Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • অক্টোবর ২৭, ২০২৪

সন্ধিক্ষণের কথাকার

সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
সন্ধিক্ষণের কথাকার

চিত্রকর্ম: দেব সরকার

 
২০২৪ এ  সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং-কে বেছে নিয়েছেন সুইডিশ একাডেমি । নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান অ্যান্ডারস ওলসন প্রশংসা করে বলেছেন যে হান এর লেখায় দেহ এবং আত্মা, জীবিত এবং মৃতের মধ্যে সংযোগ তৈরিতে অনন্য সচেতনতা ছড়িয়ে আছে এবং লেখক কাব্যিক এবং পরীক্ষামূলক শৈলীতে সমসাময়িক গদ্যের উদ্ভাবক হয়ে উঠেছেন। তিনি তার তীব্র কাব্যিক গদ্য যা ঐতিহাসিক আঘাতের মুখোমুখি হয় এবং মানব জীবনের ভঙ্গুরতা সামনে নিয়ে আসে ।
 
হান কাং এর জন্ম ২৭ নভেম্বর, ১৯৭০ এ গোয়াংজু শহরে। তাঁর পরিবার সাহিত্যিক পটভূমির জন্য সুপরিচিত। বাবা ঔপন্যাসিক হান সিউং-ওন। তাঁর বড়ো ভাই হান ডং-রিমও একজন বহুমাত্রিক লেখক, ছোটো ভাই হান কাং-ইন ও একজন কথাসাহিত্যিক এবং কার্টুনিস্ট।
 
৯ বছর বয়সে, হান সিউলের সুয়ু-রিতে চলে আসেন, যখন তাঁর বাবা পূর্ণ-সময়ের লেখক হওয়ার জন্য তাঁর শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দেন। গোয়াংজু বিদ্রোহ ছিল একটি গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন, যা ছাত্র ও বেসামরিক নাগরিকদের সামরিক হত্যাকাণ্ডে শেষ হয়েছিল। তিনি এই গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পারেন ১২ বছর বয়সে। হান পরে তাঁর শৈশবকে “একটি ছোটো শিশুর জন্য খুব বেশি” বলে বর্ণনা করেছেন। ১৯৮৮ সালে, পুংমুন গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী ১৯৯৩ সালে, ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। ১৯৯৮ সালে, তিনি ইউনিভার্সিটি অফ আইওয়া ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে যোগ দেন। এরপর হান মাসিক সেমেটিও ম্যাগাজিনের রিপোর্টারের কাজে সংযুক্ত হন । হানের সাহিত্য জীবন একই বছর শুরু হয়েছিল, যখন “সিওলে শীত” সহ তাঁর পাঁচটি কবিতা ত্রৈমাসিক সাহিত্য ও সমাজের শীতকালীন ১৯৯৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পরের বছর হান কাং-হিউন ছদ্ম নামের আড়ালে কথাসাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ করেন, তাঁর ছোটোগল্প “দ্য স্কারলেট অ্যাঙ্কর” সিওল শিনমুন আয়োজিত নববর্ষের সাহিত্য প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়। তাঁর প্রথম গল্প সংকলন, “আ লাভ অফ ইয়েসু” ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় এবং এর সুনির্দিষ্ট এবং শক্তভাবে বর্ণিত কাঠামোর জন্য মনোযোগ আকর্ষণ করে।এরপর, শুধুমাত্র সাহিত্যে মনোনিবেশ করার জন্য পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দেন হান কাং।
 

হান কান – “ উপন্যাস আমার কাছে প্রশ্ন করার একটি পরিসর। আমি  লেখার মাধ্যমে আমার প্রশ্নগুলি সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করি এবং আমি প্রশ্নগুলির মধ্যেই থাকার চেষ্টা করি, যা কখনও বেদনাদায়ক, কখনও ভাল, কখনও দাবি

 
কলেজের দিনগুলিতে হান কোরিয়ান আধুনিকতাবাদী কবি ই সাং–এর কবিতার একটি লাইনে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন : “আমি বিশ্বাস করি যে মানুষের উদ্ভিদ হওয়া উচিত।” জাপানি দখলদারিত্বের অধীনে কোরিয়ার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান বোঝাতে কবিতার পংক্তিটিতে আসক্ত হয়ে পড়েন । লাইন বুঝতে পেরেছিলেন এবং এটিকে তাঁর সবচেয়ে সফল কাজ, “দ্য ভেজিটেরিয়ান” লেখার অনুপ্রেরণা হিসাবে গ্রহণ করেন। তিন খণ্ডের উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ, মঙ্গোলিয়ান মার্ক, ই সাং সাহিত্য পুরস্কার জিতে নেয়।
 
হান দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম লেখক যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন।  এর আগে সেদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কিম ডাই-জং শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার পূর্ববর্তী সামরিক শাসনের সময় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং সম্পর্ক উন্নয়নে তাঁর প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিল।
 
১৯৯৩ এ হান কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম ছোটোগল্প সংকলনটি পরের বছর প্রকাশিত হয় এবং প্রথম উপন্যাস ‘ব্ল্যাক ডিয়ার’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। ইংরেজিতে অনূদিত রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’, ‘গ্রিক লেসনস’, ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’। ‘দ্য হোয়াইট বুক’-একটি কাব্যিক উপন্যাস যা হান এর বোনের মৃত্যু নিয়ে লেখা।তাঁর ‘দ্য হোয়াইট বুক’ ২০১৮ সালে বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন তালিকায় ছিল।
 
২০১৬ সালে দ্য ভেজিটেরিয়ানের জন্যও বুকার জিতেছিলেন হান কাং । এ এক অন্য ধরনের উপন্যাস যেখানে একজন মহিলার মাংস খাওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্তের বিধ্বংসী পরিণতি ভেসে ওঠে। সে পুরস্কার জেতার সময়, হান বলেছিলেন – “উপন্যাস আমার কাছে প্রশ্ন করার একটি পরিসর। আমি আমার লেখার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমার প্রশ্নগুলি সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করি এবং আমি প্রশ্নগুলির মধ্যেই থাকার চেষ্টা করি, যা কখনও বেদনাদায়ক, কখনও ভাল, কখনও দাবি”। ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’- প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “আমি মানুষ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম এবং আমি এমন একজন মহিলার বর্ণনা করতে চেয়েছিলাম, যিনি মরিয়া হয়ে মানব জাতির সঙ্গে যুক্ত হতে চান না, প্রকট জেদ নিয়ে মানবজন্মকে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিলেন।”
 

তাঁর উপন্যাস হিউম্যান অ্যাক্টস সম্পর্কে বুকার কমিটির চেয়ারম্যান ওলসন বলেছেন, ‘সাক্ষী সাহিত্যের’ এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত।নিজের শহর গোয়াংজুতে গণতন্ত্রপন্থী আর প্রতিবাদী জনতার ওপর স্বৈরশাসকের নৃশংস অত্যাচার, হত্যাকান্ড স্বচক্ষে দেখেছেন হান, এটাই তাঁর এ উপন্যাসের বিষয়, যেখানে মানুষের বিভ্রান্তি ও ক্ষমতামত্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন লেখক , শক্তিশালী পদ্যময় গদ্যে । নোবেল কমিটির স্থায়ী সদস্য আনা কারিন-পাম বলেছেন, হান কাং এর ভাষা আর বিষয়ের নির্মাণে জড়িয়ে আছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, লেখকের মগ্নচৈতন্যকে, বিবেবককে পরাবাস্তবের জগতে নিয়ে যায়, খুলে দেয় সমস্ত বন্ধন- । বস্তুত, অদ্ভূত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমরা । একদিকে, পিতৃতান্ত্রিক, পুরুষ-শাসিত সমাজে মেয়েদের অস্তিত্বের ওপর লাগাতার হামলা, অন্যদিকে মেয়েরাই প্রতিবাদে মুখর এবং তাঁদের প্রতিবাদকে সম্মান জানাচ্ছে, গ্রহন করছে, প্রশ্ন তুলছে সীমান্তহীন মানবিকতা ।
 
হান কাং এর কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে এই সংযুক্তি আরও গভীরভাবে টের পেলাম । তাঁর সাহিত্যচর্চাকে অনেকেই ট্রান্সগ্রেসিভ আর্ট বলে বিশেষিত করে থাকেন । নোবেল সাহিত্য কমিটি মূ্ল্যায়ন করল এইভাবে যে, হান কাং এর সাহিত্যকর্ম বহুধরনের শৈলীকে একত্রিত করে নতুন নির্মাণের, অভিনব সূষ্টির জন্ম দিচ্ছে, আর এ কাজে হিংসা, শোক আর পিতূতান্ত্রিক সমাজের জটিলতার নানা স্তরের ছবি তুলে ধরছে ।

 

হান কাং

ঘন কালো আলোর ঘর

তরজমা: সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়

 
সেদিন উই-ডং এ বরফ পড়ছিল,
আমার শরীর ও সত্তা কাঁপছিল
প্রতিটি অশ্রুপাতের সঙ্গে ।
 
এবার তোমার পথে যাও ।
 
তুমি কি দ্বিধাগ্রস্ত ?
তুমি স্বপ্নে ভাসছ ?
 
দোতলা বাড়িগুলো ফুলের মতো মাতাল,
তাদের নিচে বসে
আমি নিদারুণ যন্ত্রণা পেতে শিখেছি,
বোকার মতো হাত বাড়িয়েছি
সে অস্পৃশ্য ভালোবাসার দিকে ।
 
এবার তোমার পথে যাও।
 
তুমি কি স্বপ্ন দেখছ?
এগিয়ে যাও রাস্তার বাতিগুলোর ওপর দিয়ে
জমে থাকা স্মৃতির দিকে,
আমি হাঁটছি,
আমি চোখ তুলে তাকালাম,
সে আলোছায়ার ভেতরে,
একটা ঘন কালো রংয়ের ঘর,
ঘন কালো আলোর একটা ঘর।
 
আকাশ অন্ধকার,
সে অন্ধকারের বাসিন্দা পাখিরা
তাদের শরীরের ভার মুক্ত করে উড়ছে,
এভাবে ওড়ার জন্য
আর কতবার মরতে হবে আমাকে?
কেউ আমার হাত ধরবে না।
 
কোন স্বপ্ন এত প্রিয়?
কোন স্মৃতি এতো উজ্জ্বল?
 
মায়ের আঙুলের স্পর্শের মতো বরফ পড়ছে,
মসৃণভাবে গড়িয়ে পড়ছে
আমার অবিন্যস্ত ভুরুর মাঝখানে,
ধাক্কা দিচ্ছে হিমায়িত চিবুকে,
সূক্ষ্ম রেখা টেনে দিচ্ছে
সেই একই জায়গায় ।
 
তাড়াতাড়ি করো
তোমার নিজস্ব পথে যাও।
 

♦•♦–♦•♦ ♦•♦–♦•♦

কবি পেশায় চিকিৎসক । কলকাতার বাসিন্দা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!