- ব | ই | চ | র্যা রোব-e-বর্ণ
- মে ১৯, ২০২৪
বাংলা গল্পের অন্য স্বর, অন্য ভুবন

সব পাঠকের নিখুঁত, বিশুদ্ধ পাঠক হয়ে-ওঠার সৌভাগ্য হয় না, এজন্য প্রস্তুতি দরকার, দরকার ভাষা, শব্দ প্রয়োগ, গল্প বা উপন্যাসের পটভূমি নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা; দ্বিতীয়ত, লিখিয়ের জেনে রাখা প্রযোজন, যে- ভাষায় লিখছেন সে ভাষার গল্প বলার আয়তন কতটুকু। বাংলা-গল্প নির্মাণের ইতিহাসের বয়স কম নয়, ঐতিহ্য দীর্ঘ, এবং নিপুন। মধ্যযুগে, বিশেষত কাহিনীধর্মী কাব্যে তার অবয়ব একাত্মভাবে দেশজ, পদ্য ভাষায় গল্প বলার চেষ্টা বাংলার লেখক-কবির নিজস্ব, স্বতঃস্ফূর্ত আড়ম্বর। এখানে আরব আর ইরানি প্রাচ্যের আরোপিত চেষ্টা নিরন্তর। আলাওল, দৌলত কাজী বিষয়ান্তরে দেশজ আর দেশজ মননের বাইরে হেঁটেছেন, কিন্তু তাঁদের গল্প বলবার ঝোঁক সাধারণ বাঙালি শ্রোতা বা পাঠকের অভ্যাস থেকে দূরে সরে যায়নি। মঙ্গলকাব্যেও নিজস্বতার ঘরানা বর্হিস্থিত নয়।কবি আর লেখকের পটভূমিতে নির্মাণে রীতি তৈরিতে উপনিবেশিকতার অনুপ্রবেশ ঘটল উনিশ শতকে। তবু বিদ্যাসাগর থেকে বঙ্কিম, মীর মোশারফ হোসেন থেকে রবীন্দ্রনাথ— অনেকেই দেশীয় মুন্সিআনার নবায়নকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। চিত্র-বদল শুরু হয় অনেক পরে, পূর্ব-পশ্চিমের মিলিত কারুকার্যে পশ্চিমের অনুকরণ যখন প্রধান হয়ে উঠল। বাংলাভাষার এ-এক দুর্ভাগ্য। চালচিত্রের নিমার্ণ থেকে তাঁর লেখকরা সরে গেলেন, তাঁদের চিন্তা আর চেতনাকে গ্রাস করল তাঁদেরই অর্জিত, অনুশীলিত ইংরেজি সাহিত্য পাঠের দেখনদারি।
দেবেশ রায় বলেছিলেন, আমাদের গল্প-উপন্যাসের নির্মাণ ও ধারণায় বদল দরকার। ফিরতে হবে বঙ্গজ রীতিতে। চিন্তাশীল বিবর্তনশীল লেখক, শেষের দিককার সৃজন কর্মে, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত থেকে দাঙ্গার প্রতিবেদন— এরকম বহু বিস্ময়কর সৃজনে দেবেশ গল্প বলার দেশজ রীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। জীবনের বড়ো অংশ কেটেছে তাঁর উত্তর বঙ্গের জলপাইগুড়িতে আর কলকাতায়। কিন্তু আঞ্চলিকতা অথবা শুষ্ক নাগরিকতা তাঁর লেখকসত্তার বাহক হয়ে ওঠেনি কখনো। মফস্বল বৃত্তান্ত, তিস্তাপারের বৃত্তান্তে, বহু সংখ্যক গল্পে উত্তর বঙ্গের জীবন আর স্থানীয় লড়াইচিত্র এঁকেছেন, এসব অঙ্কনে সরলীকরণ নেই, নেই খন্ডিত, আঞ্চলিকতার চিহ্ন। বিশ্বজনীন; মানবিক দৃষ্টি দিয়ে চিত্রিত করেছেন সমষ্টি আর তাঁর ব্যক্তি চিন্তাকে। দেশেরই সমসাময়িক, রাঢ় বাংলার আরেক লেখক সৈয়দ মোস্তফা সিরাজের হয়ে-ওঠা মুরশিদবাদে। তাঁর ব্যক্তিস্বরূপের নির্মাণে জড়িয়ে আছে গ্রাম, শহর, আলকাফ আর সাংবাদিকতার বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কলকাতায় তাঁর জীবন-যাপনের শুরু সম্ভবত ১৯৬৩ এর মাঝামাঝিতে। গল্পকার হিসেবে। পরে উপন্যাসের নিমার্ণ আর বিস্তারে। কিন্তু বহু পূর্বে, বহু স্তরে বিচ্ছুরিত সিরাজ তাঁর আশৈশব অভিজ্ঞানকে কখনো ভোলেন নি। ভুলতে দেননি স্মৃতিকে। অতীতমুখী রোমান্টিকতা তাঁকে বন্দী করেনি, অতীতকে দেখেছেন সময়কে সঙ্গে নিয়ে; নাগরিকতার সংস্পর্শে এসেও, গ্রামীন সরলতা, গ্রামীন কথকতা আমৃত্যু তাঁর সঙ্গ আর নিঃসঙ্গতার অবলম্বন হয়ে রইল। নিঃসঙ্গতা বলতে এককতা ও স্বাতন্ত্র্যের কথা বলতে চাইছি। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক, অদ্বৈত মল্ল বর্মন যেমন বা নগরবাসী হয়েও স্মৃতির জনপদ, গ্রামীন আলো হাওয়ার চর্চা ও চর্যায় মগ্ন থেকেছেন, সচেতন স্বতঃস্ফূর্ত কৌশলে; যে- রকম পুরনো ঢাকার চৌহদ্দি আর পারিপার্শ্বিকতাকে ঘিরে তাঁর গল্প-ভুবন গড়ে তুলেছেন আখতারুজ্জমান ইলিয়াস; যে-রকম পূর্ববঙ্গে বসবাসের শুরু থেকে, মৃত্যু পর্যন্ত নাগরিক গদ্যে প্রমিত বাংলাকে গুরুত্ব দিয়েছেন হাসান আজিজুল হক, ঠিক সে রকম সিরাজ স্থানীয় সংলাপের ভেতরে ও বাইরে বিচরণ করেছেন সহজ ভঙ্গিতে।
সিরাজের পরে মুর্শিদাবাদকে ঘিরে, সবচেয়ে বড়ো আর শক্তিমান উত্তরণের নাম আবুল বাশার। যেমন গল্পকার, তেমনি ঔপন্যাসিকের ভূমিকায়। আমাদের স্থুলতায়, আমাদের রুচির বিচ্যুতি তাঁর ‘ফুলবউ’কে শুধু দেখল। দেখল না শক্তিমান গদ্য চিত্রায়নের দক্ষতা এবং গল্প আর উপন্যাসের ধারাবাহিক গঠনের সৃজনকে। সমসাময়িক লেখকদের ছোট করছি না, স্ববৃত্তে প্রত্যেকেই কম বেশি স্বতন্ত্র। কিন্তু বাশারের স্বাতন্ত্র্য, দক্ষতা আর গদ্যস্রোত এতটাই তীক্ষ্ণ, প্রবল, উজ্জ্বল; যার মূল্যায়ণের চেষ্টাকে কেবল তাৎক্ষণিক আয়োজন দিয়ে পূর্ণ করা কঠিন। এ ব্যাপারে আরো কিছু কাল অপেক্ষা করতে হবে।
সমালোচনা সাহিত্যকর্ম নয়, সৃজনশীল নয়, কি কারলাইল কিংবা কিংবা বুদ্ধদেব বসুর মতো অর্ন্তদ্রষ্টা আর সৃজনশীলদের হাত ছুঁয়ে তা দিগন্তময়, কালোত্তীর্ণ হতে পারে। এরকম দ্রষ্টা এ দেশে বিরল, বিশ্বসাহিত্যেও সংখ্যা তাঁদের সীমিত। বাশারকে তাঁর সময় আর নিঃসঙ্গ, আত্মমগ্নতা ও পরিচর্যা দিয়ে বিচার করা হয়তো জরুরি। স্বীকার করছি, বিষয়টি নিয়ে আমার নিজের ধারণাও স্পষ্ট নয়, ভ্রান্তি- বিলাসে ভুগছি। সীমায়িত লেখাপড়া, যাপনকে নানা দিকে ছাড়িয়ে দেওয়ার ঝোঁক সমস্যা তৈরি করছে। বিশেষকে, বিশেষভাবে খতিয়ে দেখবার জন্য চিন্তা আর ভাবনার যে সংযোগ জরুরি, আমার আয়ত্ত্বে তার উপস্থিতি কোথায়? যাযাবর, একধরনের উদ্বাস্তু স্বভাব ক্রমশ আমাকে ঘরহীন করে তুলছে। পড়বার সময় কম, যে-সব বই হাতে আসে, সবটা পড়া হয় না, পড়ে থাকে চোখের সামনে মুদ্রিত সমুদ্র, আমি শুধু ঢেউ দেখি, ঢেউয়ের ঢেউ সাঁতার কাটার আনন্দ ছিনিয়ে নেয় বাহ্যিক আড়ম্বর, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পর্যটকদের কোলাহল, এবং বিরচিত বৃত্তের আঁকা বাঁকা রেখা। এরকম আবহেও কখনো কখনো, দৃষ্টিগ্রাহ্য ঝলক তৈরি করে যে-সব হাসি, যে-সব বই, যে-সব চিত্রকর্ম, তাদের এড়িয়ে যাওয়া কি সম্ভব?
সম্প্রতি হাতে এসেছে, পাতাউর জামানের গল্প, এবং সৌরভ হোসেন-এর ২৫ গল্পের সঙ্কলন। পাতাউরের গল্প আগে পড়ার সুযোগ হয়নি। তাঁর ‘সমাপ্তি’, আর ‘বিজয়ার পর বাইচ খেলে রহমত ঘরে ফিরছে’ পড়ে মনে হল, নিঃসময়ের দৃষ্টিপাত ঐতিহ্যের অঙ্গীকার ফিরে আসছে। মনে পড়ছে বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধশালা প্রসঙ্গ’। তার উচ্চতা স্থায়ী সম্পদ হয়ে আছে। পাতাউর ঠিক এরকমই দুটি গল্প দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, বলতে এসেছেন। না-বলা কথা বলতে বলতে হাঁটবেন, ছুটবেন, মেধা তার অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে। তাঁর যাত্রা একক নয়, বহুজনের মিলিত স্বপ্ন, সুখ, অসুখের মিলিত কাহিনী, গ্রামীন মানচিত্র, ভাষা উপভাষা তাঁর সহচর, তাঁর ঘোষিত প্রতিশ্রুতির সাঙ্কেতিক গন্তব্য। যাপিত জীবন আর খুঁটিনাটি অভ্যাসকে দেখার দৃষ্টির গভীরতায় মুগ্ধ, বিস্মিত হতে হয়। জীবন তাঁর ঋদ্ধ, বিবরণ সচরাচর এবং বহুচরীয় ঘটনার খুঁটিনাটি মত চোখে পড়ে না। বহুদিন পর জ্বলে-ওঠা অন্ধকার আলো ছড়াল সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, কিছু কিছু নাগরিক লেখকের গ্রাম্যতা, সীমাবদ্ধতা আর পর্যটকের তাৎক্ষণিকতাকে উড়িয়ে দিয়ে, ঐতিহ্যের বর্ণ আর গন্ধের বন্ধন ছাড়া সম্ভাবনাময়, প্রতিশ্রুতিময় কোনো লেখকের উদয় কি সম্ভব? বলতে ভালো লাগছে পাতাউর জাগতে এবং জাগাতে এসেছেন। তাঁর অনিদ্রা, সঞ্চয়ন, আর অনুশীলন অনেকানেকের সহযাত্রী হয়ে উঠবে, আশা করছি। প্রান্তিক-অপ্রান্তিকের জাগতিকতা, তাঁর পর্যবেক্ষণের রূপান্তর, নাগরিকতা বোধকে খন্ডিত, বিচ্ছিন্ন করবে বলে মনে হয় না বরং তাঁকে সহিতের দৃষ্টি খোলা সহগামী এবং অন্যতম সফল কারিগর বানিয়ে তুলবে, ক্রমশ, স্তরে স্তরে।
পাতাউর না-বলা কথা বলতে বলতে হাঁটবেন, ছুটবেন, মেধা তার অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে। তাঁর যাত্রা একক নয়, বহুজনের মিলিত স্বপ্ন, সুখ, অসুখের মিলিত কাহিনী, গ্রামীন মানচিত্র, ভাষা উপভাষা তাঁর সহচর, তাঁর ঘোষিত প্রতিশ্রুতির সাঙ্কেতিক গন্তব্য । সৌরভ গল্পে এঁকে রেখেছেন স্ব-চিহ্ন। প্রচার সর্বস্ব অন্তর্জালে, মনে হয় আটকা পড়বার, ভেসে যাবার পাত্র নন। নৃত্যরত অনুশীলন, আঞ্চলিকতার মধ্যেও বিশ্বায়িত দৃষ্টি তাঁর লেখকস্বরূপের বির্বতনের সঙ্গী হয়ে থাকবে।এক গল্প থেকে আরেক গল্পে বিষয় বদলের প্রবণতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। তাঁর পারিপার্শ্বিকের অদূষিত ছবি উঠে আসে।
সৌরভ হোসেন গল্প লিখছেন সম্ভবত দু দশক জুড়ে। তাঁর লেখালেখির প্রবাহের উৎসকাল আরো বেশি হতে পারে, কমও হতে পারে। সময়ের আয়তন দিয়ে লেখকতাকে ওজন করা যায় না, লেখক কী লিখছেন, কেন লিখছেন, তাঁর পটভূমি কী, গন্তব্য কী, কোন যাপনের চালচিত্র ভেসে উঠছে নির্মিত ভাষায় এবং তা বিষয়ের নির্মাণ হলে কোন চেহারা ধারণ করছে, এরকম বহু প্রশ্ন ভাবিয়ে তোলে সচেতন পাঠককে। সৌরভ মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। তারুণ্যে ভরপুর। পেশাদারিত্বে স্ব নির্ভর। স্বভূমির বৃত্তান্তে তাঁর আকর্ষণ দুর্বার। এখানে-ওখানে লেখা পড়ছি, আন্দাজ করছি, লেখালেখিকে নিছক ছক ও শখ করতে রাজি নন। যে আঞ্চলিক বৃহতকে ছুঁয়ে থাকে সৈয়দ মোস্তফা সিরাজ এবং আবুল বাশারের মনোজগত, সেদিকেই তাঁর ঝোঁক বেশি। এরকম ঝোঁক থাকা ভালো, ভালোকে উত্তম, উর্দ্ধারোহী করে তুলতে হলে রক্তক্ষরণ, আর সংযম দরকার। জরুরি ঐতিহ্যের পাঠ, পুর্নপাঠ। না হলে আঞ্চলিক অভিজ্ঞতা নিছক চালচিত্রের বয়ানে হারিয়ে যায়, যে রকম বজবজ আর সংলগ্ন এলাকার নিখুঁত, বিচিত্র, আজন্ম লালিত অভিজ্ঞতায় ধনী হয়েও লেখকতার ধারাবাহিক গড়নে নিবিড় সুরকার, সুগায়ক, স্বরস্রষ্টা হয়ে উঠবার সাফল্য থেকে দূরে পড়ে রইলেন, ‘বাংলার চালচিত্র’, ‘বাংলার মুখ’, ‘ইলিশমারির চর’ এর মৃত্যুহীন কথক আব্দুল জব্বার। পাঠকের বিস্মরণ ও বিশ্বাসঘাতকতায় হারিয়ে গেলেন একজন প্রকৃত স্বভাবজাত কথাশিল্পী। দেশ পত্রিকায়, পরে অমৃতে প্রকাশিত যে প্রতিভা অভূতপূর্ব বিস্ময় তৈরি করেছিল, তিনি বেঁচে থেকেও, কেন ‘আত্মঘাতী’ হয়ে উঠলেন? কারণ কী? প্রতিষ্ঠানের অবজ্ঞা, স্বনির্বাচিত বিচ্ছিন্নতা, পথ দেখানোর মতো হিতাকাঙ্খীর সঙ্গযাপনের ব্যর্থতা? প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন। এরকম প্রশ্নে সচেতন আর নতুন করে প্রণোদিত হতে পারেন আঞ্চলিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ উদীয়মান, প্রতিশ্রুতিময় লেখকরা।
সৌরভ গল্প বলতে জানেন। ২৫ টি প্রকাশিত গল্পে এঁকে রেখেছেন স্ব-চিহ্ন। প্রচার সর্বস্ব অন্তর্জালে, মনে হয় আটকা পড়বার, ভেসে যাবার পাত্র নন। নৃত্যরত অনুশীলন, আঞ্চলিকতার মধ্যেও বিশ্বায়িত দৃষ্টি তাঁর লেখকস্বরূপের বির্বতনের সঙ্গী হয়ে থাকবে। সৌরভের এক গল্প থেকে আরেক গল্পে বিষয় বদলের প্রবণতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। তাঁর পারিপার্শ্বিকের অদূষিত ছবি উঠে আসে। অবশ্যই এ এক সুলক্ষণ। ভয় একটাই খন্ডিত শব্দের পুনরাবৃত্তি, একমুখী গদ্য তাঁকে, তাঁর স্বরূপকে বিভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট করে দিতে পারে।
পাতাউর জামানের গল্প ♦ নবস্পন্দন গ্রন্থমালা •পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ♦ দাম: ২৫ টাকা
পঁচিশটি গল্প সৌরভ হোসেন ♦ একুশ শতক ♦ দাম: ৪০০
♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦
❤ Support Us