- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- জানুয়ারি ৫, ২০২৫
বড়ো গল্প: ফেরার

প্রথম পর্ব
একটা জায়গায় যাবে, তার জোগাড় যন্তর সেরে একটু যে ধীরেসুস্থে বেরবে, তা কোথায় কী – দুচোখের পাতা তাই রাতের মধ্যে একবারও এক হলো না জৈগুনের ! মম্মদের বাপ মফি গাজি, ওই কাল্লিমে ব্যামোটা আজ বাড়িই ফিরল না সারা রাত।
সকাল বেলা ইঞ্জিন ভ্যান নিয়ে কাজে বেরল, বলল সন্ধের আগে ফিরবে। ফিরল তো না-ই, উলটে সকাল হলেই বন্ধনের কিস্তি, তার জন্য যে তিনশটা টাকা গোছানো ছিল, তার থেকে পঞ্চাশটা টাকা কোন ফাঁকে হাতিয়ে বের করে নিয়ে চরতে বেরল। জৈগুন কত আর পাঁকে পাঁকে থাকে, টেরই পেল না ! দুটো হাঁস, দুটোই ডিম দিত অঘরান মাস পড়লেই আর তিনটে ডেগি মুরগি ছিল সংসারের সার। হাতে চারশটি টাকা ধরিয়ে দিয়ে তার দুটো নিয়ে গেল মলম সদাগর ! কুলপীর মা পেত নগদে পঞ্চাশ আর আবিজানদের মুদি দোকানে ধার হয়েছিল দুশো কুড়ি টাকা, সেখানেও পঞ্চাশ জমা করে হাতে ছিল এই তিনশ। রঙ ওঠা ফেসকো লাল একটা ব্লাউজেই কেটে গেল দুবছর, আরেকটা যে কিনবে ভয়ে দুরুদুরু করে বুক !
জৈগুনের ভরণ-পরন টের পেয়ে মলম সদাগর সেদিন খপ করে উঠে এসেছিল ঘরে। হাত প্রায় ধরবে এমনই ব্যামো ওই লোকটা। আবার বলে কিনা
আল্লার মর্জিতে ভালোই আছি ভাবি, তুমি কেন বিগড়ে আছো বলোদিনি ? মন ভরে পেলি তোমার কোনো অনিষ্ট হতি দেব না, বুঝলে ?
সদাগর মানুষটা খারাপ না, তবে একদিকে মম্মদ আর মম্মদের বাপ আরেকদিকে সংসারের তার আয় ব্যয়।আয় যদি এক তবে ব্যয় তার একশো। মলম সদাগর একদিন দেবে দুদিন দেবে, কিন্তু দরকার তো তার একশগুন বেশী, মাঝখান থেকে দহরম মহরমটুকু, দুগাল হেসে ভাল মন্দর ফুসরতটুকু যেটুকু আছে তাও নষ্ট হবে। লোকে জানবে মম্মদের মা খানকি, লোকে জানবে মম্মদের মা ছিনাল।
তাছাড়া দেহখাগি মেয়েমানুষ সে নিজেই, মফি গাজীর সঙ্গে যেবছর তার বিয়ে হল, পায়ের গোচ ছিল মোটা, বড় বত্রিশ ব্লাউজ না পরলে হাঁসফাঁস করত দেহ ! দুফেরতা কাপড়ে জড়াতে হত আছাপাছা ! অথচ বান নয় বাজ নয়, মফি গাজির হাঁড়ির কানায় পড়ে গা তার নোংরা হতেও দিকভুল করে মাসে মাসে ! ভাত জল বিনে, দেহের খোরাক হতে হতে দেহ তার কুয়াশা হল দিনে দিনে। দিনভর ঝরে, কমে, ক্ষয়ে যায় ! সুতরাং মলম সদাগরকে বাপকেলে ভাই বানিয়ে তোয়াজ করা ছাড়া মম্মদের মা হিসাবে তার আর গতি কী ! সদাগর চলেও গেল !
এইসব ব্যাপার বৃত্তান্ত কিন্তু মফি গাজি জানে। জানে মম্মদকে নিয়ে জৈগুন, সঙ্গে যাবে এক আজগুবি মেয়েমানুষ, নাম কপিলা, পাশের পাড়ায় বাড়ি, ঘোষেদের এক বউ, হাতে শুধু এই রাতটুকু, পোহালেই যাবে কোন এক পুর্নির ঘাটে, এক সাধুবাবার আস্তানায়।
বাসে করে প্রথমে চাকদা, তারপর টোটো ধরে রাইনগর, রাইনগর পেছনে ফেলে এবার হাঁটা, খালবিলের জায়গা তারপর ফাঁকা একটা মাঠ পড়বে বড়ো, সে মাঠের নাম চরবাওনি আর চরবাওনির পশ্চিমে সাধুবাবার সেই আস্তানার নাম পুর্ণিরঘাট। বিরাট এক বটতলায়, কত দূরের পথ; সে কথাও মফি গাজি জানে !
তাহলে সে কোন প্রাণে ঘরে মোথলো করে রাখা টাকা থেকে সরাতে পারে পঞ্চাশটা টাকা, তাও মম্মদের বাপ হয়ে, হাঁত একবার কাঁপল না, কুষ্ঠ হল না কেন অমন হাতে !
রাত টাল খেয়ে পড়ে নাকি তার মাথাটায় কাঁধ থেকে ছিঁড়ে বাঙ মেরে ওঠে, টের পায় না এখন জৈগুন ! পঞ্চাশটা টাকার শোকে বুকে তার শিয়াল হাঁপায় কুকুর কাঁদে আর নিজেকে সে দুহাতে ধরে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর ঘরের অদিশ এক ফাঁদে আবার বসায় !
পুর্ণির ঘাট যেতে যেটুকু টাকা, পঞ্চাশ হোক একশ হোক রেখে বাকি টাকাটা সে কিস্তিবাবদ রেখে যেতে পারত আবিজানের মায়ের কাছে ! এখন যদি সে যাওয়া বাবদ একশ রাখে, থাকে দেড়শ। সকালটুকু হতে যা বাকি কিস্তি আলা এসে বাপ মা তুলে খিস্তোবে যখন, তখন এই দেড়শরই বা সাধ্য কী কিস্তি আলাকে ঠান্ডা করে !
মম্মদ আবার ভড় ভড় করে হাগল, জৈগুন টের পায় টলটল করে উঠছে মম্মদের গোটা বিছানাটা, জলের বোতলটাও কখন গড়িয়ে পড়েছে ঘরের বেড়ায়। মালোম পেয়ে জৈগুন যেন নিজের হাতে খেঁচে দিল নিজের মাথাটা, আর ঘেউ ঘেউ করে উঠে হাতে আবার তুলে নিল টাকার মোথলোটা, নিয়ে দরজার মুখটায় এসে সে দাঁড়াল। পরণে ভেজা নেতানো শুধু শায়া !
হাসর তলা হয়ে ময়দান হয়ে কচি দুটো পায়ে দৌড় মেরে মম্মদ কাতারে কাতারে গুলিয়ে যাচ্ছে। সে যেন টের পেল, এখন জৈগুনও যেন ওই কাতারে ঢুঁশে যেতে পারলে বাঁচত !
কিন্তু গরম তেল ভরতি কড়াই, অন্ত না পাওয়া বিষাক্ত সাপ যেন ক্রমেই তার আলগা বুক পেট ও খোলা আওলানো চুলে চুড়বুড় করে উঠলে সে মালোপ পায়। কপা দুরেই পুকুর, তার ডানধারে যে পাড়, সেদিকটায় অন্ধকার যেন ঘাপটি মেরে ছিল, এখন ঘোৎ ঘোৎ করে উঠছে।
জৈগুন তবু রাতের ভেতর পুকুর, পুকুর পাড়ে রাত, সবকিছু দুচোখে কুটি কুটি করে ফেড়ে মফি গাজির পায়ের শব্দ কিংবা ছোট্ট একটা মা ডাক শুনতে পাবার লোভে তাকিয়ে থাকল !
কিন্তু ৫০ টাকা কম ৩০০ টাকাটা এখন আরো কম কম ঠেকতে লাগল জৈগুনের হাতে। উদোম গায়ে চুল তার আউলেই ছিল, এখন সে আরো তরাস পেয়ে উঠে এল মম্মদের বিছানায়, মম্মদের বুক পর্যন্ত কাঁথাটা পাতলা পায়খানায় এখন সেঁতিয়ে উঠেছে। জ্বর তাতেই নেমে গিয়ে হিম ঠান্ডা লাগছে মম্মদের মাথা ও মুখ ! জৈগুন বুকে মুখে এখন রগড়ে রগড়ে ভাঙে, মম্মদকে কাঁথা থেকে বালিশ থেকে, এমনকি তার হাত পা মাথা মুখ গলা থেকে তুলে শুকনো একটা ছেঁড়া চাদর তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনে বিছানায় পাতিয়ে শুইয়ে দিয়ে মুখটুকু ধরে ডাকে…. আববু ? ও বাপ মম্মদ ? শোনচো বাপ ?
মম্মদ কাঁদে না দম ফেলে বোঝা যায় না। জিভ বের করে সে চোখ দুটোর মধ্যে আবার গড়িয়ে পড়লে, জৈগুন মুখটা মম্মদের মুখের পর রেখে তোষামোদ করে বলল, ওই বাইরের দিকে দ্যাখো, সকাল এবার আসছে। আমরা ছ্যান করে তেল মেখে বেড়াতি যাবো দূরের এক গাঁয়ে। ওখানে তোমার এক খালা আছি, কপিলা খালা, তানিই নিতি আসবে আরেকটু বাদ। তুমি যাবা তো বাপ, খালা ওষুধও দেবে, তুমি ভালো হয়ে যাবা মানিক, দেখে নিও…!
মম্মদ কোনো সাড়া দিল না, হ্যাঁ হুও করল না ! এসব করার মুরোদ তার কখনো ছিল, তাও কেও পারবে না বলতে ! তার তো ধরতে গেলে জন্ম ইস্তকই অসুখ। পেট ছাড়া শরীরে তার আস্ত বলে কিছু হলই না। মুখ আছে খোলে, খাবার পেলে গেলে ! অথচ হাঁটা, কথা বলা শিখেছিল সে একবছর বয়সেই ! কবছর আগে এক সন্ধেই জ্বর এল তার একটু খানি, সকাল বেলা বাজারের মতি ডাকতার ওষুধ দিল দুশো টাকার।জ্বর নামল আর শুরু হল অনাবেত্তক পায়খানা, পাছা গলানিও বলা চলে। সেই যে শুরু হল এ ব্যামো আর সারল না, প্রথমে ৩০০ টাকা ভিজিটের দুজন ডাকতারই পালা করে ওষুধ দিল কাড়ি কাড়ি, মম্মদ খায় আর জাবড়ায়। হাত পা সব নেতড়ে গেলে তারে নিয়ে ঠেলে উঠল জৈগুন কল্যাণীর জওহরলাল হাসপাতালে, মাস কাবারে ওষুধ যা লেখে যা হাসপাতাল থেকেই কিনতে হয়, আনে খাওয়ায়, কিন্তু ব্যামোর কোনো নড়চড় হয় না। এদিকে বয়স ধরা করল দেখতে দেখতে চার চারটে বছর, দুদিন সে বিছানায় উঠে বসে তো বাকি মাস কাঁথা কাপড়ে শুয়ে শুয়ে কোৎ পাড়ে। বাড়ে জ্বর, বাড়ে বিকার, ওইটুকু ছেলে সেই বিকারের জ্বালায় কথা ফুরিয়ে ফেলে, ডাকও !
প্রথম কদিন মনে হল জৈগুনেরই মনের ভুল, পরে তোয়াক্কায় তোয়াক্কায় থেকে সে বুঝল মম্মদ আর মা শব্দটুকুও গলা থেকে উগরে দিতে পারছে না, চোখ মুখ থরথর করে কাঁপিয়ে ছেলেটা যা শব্দ করে তা মা ডাক নয়, গালটুকুর হা মাত্র। তাতে মুখে এসে বসা ভনভনে মাছি একটু আধটু তরাস খায়, তার বেশি কিছু নয়।
খেয়াল করে মফি গাজিও একদিন উন্মত্তের মত নিজের বুক কপাল কিলোতে কিলোতে কাঁথা বিছানাসহ মম্মদকে উঠোনে মেরেছিল টান ! নেহাত বাঁচার জন্য ছোড়াটা দিনভর গাল হা করে রাখে তাই রক্ষে, নাহলে সেইদিনই ওকে কবরে রেখে আসতে হতো সাড়ে তিনহাত মাটির কোন খোদলে।
মম্মদের ঠ্যাঙ আর মাথা তুবড়ে গেল মাটিতে আছাড় খেয়ে, অথচ পুকুর পাড় ধরে হাঁটা দিল মফিগাজি জৈগুনকে খিস্তোতে খিস্তোতে — যে ছেলে বাপ ডাকা তো দূর, মালোম পায় না বাপের, তার বাঁচা মরায় আমি মুতিরে মাগী !
কুড়ি টাকার আউটডোর টিকিট কেটে দুপুর গড়ালে ডাকতার । ঝাড়া সকাল থেকে শুধু দাঁড়িয়ে, কোলে বুকে মম্মদ, আর কিছু না থাক ঘাড় ধাক্কা দেয়ার লোকের অভাব হাসপাতালে হবার নয় ! অথচ মম্মদকে কোল থেকে নামিয়ে টেবিলে তাই বসাতে বলল না সেদিন ডাকতাররা। আগের কাগজ দেখে, মুখের দিকে না তাকিয়ে দুয়েকটা প্রশ্ন করে, শুধু ওষুধ লিখে কাগজটা ফেরত দিল এক ডাকতার, খুব তাচ্ছিল্য করে।
জৈগুনও হাতের নাগালে পেলে মফি গাজিকেও চেলে ফেলে দিত সামনের পুকুরে ! পাঁকে কাদায় চুবিয়ে আধমরা করে তুলত বুড়োর পাড় ওই মশুকুন্ড টাকে ! …যেন কত বাহাদুর, বয়েস ভাড়িয়ে বিয়ে করা মারিয়ে আর সকাল সন্ধে মদ তাড়ি গিলে, এখন নিজেই তো এক আস্ত গোঘাসি !
ইঞ্জিন ভ্যান আছে ভাঙড়ি একটা, তাই নিয়ে মাল টানে চুয়োডাঙা বিষ্ণুপুর। আগে ইনকাম যা হত তাতে সংসার চলেও দুটো পয়সার মুখ দেখতে পেত জৈগুন। আজ ডাকতার কাল হাসপাতাল করতে কষ্ট হলেও সয়ে যাচ্ছিল ! এখন নাকি ভ্যানটা বিকল হয় কথায় কথায়, আয় ইনকাম যা হয় সব ক্ষয় করে আসে আজ এই গ্যারেজে তো কাল ওই গ্যারেজে ! আসলে সব তার নসল্লা, রোগালা হাড়ে ভেলকি চলে কাজ চলে আর কত দিন !
পরনের কাপড় মাথার তেল দূরের কথা, পেট কাচালে সংসার, সে সংসার কোনো কালেই কি শুধু সপ্তায় পাঁচকেজি চালে আর এককেজি আলুতে চলে ! ব্যামোর সংসারে এসে জৈগুন একটা বাজার করার থলের মুখ তাই দেখল না। সকাল গেল দুপুর গেল বিকেলও গেল, মফি গাজি ঘরে আসল, গলায় ঝুলোনো গামছা, তাতেই টোঁপলা করে বাঁধা ওই চাল আর আলুটুকু ! ভালো গেল মন্দ গেল আস্তে আস্তে তেল আর নুন, তাও কোরবানির গোস্ত কোরবানির মাস না এলে জুটবার নয় !
অথচ মুখে টুনকো মফি গাজি ষোলো আনা। পুকুর পাড় ধরে একবাগে ফড়কে যেতে যেতে মরণের মরণ মফি গাজি চিল্লিয়ে গলা ফেড়ে জৈগুনকে শাসায় …ওরে তুই পেটে ধরিলি, ওরে তুই কবর দিয়ে আয় আজই..!
ভাবখানা এমন মম্মদকে যেন বাপের বাড়ি থেকেই হাঁটানি করে এঘরে এনেছিল জৈগুন ! জৈগুন ধড়ফড় করে মরতে মরতে, সেই মম্মদকে কোলে টোঁপলা করে পরের দিন ছুটেছিল আবার কল্যাণীর হাসপাতাল…, শরিয়তের মা মিনুর কাছ থেকে ধার করে আনা সত্তরটা টাকাই ছিল সেদিনের সম্বল। তাতে বাস, ট্রেনের ভাড়া বাবদ খরচ তিরিশ টাকা একবারে শুধু আসায়। তাও ডাকতাররা যদি একটু মম্মদকে হুটকে পাকলে একটু ভালো করে দেখত, অসুখটা কি, সারছেই বা না কেন। বলত, তাহলে জাহানে জলটুকু অন্তত আসত জৈগুনের।
সকাল আটটায় লাইন দিয়ে কুড়ি টাকার আউটডোর টিকিট কেটে দুপুর গড়ালে ডাকতার । ঝাড়া সকাল থেকে শুধু দাঁড়িয়ে, কোলে বুকে মম্মদ, একটু বসা নয়, বসবে যে কোথাও লাইন সরে যাবে, আর কিছু না থাক ঘাড় ধাক্কা দেয়ার লোকের অভাব হাসপাতালে হবার নয় !
অথচ মম্মদকে কোল থেকে নামিয়ে টেবিলে তাই বসাতে বলল না সেদিন ডাকতাররা। আগের কাগজ দেখে, মুখের দিকে না তাকিয়ে দুয়েকটা প্রশ্ন করে, শুধু ওষুধ লিখে কাগজটা ফেরত দিল এক ডাকতার, খুব তাচ্ছিল্য করে।
অবশ্য কোনোদিনও এই ব্যবস্থার ব্যত্যয় হয় না। বাইরে ঠাঠা রোদ আর ভিড়ের চাপে বুকটা এমনিতেই খুবলে আসছিল জৈগুনের, পিপাসায় ফাটছিল, জল আনা বোতলটা আসার সময় স্টেশনে কোথাও পড়ে গিয়েছিল নাকি মনের ভুলে বাড়ি থেকেই আনা হয়নি, মনে পড়ছিল না তার। পেটে ভাত পড়েছিল তার আগের দিন দুপুরে, তাতে মাটিতে আছাড় খেয়ে মাথা আর পা তুবড়ে গিয়েছিল মম্মদের, এখন ডাকতার দেখাতে কোল ছাড়া হতেই সে শুরু করেছিল চিল্লানি, জৈগুন আর পেরে দিল না নিজেরই সঙ্গে।
সবচে কষ্ট, জৈগুনের মনে হল হাসপাতাল তার বিলডিং তার ডাকতার সব যেন খক খক করে হাসছে— মম্মদ আর জৈগুনের অবঘিন্নে দশায় !
মাস গেলে আসা ! আসলেই ২০০ টাকার ওপর খরচ আর গোটা দিনটা মাটি, আজও হয়তো বাড়ি ফিরে সে দেখবে হয় হাঁস নয় মুরগি— একটা না একটা ঠিক হয় শিয়ালের পেটে নয়তো কোন হাঘরে নির্বংশ মানষির পেটে বিসমিল্লাহ হয়ে গেছে। এটুকু ভেবে জৈগুন, তাল হারিয়ে শরম হারিয়ে হাউ মাউ করে ওঠে, জোরে !
মফি গাজি ভ্যান নিয়ে বেরোয়, পথ ঘাট বাজারে ইয়ার বন্ধু তার কম নেই, অভাবও নেই। ফেরে মাঝরাতে, তখন মুখে গন্ধ, পা করে টলমল !
এদিকে টাকা ধার করতে করতে বাড়ি পড়শি বলে আর কিছু বাদ নেই, মিনুর মায়ের বাড়ি যেমন পাড়ার বাইরে— ২০০ টাকা ধরে পড়ে গিয়ে চাইতে দিল সত্তর টাকা, আজ ওইটুকুই নিয়ে তার কল্যাণী আসা !
অথচ সে বেলায় বোঝার কোন নামগন্ধ নেই, ডাকতাররা যেন বাল খেয়ে পাশ দিয়েছে, নয়ত পাশ দিয়ে বাল ছিঁড়েছে গাদা গাদা এই হাসপাতালের !
ডাকতার না বলতেও কোলটা একটু আজড় করে মম্মদকে জৈগুন টেবিলে শুইয়ে দিয়েছিল, যাতে চেয়ারে বসা তিনজনের একজন ডাকতার মম্মদকে একটু তলিয়ে ভেবে দেখে !
ফল হলো উলটো। তিনজন ডাকতারই একযোগে জৈগুনকে প্রায় ঘেয়ো কুকুরের মত হাত দিয়ে হেড়ো মারতে উঠে বসল মুহূর্তে, তারই হুড়োহুড়িতে টেবিল থেকে কাৎ হয়ে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে মম্মদ নিভে গেল দপ করে !
টের পেয়ে জৈগুন আর আস্ত থাকল না, মম্মদকে কোলের মধ্যে গুছিয়ে নিয়ে চিগরে উঠল সে আর বিদেশি ভাষায় কথা বলা মর্কটগুলোকে নাঙ ভাতার তুলে খিস্তিয়ে, হাত পা ছুড়ে। আউটডোরটাকে একাই সে মাথায় করে তুলল, ভাবখানা এমন যেন ডাকতারদের মুখ প্রতি দুটো করে লাথি না মেরে সে থামবে না !
মম্মদ আবার কোত পেড়ে উঠলে, থামতে তাকে হলই।
যে থামাল সেও বড়ো জ্বালার মানুষ— হাসপাতালের ওপর জ্বলা মানুষ, দৌড়ে এসে জৈগুনকে সে ধরে ফেলল জাপটে, ব্যাগসহ বের করে নিয়ে গেল ঘরের আড়ে ঘর, তারপর সিঁড়ি, তারপর দৌড় লম্বা এক চাতাল, ঠুসে বসাল জৈগুনকে সে সেখানেই !
— অত চেতলি তুমি যে মরবা, ও দিদি, মরার জন্য এ জায়গা কেন বাছলে এমন করে ?
এই দেখ, আমি হলামগে কপিলা, আর এই আমার ছেলে, পিলে জন্ডিসে মরছিল, এখন ভালো হয়ে গিয়েছে, সিডা এই মর্কটদের জানাতিই আজ আমার আসা দিদি !
হাঁপিয়ে কেশে কপিলা আবার বলল, এসব হল নারসিং হোমের ডাকতার, রুগি কুড়োতি হাসপাতালে আসে, দেখছো না ফোন আসছে ঘন ঘন, সব ওই নারসিং হোমের ফোন..!
কপিলার মন ভজানি কথায় নাকি নিজের এই সাড়ে সর্বনেশে দশায় বিতিকিচ্ছিরি মেরে এসে জৈগুন এখন পুরোপুরি পা ছড়িয়ে বসে ! বুকে মম্মদকে জাপটে নিয়ে, বুকে মাথা ঠুসে কাঁদে…! দম তার ঢিলে হয়ে আসে, হাত পা নেতড়ে যায়।
খেয়াল করে নিজের ছেলেটাকে একটু তফাতে সরিয়ে দিয়ে, কপিলা খুব যত্ন করে জৈগুনকে সেধিয়ে নিল নিজের বুকে ও কাঁধে ! পাছা জাবড়ে, তাতেই বসতে হলো তাকে আরেকবার !
জৈগুন বিস্মিত। সবচে বড়ো বিস্ময় কথা কপিলা নামের এই মানুষটা তাদের কোনো পর না, জৈগুন কিম্বা মম্মদদের বাড়ি যে গ্রামে, কপিলার বাড়িও তাদের গ্রামের পাশের গ্রাম মথুরগাছিতে।মাঝে একটা মাঠ, মাঝে একটা বটগাছ ! কথা সেটাও না। কল্যাণী আসতে তাদের দুজনেরই বিষ্ণুপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস ধরতে হয়, সকাল সাতটা দশের ডাউন রানাঘাট লোকাল ধরতে হয় চাকদা থেকে !
বৌটা তাকে চ্যাঙদোলা করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল আউটডোর থেকে বিশহাত দূরে। কোলে মম্মদ না থাকলে জৈগুন আজ বোধয় নিজের মাথা নিজেই ফাটিয়ে মরে যেত !
হতো আর কি, আউটডোরের লম্বা লাইন, অদূরে হাসপাতালে আসা যাওয়ার ঘোরানো পেচানো গেট, হোতকা পাষাণ মার্কা বিলডিং সবখানে দাঁড়িয়ে বসে হামাগুড়ি দেয়া সুই সেলাইন সিরাপ আর বড়ির মুখে ফুল চন্দন পড়ত হরিনামসহ। কপিলা বড়ো গরজ করে কথা কটা বলেছিল জৈগুনকে !
শুধিয়ে ছিল, আজ বোধয় পেটে কিছু পড়েনি দিদি, না ?
জৈগুন চোখে মুখে ডেবে মাথাটা আরো নামালে কপিলা আবার শুধিয়েছিল, রাতেও কিছু খাওনি ? ও দিদি, শরীর তোমার ছেলের চেয়েও খারাপ, খুব যে দেখা যায় !
আর রুগি রোগ জন্ম মৃত্যু মাথায় তুলে নিজের আনা খাবার থেকে দুটো আটার রুটি, একদলা আলুর তরকারি জোর করে ধরিয়ে দিয়েছিল সে জৈগুনের হাতে, বলেছিল খাও দিদি আর এই জল নাও।
আবর্জনার চাতাল পথের পাশে পাঁচিল আর পায়ে পায়ে ঠোকা লাগা মানুষ, নিজেরটাকে চাতালে বসিয়ে মম্মদকে কোলে নিয়েছিল কপিলা, এতেও বুক ভাঙা কান্নায় আরো জাবড়ে গিয়েছিল জৈগুন ! কবছর ধরে ছেলেটা হয় তার কোলে, নয় বিছানায় কাপড়ে পড়ে থাকে, ওষুধ খেলে ধুকধুক করে না খাওয়ালে নি:সাড় মেরে যায়…!
এক কথায় এবাড়ি-ওবাড়ি মিলিয়ে তাদের পাড়াটা খুব ছোট নয়, খালা মামু ,ফুবু দিদি, নিজের বলে কেউ না থাক, মম্মদ একদম মাওড়াও নয়।
তারও একটা বাপ আছে, শরিকানা মতে ভাইবোন আছে পাঁচ সাতটা, এমনকি নাজুর মা মুশলির মা শাইলির মা বলে মানুষও আছে বেশ কজন, তারা কেউ আজ পর্যন্ত মম্মদ কে কোলে তুলে নেয়া তো দূরে থাক, ছুঁয়ে তাই দেখেনি একবার।
কথায় বলে খতিবপুর তার বাপের ঘর।
কথাটা মনে পড়তে কান্না জৈগুনকে কাবু করল আরো খানিকটা।খতিবপুর কিম্বা খতিবপুরের মানুষ জানলেও যে জৈগুনের বুকটা উতলা হয়, ডেকে বসাতে দুটো কথা শুনতে ও বলতে মন গা ফুলে ওঠে। সেই বাপের ঘরে গেল শ্রাবণ মাসের শেষে, বাপের ঘরের একজনও বসতে বলল না ঘর বারান্দায় উঠে।
এও তার খেয়াল হয়েছিল, বহুকাল কেউ তাকে আব্দার করে বসতে তাই বলেনি। দরকার মিটোতে হয়েছে, হয় দাঁড়িয়ে, নয় একদম বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে ! পথেও ত মানুষ বসার একটু জায়গা পায়, কিন্তু মফি গাজির বউ হওয়া ইস্তক, সে গুড়েও তার বালি !
বাপের ঘর তার ষোলো আনা এখন ভাই ভাবীর সংসার, কালের এই নিয়ম কার হাতে বশ ! কিন্তু দুটো ভাইবউ আর তাদের চার পাঁচটা ডাগর ডোগর মেয়ে সব পর্দাভোগী মানুষ, আলেম মোল্লা হাদিশবিদ একেকজনা ! ওরা আজকাল ঘরে তাই পর্দা করে বুলি আওড়ায় !
এদিকে জৈগুন ত মোটে গায় কাপড়ে, মাথায় কাপড়ে মানুষ ! তাতে এটা তার জনমমাটির গ্রাম, তাতে এটা তার ষোলোআনায় বাপের ঘর !
মাথাটা আলগা করে সে সবে গিয়ে উঠোনো একটু দাঁড়িয়েছিল, হেঁসেলে ছিল বাকের ভাইয়ের বউ, বাকের আলি তার আপন বড়ো ভাই, বড়োভাই বাকের তখন বাড়িতে, উঠোন কোণে গাছতলা, তার ছায়ায় বসে ঝুড়ি বুনছিল বাঁশের বাখারি দিয়ে !
ভাই দেখল জৈগুন দুপুর মাথায় করে উঠোন পর্যন্ত এসেছে, ভালোমন্দ কী যেন সে বলতে যাবে, হাজার হলেও মায়ের পেটের বোন— উঠে দাঁড়াল !অমনি হেঁসেল থেকে বেরিয়ে এল বাকের ভাইয়ের বউ, তার দেখে ভাইঝি কটা কে কোথায় ছিল, সব ফড়কে গেল ঘরের ভেতর ! বাড়িতে যেন ডাকাত পড়েছে দিনে দুপুরে অথবা জৈগুন যেন এবাড়ির সবার পরপুরুষ !
বাকের ভাইয়ের বউ হাতের খুন্তি পারলে ছুঁড়েই মারে জৈগুনের মাথায়, সঙ্গে কাঁচা কাঁচা খিস্তি আর তার ডাফুরেগিরি ! — কিডা গো ন্যাংটা মাগির ছা, এডা কি বাজার পেয়েছ না চরে খাওয়া ভাতারের ভিটে ? বেরোও বলছি ! গলায়ও কি কাঁসর হয়েছে না উলাওটো হয়েছে, জানো না মুমিন বাড়ী ঢুকতে হলে গা খাঁকার দিয়ে ঢুকতে হয় ?
জৈগুন যেন মানুষও না জন্তুও না।
বাপ মরেছে একথা ঠিক, মা গিয়েছে কবরে তাও ঠিক, বাপের ঘরের যে ভিটে তার চারধারের চারটে দিক তো এখনো একই আছে, এমনকি ওই যে বাঁশবাগান, তলা ভর্তি শরীর জুড়ানো ছায়া, ওই ছায়া হাতড়ালে এখনো তার দড়ি খেলার দড়ি, গাদি খেলার কোর্ট হুবহু হয়তো মিলে যাবে ! …ওই যে ওপাশের ঘর, দেয়ালে টাঙানো আয়না, তাতে গোঁজা হাঁড়ের যে কাঁকুই, তাও তো তার বাপ গগন মালোর হাতে করে কিনে আনা, বাবা খেদাইয়ের মেলা থেকে !
ঘরের পিছনে ওই বাঁদাড়, ওই কুশে মোড়লের আমবাগান, তারপর মসজিদ, তারপর হাওড়ের বিল টাল খাচ্ছে জলে ও নৌকায়, ওখানে গিয়ে দাঁড়ালে এমন লাখো কোটি ডুব আজকেও হয়তো ভুস ভুস করে ভেসে উঠবে, যাতে জৈগুনের কপালে টিকলিটা, কোমরের রশিটা, হয়ত বুড়বুড়ি কাটছে আজো, টের পাওয়া যাবে।
চোখ আর ঝোঁকের মাথা খেয়ে জৈগুন হেঁসেলে ঢুকলো ফস করে, কাউকে কেয়ার না করে একটা ঘটি খুঁজে বের করে নিল হাঁড়িকুড়ির ভেতর থেকে !
জল নিল কলসী থেকে, খেল ঢকঢক করে, তারপর বাকের ভাইয়ের বউকে বলল, ইডা যে বাপের বাড়ি থেকে মুমিন বাড়ি হয়েছে, মালোম ছিল না বড়ো বউ ! বেগাত্মা হয়ে এসেলাম, চলেও যাচ্ছি, তোমাদের আখেরাতে আমার কোন মানত নেই, শুধু বুকটা কদিন ধরে হ্যাচর প্যাচর করছিল,
জুৎ পাচ্ছেলাম না একটুও, এবার আমার জুৎ হয়েছে খুব, চললাম…!
… মাগি কি হেঁদু হৈ গেলেন নাকি ? বাকের আলিকে মুখ ঝামটে শুধিয়েছিল বাকেরের বউ ! মুখ টুকু তার কাপড় থেকে আলগা, বলেছিল, এয়েছ যখন আরেকটু দাঁড়িয়ে যাও, তুমার কিছু পাওনা ছাওনা আছে নিয়ে যাও !
বলেই অন্দরে গেল বাকেরের বউ, আর কদন্ড পরেই বাইরে এল একটা কাপড় হাতে, সেটা জৈগুনের হাতে দিয়ে বলেছিল— এসব ন্যাঙটা মানুষের বস্তর! তোমারই ! এখন এয়েছো যেখন নিয়ে যাও !
এমনই কপাল, আবিয়েত কালের তার সেই কাপড়খানই এখন জৈগুনের পরনে, বাইরে আসার একমাত্র বস্তর !
ক্রমশ…
❤ Support Us