- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৫
বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচঃ

বারাণসীর আদি বাসিন্দা হলেও কয়েক প্রজন্ম ধরে সত্যেন্দ্রদের বাস বেচু খাস্তগীর লেনের ভাড়া বাড়িতে। বাপ ঠাকুর্দার সুপ্রতিষ্ঠিত পেড়া-কচুরির দোকানে এখন আর তেমন রমরমা নেই। গুটিকয় বয়স্ক মানুষ ছাড়া শর্মার রাবড়ির তেমন কদর কেউ করে না। সত্যেন্দ্রর বড়দা ছাড়া আর কেউ সে দোকানের দিকে বড়ো একটা ঘেঁষে না।
সত্যেন্দ্র বরাবরই পরিবারের সকলের থেকে একটু আলাদা। ভাইরা যে যার রাস্তা খুঁজে নিলেও সে কোনোদিন ও-পথ মাড়ায়নি। ইস্কুলে বন্ধুদের টিফিন কেড়ে খাওয়া থেকে শুরু করে সকলের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েই জীবনের প্রায় ষাটটা বসন্ত কাটিয়ে দিল সত্যেন্দ্র। নামমাত্র পরিশ্রম করে মোটা টাকা রোজগার করার কৌশল শিখে নিয়েছিল ছাত্রজীবনেই। বয়স যত বেড়েছে তত সেই কৌশলে শান দিতে দিতে এখন সে বড়ো রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী সত্যেন্দ্রদা। এলাকার প্রোমোটার থেকে শুরু করে পাতাখোর পকেটমার সকলের মসীহা। শুধু অশিক্ষিতমহলই কেন, মন্ত্রীসান্ত্রীর আনুকূল্যে উচ্চশিক্ষার অঙ্গনেও তার অবাধ যাতায়াত। এলাকার হেডদিদিমণিও তার ওই ছ্যাৎলাপড়া দাঁতখিঁচুনির ভয়ে তটস্থ। ইস্কুল কলেজের একটা গাছের পাতাও সত্যেন্দ্রর ইচ্ছে ছাড়া নড়ে না। কোনো কাজের বরাত পেতে টেন্ডারওয়ালা ভেন্ডারদের সময়মতো নজরানা পৌঁছে দিতে হয় সত্যেন্দ্রর বাড়িতে। ক্ষমতা আর টাকার মিহি মিশেলে সত্যেন্দ্র যেভাবে ফেঁপেফুলে উঠেছে, তাতে ওই বেচু খাস্তগীর লেনের বারো ঘর এক উঠোনে ওকে আর মানায় না। বেলতলার চৌরাস্তার কাছে বিঘেখানেক জমির উপর চকমিলানো বাড়ি বানিয়েছে সত্যেন্দ্র। হনুমানের পরম ভক্ত সত্যেন্দ্রর সে বাড়ির নাম — পবনমহল।
পবনমহলে গৃহপ্রবেশের জমজমাট ভোজের আসর বসেছে। এলতলা, বেলতলা, হাটতলা, বটতলা সমস্ত পাড়ার কেষ্টবিষ্টুদের বিনোদনের এলাহি বন্দোবস্ত। তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে বাগান পর্যন্ত নীল সাদা আলোর রোশনাই। বাগানে বাটলারের আনাগোনা। এ টেবিলে শ্যাম্পেন, ও টেবিলে ফিশফিঙ্গার, পাশের টেবিলে স্কচহুইস্কি, হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে শহরের সবচেয়ে নামী কেটারিং কোম্পানির বাটলারের দল। সত্যেন্দ্রর তালপাতার মতো ছিপছিপে শরীরে ‘মান্যবর’ এর দামি শেরওয়ানিটা যেন দোকানের শোকেসেই ঝুলে রয়েছে। সিল্কের চুড়িদারের সঙ্গে বাদশাহি নাগরা। সবমিলিয়ে কিছুটা এয়ার ইন্ডিয়ার সেই জোকারটারটার মতো। বাড়ির সদর দরজায় গোলাপজলের ছিটে দিয়ে অতিথি অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সপরিবার আমন্ত্রিত এলাকার বিধায়ক।
“আরে সত্যেন্দ্র জব্বর বাড়ি হাঁকিয়েছ দেখি”
সত্যেন্দ্রর লম্বা শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে যায় বিনয়ের চোটে। ছ্যাৎলা পড়া দাঁতে মেকি হাসি —
“কি যে বলেন দাদা। গরিবের কুটিরে আপনাদের পা পড়ল, এতেই আমি ধন্য।”
পাঁচ জায়গায় বক্তৃতা করার খেপ খেলতে খেলতে মুখ আর মুখোশ নিয়ে নিখুঁত জাগলিং রপ্ত করেছে সত্যেন্দ্র। চ্যালা চামুন্ডারা যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছে। মুখের কথা খসানোর অপেক্ষা। সব কিছু রেডি।
অভ্যাগতদের মধ্যে কে নেই! মন্ত্রী, আমলা, ছোটোবেলার বন্ধুরা, আত্মীয়-পরিজন, ইস্কুল-কলেজের মাস্টারমশাই, প্রোমোটার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, থানার ওসি, পুলিশ কমিশনার, উকিল, ব্যারিস্টর, ডি এম, পোস্টমাস্টার, ব্যবসায়ী সমিতির লোকজন থেকে মিতালি কটন মিলের শ্রমিকের দল, মাছের ভেড়ির দালাল থেকে বন্ধ জুট মিলের ভুখা শ্রমিকের দল সকলে রয়েছে নেমন্তন্নর তালিকায়।
একতলার বিশাল হলঘরটায় তাক লাগানো আসবাব। বিকানিরি কাজ করা সোফাসেটের সঙ্গে কাশ্মীরি জাফরির সেন্টারটেবিল, কাচের আলমারিতে সাজানো দেশবিদেশের অসাধারণ শো-পিসের সম্ভার। সব কিছু দেখেশুনে থ হয়ে গেছে মন্ত্রী, আমলা, অধ্যাপক, ডাক্তার, মোক্তার, প্রোমোটার, কমিশনার।
মন্ত্রীমহোদয় সত্যেন্দ্রর পিঠ চাপড়ান — “করেছেন কি মশায়! এতো হেব্বি ব্যাপার।”
সত্যেন্দ্র আবার বিনয়ের অবতার —
“সবই আপনাদের আশীর্বাদ। আপনারা সমাজের কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমার যোগ্যতা আর কতটুকু বলুন তো!”
বেশি বিনয় দেখাতে গিয়ে সত্যেন্দ্রর মুখটা মাঝে মাঝে নার্ভের রুগির মতো বেঁকে যায়। একগাল কাঁচা পাকা দাড়ি দিয়ে চোয়াড়ে মুখটা ভরাট করার চেষ্টা করলেও শুকনো দড়ির মতো সে মুখেটা সুন্দর হয় না।
“আলমারির শো-পিস গুলো দেখেছিস? বিলেত থেকে আনা মনে হয়” — নিমন্ত্রিত এক অধ্যাপক তাঁর ছাত্রকে বললেন ফিসফিস করে।
“ঠিক বলেছেন স্যার। কোথা থেকে জোগাড় করল বলুন তো?”
নিমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে নানারকম জল্পনা। কেউ আবার ফিসফিস করে বলছে – বেশি ছবিটবি তুলো না ভাই। কে কখন ফাঁসিয়ে দেবে তার ঠিক নেই।
খানাপিনা, গানাবাজানা সব মিলিয়ে এক রংবাহারি সন্ধ্যায় সত্যেন্দ্রর জমকালো গৃহপ্রবেশ হয়ে গেল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অতিথিদের ফেসবুক পেজ ভরে গেল সেই স্মরণীয় সন্ধ্যার অজস্র ছবিতে। গদগদ হয়ে একমনে সেসব ছবি দেখছে সত্যেন্দ্র। কাল রাতে ফুর্তিটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। কোনো এক বন্ধু ফেসবুকে পোস্ট করেছে সত্যেন্দ্রর শখের কাচের আলমারির ছবি। আহা! মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে ঘর আলো করা আলমারিটার সামনে। আত্মতুষ্ট সত্যেন্দ্র আলতো করে হাত বোলায় আলমারির তাকগুলোয়।
এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে বসতে যা দেরি, ভক্তদের আনাগোনা শুরু। সকলেই সত্যেন্দ্রর আয়োজনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কলেজের এক ছাত্রনেতা তো পারলে তার পায়ে গড়াগড়ি খায়।
“কাকু এবার আমাদের দিকটা একটু দেখো, কতদিন কিছু আমদানি হয়নি। সব কাজ যদি তোমার লোকই পেয়ে যায়, আমাদের কি হবে কাকু!”
“হবে হবে সব হবে”– কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বোলায় সত্যেন্দ্র। আড়চোখে একবার তাকায় আলমারির দিকে। সদ্য কলেজ থেকে পাওয়া রুপোর সরস্বতীটা একদম ঝকঝক করছে। কপালে একটু ভাঁজ পড়ল। সরস্বতীটা ওই ইটালিয়ান কাচের ফুলদানিটার পিছনে কি করে চলে গেল! দামু মুছতে গিয়ে সরিয়েছে বোধহয়। মালতি কটন মিলের একদল শ্রমিক এসে পড়েছে।
“দাদা কারখানাটা খোলার কিছু হলো? এবার যে বৌ-বাচ্চা নিয়ে পথে বসব, আর না হলে আপনার বাড়ির সব দামি জিনিস লুঠ করে নিয়ে পালাবো।”
“আরে! লুঠ করতে যাবে কেন? আমি থাকতে তোমাদের কোনো চিন্তা নেই।”
শ্রমিকের দল বুক ভরা আশা নিয়ে সবে বেরিয়েছে, জহর কন্সট্রাকশানের মালিক এল ঢাউস মিষ্টির বাক্স নিয়ে।
“দাদা, মিলের জমিটা তাহলে সামনের মাসে রেজিস্ট্রি হয়ে যাবে তো!”
“কথার খেলাপ হয়েছে কখনো? অশ্বিনী জুট মিলের অত বড়ো জমিটাও তো তোমাদেরই দিয়েছি নাকি!”
“হ্যাঁ দাদা। আপনি না থাকলে ওই লেবারদের কেসটা আমরা কোনদিন জিততে পারতাম না।”
“তবে? আমি ঠাকুরের ভক্ত বুঝেছ! ঠাকুর বলেছেন এসেছিস যখন দাগ রেখে যা। আমিও তাই মেনে চলি।”
“দাগ রাখলেন বটে দাদা। এ তল্লাটে এমন সাজানো গোছানো একখানা বাড়ি, ঘরে এমন দামি জিনিসপত্তর”
“আরে ধুস! ও সব তো মায়া। আজ আছি, কাল নেই। ওসবের কি দাম আছে!”
জহর মনে মনে ভাবে শালা চামার। তোমার আবার মায়া! টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝ তুমি? টাকার জন্য নিজের মেয়েকেও হাটে বেচে দিতে পারো।”
এরই মধ্যে আবার ডোরবেল। কলেজের দিগন্তবাবু। “সত্যেন্দ্রদা! এই প্রিন্সিপালটাকে সরানোর কিছু ব্যবস্থা করুন! এ তো সবার সব রোজগার বন্ধ করে দিয়েছে। বেশ তো হাসি হাসি মুখে রুপোর সরস্বতী নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। আমাদের কপালে কাঁচকলা। এখন আমাদেরও তো কিছু চাই নাকি?”
“হবে হবে। ওই অজেয়া মিত্রর আয়ু আর বেশিদিন নয়। এমন প্যাঁচে ফেলব না, বাপের নাম ভুলে যাবে।”
“ও তো আজ পাঁচ বছর ধরে শুনছি। উলটে ওর দাপটে আমরাই বাপের নাম ভুলতে বসেছি।”
“কাজটা এত সহজ নয় দিগন্তবাবু, সময় লাগবে।”
“তবে যাই বলেন দাদা, সরস্বতীখানা কিন্তু জব্বর বাগিয়েছেন।”
করুণ চোখে আলমারির দিকে তাকিয়ে দিগন্ত ভাবে ব্যাটা সরস্বতী বানান লিখতে পেন ভেঙে ফেলবে, তার ঘরে এমন ঝলসানো উপহার। আর আমি! এত কষ্ট করে
এখান-ওখান থেকে টুকে একটা ডক্টরেট করলাম! আমার কপালে কচুপোড়া! ওই অজেয়া মিত্র, নষ্টের গোড়াটাকে পারলে খুন করে ফেলব।
হাঁটুর উপর আটহাতি ধুতিখানা তুলে গলায় গামছা দিয়ে এল দামু। সত্যেন্দ্রর কানের কাছে ফিসফিস — “দাদাবাবু, বৌদি জলখাবার নিয়ে বসে আছে”
সত্যেন্দ্র যেন ষাঁড়ের তাড়া খেল — “চ চ চ, এক্ষুণি বাড়ি মাথায় করে চেঁচাবে তোর বৌদি। খিদে একদম সহ্য হয় না সুশীলার।”
দৌড়ে বেরোতে গিয়ে আর একবার চোখ পড়ল সরস্বতীটার দিকে।
“এই দামু তুই সরস্বতীটা পেছনে সরিয়েছিস কেন?”
“আমি! কই না তো?”
“এই ব্যাটা, দেব এক কানের গোড়ায়! কে সরিয়েছে তাহলে!”
দামুর মুখের সমস্ত রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। মরা মানুষের মতো ঠান্ডা হাত-পা।
“আমি সরাইনি বাবু…”
সত্যেন্দ্র একটু চিন্তায় পড়ে গেল। তাহলে কে? সুশীলা! তাই হবে।
সেগুন কাঠের গোল ডাইনিং টেবিলের এক পাশে মুখ গুঁজে বসে আছে সত্যেন্দ্র। উল্টোদিকে সুশীলা। দুজনের পাতে গরম গরম লুচি দিয়ে চলেছে মন্দিরা। সাদা আলুর চচ্চড়িটা বড়ো ভালো রাঁধে মেয়েটা।
“আজ আমার বালাগুলো ডেলিভারি দেওয়ার কথা। মনে আছে তো নাকি রাজকার্যের ঠেলায় ভুলে গেছ সব!” সুশীলার গলার ঝাঁঝ ওর পানের বেনারসি মশলার থেকে কিছু কম নয়। সুগন্ধটুকু ওই ঝাঁঝেই মিলিয়ে যায়। সত্যেন্দ্র মাখনের মতো গলে যাচ্ছে। “কি যে বলো! সব মনে আছে আমার।”
“হ্যাঁ মনে থাকার বহর তো দেখছি। এই নিয়ে তিনদিন ভুললে। আজ যদি বালাজোড়া না নিয়ে বাড়ি ঢুকেছ, তোমার ওই রুপোর সরস্বতী আমি ডাস্টবিনে ফেলে দেব।”
সত্যেন্দ্র কিছুতেই ভেবে পায় না মাত্র দুদিন আগে বাড়িতে এসেছে এই রুপোর সরস্বতী, সবার নজর সেই দিকে? এত লোকের চোখের জলের বিনিময়ে যে রাজপ্রাসাদ সে বানিয়েছে তার কোনো মূল্যই নেই! সরস্বতীর এমন মহিমা! ক্লাবের মিটিং, মঞ্চের বক্তৃতা, গোটা ছয়েক বিয়েবাড়ি, বোসবাবুর জন্য অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা সবকিছু সেরে দোকানে যখন পৌঁছল সত্যেন্দ্র, তখন কালীমাতা জুয়েলার্সের রোলিং শাটারে তালা লাগাচ্ছে শিবু।
“এই দাঁড়া দাঁড়া তোর বৌদির বালাজোড়া…”
“আজ আর হবে না সত্যেন্দ্রদা আমি শাটার বন্ধ করে দিয়েছি।”
চোখের সামনে সুশীলার রুদ্রমূর্তি ভেসে উঠল সত্যেন্দ্রর। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সুশীলা এগিয়ে চলেছে জঞ্জালের স্তূপের দিকে। হাতে রুপোর সরস্বতী।
“বন্ধ করেছিস তো কি হয়েছে আবার খোল…”
“কাল সকালে এস না দাদা! এতগুলো তালা আবার খুলতে হবে যে…”
“হবে তো কি? খুলবি! পাড়ায় ব্যবসা করার ইচ্ছে আছে? কাল সকালে এসে দেখবি পুরো দোকান সাফ হয়ে গিয়েছে। সইতে পারবি তো!”
ছেলেটার জ্বর ক’দিন ধরে ছাড়ছে না। ভেবেছিল আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবে। রুম্পাটা একা আর কতদিক সামলাবে। এই মস্তানগুলোর জ্বালায় কেউ ভালোভাবে বাঁচতে পারবে না। ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই কিল মারার গোঁসাই।
বালাজোড়া ব্যাগে ভরে রতনের বাইকে চড়ে বসল সত্যেন্দ্র। এমন খান দশেক রতন সারাদিন কোলে ক্যাঁকালে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সত্যেন্দ্রকে।
জল ঝড় তুফান কিছুর পরোয়া করে না। করলে কি করে চলবে! কারো বিবাহিত বোনের স্কলারশিপ, কারো বৌ-এর বিধবাভাতা, কারো ভুয়ো রেশনকার্ড সবই যে দাদার হাতে। ‘দুয়ারে সত্যেন্দ্র’ প্রকল্পের বিশ্বস্ত সারথি এই রতনের দল।
এলাকায় ওদের ভয়ে মরা মানুষেরও পিলে চমকে ওঠে। এত কিছু পেতে হলে একটু পেট্রলের খেসারত… ও আর এমন কি!
আজ সকাল থেকে সত্যেন্দ্রর বাড়িতে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। ওসি, কমিশনার, ডিজি, হেজি, পেঁজি, কোনো অফিসার বাদ নেই। সত্যেন্দ্র কোথায়! বাড়ির ভিতরে? না কি…! দোকানে চায়েপে চর্চা। সত্যেন্দ্রর বাড়িতে নাকি বড়োসড়ো চুরি হয়েছে।
“সে কি রে রতন! তোরা থাকতে কোন চোরের এত বুকের পাটা হলো রে!”
“আর বলিস না ভাই। ভেতরের কেউ আছে মনে হয়।”
“তা চুরিই হলো নাকি কেন্দ্রীয় এজেন্সি! শাক দিয়ে মাছ ঢাকছিস নাকি রে রতন!”–বিতর্ক ছুড়ে দিলেন সরলাবালা হাইস্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই। সাইক্লোনের গতিতে সে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ল পাড়া থেকে পাড়ায়, ওয়ার্ড থেকে ওয়ার্ডে, ব্লক থেকে ব্লকে। ক্যামেরা আর মাইক্রোফোনের বোঁচকা নিয়ে ছুটে এল রিপোর্টারের দল। জবর খবর, আবার খবর, সফেদ খবর, জনবার্তা, অজ্ঞানের অন্ধকার, বিজ্ঞানের আলো কে নেই! কিন্তু কে দেবে খবর? বাড়িতে তো মাছি গলবার উপায় নেই। সত্যেন্দ্রই বা কোথায়! চালান হয়ে গেল নাকি!
মা কালীর ছবিটায় ধুপ দিতে দিতে প্রার্থনা করে শিবু — বালাজোড়া যেন চোরে নিয়ে যায় মা! মালতি কটন মিলের শ্রমিকের দল বাংলা মদের আসর বসায় — শালা ধান্দাবাজ। বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি! বেশ হয়েছে। মর শালা। টান জেলের ঘানি। জহর কন্সট্রাকশানের অফিসে রূদ্ধদ্বার বৈঠক — হাতছাড়া হয়ে গেল মিলের জমিটা! কলেজের ছাত্রনেতার মাথায় হাত — তার কুকর্মের ভিডিওগুলো তো সব কাকুর কাছে, পুলিশ যদি হাতে পেয়ে যায়! পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ দিগন্ত সেন। বেশ হয়েছে। আমার নাকের সামনে দিয়ে সেদিন দোলাতে দোলাতে নিয়ে গেল সরস্বতীটা! এবার দেখ কেমন লাগে।
প্রায় ঘণ্টা দশেক পরে খুলল পবনমহলের সিংহদুয়ার। গোটা ছয়েক ট্রাঙ্ক আর কয়েকটা বস্তা ভরে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল পুলিশের ভ্যান। বাড়ির বাইরে কয়েক হাজার জিজ্ঞাসু চোখ। কি আছে ঐ ট্রাঙ্ক আর বস্তায়? টাকা? গয়না? কোনো লাল ডায়েরি? কারো নাম লেখা কাগজের তাড়া? বেনামি কোম্পানির মালিকানার কাগজ? উত্তর কারো জানা নেই। ভিড়ের এক কোনায় কেষ্ট ঠাকুরের স্টাইলে দাঁড়িয়ে ভাবছে দিগন্ত — সরস্বতীটাও চালান হয়ে গেল? কিছুক্ষণ পরেই সন্ন্যাসী রাজার উত্তমকুমারের পোজে সত্যেন্দ্রর প্রবেশ। কমিশনার স্বয়ং হ্যান্ডশেক করছে তার সাথে। প্রায় চুমু খাওয়ার ভঙ্গিতে বলছেন — “আরে স্যার নিয়মটা তো রাখতে হবে। একটা তো রাত। না হয় আমার কোয়ার্টারেই থাকবেন। কাল সকালেই জামিন হয়ে যাবে।” পুলিশভ্যানে উঠল সত্যেন্দ্র। হঠাৎ ডিজে বাজার মতো স্লোগান উঠল আকাশ কাঁপিয়ে —
কেন্দ্রীয় এজেন্সী দিয়ে ভয় দেখানো যায়নি যাবে না।
পুলিশের ভ্যানের পিছনে ভক্তের কার্নিভাল। বিধ্বস্ত বাড়িটার সিংদুয়ারে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে চোখ মুছছে দামু। কোন ছোটবেলায় শর্মাজি দেশ থেকে নিয়ে এসেছিল তাকে। শেষমেশ কিনা পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হলো! দেশে যে ফিরে যাবে সে রাস্তাও বন্ধ করে দিয়ে গেল পুলিশ।
কমিশনার সাহেবের যেমন কথা তেমন কাজ। সারারাত ওনার কোয়ার্টারে রাজার হালে কাটিয়ে একবার কোর্টের দরজায় মুখ দেখাতে না দেখাতেই জামিন হয়ে গেল সত্যেন্দ্রর। এক কাপড়ে এত সময় বহুদিন কাটায়নি সে। গা ঘিনঘিন করছে। নিজেকে মালতি কটন মিলের শ্রমিক মনে হচ্ছে। সমস্ত কেচ্ছার কালি ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে হলঘরের সোফায় বসেছে সত্যেন্দ্র। সোফাগুলো ছিঁড়ে ফাটিয়ে সব বের করে নিয়ে গেল টিকটিকিগুলো। একটাই বসার জুগ্যি রয়ে গেছে। পাশে আটপৌরে ছাপা শাড়িতে সুশীলা। গায়ে একটাও গয়না নেই।
দামি শো-পিসে সাজানো আলমারিটা একদম খাঁ খাঁ করছে। শুধু মাঝের তাকে ঝলমল করছে রুপোর সরস্বতীটা। সত্যেন্দ্রর কানে বাজছে ডিজির কথাগুলো — “ওটা নিতে হবে না। আমি জানি ওটা কালোটাকায় কেনা নয়।”
রতনের কাঁধে চেপে কলেজের সরস্বতী পুজোয় স্বমহিমায় উপস্থিত সত্যেন্দ্র। সিকিউরিটি বিমল থেকে কলেজের অছাত্রের দল সাতরঙা প্রজাপতির মতো ছুটে আসে তার দিকে। জগৎপিতার মতো আশীর্বাণী ছড়িয়ে এগিয়ে চলে সত্যেন্দ্র। গোবেচারা পুরোহিত অঞ্জলির মন্ত্র পড়ে —
সরস্বতী মহাভাগে
বিদ্যে কমলে লোচনে
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী
বিদ্যাস্থানেভ্য এবচ
সমস্তটা গুলিয়ে ফেলে সত্যেন্দ্র আওড়ায় শুধু শেষ লাইনটা — বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচঃ।
♦•♦♦•♦–♦•♦♦•♦
❤ Support Us