া এ বাড়িতে রান্নাবান্নারও প্রচুর হিরিক রয়েছে। সায়ক রসে বসে থাকা লোক। খাওয়া দাওয়া বিষয়ে খুতখুঁতে। তেল মসলা ঘি সহযোগে নিত্যনতুন খাওয়ার ধারা তার। এদিকে মা খাবেন প্রায় বিনা তেলের রান্না, সবজি সিদ্ধ, স্যুপ জাতীয় খাবার। সব মিলিয়ে রোজ চার পাঁচ রকম কী তারও বেশি সংখ্যক পদে রান্না করতে হয়। বাড়িতে লোকজন আসার ঝামেলাও লেগেই রয়েছে। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেছে সায়ক সে প্রায় বছর দুই হতে চলল। নতুনই বলতে গেলে। ফলে সব সময় সে ব্যস্ত। শ্রুতি চাকরি বাকরি কিছু না করেও সময় পায়না একটুও। এতদিন তো এই এত ফিরিস্তির সঙ্গে ছেলের পড়াশোনাটাও ছিল। স্কুল, টিউশন, আঁকার স্কুল হাজার একটা ঝঞ্ঝাট। এখন এই কোটাতে পড়তে পাঠিয়েছে ওর বাবা তাই মনটা খারাপ হলেও কাজটা একটু কমেছে। সারাদিনের পর রাতে যে একটু নিজের মতো করে সময় কাটাবে শ্রুতি সে উপায় পর্যন্ত ছিল না। বন্ধুদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে একটু আড্ডা দিতে গেলেও সায়কের চোখে আলো পড়ে ঘুমের অসুবিধা হয়। খাওয়ার ঘরে বসে বসে আড্ডা দিতে হয় তাহলে। আগে শ্রুতি একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরি করত। তখন জীবনটা অন্যরকম ছিল কিছুটা। পাখির ডানায় ভাসত। ছেলে ক্লাস সেভেনে উঠল, শ্বশুরমশাই চলে গেলেন, শ্রুতিকেও চাকরিটা ছেড়ে দিতে হল। তারপর থেকেই চলছে এই ঘানি টানা।

 

সেই পাখির ডানায় ভেসে থাকা জীবনটার কথা মনে করছিল শ্রুতি দুধটা গ্যাসে বসিয়ে। অন্যমনস্কতায় উথলে পড়ে গেল খানিকটা। তাড়াতাড়ি সচেতন হয়ে উঠে গ্যাসটা কমিয়ে চা ছেঁকে নিল কাপে। ঘুরে ফিরে পার্সেলটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ইদানিং ফেসবুকের সুবাদে অনেক নতুন মানুষের সঙ্গে টুকটাক পরিচয় হয় শ্রুতির। ওই ফেসবুকের মধ্যেই সীমিত যদিও তবুও বেশ লাগে। রাতে এখন ছেলের ঘরেই শোয়  সে। একটু ফেসবুক করে। এর ওর পোস্ট দেখে কমেন্ট করে। নিজেও অল্পবিস্তর পোস্ট করে। ওখান থেকেই কি কেউ পাঠাল ? শ্রুতি মনে করার চেষ্টা করল। আছে কয়েকজন যাদের কথা ভাবা যেতে পারে। কবিতা লেখে এরকম দু তিনজনের কথা মনে পড়ল।

 

শ্রুতির শরীরটা যেন রহস্য রোমাঞ্চের মতো ছমছমে হয়ে উঠল। সে ছাড়া আর কে লিখতে পারে এমন ? বরুণ সেন ? সেও তো কবিতা লেখে। না এই শব্দ, এই অনুভূতি বরুণ সেনের লেখায় পায়নি শ্রুতি। এই ভাষা, এই আকুলতা ইমতিয়াজের। কিন্তু তাকে এমনভাবে লিখেছে ইমতিয়াজ ?  কবির নাম অভিমন্যু লেখা কেন তবে ? ছদ্মনাম ? তাই কি পদবিবর্জিত ?

 

মায়ের ঘরে শ্রুতি রূপা আর মায়ের চা দিয়ে এল। রূপাকে বলল, বিস্কুট নিয়ে নিতে। তারপর নিজের চায়ের কাপ নিয়ে ফের ঘরে এসে পার্সেলটা নিয়ে বসল।

 

ইমতিয়াজ নাম ওই ছেলেটির। ছেলে কেন লোক হবে। অতটাও ছোট নয় মনে হয়। প্রোফাইলের ছবি দেখে এখন কারও বয়স বোঝা কঠিন। খুব ভালো লেখে ইমতিয়াজ। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে লেখাগুলো পড়ে শ্রুতি। মন্তব্য করে। ইনবক্সে কথাও হয়। সুপ্রভাত পাঠায়। ইমতিয়াজ নিজের লেখা কয়েক ছত্র কবিতা উত্তরে দেয়। ইমতিয়াজ জানে শ্রুতি কোথায় থাকে কী করে ইত্যাদি। খুব ডিটেইল কিছু নয় অবশ্য। শ্রুতি কী করে, কোথায় থাকে এইসব জিজ্ঞাসা করেছিল ইমতিয়াজ একদিন। সে প্রসঙ্গেই যা কথা হয়েছে। সেসব কি মনে রেখে দিয়েছে ইমতিয়াজ ? ক’দিন আগে শ্রুতির জন্মদিনে ইনবক্সে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিল। বলেছিল উপহার বাকি রইল, একদিন সারপ্রাইজ দেবে। এই কি তবে সে সারপ্রাইজ ? কিন্তু বুকমার্কগুলো দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে তবে ? শ্রুতি বুক মার্কের পাতাগুলো খুলে পড়তে থাকে।

 

ডিঙিয়ে যাও
এপারের ফুরিয়ে যাওয়া বাতাস নিয়ে
তোমার ঘরের দেয়ালে ছবি করো
মনে রেখো বাদরার মাঠে ফেলে এসেছ
চাবির গোছা
ঘর পড়ে রইল খোলা
দক্ষিণের বাতাস লাগছে বুকে
তোমার ভিনদেশি গন্ধ বনকলমি লতার মতো লাগে
আরও যা কিছু বনজ সম্পদ
রাত হলে অবাধ্য ভিড় করে,
শ্বাসের শব্দ শুনি সহবাসে
তুমি টের পাও ?

 

শ্রুতির শরীরটা যেন রহস্য রোমাঞ্চের মতো ছমছমে হয়ে উঠল। ইমতিয়াজ ছাড়া আর কে লিখতে পারে এমন ? বরুণ সেন ? সেও তো কবিতা লেখে। না এই শব্দ, এই অনুভূতি বরুণ সেনের লেখায় পায়নি শ্রুতি। এই ভাষা, এই আকুলতা ইমতিয়াজের। কিন্তু তাকে এমনভাবে লিখেছে ইমতিয়াজ ?  কবির নাম অভিমন্যু লেখা কেন তবে ? ছদ্মনাম ? তাই কি পদবিবর্জিত ?

 

জীবনের রোমান্টিক দিকগুলো বহুদিন হারিয়ে গেছে। সেই কবেকার এক প্রেম কলেজ জীবন থেকে শুরু হয়ে কয়েক বছর পরে যুগের প্রতিযোগিতায় হারিয়ে গেছিল। সৌম্য চলে যাওয়ার পর দুটো বছর লেগেছে ডিপ্রেশন কাটাতে। তারপর বাড়ি থেকে সম্বন্ধ করে বিয়ে। সায়কের সঙ্গে প্রথমজীবন খারাপ কাটেনি শ্রুতির। এখন কি খারাপ কাটছে বলতে পারবে। না পারবে না। সায়কের রোজগার মন্দ নয়। উচ্চাভিলাষী। চাকরি ছেড়ে এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে নতুন ব্যবসা শুরু করেছে। পরিশ্রমী। মা বাবাকে যত্ন করে, সন্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে দায়িত্ববান। আর কী চাওয়ার থাকতে পারে ? শতকরা সত্তরজন বাঙালি মেয়ের বিবাহিত জীবনের মতো চর্যা বহাল রয়েছে শ্রুতির জীবনে। স্বামী, সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি, দায়িত্ব, কর্তব্য, বছরে একবার ঘুরতে যাওয়া সবই রয়েছে। তবুও ওই বনকলমি লতার গন্ধ রয়েছে এতে ? নেই। সেকথা কি বলা যায় ? বাঁচতে যা কিছু লাগে তার সবকিছু ভরপুর থাকলে, না পাওয়ার কথাটা তৃতীয় পুরুষের মতো লাগে। এই ক্রাইসিস যেন এক পরকীয়া। একে বলতে নেই, অনুভবই এর প্রাণের সারাৎসার। বহুদিন পরে পুরোনো যৌবনের ঘোর নামে শ্রুতির মেঘাচ্ছন্ন মনে। এত কিছু পাওয়ার ছিল এখনও ? এটুকু নিয়েই তার সব শূন্যতা ভরে যায়। শ্রুতি বুকমার্ক অনুসরণ করে কুড়ি নম্বর পাতায় চোখ রাখে।

 

সম্পর্ক মানো ?
পাখি উড়ে যায় সমতল ছেড়ে
ঘাত পড়ে থাকে
পালকে পালকে এমন বিস্তীর্ণ
মহাদেশ
রেখায় রেখায় উরুদ্বয়, ভঙ্গিল ভাঁজ–
অবরোধ তুলে নেয়…

 

শ্রুতি ডুবে যায় লাইনে লাইনে। রূপার যাবার সময় হয়। মা টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে দিতে বলে। শ্রুতিকে আটা মেখে রুটি করতে হয়। ওবেলার ভাত, ডাল তরকারি গরম করতে গিয়ে হাতটা পুড়ে যায়। তবুও শ্রুতি ভীষণ ভীষণ খুশি হয়ে থাকে। গুনগুন করে গান ভাঁজে। মনে মনে কথা বলে চলে। সায়ক বাড়ি ফেরে সাড়ে এগারোটায়। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে। ইদানীং ছেলে হোস্টেলে যাওয়ার পর থেকে শ্রুতি ছেলের ঘরেই শোয়। মনে হয় সায়কের সুবিধাই হয়েছে এতে। শ্রুতি কাজ সেরে আবার বই খুলে বসে। বুকমার্ক অনুসরণ করে। মন মেলে দেয়। ফেসবুক নোটিফিকেশন পাঠায় তাকে। ইমতিয়াজ অন, সবুজ বাতি জ্বলছে নামের পাশে।

 

শ্রুতি: উপহার এত সুন্দর হয় ?

ইমতিয়াজ: উপহার তো আবিষ্কার।

শ্রুতি : তবে বুকমার্ক কেন দেওয়া হয় ?

ইমতিয়াজ: নির্দিষ্টের মধ্যে উদ্দিষ্টকে চিহ্নিত করে দেওয়ার জন্য

শ্রুতি: আপনার লেখা ঈশ্বরপ্রদত্ত। অমূল্য উপহার

ইমতিয়াজ: যা আপনি পড়েছেন শ্রুতি, যা আপনার হৃদয়ের অন্তর্গত, তা শুধু আপনার।

 

একসময় ঘুম নেমে আসে শ্রুতির চোখে। লাইট জ্বলতে থাকে সারারাত।

 


 

সকালে উঠতে দেরি হয়ে যায় শ্রুতির। তারমধ্যে রূপা ফোন করে জানায়, তার মেয়ের শরীর ভালো নেই, সে আজ আসতে পারবে না।

 

সায়ক চেঁচামেচি শুরু করে। মা বাথরুম যাবে বলছে দশমিনিট ধরে। শ্রুতি আসছি আসছি করে যাচ্ছে।

 

গ্যাসটা কমিয়ে বাধ্য হয়ে দীপমালাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যায় শ্রুতি। তবুও অস্থির লাগে না তার। দিন আজ সুন্দর। হেমন্ত এক অদ্ভুত হাওয়া আছড়ে ফেলছে রান্নাঘরের জানালায়। বারান্দায় গাঁদা ফুল ফুটেছে অনেকগুলো। একটা গোলাপের কুড়ি পাখনা মেলেছে। শ্রুতি খুব খুশি। অকারণে হেসে ফেলে। সায়কের দিকে ব্রেকফাস্ট এগিয়ে ধরে বলে, সরি আজ দেরি হয়ে গেল গো! ব্যস্ত সায়কের চোখে শ্রুতির ইমেজারি ধরা পড়েনা। সে মায়ের সকালের ওষুধগুলো মাকে খাইয়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায়, শ্রুতি দুপুরের ওষুধগুলো মাকে দিতে যেন ভুলো না।

 

শ্রুতি সবকাজ তাড়াতাড়ি গুছিয়ে সেরে নিতে চায়। দুপুরবেলা ছাদে গিয়ে বসবে আজ। বইটাও নিয়ে যাবে সঙ্গে। মনে মনে কিছু লাইন আওড়াতে থাকে সে।

 

স্নানঘরে একার সাবান
ফেনা মাখা মলিনতা…
পিছল রৌদ্রকণা স্পর্শ করছি আমি
গ্রন্থির ফাঁস খুলে যায় –
লৌকিক অবতলে,
পাহাড়ের উচ্চতা ভেঙে,
অবিনশ্বর বিজয়ভঙ্গিমা –

 

স্মৃতিবিজড়িত মেহগনিফল
তুমিও কি ছুঁয়েছিলে প্রথমেই ?

 

অদ্ভুত এক নেশা পেয়ে বসেছে যেন শ্রুতিকে। আনন্দমধুর ঘন বিহ্বল এক নেশা। আজ পর্যন্ত কবিতাকে এভাবে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেনি সে কোনোদিন। বাংলা কবিতা এত সুন্দর হয়? আজ মনে হয় এই বইয়ের সব লেখা শুধু তার জন্য। শুধুমাত্র তার।

 

মা কে স্নানঘরে নিয়ে আসে শ্রুতি। যত্ন করে স্নান করিয়ে টাওয়েল দিয়ে গা মুছিয়ে দেয়। তারপর নিজে স্নানে যায়। বহুদিন পরে অনেকটা সময় নিয়ে স্নান করে। ময়েশ্চারাইজার মাখে শরীরে। গরমজলে পা চুবিয়ে পিউমিক স্টোন দিয়ে ফাটা দাগ ঘষে তুলে দেয়। মাথায় শ্যাম্পু করে কন্ডিশনার দেয়। স্নান সেরে বেরোনোর পরে ফুরফুরে তাজা শরীর। পুজোয় বসে। যত্ন করে ঠাকুরের আসন সাজিয়ে তোলে বারান্দা-বাগানের টগর, গাঁদা আর জবা ফুলে।

 

এরপর মা কে খেতে দেওয়া। সেও ত্রুটিহীন রাখার চেষ্টা করে শ্রুতি। এরপরেই তো খেয়ে ছাদে যাবে বইটা নিয়ে। এরপর তো অনেকটাই সময় পাবে। তথাগতকে এর মাঝখানেই একবার ফোন করে কথা বলে নেয় শ্রুতি। নতুন জায়গায় ছেলেটার খাওয়া দাওয়ার ভারি অসুবিধা। আর এক সপ্তাহ পরেই অবশ্য বড়দিনের ছুটিতে আসবে। এবার ছেলের সঙ্গে যাবে শ্রুতি। কিছুদিন থেকে আসবে কাছাকাছি কোনো হোটেল বা হোম স্টে-তে। রুয়াকে বলবে এখানে এসে থাকতে ক’দিন। ওর তো নিজের মা। একটু তো দায়িত্ব নিক মাঝেসাঝে।

 

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কলিংবেল বেজে ওঠে। এইসময় কে এল আবার ?

 

দরজা খুলে দেখে পাঁচতলার ফ্ল্যাটের সুমনা এসেছে। ওরা ক’দিন বাড়িতে ছিল না। চাবি রেখে গেছিল শ্রুতির কাছে।

 

মেয়েটাকে ভারি ভালো লাগে শ্রুতির। সবে কলেজে উঠেছে, খুব মিষ্টি মেয়ে। ওদের ঘরের চাবিটা দিতে দিতে বলে,

 

– খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে তোরা না থাকলে। তোদের ঘরেই তো একটু  যাই মাঝেমধ্যে।

 

সুমনা হেসে একটু সংশায়াচ্ছন্ন কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,

 

–আন্টি একটা পার্সেল আসার কথা আমার তোমার ঠিকানায় এসেছে কি ?

 

শ্রুতি অবাক হয়ে তাকায়। সুমনা আবার বলে,

 

 – ছিলাম না তো তাই তোমার নাম ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিলাম। ফোন করে যে বলব তোমাকে সে খেয়াল নেই। এসেছে কোনো পার্সেল ?

 

শ্রুতির চারপাশটা যেন দুলে ওঠে। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে সে।

 

– কীসের পার্সেল রে ? বই কোনো ?

 

– হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার খুব কাছের একজন বন্ধু ওর লেখা বই পাঠিয়েছে। সুমনা ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে।

 

– আমি কিন্তু খুলে ফেলছি পার্সেলটা সমু। তুই তো আমাকে কিছু বলে রাখিসনি। ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয় শ্রুতি।

 

– হ্যাঁ হ্যাঁ তাতে কী হয়েছে। সে তো খুলতেই পারো। সুমনা বিনীতভাবে বলে ওঠে।

 

 শ্রুতি ঘর থেকে বইটা নিয়ে ছেঁড়া প্যাকেটটার মধ্যে রেখে সুমনার হাতে দেয়। খুব খুশি হয়ে থ্যাঙ্ক ইউ বলে মেয়েটা লাফাতে লাফাতে চলে যায়।

 

দরজাটা বন্ধ করে শ্রুতির মনে হয় ঠাস ঠাস করে নিজের গালে চড় মারে। খুব রাগ হয়। ঘেন্না হয় নিজের উপর। ছি ছি ছি সে কী না কী ভেবে বসেছিল ওই বই নিয়ে। এত বড় একটা ছেলের মা সে, এতবড় একটা সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে, চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেল গত অক্টোবরে… সে ভাবল কী করে, কেন ভাবল কেন কেন…

 

দুপুরে খেতে ইচ্ছা করল না শ্রুতির। মা কে ওষুধ জল ঠিকমতো গুছিয়ে দিয়ে ঘরে এসে ফোন করল তার নিজের মা কে। অনেকদিন ফোন করা হয়না। গতকাল ফোনও করেছিল মা। শ্রুতি ধরেনি। ওই বইটার জন্য। বইতে মুখ গুঁজে বসেছিল সে।ও-বাড়িতে যাওয়াও হয়নি প্রায় দুমাস হতে চলল।

 

ওপাশ থেকে ফোন তুললেন অসীমা

 

– কী রে খবর কী তোদের ? কাল ফোন ধরলি না। শেষে আমি সায়কের কাছ থেকে খবর নিলাম।

 

– মা

 

– হ্যাঁ বল।

 

শ্রুতি কিছু বলতে পারল না। তার চোখ ফেটে জল আসছে

 

– কী রে কী হয়েছে কী

 

– মা

 

– কী হয়েছে শ্রুতি ? কাঁদছিস নাকি তুই ?

 

– ফোনটা দুইহাতে চেপে ধরে হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে শ্রুতি।

 

♦·–·♦♦·–·♦♦·–·♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!