- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- নভেম্বর ২৪, ২০২৪
নাম বদলের রাজনীতি অথবা ক্ষমতার ষড়যন্ত্র
স্থান-নাম বদলের এই খেলা শুধুমাত্র ক্ষমতারই। ক্ষমতার নগ্ন প্রদর্শন কে গ্রহনযোগ্য করে হাজির করতে, ক্ষমতাসীনরা ইতিহাস, সাহিত্য থেকে ধর্ম – যে কোনো অজুহাত বেছে নেয়, নিতে পারে, নিয়েছে, নিচ্ছে আর প্রায় সব ক্ষেত্রেই আদত সাহিত্য, ইতিহাস বা ধর্ম-পুঁথি’কে তারা বিকৃত করেছে
নামে কি আসে-যায় ? – অবশ্যই আসে-যায়। কেন ? যে পাড়ায় অনেক গোলাপ গাছ, বাগান, চাষ, সে পাড়ার নাম– “গোলাপ পাড়া” না “রোজ স্ট্রিট” নিয়ে তর্ক ওঠে ? ঝগড়া বাঁধে ? এবং অন্তিমে, সে ঝগড়ায় জয় কাদের হয় ? কেন হয় ? কেন নাজি বা নাৎসিরা, একদা, বদলে দিয়েছিল অসংখ্য স্থান-নাম ? যেমন পূর্ব প্রুশিয়ায় ১৯৩৮ সালে ১৫০০-এরও বেশি স্থান নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল। জার্মানি এবং নাৎসিদের আগ্রাসিত অঞ্চলগুলিতে শহর-নাম, রাস্তা এবং চত্বর-নাম নাৎসি নেতাদের নামে এবং যুদ্ধ করতে গিয়ে অক্কা পাওয়া খুনি সব জার্মান অফিসারদের নামে, নামকরণ করা হয়েছিল। উদাহরণ : অ্যাডল্ফ হিটলার, হারম্যান গোরিং, হর্স্ট ওয়েসেল ইত্যাদি। বিভিন্ন রাস্তা এবং চত্বর অ্যাডল্ফ হিটলারের নামে নামকরণ করা তো হয়েইছিল।
কেন ?
উত্তরে যদি বলি, প্রথমত, এই পরিবর্তনগুলি নাৎসিদের দ্বারা দখলীকৃত ও নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে, তাদের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ আরোপের ব্যাপক কৌশলেরই অংশ। দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল নাৎসিদের মতাদর্শ প্রচার করা এবং অ-জার্মান সমস্ত কিছু মুছে ফেলা। দেখা যাচ্ছে বদলে-ফেলার আগে, সে নামগুলি ছিল পুরানো প্রুশিয়ান, লিথুয়ানিয়ান এবং পোলিশ উত্সের।
– এভাবে বললে হয়তো বলাটা বেশ ভারি হয়, কিন্তু বোধ্যতা তাতে কমে যায়। যেতে বাধ্য। বরং ফিরে যাই সেই “গোলাপ পাড়া” র গল্পে।
ধরা যাক গোলাপ পাড়ার বাসিন্দারা ছিল গোলাপ-চাষী। তিন পুরুষ ধরে কিংবা সাত পুরুষ ধরে। অতঃপর গোলাপের সৌরভে, সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে, প্রমোটার বাবুর, কিছুসংখ্যক গোলাপ-চাষীকে পটিয়ে, কাউকে কাউকে ভয় দেখিয়ে “কব্জা” করে নিল খানিকটা জমি আর তাতে তুল্লো তল্লাটের প্রথম ফ্ল্যাটবাড়িটি যেখানে খোপ-কোঠা কিনে বাস করতে এলেন গোলাপের-মাধুর্য্যে মাতোয়ারা উচ্চ ও মধ্য মধ্যবিত্তের দল, যাঁদের আয়ের উৎস – চাকরি, ব্যবসায় অথবা দালালি, যাঁদের বাক্যে, ভুলে-শুদ্ধে ইংরেজি মিশে গিয়েছে। “গোলাপ পাড়া” র না্ম “রোজ স্ট্রিট” হলে বেশি ভালো হয় কেননা অমুক অমুক দেশে রয়েছে এমতো স্ট্রিটের-নাম – এই প্রস্তাবটি আসবে ওই বাবুদের দিক থেকেই। কিন্তু প্রস্তাবটি ততক্ষন জোরালো হবে না যতোক্ষন না “গোলাপ-প্রিয় প্রোমোটার” দের মাধ্যমে আরও কিছু ‘গোলাপ-জমি’ গ্রাস করে, তাতে আরো কিছু ফ্ল্যাট না ওঠে। অর্থাৎ যে মুহুর্তে “কোয়ান্টিটি” ভারি হতে আরম্ভ হবে, উচ্চ ও মধ্য-মধ্যবিত্তের (যাঁদের আয়ের, উপার্জনের উৎস – চাকুরি, ব্যবসা অথবা দালালি – তখনই “রোজ স্ট্রিট” বনাম “গোলাপ পাড়া”-র ঝগড়ার পরণতি যাবে “রোজ স্ট্রিট ” এর পক্ষে। পক্ষান্তরে, যদি একটি আজগুবি পরিস্থিতির কথা ভাবা যায় (যেমন থাকে “ডিসডোপিয়ান” ওয়েব-সিরিজ গুলিতে) যেখানে, এই “রোজ স্ট্রিট” এ একদিন ফিরে এল সব সাবেক গোলাপ-চাষীরা, ফিরে এল তাদের সেই আগেকার আর্থ-সামাজিক অবস্থান নিয়েই। এবং এসে, সেই একই পাড়ায় বাসও করতে লাগল, তখন, কোয়ান্টিটি’র ভারে, আবার “গোলাপ-রোজ” দরবার, নিশ্চিত না হলেও, সম্ভাব্য এবং এবার নিষ্পত্তিও “গোলাপ পাড়া”র পক্ষেই যাওয়াও সম্ভাব্য।অর্থাৎ, স্থান-নামের পরিবর্তন আদতে ক্ষমতারই প্রদর্শন, নিদর্শন।
নামবদলের অন্তর্গত রাজনীতি ও আধিপত্যবোধের বিরুদ্ধে সহমত প্রত্যেক সহ-নাগরিককে বুঝতে হবে, শাসকের ‘হেজিমনি’ জাত বিষয়ভাবনার নিঃশব্দ, সশব্দ ছোবল ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনবে; সামাজিক উদাসীনতার সুযোগে এই নাম বদল, এই সকল নাম-বদল, আদতে, আমাদের প্রত্যেকের গালে, এই শাসক-গোষ্ঠীর এক একটি সপাট থাপ্পড়। এ রকম থাপ্পড় আমরা আর কত মেনে নেব ?
ক্ষমতা প্রদর্শনের এই প্রতীকী খেলায় জয় তারই হয়, যার হাতে ক্ষমতা। আরো স্পষ্ট করে বললে, রাজনৈতিক ক্ষমতা যার, সেই এই খেলা জেতে। এইহেতুই উপনিবেশ গুলিতে স্থান-নাম, রাস্তা-নাম – হয় ঔপনিবেশিকদের নামে, যেমন “বেন্টিংক্ট স্ট্রিট”। আর তাদের বিকৃত উচ্চারনে “নেটিভ” নাম, যথা, বর্ধমান হয়ে যায় “বড়ডোয়ান”। সবই ঔপনিবেশিক ক্ষমতার প্রতীকী প্রদর্শন। আমাদের “গোলাপ পাড়া” গপ্পে, গোলাপ-চাষীদের পাড়ায় উঠে আসা পেটি বুর্জোয়া বাবুরা ওই ঔপনিবেশিকদের ভূমিকাটি পালন করেন এবং পালন করতে সক্ষম তখনই হন, যখন, তল্লাটের রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীরা এসে দাঁড়ায়, অবশ্যই তাদের নিজস্ব স্বার্থে, ভোটবাজি ইত্যাদির দরকারে।
এর অর্থ, স্থান-নাম বদলের এই খেলা শুধুমাত্র ক্ষমতারই। ক্ষমতার নগ্ন প্রদর্শন কে গ্রহনযোগ্য করে হাজির করতে, ক্ষমতাসীনরা ইতিহাস, সাহিত্য থেকে ধর্ম – যে কোনো অজুহাত বেছে নেয়, নিতে পারে, নিয়েছে, নিচ্ছে আর প্রায় সব ক্ষেত্রেই আদত সাহিত্য, ইতিহাস বা ধর্ম-পুঁথি’কে তারা বিকৃত করেছে। কাজেই, ২০২৪ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে, কবিতার পংক্তিকে বিকৃত করা হয়, তখন আশ্চর্য হইনা। ভীত হই। ভীত হই, কেননা – যাঁরা সরিষার থেকে তেল নিঙড়ে নেওয়ার কাজটি করতেন, তাঁদের পাড়ার নাম, স্বাভাবিক ভাবেই, তেলীপাড়া, যাঁরা ফুলের কারবার করতেন, অর্থাৎ মালী, তাঁদের পাড়ার নাম মালীপাড়া – স্বাভাবিক ভাবেই। লঙ্গাই নামক নদীর কিনারে যে পাড়া, তার নামও হয়েছিল ‘লঙ্গাই রোড”। – এইবার ‘মালী পাড়া’ নাম বদলে দিয়ে, ক্ষমতাসীনেরা “সারদা পল্লী” করে দিলে, আদতে যা দাঁড়ায়, তা, ওই “মালী” নামক জীবিকা যাঁদের পূর্ব পুরুষের – তাঁদের সক্কলকে এক কথায় নাকচ করে দেওয়ার সুপরিকল্পিত কৌশল। এর দ্বারা না হয় রামকৃষ্ণ-পত্নী সারদাদেবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, না অন্য কিছু। ঠিক যেভাবে লঙাই নদীর তীরবর্রতী পাড়া লঙ্গাই রোড কে “সৎসঙ্গ রোড” করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলে। – সবই আদতে আগ্রাসন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আরেকটি বিষয় তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, নাৎসিরা যেমন পুরানো প্রুশিয়ান, লিথুয়ানিয়ান এবং পোলিশ বিষয় সংস্কৃতির দিকে চালিয়েছিল তাদের সার্বিক বুলডোজার, তেমনি, ভারতবর্ষে আগ্রাসনের শিকার হয় অ-হিন্দু জনগোষ্ঠী আর স্থান নাম বদলেও তার নিরুত্তর স্থাপনা লক্ষণীয় হয়ে ওঠে ।
এখানে অ্যান্টোনিও গ্রামসি-র “সাংস্কৃতিক আধিপত্যে” নিয়ে ধারণার কথাটি অতি সংক্ষেপে বলে রাখছি, কেননা এ’টি এই আগ্রাসনের চরিত্রকে বুঝে নেওয়ার পক্ষে খুবই জরুরি। ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে গ্রামসি দেখিয়েছেন, যে, শাসক শ্রেণি শুধু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই নয়, সাংস্কৃতিক ঐক্যমত্য তৈরির মাধ্যমেও ক্ষমতা বজায় রাখে । তাদের আধিপত্যের সমর্থনে তারা নানা রকম গপ্পো, ধারনা নির্মাণ করে এবং ছড়িয়ে দেয়। ফলে, এক সময় জনতা, শাসক শ্রেণির ইচ্ছা, যা আদতে গনবিরোধী, তাকেই স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক এবং অনিবার্য বলে মনে করতে বাধ্য হয়ে পড়ে।
ঠিক যেমন ১৮৭৬ সালে, আসাম গেজেটে, যে স্থানটিকে “করিমগঞ্জ” বলা হয়েছে, তাকে ২০২৪ এ, রাজনৈতিক স্বার্থে এবং অ-হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ভীত করতে, “শ্রীভূমি” বলে ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে, জনতার একাংশ বাজি পোড়ান। কেননা, তাঁদের মগজে ক্রিয়াশীল শাসকশ্রেনীর বানানো গপ্পো, যা গ্রামসির ভাষায় “হেজিমনি” ডালপালা ছাড়াচ্ছে ।
ইতিহাস বিশ্লেষণের দ্বারা গ্রামসী যে দ্বিতীয় কথাটি বলেছেন, তা এই যে, স্থানগুলির নাম পরিবর্তন করে, শাসক শ্রেণি তাদের নিজের শ্রেণীর মূল্যবোধ এবং ঐতিহাসিক আখ্যানগুলিকে বৈধতা দিতে চায়। নিজেদের মত কে শারীরিক ভূদৃশ্যে মুদ্রণ করতে ও সক্ষম হয় ।–এই প্রক্রিয়াটি তাদের শাসনকে, শাসন করবার প্রয়োজনে শোষণ ও অত্যাচার কে বৈধ করতে করতে সাহায্য করে। তাছাড়া বিকল্প বা বাস্তব ইতিহাসকে অবমূল্যায়নও তারা করেছে। করছে।
এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কবিতার অপব্যবহার তার নিদর্শন। এই অপব্যবহারের ব্যাখ্যা-বিস্তারে যাব না, কেননা তা প্রায় সর্বজনবিদিত। শুধু প্রসেনজিৎ চৌধুরী’র নিবন্ধ “বাঙালির করিমগঞ্জ এখন শ্রীভূমি, রবীন্দ্রনাথ লিখিত শ্রীভূমি কোনটি? তিনি কেন লিখেছিলেন?” থেকে এটুকু অংশই পেশ করছি:
“ রবীন্দ্রনাথ লিখিত শ্রীভূমি কোনটি ? তিনি কেন লিখেছিলেন ?
১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড হয়। মর্মাহত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেন। এই ঘটনার মাস চারেক পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা থেকে শিলং এসেছিলেন। তখন শিলং আসামের (অসম) রাজধানী। আর এই বিভাগের তৎকালীন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল সিলেট (শ্রীহট্ট)। বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ সিলেট। রবীন্দ্রনাথ শিলং এসেছেন শুনে সিলেটের ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দনারায়ণ সিংহ মজুমদার উদ্যোগ নেন কবিকে সিলেট দর্শন করানোর। তাঁর উদ্যোগে স্থানীয় আঞ্জুমানে ইসলাম, শ্রীহট্ট মহিলা সমিতি এবং বিভিন্ন সংগঠনের তরফেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। শিলং থেকে গৌহাটি (গুয়াহাটি) হয়ে পাহাড়ি রেলপথ ধরে লামডিং হয়ে সিলেটে আসেন রবীন্দ্রনাথ।শ্রীহট্ট তথা সিলেটের প্রাকৃতিক শোভা ও বড় সংখ্যায় উচ্চশিক্ষিত বাংলাভাষীদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন–
“ মমতাবিহীন কালস্রোতে
বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে
নির্বাসিতা তুমি সুন্দরী শ্রীভূমি।
ভারতী আপন পুণ্যহাতে
বাঙালীর হৃদয়ের সাথে
বাণীমাল্য দিয়া
বাঁধে তব হিয়া।
সে বাঁধনে চিরদিন তরে তব কাছে
বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা হয়ে আছে।’’
রবীন্দ্রনাথের সিলেট ভ্রমণের স্মারক গ্রন্থ ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইতে সিলেট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লিখিত ‘কবি প্রণাম’ এবং নামে স্বাক্ষরিত ছিল কবিতাটি। এই কবিতায় লেখা ‘শ্রীভূমি’ শব্দটি অসমের করিমগঞ্জ জেলার নতুন নাম হিসেবে প্রস্তাব পেশ করলো অসম সরকার।” [ সূত্র: kolkata24x7.in ]
এখানে বলে রাখি, যদিবা “করিমগঞ্জ” নামের নির্দিষ্ট ভূখন্ড কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা নজরুল ইসলাম অথবা মাইকেল মধুসূদন দত্ত – কোনো কাব্যে, রচনায় “শ্রীভূমি” বলে উল্লেখ করে থাকতেন, তাহলেও স্থান-নাম বদলের এই ক্ষমতা-খেলার কোনো চারিত্রিক পরিবর্তন হয়না কেননা এ কোনো গণদাবী-জাত সিদ্ধান্ত নয়। এ এক স্পষ্ট রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র যা ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যেও, নানা অছিলায়, সিদ্ধ করেছে শাসকগোষ্ঠী। রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি ঠিক কবেকার, কোন ইস্টিশনে বা কার বাড়িতে বসে লিখিত, এসব তর্ক, প্রশ্ন, প্রশ্নোত্তর– নিতান্ত অনর্থক ও অবান্তর এবং এই সকল ধূলি উঠিয়ে, ছড়িয়ে, মূল প্রশ্নটিকে, অর্থাৎ ক্ষমতা ও রাজনীতির রসায়নকে এড়িয়ে, জনতার চোখে ধূলো দেওয়া আরো সহজ হয় শাসকদের।
বাস্তবে, স্থান-নাম পরিবর্তনের আরো একটি কারণ, “জনস্মৃতির নিয়ন্ত্রণ”। গ্রামসীর মতে, “বিরোধী পরিচয়গুলি মুছে ফেলা”।এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে “করিমগঞ্জ” শব্দটি, জনমানসে যে, অ-হিন্দু আমলের স্মৃতিকে জিইয়ে রাখছে, তা বর্তমান শাসকেরা চায় না। চায় না, কেননা “করিমগঞ্জ” অঞ্চলটির উন্নতি ও উৎকর্ষের অন্দরে অ-হিন্দুদের যে বিরাট ভূমিকা আছে, তা এরা অস্বীকার করতে চায়। “করিমগঞ্জ” একটি শব্দবন্ধের “করিম” অংশটি আরবি এবং “গঞ্জ” ফারসি। গঞ্জ অর্থ হাট। করিমগঞ্জ ছিল বড় অথবা ব্যস্ত একটি হাট – এতদূর আন্দাজ করেছেন ইতিহাসবিদেরা। কিন্তু আরবি-ফারসি মিশে থাকার জন্য আরো তথ্য প্রমাণের প্রয়োজন, সম্পূর্ণ নামটির অর্থ সম্পর্কিত ধারণাকে স্পষ্টতর করে তুলতে। – কিন্তু যা স্পষ্ট, তা হল, অ-হিন্দু প্রাধান্য আর একে জনতার স্মৃতি থেকে মুছে দেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে শাসক শ্রেণী। এটি মুছে দিলে, এ’ও মুছে যাবে, অচিরেই যে, একদা করিমগঞ্জের বদরপুর, যাকে “বুন্দাশীল” বলা হত, সেই অব্দি ছিল তুর্ক-আফগানদের শাসনাধীন ও পরে মোগল শাসনের আওতায়। ফলে স্থানটি এবং তার ক্রমোৎকর্ষের মূল যে অ-হিন্দু শাসনকালেই, এই নিহিত সত্যটি মুছে দিতে তৎপর, এই মুহুর্তে, ভারতীয় ক্ষমতামত্তরা।
এই তৎপরতা আজকের নয় এবং “করিমগঞ্জ” ও নয় এরকম আগ্রাসনের প্রথম শিকার। একথা বহুজনবিদিত। তথাপি এই লেখাটি লিখতে হলো, তার প্রথম কারণ, আমার নিজের নাড়ি প্রোথিত করিমগঞ্জ শহরে। স্বাভাবিক এই ধরনের আগ্রাসন আমাকে আহত করে বেশি, ভেতরের ক্ষতকে গভীরতর করে তোলে ।
নামবদলের অন্তর্গত রাজনীতি ও আধিপত্যবোধের বিরুদ্ধে সহমত প্রত্যেক সহ-নাগরিককে বুঝতে হবে, শাসকের ‘হেজিমনি’ জাত বিষয়ভাবনার নিঃশব্দ, সশব্দ ছোবল ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনবে; সামাজিক উদাসীনতার সুযোগে এই নাম বদল, এই সকল নাম-বদল, আদতে, আমাদের প্রত্যেকের গালে, এই শাসক-গোষ্ঠীর এক একটি সপাট থাপ্পড়। এ রকম থাপ্পড় আমরা আর কত মেনে নেব ?
চলুন, গর্জে উঠতে না পারি, অন্তত প্রতিরোধের পথে হাঁটা আরম্ভ করি। চেষ্টা করি ব্যারিকেড গড়ার।
♦·♦–♦·♦♦·♦–♦·♦
সপ্তর্ষি বিশ্বাস (জন্ম ১৯৭২) শক্তিপদ ব্রহ্মচারী-উত্তর বরাক উপত্যকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি ও গদ্যকার।প্রকাশিত গ্রন্থ: পাপের তটিনী ধরে, যুগলবন্দী, হুমায়ুন ফরিদি ও অন্যান্য বিষাদগাথা,গৃহপথগাথা, দাহ্য মাধুকরী, ইত্যাদি। সপ্তর্ষি বড় হয়েছেন বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জে। বর্তমানে জীবিকাসূত্রে ব্যাঙ্গালুরুবাসী।
❤ Support Us