Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • নভেম্বর ৩, ২০২৪

লোভ

দেবাশিস ভট্টাচার্য
লোভ

অলঙ্করণ: দেব সরকার

দেবেন্দ্র হাতের ফর্দাটা দেখতে দেখতে বললো, ‘ষোড়শোপচার কি ঠাকুরমশাই ?’

উমাকান্ত বললেন, ‘ষোড়শোপচার হলো আসন,স্বাগত, পাদ্য,অর্ঘ্য, আচমনীয়, স্নানীয়, বসন,ভূষন,গন্ধ, পুষ্প, দীপ,ধুপ,নৈবেদ্য, মধুপর্ক কটি হলো বলোতো ?’

আজ্ঞে আর মাত্র দু-টি বাকি।

উমাকান্ত মনে মনে আরো একবার উচ্চারণ করলেন উপচারগুলিকে। তারপর বললেন,’ হ্যাঁ বাবা, তর্পণ আর নতি। এই হলো গে তোমার ষোড়শোপচার। তুমি দশকর্মা ভান্ডারে দেখালেই ওরা সব বুঝিয়ে দেবে।

গৌরী এসে দাঁড়ালো সামনে। একটি রেকাবিতে গুটি কয় সন্দেশ আর কাঁসার গ্লাসে জল এনে রাখল মেঝেতে। বললো, ‘খাও বাবা।’

তিন পুরুষের যজমান দেবেন্দ্র। ওর পিতার অবর্তমানে স্বগৃহে এবার পৌষ মাসে করালবদনার আরাধনার জন্য কুলপুরোহিতের কাছে পুজোর ফর্দ নিতে এসেছে। সে বললো, ‘ঠাকুরমশাইকে দিলেন না মা ?’

উমাকান্ত বললেন, ‘না বাবা, এই ত্রিসন্ধ্যায় কোনো আহার করি না আমি। তুমি খাও। ত্রিসন্ধ্যা কাকে বলে জানো ?’

– না ঠাকুরমশাই।

– জেনে রাখো, ত্রিসন্ধ্যা হলো প্রাতঃসন্ধ্যা বা প্রাতরাহ্নিক, মধ্যাহ্ন-আহ্নিক আর সান্ধ্য-আহ্নিক। বুঝেছ ?

– আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু বলছিলাম ঠাকুর মশাই বাবা নেই, এত বড় দায়িত্ব। সব ঠিকঠাক পারবো তো ?

– কেন পারবে না ! দেবী শিবরোহিণী চণ্ডিকা তোমাকে দিয়ে সব করিয়ে নেবেন। তবে একটি কথা মনে রেখো, তোমার পিতা কখনো দেবী আরাধনায় কোনো রকম কার্পণ্য রাখতেন না বাবা।

– কিন্তু ঠাকুরমশাই, বাবার মৃত্যুর পর আমাদের পারিবারিক ব্যবসা অনেকটাই কমে গেছে। ভাবছি এবছর প্রীতিভোজের ব্যাপারটা স্থগিত করে দেবো।

– এই দেখো এসব হলো গে ওই গ্রহবিপাকের ফল বাবা। যাকে বলে দৈবদোষ। তোমার মা-কে বলবে, এ দশা অচিরেই আমি কাটিয়ে দেবো। তোমার পিতৃ দেবের দেওয়া রুপোর আরশে আমার শ্রীধর অধিষ্ঠান করেন। তোমাদের গ্রহবৈগুন্য খুব শীঘ্রই দূর হয়ে যাবে বাবা।

বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। উমাকান্ত বললেন, ‘দেখোতো গৌরী, এই সময় আবার কে এলো !’

পিতৃপুরুষের ভিটে উমাকান্তর। বেড়া দিয়ে ঘেরা বাস্তুভিটে। মোটা মোটা দেওয়ালের ঘর। খিলান দেওয়া দালান,উঠোন, তুলসীমঞ্চ। উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা। সুরকি খসা দেওয়ালে প্রাচীন কাঠের দরজার মাথায় শামুকচুনে লেখা ‘হরিধাম’।
গৌরী উঠোন পেরিয়ে এসে দরজা খুলতেই দেখলো আরতি দাঁড়িয়ে। মদন পল্লের স্ত্রী। ঘোষেদের পুকুরের ওপারেই বাড়ি। বছরখানেক হলো হঠাৎ স্বামী বিয়োগ হয়েছে আরতির। গৌরী বললো, ‘এসো ।’

গৌরী দেখলো কুলুঙ্গীতে জ্বলা প্রদীপটা যেন পলক ফেলতে ভুলে গেছে এই ঘরে। দেখলো টপটপ করে মেঝেতে পড়ছে জলের বিন্দু। সেই লজ্জিত ফোঁটাগুলোকে নিজের আঙ্গুল দিয়ে মুছলো আরতি। হিজিবিজি কাটলো তার ওপর

গৌরীর পিছন পিছন দালানে এসে দাঁড়ালো আরতি। গৌরী একটি জলচৌকি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বসো আরতি।’ আরতি বসলো না। ইতস্তত ভঙ্গিতে বললো, ‘আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে দিদি। ঘরে চলুন।’ গৌরী বললো, ‘ও, এসো তাহলে।’

ঘরে এসে মেঝেতেই বসে পড়লো আরতি। তাক থেকে পেড়ে একটা আসন দিচ্ছিল গৌরী,নিলোনা। বললো,’ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে দিদি। কি করে যে বলব কথাটা !’ গৌরী বললো, ‘নিঃসঙ্কোচে বলো আরতি, আমি তোমার দিদির মতো।’
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো আরতি। ম্লান উপবাসীর মত দেখাচ্ছিল আরতিকে। গৌরীর চোখের থেকে চোখ নামিয়ে বলল, ‘মেয়ে আমার তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা দিদি।’

আরতির মেয়ে দোলন, সবে বারো ক্লাসের পরীক্ষা দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো। সেই মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা !
এই প্রথম তার ঘরে অবৈধ সন্ধ্যার অন্ধকার প্রত্যক্ষ করল গৌরী। কু গেয়ে উঠল নিরুদ্ধ ঘরের বাতাস।বললো, ‘দোলন অন্তঃসত্ত্বা ! কি বলছো তুমি ! অমন ফুলের মত মেয়েটার সর্বনাশ কে করলো আরতি ! চুপ করে আছো কেন, বলো !’

গৌরী দেখলো কুলুঙ্গীতে জ্বলা প্রদীপটা যেন পলক ফেলতে ভুলে গেছে এই ঘরে। দেখলো টপটপ করে মেঝেতে পড়ছে জলের বিন্দু। সেই লজ্জিত ফোঁটাগুলোকে নিজের আঙ্গুল দিয়ে মুছলো আরতি। হিজিবিজি কাটলো তার ওপর। তারপর কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললো, মুখপুড়ির সব্বোনাশ করেছে তোমার ছেলে লিটন দিদি, লিটন।

পূর্বাভাস ছাড়াই বজ্রপাতের মত কথাটা এসে লাগল গৌরীর বুকে। গৌরী বললো,’কি বলছো কি তুমি ! কথাটার মাত্রা বোঝো !

– বিশ্বাস কর দিদি, আমি এক বর্ণও মিথ্যা বলছি না। মানুষটা চলে যাবার পর, নানা দায় বিপদে ডাকলেই ঘরে আসতো ছেলেটা। তোমাদের বংশ উঁচু। ওরা যে লুকিয়ে লুকিয়ে এসব করতো, মা হয়ে আমি ঘুণাক্ষরেও কোনোদিন বুঝতে পারিনি দিদি !

হাতে ধরা আসনটা মেঝেতে পড়ে গেল গৌরীর। অন্তঃসত্ত্বা শব্দটা গুলে গেল প্রদীপের কাঁপা কাঁপা আলোয়। এই ঘরভর্তি দেবতাদের সাক্ষী রেখে আরতি যেন জ্বেলে দিলো একটা আগুন। যেটা থেকে তাদের গৃহদাহ শুধু সময়ের অপেক্ষা।

বৃষ্টি হলে ঠাকুর ঘরের চাল থেকে জল পড়ে। ঠাকুরঘরের অনেক জায়গাতেই বাঁশের মুট দিয়ে জল পড়া ঠেকাতে পারছে না উমাকান্ত। তাই এবার বর্ষার পরই দেবতাদের সরিয়ে এনেছেন তাঁদের এই শয়ন কক্ষে। মেঝের একদিকে জলচৌকি পেতে পেতে, তার ওপর গুছিয়ে রেখেছেন দেব দেবীর বিগ্রহ। জলচৌকির পিছনের দেওয়ালে টাঙিয়েছেন বাঁধাই করা আরো কিছু দেবদেবীর ছবি। স্থান অকুলানের জন্য বাঁধাই করা কিছু ছবি, বাণ্ডিল করে ঈশান কোণে রাখা।

এতদিন উচ্ছন্নে যাওয়া অন্যের সন্তানের এমন কু-কীর্তি শুনে তো শিউরে উঠতো গৌরী। আজ তাকে শুনতে হলো নিজের সন্তান সম্পর্কে। মনে হচ্ছে তার শরীরের ভেতর একটা কেচ্ছা ঢুকিয়ে মর্গের সুতো দিয়ে সেলাই করে দিয়েছে কেউ। মনে হচ্ছে একটা নুড়ি বেরোতে পারছে না বলে ছটফট করছে সারা শরীর জুড়ে।

যা ছিল তার উপাসনাগার, সেটি আজ যেন পরিণত হয়েছে কারাগারে। তাকে ভর্ৎসনা করছে গিরিনন্দিনী, রুদ্রাণীর দৃষ্টিতে ক্রুরতা, ক্ষীরোদতনয়া চঞ্চলা। আদ্যামার ছবি থেকে খুলে একদিকে বিশ্রী ভাবে ঝুলছে গাঁদার মালা, অসন্তুষ্ট শ্রীনিবাস, রুষ্ট শ্রীকন্ঠ, গোপীবল্লভের মুখ থেকে উধাও হয়ে গেছে হাসি। ত্রিকালদর্শী বিনায়ক এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে গৌরীর দিকে।

ওই হারামজাদী দোলনের মুখটাকে গৌরীর মনে হচ্ছে অকাল সঙ্গমউত্তীর্ন এক অঘটন-পটিয়সীর মুখ। গৌরী কি করে বলবে, ছেলের ব্যাপারে সদা উদ্বিগ্ন উমাকান্তকে এই কু-কথা ! কেমন করে উচ্চারণ করবে কথাগুলো ! এই সংবাদ শোনার আগে কেন তার মৃত্যু দিলোনা দেবতারা ! অথচ এমন হীন কাজ করে কেমন দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে লিটন !

গৌরী লক্ষ্য করেছে, কোনোরকম চাকরি না করেও এখন মাঝেমধ্যেই টাকা আসে ওর পকেটে। গৌরী স্পষ্ট বুঝতে পারে ওই উপার্জনে ওর কোন বৈধ পরিশ্রম নেই। উমাকান্ত খেতে বসে টাকার উৎসের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল একদিন। বলতে চায়নি লিটন। উমাকান্ত চাপ দিতে থালাটা ছুঁড়ে ফেলে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল ছেলেটা।

তৃতীয়ার এক ফালি চাঁদ ক্রমশ যেমন বৃত্ত হয়ে ওঠে পূর্ণিমায়, সেই রকম তিল তিল করে দোলনের পেটের ভেতর বড় হচ্ছে এই চাটুজ্জে বংশের অবৈধ সন্তান ! ছিঃ ছিঃ !

গৌরী জিজ্ঞাসা করলো,’ কি চাও তুমি আরতি ?’

– জানিনা দিদি। হারামজাদীর পেটের শত্তুরটাকে নিয়ে আমি আর ভাবতে পারছি না।

উমাকান্ত বংশের ধারার সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম রাখতে চেয়েছিলেন দিব্যকান্ত। রাজি হয়নি গৌরী। অনেক ভেবেচিন্তে একমাত্র ছেলের নাম রেখেছিল লিখন। কলেজের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে লিখন থেকে কখন লিটন হয়ে গেছে ছেলেটা।

শানু ব্যানার্জীর কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন উমাকান্ত। ঘরে এসে ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে বসলেন দালানের মেঝেতে। গৌরী মুড়ি বাতাসা এনে রাখলো সামনে। সাতসকালে এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মানুষটা।গৌরী জিজ্ঞাসা করলো, ‘কিছু হলো ?’

– না।

– খোকা যে বলেছিল শানুদা একটা ব্যবস্থা করে দেবে!

– এখন অন্য কথা শোনাচ্ছে।

– অন্য কথা !

– লিটন ওদের পার্টিতে খুবই সক্রিয়। ভালো বলতে টলতে পারে। এলাকায় দাপট আছে। রাজনীতিতে ওর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। সামান্য চাকরি নয়, ওর কথা ওরা অন্যভাবে ভাবছে।

– বললেই হল ! এখন চলবে কি করে ! বিয়ে করে এনে বাপের ঘাড়ে বসে বসে খাচ্ছে ! কালঘাম ছুটিয়ে তুমি হন্যে হয়ে ঘুরছো ! বাবু এখনো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে ! চিন্তা আছে কোনো !

উমাকান্ত উত্তর দিল না কোনো। মনে মনে ভাবলেন তখন পই পই করে বারণ করেছিলাম। ঘরে জাগ্রত শালগ্রামশিলা।যজমানি করে খেতে হয়। ওই বেজাতের মেয়েকে এনে তুলো না।

কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে গৌরী গলায় ঝাঁজ মিশিয়ে বললো, ‘কথা কানে যাচ্ছে তোমার ?’

পরিবেশ ভারী হয়ে যাচ্ছে বুঝে উমাকান্ত একটু ঝুঁকে হালকা স্বরে বললেন, ‘কই,মেয়েটাকে দেখছি না তো !’ গৌরী খানিকটা অবাক হয়ে বলল, আজ হঠাৎ খোঁজ নিচ্ছ যে !’

– না, এমনিই।

– তাও ভালো। আজ ওর শরীরটা খারাপ। বমি করছে।

বুকটা এবার ছ্যাক করে উঠলো উমাকান্তর। একমুঠো মুড়ি তুলতে যাচ্ছিলেন গালে, শিথিল হয়ে এলো হাতটা। বাঁধনমুক্ত কয়েকটা মুড়ি উড়ে গেল এদিক সেদিক। গৌরী লক্ষ্য করছিল উমাকান্তকে। ঘাড়ের কাপড়টা একটু মাথায় টেনে মুখটা ঘুরিয়ে বললো, ‘ছিঃ,তুমি না দাদু হবে !’

উমাকান্তর ভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। বিগত অল্প ক-দিনে এই সংসারে যা যা প্রলয় ঘটেছে, তাতে ভিতর ভিতর অনেক শক্তি ক্ষয় হলেও তিনি তা আড়াল করতে পেরেছিলেন গৌরীকে। কিন্তু এবার তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালেন গৌরীর দিকে। এই অসহায় দৃষ্টিতে মনটা যেন ভিজলো গৌরীর। বললো, ‘শোনো আর কারো কাছে যাবার দরকার নেই। কারোর ভরসায় ছেলের বিয়ে দিয়ে দিইনি আমরা।’

উমাকান্তকে নিশ্চুপ দেখে আরো একটু সাহস সঞ্চয় হলো গৌরীর। ফিসফিস করে বললো, ‘ আমাদের পূর্বপুরুষের সঞ্চিত রাখা ধন, যেটা গোয়ালে পোঁতা আছে, সেটা তুলে নিলেই তো হলো।’

কোনো এক দুর্বল মুহুর্তে উমাকান্ত এ কথা ফাঁস করে ফেলেছিলেন গৌরীর কাছে। সে যে কত বড় ভুল, তিনি এখন তা মর্মে মর্মে অনুভব করেন। বিরক্ত কন্ঠে উমাকান্ত বললেন, ‘কি বলতে চাইছো তুমি !’

একাধিকবার জীবনে প্রতিকূল অবস্থায় পড়েও স্পর্শ করেননি সেই মহার্ঘ ভাণ্ডার। বরং মাটির নিচে সেই দুঃসময়ে অনেক আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। পূর্বপুরুষের প্রতি কৃতজ্ঞতায় উমাকান্ত কতবার গঙ্গাজল ছিটিয়ে গেছেন সেই পুণ্যভূমিতে। সেই সম্পদকে গৌরী আজ তুলে দিতে বলছে এক হীনবীর্য,লম্পট, কুলাঙ্গারকে !

– বলতে চাইছি, তোমার বাপ ঠাকুদ্দার আশীর্বাদ ঘরে থাকতে কেন দরজায় দরজায় ভিক্ষে করবে তুমি !

– তুমি কি পাগল হলে ! দেবতার উৎসর্গীকৃত ধন- সম্পদ ওই চরিত্রহীন ছেলের হাতে তুলে দেব !

– দুর্দিনেই যদি ওগুলো কাজে না লাগলো তাহলে কিসের জন্য গচ্ছিত রাখা !

– অসম্ভব এ কাজ তুমি করতে বলো না আমায়। আমি পারবো না। ওই অর্থ হাতে পেলে আর একটা কুটোও নাড়বে না তোমার ছেলে! দুদিনেই উড়িয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবে সব !

উমাকান্তর পূর্বপুরুষ গোয়াল ঘরে কিছু ধনসম্পদ মাটির নিচে গচ্ছিত রেখে যান। উমাকান্তর পিতা চন্দ্রকান্ত, তাঁর শেষ জীবনে কোনো এক চৈতালী পূর্ণিমায় একটি বর্ণদূত হস্তান্তর করেছিলেন উমাকান্তকে। সেই প্রাচীন ক্ষয়িষ্ণু পাতায় লেখা ছিল অস্পষ্ট কিছু হরফ। চন্দ্রকান্ত বাস্তু দেবতার নামে শপথ করে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন,উমাকান্ত যেন কোনোভাবেই ওই পরম্পরাগত মূল্যবান সম্পদ অপচয় না করে। কুলদেবতার কাছে শপথ নেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে বদ্ধপরিকর উমাকান্ত।

গৌরী বললো, ‘ বছরের পর বছর মাটির নিচে পড়ে থেকে ওর কটা ঠ্যাং বেরোবে শুনি ! শুধু যক্ষের মতো পাহারা দিয়ে লাভ কি!  মাটির নিচে পড়ে থাকার দিন শেষ হয়েছে ওর।’

– আঃ! চেঁচিও না ! দেয়ালেরও কান আছে । ভুলে গেছো কথাটা ! কত সংকটের মধ্যেও ওটাকে অক্ষত রেখেছি তুমি তো জানো !
– জানি। ছেলেটা নিজের পায়ে দাঁড়ালে সংসারটা ঘুরে দাঁড়াবে। অর্থ-সংকট সম্পর্ককে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। তুমি তাই চাও ?
– আর অর্থ যদি অনর্থের কারণ হয় ?
– এ তো আমাদের অর্থের প্রতি লোভ নয়। তা যদি হতো অনেক আগেই বের করে নিতে পারতাম ওটাকে।

তবুও কোথাও যেন প্রস্তাবটা মানতে পারছেন না উমাকান্ত। সেই চৈতালি পূর্ণিমার রাত্রিটির কথা মনে পড়ছে তাঁর। মনে পড়ছে অহিংস সন্ন্যাসীর মতো পিতার সেই দৃষ্টি। শুধুমাত্র একটা বিশ্বাসের বিনিময়ে তাঁর হাতে অর্পণ করে গেছেন অতি গোপন প্রাচুর্য। পিতার সেই অন্তিম ইচ্ছাকে আজও মনে মনে সম্মান করেন উমাকান্ত। না, এ কাজ তিনি বেঁচে থাকতে করতে পারবেন না।

একাধিকবার জীবনে প্রতিকূল অবস্থায় পড়েও স্পর্শ করেননি সেই মহার্ঘ ভাণ্ডার। বরং মাটির নিচে থেকে সেই দুঃসময়ে অনেক আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। পূর্বপুরুষের প্রতি কৃতজ্ঞতায় উমাকান্ত কতবার গঙ্গাজল ছিটিয়ে গেছেন সেই পুণ্যভূমিতে। সেই সম্পদকে গৌরী আজ তুলে দিতে বলছে এক হীনবীর্য,লম্পট, কুলাঙ্গারকে ! উমাকান্ত বললেন, ‘ও আমার কষ্টার্জিত ধন নয়। ওটিতে হাত দেবার কোনো অধিকার আমার নেই।’

গৌরীর মনে হল এই পৃথিবীতে এই মানুষটা অচল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ওগুলো কি পোঁতা থাকবে মাটির নিচে ! কি চাইছেন মানুষটা ! গৌরী দেখলো পিতৃপুরুষের কাছে যেন কুন্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন উমাকান্ত।

এমন সময় খোকার ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো দোলন। উঠোনের দিকে গেল ধীর পায়ে। চাটুজ্জে বংশের প্রায় লুপ্ত সভ্যতার উপর হেঁটে যাওয়া মেয়েটাকে তাঁর পোড় খাওয়া চোখে দেখলেন উমাকান্ত।

দালানের এক কোণে রাখা আমকাঠের তক্তপোশে বালিশে হেলান দিয়ে বসেছিলেন উমাকান্ত । দরোজা খোলা থাকলে ঘরের কিছু অংশ দেখা যায় তক্তপোশ থেকে। উমাকান্ত দেখলেন একাগ্রচিত্তে মৃদুস্বরে পাঁচালী পড়ছে গৌরী। পড়া শেষ করে জীর্ন মলাটের বইটা মাথায় ঠেকালো। কুলঙ্গির একপাশে জ্বলছে প্রদীপ। তেল-কালির দাগ পড়ে পড়ে কুলঙ্গির ভেতরের আলোটাকে মনে হচ্ছে যেন গুহা রঙের আলো। গৌরী হাতের বইটা যত্ন করে ভরে রাখলো একটি কাঠের ছোটো বাক্সে। প্রদীপটি নিয়ে বেরিয়ে এলো উঠোনের তুলসীমঞ্চের কাছে।

উমাকান্ত দেখলেন শিকারি জন্তু যেরকম শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেই ভাবে কোথা থেকে গৌরীর দিকে এগিয়ে এলো লিটন। চোখ দুটো লাল। হিংস্র দৃষ্টি। বললো, ‘মাল গুলো কোথায় ?’

– কি বলছিস যা তা !

এক পৈশাচিক হাসি ছড়িয়ে পড়লো লিটনের মুখে। বললো, “শালা ন্যাকা, মাল বুঝিস না ! গুপ্তধন ! যেটা তোর শ্বশুর আমার জন্য রেখে গেছে। ‘

– জানিস ওটা দেবতার ধন ! চোদ্দপুরুষ ধরে গচ্ছিত আছে।

– শালা চৌদ্দপুরুষ মারাচ্ছে ! চৌদ্দপুরুষ ধরে যা কামিয়েছে এক পুরুষে করে দেখিয়ে দেবো আমি। মালটা কোথায় রেখেছিস বল, নইলে–

উমাকান্ত দেখলেন সন্তানের সমস্ত ব্যাকরণ ভেঙে লিটন দাঁড়িয়ে আছে তার মায়ের মুখোমুখি। সন্তানের সেই বিকৃত মূর্তি দেখে গর্জন করে উঠলো গৌরী। বললো,’নইলে কি করবি তুই ? বখাটে, লম্পট, গুণ্ডা, মাতাল, হারামজাদা।’

হাতের এক ঝটকায় মা-কে মাটিতে ফেলে দিল লিটন। গৌরী হুমড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ল তুলসী মঞ্চের পাশে। গৌরীর হাত থেকে জ্বলন্ত প্রদীপটা উল্টে পড়ে গেল নিচে। উঠোনে জড়ো করা পাতাগুলো জ্বলে উঠল দাউদাউ করে। সমস্ত আগুনের থেকে আলাদা শ্মশানের আগুন। উমাকান্ত দেখলেন সেইরকম আগুন জ্বলছে আজ তার উঠোনে। তার বাস্তু ভিটে জ্বলছে। সেই জ্বলন্ত আগুনের আভায় লিটনের চোখ দুটো আততায়ীর মতো। এবার সেই আগুন ক্রমশ এগিয়ে আসছে গৌরীর দিকে। উমাকান্ত উঠে বসতে গেলেন। কিন্তু সমস্ত শরীরটা অবশ। চিৎকার করতে চাইলেন। না, কোনো শব্দ বের হলো না তাঁর মুখ দিয়ে। আগুন এবার গ্রাস করবে গৌরীকে।

পাঁচালী পড়া থামিয়ে উঠে এলো গৌরী। বললো, ‘এই অবেলায় শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখছো নাকি ? গৌরী তার হাতটা রাখলো উমাকান্তর বুকে। উমাকান্তর শরীর তখনও কাঁপছে। পায়ের কাছে রাখা কাঁথাটি বুকের কাছে টেনে দিলো গৌরী। তখনো স্বপ্নের ঘোর কাটেনি উমাকান্তর। স্বপ্ন-আতঙ্ক দৃষ্টিতে দেখলেন আলকাতরা মাখানো কড়ি বরোগা, সুরকি খসা দেওয়াল। তবুও চাটুজ্জে বংশের মর্যাদা তিনি ঝরতে দেবেন না।

উমাকান্ত দেখলেন ঘরের ভিতরে প্রদীপটা স্থির। সেই পিলসুজের পাশে সন্ধ্যার ওপর পড়ে আছে মাদুর কাঠির আসনটি। তাঁর জীর্ণ কোঠাবাড়ি ভরে আছে পিতল রঙের আলোয়। সেই শান্তিকল্যাণ আলোয় তিনি মনস্থির করলেন লুকিয়ে ফেলতে হবে। অন্যত্র লুকিয়ে ফেলতে হবে যথাশীঘ্র।

পরদিন সকালে উমাকান্ত স্নান সেরে সূর্য প্রণাম করলেন। মন বড়ই অস্থির। তবু্ও যৎপরোনাস্তি চেষ্টা করলেন স্বাভাবিক থাকার। কেউ যেন কিছু টের না পায়। এমনকি গৌরীও। পরিকল্পনা নিঁখুত হওয়া চাই। যা যা প্রয়োজন হবে সবকিছুই রাখতে হবে হাতের নাগালের মধ্যে। আর বিলম্ব করা যাবে না। আজ নিশীথেই লুকিয়ে ফেলতে হবে। অতি গোপনে।

ক্ষণে ক্ষণে দেবী সিদ্ধেশ্বরীকে স্মরণ করে নির্বিঘ্নে পার করলেন দিনটি। না, কেউ সন্দেহ করেনি। সন্ধ্যাকালে উমাকান্ত পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন নিজের জগতে। আজও তাই করলেন। রাত হল। আহারাদি সমাপ্ত হলে বিছানা করলো গৌরী। ক্লান্ত অবসন্ন গৌরী নিয়মমাফিক এ কথা সে কথার পর হুঁ,হ্যাঁ ব্যতীত প্রত্যুত্তর না পেয়ে অচিরেই নিদ্রামগ্ন হল। ঘুমের ভান করে আরো কিছুক্ষন চোখ বুঁজে শুয়ে রইলেন উমাকান্ত। এইভাবে কাটলো কয়েক দন্ড। আজ সাতুই ফাল্গুন। তিথি শুক্লা নবমী। রাত্রি দ্বিপ্রহরে হালকা শীতের আমেজ। উমাকান্ত অতি সন্তর্পনে নিঃশব্দে শয়ন কক্ষ ত্যাগ করে উপনীত হলেন দালানে। শ্বাপদের মত তীক্ষ্ণ তাঁর দৃষ্টি। দালানে দুটি দরোজা। উত্তর দিকের দরোজাটা সচরাচর বন্ধ থাকে। অতি সন্তর্পণে সেই দরোজাটি খুলে পদার্পণ করলেন বাস্তুর ব্রহ্মস্থানে। শুক্লা নবমীর অযাচিত চন্দ্রিমা তাঁকে দু-পা পিছিয়ে দিল। চাঁদের আলোর এই প্লাবন তবে কি তার অভিলিপ্সার বিরোধী ! মৃদু হাসলেন উমাকান্ত । এই মধ্য যামে কেই বা তাঁকে অনুসরণ করবে !

বাতাসে বাতাবি লেবু ফুলের সৌরভ। পা-দুটি মৃদু কাঁপছে উমাকান্তর। অন্তর তার দৃঢ়। কর্তব্যে অনড়। এক পা এক পা করে হাঁটছেন। শব্দ শুষে নিচ্ছে চরণতল। উঠোন পেরিয়ে আগল খুলে তিনি এসে দাঁড়ালেন বাথানের মাঝখানে। এককালে এখানে থাকতো গোমাতা ভগবতীর পূর্ণ সংসার। কাঁচা ইঁটের মেঝে। এসময়ে এখানে তাঁর উপস্থিতি অনাহুত।

রুক্ষ হাতে কুপিটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু এ কোন উমাকান্ত ! দু-চোখে আগুন। ফাটল ধরেছে সারা মুখে। যেন এক জাতিস্মর উঠে দাঁড়ালেন কোনো প্রলয়ভূমিতে। অতি যত্নে রক্ষিত সেই পুঁথির রহস্য পুনর্বার পাঠোদ্ধার করতে হবে। জ্বলন্ত কুপিতে কোনো অক্ষর অবলোকিত হলো না

উমাকান্ত বুঝতে পারছেন এ বড় কঠিন কাজ। পূর্বপুরুষের সত্য ধর্ম ইঁট খুঁড়ে তুলবেন তিনি। বাতাসে তাঁদের নিঃশ্বাসের শব্দ। লুকিয়ে ফেল উমাকান্ত, লুকিয়ে ফেল। কুপি জ্বালালেন উমাকান্ত। সলতে কমালেন। ম্রিয়মান শিখায় আধিভৌতিক গোয়ালে তাঁর শরীরে মৃদু শিহরণ অনুভূত হলো। দু-হাত জোড় করে জপ্ করলেন মন্ত্র –

ওঁ শ্রীম্
ওঁ হ্রীম্ শ্রীম্
হ্রীম্ ক্লিম্ শ্রীম্ ক্লিম্
বিত্তেশ্বরায় নমঃ

এবার চিহ্নিত অকুস্থানে শাবল দিয়ে একটি একটি করে ইঁট তুলছেন উমাকান্ত। অতি সন্তর্পনে। যাতে প্রতিটা শব্দ গহ্বরে মিশে যায়। কয়েক থাক ইঁট তুলতে বেরিয়ে এলো মাটি। তিনি যেন আজ নিশুতি রাতের পূজারী। সুনির্দিষ্ট ভূমি থেকে এক চিমটে মৃত্তিকা তুলে ঠেকালেন কপালে। মাটির কিছু অংশ ঝরলো, কিছু অংশ বিন্দুবিন্দু ঘামে সিক্ত হয়ে লেপে রইলো। তারপর লৌহ শলাকাটি দিয়ে গিঁথে গিঁথে অনুভব করতে লাগলেন পিতৃদান। কিন্তু উঠে এলো না কোন ধাতব শব্দ। আরো ক্ষিপ্র হয়ে উঠলেন উমাকান্ত। তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করলেন মরীয়া হয়ে। কিন্তু গুপ্তধন কোথায় ! উদ্ভ্রান্তের মতো সরাতে শুরু করলেন আরো ইঁট। স্তুপাকার করলেন মাটি। বুড়ো হাড়ে ধকল সইলো না বেশিক্ষণ। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলেন এবড়োখেবড়ো মাটির ওপর। নবমীর চাঁদ তখন আরো ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। সেই ইন্দু বিন্দু দিয়ে তিনি মেপে নিলেন উষাকাল। সময় বড়ই কম। এই ভিটেতে আজ প্রভাতকিরণ ঢুকে পড়ুক চান না উমাকান্ত।

রুক্ষ হাতে কুপিটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু এ কোন উমাকান্ত ! দু-চোখে আগুন। ফাটল ধরেছে সারা মুখে। যেন এক জাতিস্মর উঠে দাঁড়ালেন কোনো প্রলয়ভূমিতে। অতি যত্নে রক্ষিত সেই পুঁথির রহস্য পুনর্বার পাঠোদ্ধার করতে হবে। জ্বলন্ত কুপিতে কোনো অক্ষর অবলোকিত হলো না। তিনি দেবী চঞ্চলার শ্মরণাপন্ন হলেন। ‘ মা,আমি এই গোয়ালে তোমার পায়ের পাতার চিহ্নখানি হারিয়ে ফেলেছি মা। মা-গো, বলে দাও,মা ক্ষীরোদতনয়া আমাকে দয়া করো।এই বুড়ো স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে। বলে দাও মা। কোথায় তোমার সেই চরণ ?’

উন্মত্ত উমাকান্ত সেই চিহ্ন খুঁজতে জ্বলন্ত কুপি হাতে ছুটে বেড়াচ্ছেন। বাস্তুর অন্ধকার ফালা ফালা করে এক পুরোহিত যেন প্রলয় আরতি করছেন, প্রলয় আরতি।

ঘর থেকে বেরিয়ে গৌরী এসে দাঁড়ালো গোয়ালের সম্মুখে। প্রমত্ত উমাকান্তকে দেখে দাঁড়িয়ে রইলো হতভম্বের মতো। পূজারী ভিটেয় এই প্রথম তার স্বামীর অবয়ব উপাসনাহীন। বললো, ‘ মাঝরাতে এ-সব কি করছো !’

উমাকান্ত দেখলেন গৌরীকে। যেন সন্মুখে অতি পৌরাণিক যজ্ঞভঙ্গকারী এক নারী। কন্ঠে বিরক্তি মিশিয়ে বললেন, ‘তুমি এখানে কেন !’

একটু সাহস সঞ্চয় করে ইঁটের স্তূপ, তালগোল করা মাটি ডিঙিয়ে উমাকান্তের কাছে এসে চাপা স্বরে বললো, ‘পেয়েছো ?’
উমাকান্তর দৃষ্টি এবার ভুঁয়ে নিবদ্ধ হলো। অবিন্যস্ত ইঁট, মাটির উপর বাতাসার মত থোকা থোকা পড়ে আছে চাঁদের আলো। দীর্ঘশ্বাস উজাড় করে বললেন, ‘না।’

পরিবেশ দেখে গৌরীর মনে হয়েছিল সবে মাত্র মাটির গর্ভ থেকে কেউ উপড়ে নিয়েছে যক্ষের ধন। তিরিক্ষি মেজাজে বললো, ‘মিথ্যে কথা ! কোথায় লুকিয়েছো শুনি !’ পরিশ্রান্ত উমাকান্ত উদাসী দৃষ্টিতে গৌরীর দিকে বললেন—

‘ যং হি ন ব্যথয়ন্তেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ
সম দুঃখ সুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে।’

শ্লোকের অর্থ কিছু বুঝতে পারলোনা গৌরী। দু-হাত দিয়ে ঝাঁকাতে শুরু করলো সে উমাকান্তকে। বললো,’ ছিঃ,আমাকেও অবিশ্বাস !’

সেই ঝাঁকুনিতে যেন দম আটকে এলো উমাকান্তর। নতুন একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইছে জঠর থেকে। ধাতস্থ হতেই উমাকান্ত বাম হাতখানি রাখলেন গৌরীর কাঁধে। গৌরী বিতৃষ্ণায় হাতখানা ছাড়িয়ে পিছিয়ে গেল দু-পা। তখনই ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘কে, কে ওখানে !’

উমাকান্ত দেখলেন গোয়ালের দক্ষিণ গবাক্ষ থেকে একটা ছায়া মূর্তি সরে গেল। চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে সম্বরণ করলেন উমাকান্ত । দৈব কিছু আজ ঘটবে এ যেন তারই সংকেত।

সেই ছায়ামূর্তিটি দরজা দিয়ে ধীর পায়ে গোয়ালে প্রবেশ করলো। কুপির ক্ষীয়মান হলুদ আলো এসে পড়লো সেই মূর্তির মুখমণ্ডলে। ভয়ে সংকুচিত গৌরী বিস্মিত কন্ঠে বললো, ‘একি দোলন,এত রাতে !’

– হ্যাঁ মা ।

– ঘুমোওনি !

– না মা । রাতে আপনার ছেলে ছাইভস্ম খেয়ে এলো। এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমার ঘুম এলো না । তাই একটু ছাদে গিয়েছিলাম। মাঝেমধ্যে আমি তাই করি মা । ঘুম এলে নেমে আসি । আজ দেখি কে একজন উঠোন পেরিয়ে গোয়ালে ঢুকলো । চাঁদের আলোয় মনে হল যেন বাবা । চুপি চুপি গোয়ালের এই জানালায় এসে দাঁড়ালাম । দেখলাম সব । তারপর আপনি এলেন । দেখে ফেললেন আমায় । না হলে আমি ঘরে ফিরে যেতাম ।

মনে মনে স্বস্তি পেল গৌরী । যাক্ তাহলে অন্তত সাক্ষী রইলো একজন ।

উমাকান্ত এতদিন তার ও বৌমার মাঝে তুলে রেখেছিলেন একখানি দেওয়াল। গৌরী মাঝেমধ্যে তা ভাঙতে চাইলে নানা কারণ দেখিয়ে তা হটিয়ে দিতেন। স্কুলে পড়াশোনায় বৌমার একটা সুনাম ছিল। কিন্তু আজকালকার পড়াশুনা, এই অজুহাতে এই সুনাম তার কাছে ধোপে টিকতো না। আজ অলৌকিক কিছু ঘটবে,এই বিশ্বাস উমাকান্তর মনে প্রবল থেকে প্রবলতর হল। ডাকলেন,’বৌমা ?’

যেন ওঙ্কার ধ্বনিতে নড় উঠলো সব। গৌরী নড়লো, নড়ে উঠলো বৌমাও। উমাকান্ত দেখলেন বৌমা দাঁড়িয়ে আছে নতমস্তকে। বললেন, ‘এই পুঁথির অর্থ উদ্ধার করতে পারো ?’

দোলন দেখলো অস্পষ্ট হলেও তা অনায়াস বোধগম্য। কয়েকটি মাত্র শব্দ।

ঈশান বায়ু এক গজ
দখিনে এক করী মধ্যে রজ

উমাকান্ত যৎপরোনাস্তি উৎফুল্ল হয়ে অত্যুৎসাহে বললেন, ‘হ্যাঁ বৌমা, ঠিক। ঠিকই পাঠোদ্ধার করেছো। আমি কি তবে ভুল খুঁজলাম।

দোলন দেখলো গোয়ালের উত্তর পূর্ব কোণ সংলগ্ন জায়গা খোঁড়া হয়েছে। তার মনে হচ্ছে, সূত্রে অন্য কিছু বলা আছে। মন দিয়ে সূত্রটি কয়েকবার আওড়ালো দোলন।

এক গজ। এক গজ মানে এক হাতি দৈর্ঘ্য। দক্ষিণে এক করী, এক করী মানে এদিকেও এক হাতির মাপ। মনে মনে অঙ্ক কষলো দোলন । গোয়ালের দৈর্ঘ্য প্রস্থ অনুমান করে, হাতির দৈর্ঘ্য অনুমান করে, যে স্থানটি চিহ্নিত হলো, তা মূলত গোয়ালের মধ্যিখান।
দোলন জ্বলন্ত কুপিটি রাখলো নিরাপদ স্থানে। গোভুমির ব্রহ্মস্থানে প্রণাম করলো মাথা ঠেকিয়ে। উমাকান্ত দেখলেন, যেন স্বয়ং মহালক্ষী আবির্ভূতা হয়েছেন। পৃথুলানিতম্ব কমলাসনা। আনত বক্ষযুগল বিল্বসদৃশ।হাতে ভল্ল। যেন রুদ্রবীণা !

উমাকান্ত উপলব্ধি করলেন এইতো সেই বৈভবলক্ষ্মী ! যা আজ তাঁর ভিটেতে অধিষ্ঠিতা। সর্বরক্ষাকারী এই বুদ্ধিমতী নারী-ই হতে পারে আমার একমাত্র উত্তরাধিকার।

গৌরী দেখলো দৃঢ় প্রত্যয়ে দোলন খুঁড়ে চলেছে মাটি। পূর্বপুরুষের বাণী তো আর মিথ্যে হবার নয়। এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

♦–·–♦ • ♦–·–♦ • ♦–·–♦ • ♦–·–♦


  • Tags:
❤ Support Us
Advertisement
2024 Debasish
Advertisement
2024 Lakshman Seth
Advertisement
error: Content is protected !!