- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪
পাথরের চোখ

বকুল নিজের জন্য সাজিয়ে নিয়েছে একটা ঝাঁ চকচকে ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাট। টি-টেবিলে রাখা ফুলদানিতে একটু ধুলোও কখনো জমতে দেয়নি ও। অথচ বাহিরও সামলে চলেছে সমান তালে। অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের চাকরি। বাড়ি ফিরে একটা দুটো হলিউড। দুএকটা পোস্টে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার। একদিন কফিশপে একজনকে দেখে বকুল ফিরে তাকাল। একবার। দুবার। চোখে চশমা। ব্ল্যাক সেলুলয়েড। সাদা শার্ট। শার্টের দুটো বোতাম খোলা। ছেলেটির ফোনের কথা বার্তা থেকে ও জানতে পারল ছেলেটির নাম প্রিয়ম দাশগুপ্ত। সেদিন উঠে পড়েছিল ছেলেটি। তখনও কফিটা শেষ হয়নি বকুলের। কফির কাপটা মুখের সামনে ধরেই ছেলেটির চলে যাওয়া দেখেছিল বকুল। তারপর অনেকক্ষণ যেন ভ্রমের মধ্যেই তাকিয়েছিল কাচের দরজার উপর লাল স্টিকার সাঁটা লেখাটির দিকে ‘প্যুল’। তারপর কিছু মুহূর্ত নিজের মধ্যে ফিরে আসতেই কাপটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে বকুল। ঠান্ডা হয়ে গেছে কফিটা। অর্ধেকটা ও খেয়েছে। এভাবে ফেলে দিতে খারাপই লাগছিল বকুলের। এক কাপ কফির দাম ৮০ টাকা। কিন্তু ও খেতে পারল না, জল হয়ে গেছে। উঠে পড়ল বকুল। ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে ও দেখল কীভাবে একটি আঠারো উনিশ বছরের মেয়ে দুটো বাচ্চা নিয়ে ফুটপাথেই ঘর বেঁধেছে। একটা ঘুমোচ্ছে, আর একটা নিজের মনে কী যেন একটা নিয়ে খেলছে। মেয়েটি পথযাত্রীদের দিকে একটি অ্যালুমিনিয়ামের থালা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ তাকাচ্ছেও না ওর দিকে। তবু ও সবার দিকে তাকাচ্ছে। গাড়ি ও মানুষের কোলাহলে কেউ কারোর দিকে তাকায় না। তারা মাত্র দুটি দিকেই নজর রাখে এক তাদের গন্তব্য আর দুই হল সিগন্যাল। বকুলের মেয়েটিকে দেখে মায়া হল। ওর মনে হল এই মাত্র কতখানি কফি পয়সা দিয়ে কিনেও ও নষ্ট করেছে। একটা দশ টাকার নোট ওই থালার উপর দিয়েই সোজা হাঁটতে শুরু করল বকুল। বকুল ফিরে এল ঘরে। গলির মুখটায় একটা কুকুর ওর পিছন পিছন এসেছে। এক দু’বার ডেকেছে গলা ছেড়ে। কুকুরে ওর খুব ভয়। ও যেন আড়ষ্ট হয়ে যায়। পা সরতে চায় না। তবু তো যেতেই হবে। কিন্তু যেতে পারবে না কিছুতেই। বুকের ভেতরটা ধকধক করতে থাকে এক পা এগোলেই যেন খ্যাঁক করে পা থেকে কিছুটা মাংস খুবলে নেবে কুকুরটা। কোনরকমে ঘরে পৌঁছে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বকুল। ফ্যান চালিয়ে দিল। জল খেল ঢকঢক করে।
২
কিন্তু বাসের পাশের সিটে বসে আছে সেই ছেলেটা ? বিশ্বাস হয় না বকুলের। অফিস যাওয়ার পথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় কোনো কোনো দিন। কথা হয় না। অপরিচিত একজন মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলা যায় ! কেনই বা উনি বলবেন ? কী নিয়েই বা কথা হবে ? কী আশ্চর্য ! নিজের উপর রাগ হয় বকুলের৷ কিন্তু যেন কথা বলতে ইচ্ছে করে ওর। যেন জানতে ইচ্ছে হয় কীসে চাকরি করে প্রিয়ম। অথবা বাড়িতে কে কে আছে। কিন্তু কোনোভাবেই সে সাহস জোগাড় করতে পারে না৷ ফেরার সময় কখনো দেখা হয় না৷ শুধু অফিসে যাওয়ার সময়ই মাঝে মাঝে হঠাৎ বৃষ্টির মতো এসে পড়ে৷ বকুল যখন আজ আসবে আজ আসবে করে করে ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় আবার একদিন হঠাৎ এসে পড়ে। কিন্তু কেন এরকম আশ্চর্য সব ঘটছে বকুলের ! গত রাতে একটা স্বপ্নও দেখেছে ও। সেখানে এক দুসেকেন্ডের জন্য প্রিয়ম ছিল। যদিও গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকায় না, তবু সে ছিল। কেন থাকবে একজন অপরিচিত মানুষ ! ক্লাসে ফ্রয়েড পড়িয়েছিলেন অনির্বাণবাবু। তখন কিছুই বোঝেনি শুধু একটি জিনিস বারবার মনে পড়ছে বকুলের স্যার পড়াতেন ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে যা কিছু আমরা অবদমন করি তা কোথাও একটা জমা হয়। ফিরে আসে স্বপ্নের ভিতর। এসব ভাবলে খুব অসহায় লাগে বকুলের। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। ধুলো উড়ে এসে লাগে চোখে। চোখ জ্বালা করে। ভিড় ঠেলে নেমে পড়ে বকুল। একবার আকাশের দিকে তাকায়। ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে ও। বাস যেখানে নামিয়ে দেয় সেখান থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে ব্যাঙ্কে পৌঁছাতে হয় ওকে।
৩
আজও ফিরতে রাত হল। আটটা পার হয়ে গেলেই এই গলির মুখটা ফাঁকা ফাঁকা। আর ফাঁকা মানেই কুকুর। কুকুর মানেই ভয়। ভয় মানেই বুক ধকধক করে ওঠা, ঘেমেটেমে একসার। আজ কুকুর ছিল না। একপাশ দিয়ে নির্বিঘ্নে হাঁটছিল বকুল। কিছুটা যেতেই হঠাৎ পাশের গলি থেকে দুটো কুকুর নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে যেন ঝগড়াঝাটি করতে করতে প্রবল চিৎকার করতে করতে বকুলের পায়ের কাছে এসে পড়ল। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে এ ওর দিকে তেড়ে যায় ও এর দিকে। প্রবল চিৎকার করছে দুটোই। একে অপরকে আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছে। বকুল এক জয়গায় পাথরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়েছে। চিৎকার করছে। কিন্তু নড়বার ক্ষমতা ওর নেই। কুকুরদুটোর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে চলেছে। পাশ থেকে একজন ভদ্রলোক চিৎকার করছে “চলে এসো এদিকে চলে এসো ভয় নেই কিছু করবে না।” কাউকে একটা দেখতে পেয়ে যেন হালে পানি পেল বকুল। ওদিকটায় সরে গেল বকুল। ভদ্রলোকটিও অফিস থেকে ফিরছেন। উনি টাটা মটোরস্-এ আছেন। ফিরতে ফিরতে কথা হল বকুলের। লোকটি বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। বকুলও বেশ কয়েকবার ধন্যবাদজ্ঞাপন করল কৃতজ্ঞতাবোধে। বকুল ঘরে ঢুকে ব্যাগপত্র রাখল। একটু জল খেল। আজ আর রান্না করার মতো অবস্থায় নেই ও। খাবার অর্ডার করবে। ফ্রেশ হয়ে এসে অফার খুঁজতে লাগল নানান সাইটে।
৪
বেল বাজল। খুব বিরক্ত হল বকুল। এত কাণ্ডজ্ঞানহীন হয় এরা ! অর্ডার করার সময়ই বেল না বাজানোর অপশনটা ক্লিক করা ছিল। দরজা খুলে একটু ধমকালো ডেলিভারি বয়কে। একটু থতমত খেয়ে ছেলেটি বলল আপনাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। বকুল আরও রেগে গেল। “অজুহাত দেবেন না আজেবাজে” বলে আবারও ধমক লাগাল ও। খাবারটা নিয়ে ও দরজা লাগিয়ে দিল বেশ শব্দ করেই, যেন বোঝাতে চাইল কতটা বিরক্ত হয়েছে ও। টেবিলে খাবারগুলো রাখতে রাখতে আবিষ্কার করল ছেলেটি সত্যি বলেছে। ফোনে নেহা ছিল। ফোন পাওয়ার কথা নয় ছেলেটির। নেহাকে হোল্ডে রেখে ও ফ্রিজ থেকে একটা বোতল নিতে এসেছিল সেই সময়ই বেলটা বেজে ওঠে। মনটা ভীষণ বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। শুধু শুধু ছেলেটিকে এভাবে বলল। ফোন কেটে দিয়ে বকুল সাথে সাথেই একবার ড্রয়িংরুমের জানলার পর্দাটা সরিয়ে নীচে তাকাল। ছেলেটা ওর বাইকের ওপর পিঠের বড় ব্যাগটা খুলে রেখেছে। পকেট থেকে টাকার ব্যাগটা বের করে টাকাগুলো গুনল একবার৷ তারপর আবার ব্যাগটা কাঁধে নিল। বাইক স্টার্ট দিল আবার। মাঝে একবার ফোনে কী একটা করল। হয়তো কোনো অর্ডার পেল আবার। বকুল জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দেখল সবটা। ভীষণ অপরাধবোধে ও ছিন্নভিন্ন হচ্ছে এখন। এত রিয়্যাক্ট করে ফেলল ! আদতে কোনও অসুবিধাই তো ওর হয়নি। বেল বাজলে ওর কোনো গুরুতর অসুবিধার আশঙ্কা থাকলে নাহয় একরকম জাস্টিফিকেশানের পথে হাঁটতে পারত বকুল। কিন্তু এখন তার কাছে কোনও অজুহাতও নেই, ছেলেটির তবু একটা ছিল। একবার ফোন করে স্যরি বলবে? না, তা করা যায় না৷ এবার যদি ছেলেটি কথা শুনিয়ে দেয় ! কথা শোনালে আর কোনও উপায় থাকবে না শুধু শুনে যাওয়া ছাড়া কারণ সত্যিই একজন মানুষের সাথে একরকম ব্যবহার ও করতে পারে না। কিন্তু ফোন করে একবার স্যরি বললে যেন বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে যায় ওর। মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরে ঘুরে খাবার পৌঁছে এরা বেঁচে আছে। ওর মনে পড়ে ফুটপাথে দেখা ওই মেয়েটির কথা, তার চেয়েও বেশি মনে পড়ল ওইদুটো বাচ্চার মুখ। দশটাকা কত সামান্য। কত পরমাণুপ্রায়। এই ডেলিভারি বয়রা তবু ভাল। তবু কি ভাল ? কীভাবে এদের সংসার চলে ? কত টাকা মাইনে ? ছেলেটির কি সন্তান আছে ? ইস্কুলে যেতে পারে ? আমরা পয়সা দিই বলে শুধু মুখবুজে শুনে অসহায় ভাবে চলে যাবার সময় বলেছিল “দিদি, একটু রেটিংটা ভাল দেবেন। খারাপ দেবেন না প্লিজ। আমার ভুল হয়ে গেছে।” অথচ ও ভুল করেনি কোনো। ওর মনে পড়ে সন্ধ্যায় ওই কুকুরের রণক্ষেত্র। সামান্য একটুকরো বস্তুর জন্য দুটো কুকুর এরকম হিংস্র হয়ে যায়। একে অপরকে আঁচড়ে কামড়ে দিতে থাকে। মানুষ তো আরও সাংঘাতিক এক প্রাণী যে শুধু নখ দাঁত না, বুদ্ধি দিয়েও ক্ষতবিক্ষত করে পাশের মানুষকে। সেরকম একটা পৃথিবীতে এই ছেলেটিও বেঁচে আছে যেখানে এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে। বেঁচে থাকার যুদ্ধ। কেউ কাউকে এক বিন্দু জমি ছেড়ে দিচ্ছে না। পৃথিবীর খাবার ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে আর অগণিত মানুষ সেই কম পড়ে যাওয়া খাবারের জন্য একে অপরের সাথে যুদ্ধ করছে।
খুব জোরে চিৎকার আসে কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। চেষ্টা করেও চিৎকার করতে পারে না ও। মুখের কাছে মুখ এনে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আঁচড়ে কামড়ে দিতে চায় ওই কুকুরটা। অথচ স্পর্শ করতে পারে না বকুলের মুখ খুব সামান্যর জন্য। অথচ এইমাত্র যেন নাকে ঠেকে যাবে কুকুরের নাকের কালো রঙের ঈষৎ ভেজা অংশটা। পালানোর প্রাণপন চেষ্টা করেও কিছুতেই নড়তে পারে না ও। মিনিট দুয়েক এটা সহ্য করতে হয় ওকে। তারপর হঠাৎ যেন সব বাঁধন ছিঁড়ে যায়
খাবারটা ঠান্ডা হচ্ছিল পড়ে পড়ে। ও প্যাকেট খুলল একটা প্লেটে বেড়ে নিল দুটো রুটি কিছুটা মাংস। আবার মনে হল এভাবে যদি বেড়ে দেওয়া যেত ওই ফুটপাথের মেয়েটার অ্যালুমিনিয়ামের থালায়৷ অথবা এই ডেলিভারি বয়কে ফিরিয়ে দেওয়া যেত পুরো প্যাকেটটা। এত এত খাবার এরা বয়ে বেড়ায় অথচ বাড়ি ফিরে গিয়ে পোকায় কাটা বেগুন আর বুড়ো ডাঁটার ঝোল দিয়ে ভাত মেখে পরমাণ্ণ ভেবে সাপটে খায়। সেক্স করে। বাচ্চা নেয়। তারপর আরও অভাব। আরও ডিপ্রেশন। রাগ। বিষ। আত্মহত্যা ! আর ভাবতে পারে না বকুল। খাবারটা যেন তৃপ্তি দিতে পারছে না বারবার মনে পড়ছে ছেলেটার মুখ। একটা মাস্ক পরা। চোখে চশমা। শহরের বাতাসে উড়ছে অজানা জ্বরের ভাইরাস। টিভিতে দেখাচ্ছে মাস্ক পরে থাকতে হবে। এড়িয়ে চলতে হবে জনসংযোগ। এসব খবর বাতাসে ছড়ায়। এইবার খুব মাস্ক বিক্রি হবে ভেবে বউয়ের আংটি বন্ধক দিয়ে দিল রুমাল বিক্রেতা হকাররা। ট্রেনে, স্টেশনে এখন রংবেরংয়ের মাস্ক বিক্রি হচ্ছে শুধু। লোকেও কিনছে। সুর করে করে বলছে “অজানা জ্বর। বাঁচতে হলে মাস্ক পরে রাস্তায় হাঁটুন। ত্রিশ চল্লিশ লাগে না রেলগাড়িতে পাইকারি দামে দিয়ে দিলাম। মাত্র কুড়ি টাকা। কুড়ি টাকা।” কিন্তু মানুষ বুঝছে না এ মাস্কে আসলে ভাইরাস আটকাবে না। সে মাস্ক আলাদা। দুএকজন বোঝাতে চেয়েছিল সহযাত্রীদের। কাজ হয়নি। বরং হাসিঠাট্টা তামাশায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে হাজার বারোশো দিয়ে একটা মাস্ক পরার চেয়ে কুড়ি টাকায় যেটুকু আটকায় আটকাক। এবার ওর মনে আসছে প্রিয়ম সেনগুপ্তর কথা। গত রাতেও একটা স্বপ্নে প্রিয়ম ছিল আরও কিছুক্ষণ বেশি। ইদানিং যেন স্বপ্ন বেশি দেখছে ও। স্বপ্নের সময় ওকে কে যেন বেঁধে রাখে। নড়তে পারে না। যেন ইচ্ছে নেই তবু ওকে দেখে যেতে হবে স্বপ্নটা। চোখ খুলতে পারে না। হাত ওঠাতে পারে না। খুব জোরে চিৎকার আসে কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। চেষ্টা করেও চিৎকার করতে পারে না ও। মুখের কাছে মুখ এনে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আঁচড়ে কামড়ে দিতে চায় ওই কুকুরটা। অথচ স্পর্শ করতে পারে না বকুলের মুখ খুব সামান্যর জন্য। অথচ এইমাত্র যেন নাকে ঠেকে যাবে কুকুরের নাকের কালো রঙের ঈষৎ ভেজা অংশটা। পালানোর প্রাণপন চেষ্টা করেও কিছুতেই নড়তে পারে না ও। মিনিট দুয়েক এটা সহ্য করতে হয় ওকে। তারপর হঠাৎ যেন সব বাঁধন ছিঁড়ে যায়। ও উঠে বসে। লাইট জ্বালিয়ে দেয়। কিছুটা জল খায়। তারপর কিছুক্ষণ বসে থাকে বিছানাতেই। ওর মনে হয় প্রিয়ম নামের এই ছেলেটা কেন ফিরে আসছে স্বপ্নে ! ওকে তো বকুল চেনেও না। ওকে ঘৃণা করে বকুল। ও আসলে রাস্তার মোড়ের ওই কুকুর দুটোর মতো হঠাৎ নির্বিঘ্ন পথে ঢুকে পড়ে বিপদে ফেলে দেয় বকুলকে। মুহূর্তেই খারাপ লাগে ওর। একজন অচেনা ভদ্রলোককে এরকম ভাবার কোনো মানে নেই। উনি কী করেছেন ? কিচ্ছু না। এমনকি তাকায়নি পর্যন্ত। বকুলই তাকিয়েছে। দেখেছে কয়েকবার ঘুরে ঘুরে। স্বপ্নে দেখেছে। তাতেও ওই ভদ্রলোকের কোনো হাত নেই। রাস্তার কুকুরটাও সেদিন বকুলের পিছনে পিছনে এসেছিল। কে বলতে পারে সে হয়তো বকুলের দিকে তাকায়নি পর্যন্ত, সে হয়তো খোঁজ করছিল এই যুদ্ধের পৃথিবীতে কোনো আস্তাকুঁড়ে পড়ে আছে কিনা কিছুটা আমাখা ভাত। অথবা কোনো কুক্কুরী যে তাকে বংশ দেবে। অথবা কোনো মাংসের হাড় অথবা কোনো মৃতদেহ অথবা থাকার জায়গা অথবা জাহান্নাম। আলো নিভিয়ে দেয় বকুল। পাশ ফিরে শোয়। স্বপ্ন দেখলেই মা পাশ ফিরিয়ে দিত।
৫
সেদিন সকালেই ওকে বেরিয়ে পড়তে হল। বন্ধু নেহার হাসব্যান্ডের একটা ছোট অস্ত্রোপচার হবে। ব্রেইন টিউমার। নেহা ফোন করে আসতে বলেছে। রবিবার। অফিস নেই। সেভাবেই ডেট নিয়েছে ওরা। ওখানে সময় মতো পৌঁছে গেছে বকুল। এখন সব টেস্ট চলছে আবীরের। ডাক্তার এখনো আসেননি। নেহা বলল “একবার রিসেপশনে জেনে আয় না ড. প্রিয়ম এসেছেন কিনা আমার খুব টেনশন হচ্ছে রে।” নামটা শুনে কী যেন একটা মনের মধ্যে থেকে নাড়িয়ে দিল বকুলকে। যেন আবার নামটা নির্বিঘ্ন মনের পথে ভয়ঙ্কর দুটো কুকুরের মতো ঢুকে পড়ে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি শুরু করে দিল। কেন হচ্ছে এরকম কিচ্ছু বুঝতে পারছে না বকুল। একজন অচেনা মানুষ। কেউ কাউকে চেনে না। অথচ যেন একটা ভয় যদি এই ড. প্রিয়ম সেই ভদ্রলোকই হন! হলেই বা কী ! অথচ একটা পাথরের নীচে চাপা পড়া ভয় যেন পাথর ফাটিয়ে উপরে উঠে আসতে চায়ছে। কিছুতেই যেন এই ভদ্রলোকের ছায়া মারাতে চায় না বকুল ঠিক যেমন চায় না বাড়ি ফেরার পথে নির্জন রাস্তায় ওই কুকুরগুলোর ছায়া। এক অকারণ ভয় তাকে চেপে ধরছে। ঠিক ভয় কি ? জানে না বকুল। শুধু জানে ও কিছুতেই চায় না ড. প্রিয়মের পদবী সেনগুপ্ত হোক। জিজ্ঞেস করবার সাহস হল না নেহাকে। যতক্ষণ অজানা আছে, এই তোলপাড় চলছে ততক্ষণ যেন ও সহ্য করে যেতে চায় তবু জানতে চায় সত্যিটা কী। আর তা সম্ভবত সমাপতনের ভয়েই। কাউকে বলার নয় এসব কথা। নেহাকেও না। যেন লজ্জায় পড়বে ও এসব লোক জানাজানি হলে। যাইহোক তবু সে সব তোলপাড়কে লুকিয়ে রেখে রিশেপশনের দিকটায় যাচ্ছিল। একটা ছেলেকে হুউল চেয়ারে বসিয়ে একজন স্টাফ নিয়ে যাচ্ছিল। মাথাটা একদিকে হেলানো। স্থির তাকিয়ে আছে। যেন একটু হাসছে। অথবা এ বিশ্ব তার কাছে হয়ে উঠেছে রহস্যময় এক আশ্চর্য স্থান, যেখানে সমস্ত কিছুই আসলে গোলমেলে, অদ্ভুত। সে আর কিছুই বুঝতে পারছে না। নেহা দেখিয়ে বলল এই ছেলেটাকে দেখছিস সারা দেহে কোথাও কোনো আঁচড় নেই পর্যন্ত। মাথায় চোট। একটুও রক্ত বেরোয়নি শুধু মস্তিষ্কটা ভিতরে ঘেঁটে গিয়েছে। আর কিছু মনে নেই ওর। মনে পড়বেও কিনা বলা যাচ্ছে না। বাইক অ্যাকসিডেন্ট। সেদিন সাঁ সাঁ করে বাইক চালাচ্ছিল ছেলেটা শুনশান রাস্তা পেয়ে। মাঝরাতের দিকে প্রায়। ও আসলে সুইগি ডেলিভারি বয়। ড. প্রিয়মই বলল। চেক আপে আসতাম তখনও দেখেছি মাস দুই হয়ে গেল একই রকম তাকিয়ে আছে। ওর চোখদুটো পাথর হয়ে গেছে। চোখ বোজে না আর। বকুল বসে পড়ল। আরও কী কী যেন নেহা বলছিল কানে যাচ্ছে না ওর। মুহূর্তে মনে পড়ল সেই রাতে ও সুইগিতেই অর্ডার করেছিল। এটা সেই ছেলেটিই কিনা চিনতে পারা সম্ভব নয় বকুলের কারণ ছেলেটির মুখে মাস্ক ছিল। ওর মনে পড়ে সেই অকারণ অপমান। ছেলেটিকে নিয়ে যে যাচ্ছিল সে দাঁড়িয়ে পড়েছে অন্য একজন স্টাফের সাথে কী একটা বিষয় নিয়ে যেন কথা বলছে হাত নেড়ে নেড়ে। বকুলের মনে হল ওই পাথরের চোখ নিয়ে যেন ছেলেটি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আর মৃদু হাসছে। বকুল দেখছে ছেলেটিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে ওই স্টাফ। ওর মাথাটা একইরকম হেলানো। কিছুটা জল খায় ও। নেহাই গেছে রিসেপশনে। ও দু’হাতে মুখটা ঢেকে নেয়। ও ভুলতে পারছে না ওই দুটো চোখ। যেন অন্ধকারেও জেগে থাকবে ওরা যেভাবে স্বপ্নের মধ্যেও ওর চোখ জেগে থাকে। ওর ভয় হয় যদি এবার ওই কুকুরের বদলে স্বপ্নের মধ্যে ওর নাকের কাছে জেগে ওঠে ওই মৃদু হাসি। দুটো পাথরের চোখ !
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
❤ Support Us