- পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- জুন ২৯, ২০২৫
কৃষ্ণকীর্তনে নতুন সংযোজন রাধাদাস

‘রাউলে পেপারস‘ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ল কবি রাউলের খ্যাতি। রাউলে কে?
প্রশ্ন শুনে মুখ খুলল এক ছোট্ট বালক। বলল, ‘রাউলে ছিলেন মধ্যযুগের একজন ধর্মযাজক। প্রচুর কবিতা, গল্প, গদ্য লিখেছিলেন। কখনো লোকচক্ষুর সামনে আনেননি। পুরোনো একটা গির্জার সিন্দুকে সেগুলো রেখে দিয়েছিলেন। সেগুলোই উদ্ধার করেছে সে। সঙ্গে আরও প্রচুর লেখা আছে।‘
এই সব কথা যে বলেছিল, প্রকট দারিদ্রের সঙ্গে যুজে উঠতে না পেরে মাত্র আঠারো বছর বয়সে সে আত্মহত্যা করে।
আবিষ্কারক মারা যেতে পারে, কিন্তু আবিষ্কার তো আর উবে যেতে পারে না! বালকটি বলেছিল, আরও লেখা আছে। তা হলে, সেগুলো কোথায়?
সন্ধান করতে গিয়ে চমকে উঠলেন সবাই। ফাঁস হয়ে গেল প্রকৃত রহস্য। আসলে, রাউলে নামে কেউ কোনোদিন কখনো কোথাও ছিলেন না। ওই বালক পুরোনো কয়েকটা পুঁথির খোঁজ পেয়েছিল ঠিকই, তবে সেগুলো এগুলো নয়। এসব পড়ে সে এতটা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে, সে পৌঁছে যায় পুরোনো আমলে, যখন লেখা হয়েছিল এসব কবিতা। অবসর সময়ে সে এগুলো পড়ত, দেখে দেখে টুকত। নকল করতে করতে শুধু প্রাচীন ভাষা বা ছন্দ নয়, নিখুঁত ভাবে আয়ত্ব করে ফেলেছিল পুঁথির সে হস্তাক্ষরও। এক সময় তার প্রভাবে সে নিজেই লিখতে শুরু করে কবিতা। তার মতো এক হতভাগা দরিদ্র বালক কবিতা লিখছে, শুনলে কেউ কি এ কবিতা পড়বে? তাই সে তুলে ধরে মন গড়া রাউলের অস্তিত্ব।
পাঠকের কাছে পৌঁছল নতুন তথ্য। বিস্মিত হলেন পণ্ডিত মহল। পরবর্তীকালে, ‘রাউলে পেপারস‘ গ্রন্থটির জন্য কবি হিসেবে স্বীকৃতি পায় অল্পবয়সি বালক – টমাস চ্যাটারটন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিটস তাঁকে উৎসর্গ করলেন তাঁর ‘এনডিমিয়ন‘ কাব্যগ্রন্থ আর শেলি তাঁর বিখ্যাত বই – অ্যাডোনেইস।
না, এ রকম কোনো ঘটনা নয়। পুরুলিয়ার যুধিষ্টির মাজির বড়ো ছেলে শিবপ্রসাদ ১৯৯৮ সালের ২১ জুন মারা যাওয়ার অনেক আগে সত্যি সত্যিই উদ্ধার করেছিলেন একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি।
ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা এক অজানা কবির কাব্য। কবির নাম – রাধাদাস। না, রাধা দাস নয়, কারণ তখনও নামের শেষাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পদবির সৃষ্টি হয়নি। তাঁর গীতিকাব্যের নাম কৃষ্ণলীলামৃত গীত। যে বইটির কথা সাহিত্য রসিকদের কাছে এত দিন অজানা ছিল। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত‘ বইটিতে যে রাধানাথ দাসের কথা উল্লেখ করেছেন, ইনি তিনি নন। উনি ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি এবং এক দুর্বল পদকর্তা। তাঁর সঙ্গে এঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
পাঁচশো বছর ধরে বৈষ্ণব সাহিত্য নানা ভাবে, নানা রূপে, নানা রসে প্রবাহিত হয়ে সাহিত্য-শিল্প-সংগীত রসিকদের তৃপ্ত করেছে। কে নেই সে তালিকায়? জয়দেব, বিদ্যাপতি, গৌরচন্দ্রিকা, বৃন্দাবন থেকে শুরু করে বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস পর্যন্ত! যাঁর নাম এত দিন জানা যায়নি, শোনা যায়নি, সেই কৃষ্ণলীলামৃত গীত-এর পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের পরে এ বার নিশ্চয় সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারিত হবে রাধাদাসের নাম
এই পাণ্ডুলিপি আবিস্কৃত হওয়ার পর আমরা জানতে পারি, রাধাদাসই বাংলা চতুর্দশপদী কবিতার জনক। যদিও তাঁর কাব্যে দশ/বারো লাইনের কিছু কিছু কবিতা আছে। জানি না, কপি করতে গিয়ে লিপিকারের অসচেতনতায় কলমের ফাঁক দিয়ে এ সব কবিতার দু–চারটে শব্দ বাদ পড়ে গেছে কি না ! কারণ, যে পাণ্ডুলিপি থেকে কবি রাধাদাসের কাব্যটি উদ্ধার করা হয়েছে, সেটা কবির হস্তাক্ষরে লেখা মূল পাণ্ডুলিপি নয়। টীকারাম সরাক নামে এক লিপিকার মূল পাণ্ডুলিপি থেকে বা অন্য কারও হস্তাক্ষরে লেখা কোনো প্রতিলিপি থেকে টুকে নিয়েছিলেন। পাণ্ডুলিপির নিচে লিখিত তারিখ ১৯ আষাঢ়, ১১৯৬ সন।
তাঁর লেখায় বানানোর প্রচুর গন্ডগোল রয়েছে। ‘র‘-এ দীর্ঘ ‘উ‘ ছাড়া অন্য কোনো অক্ষরে দীর্ঘ উ চোখে পড়েনি। ‘স‘-এর ব্যবহার খুব বেশি। ‘শ‘ স্থান পেয়েছে যেখানে সেখানে। আবার ‘ষ‘-র চেহারা কোথাও নেই। ‘শিশু‘ শব্দটি কোথাও ‘সিসু‘, কোথাও ‘শিশূ‘, কোথাও আবার ‘শিসু‘। ‘ছাওয়াল‘ শব্দটি ‘ছায়াল‘, ‘ছায়বাল‘, ‘ছাআল‘, ‘ছাঅবাল‘ লেখা হয়েছে। দির্ঘ ‘ঈ‘-র ব্যবহার সামান্য। ‘গোপি‘ এবং ‘গোপী‘ দু–ভাবেই বানানটি লেখা হয়েছে। কবি নিশ্চয় এ ভুল করেননি।
এ তো গেল বানানের গন্ডগোল। এ ছাড়াও গীতি কবিতার ক্রমিক সংখ্যায়ও ভুল রয়েছে। কিছু কবিতার লাইন অন্য কবিতার মধ্যে ঢুকে গেছে। কয়েকটি কবিতার কিছু কিছু লাইন বাদ পড়ে গেছে। লিপিকার টিকারাম সরাক এই পাণ্ডুলিপিটি কপি করার সময় কতটা মনোযোগী বা যত্নবান ছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।
সে যাই হোক, ক্ষুদিরাম দাস এই পাণ্ডুলিপিকে অতি মূল্যবান বলে চিহ্নিত করেছেন। যুধিষ্টির মাজি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বইটা ঠিকঠাক সাজিয়ে, সম্পাদনা করে, অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, অধ্যাপক দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় ‘রাধাদাস প্রণীত কৃষ্ণলীলামৃত গীত‘ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
১৩০টি গীতি কবিতার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম থেকে মথুরা যাওয়ার সময় পর্যন্ত কৃষ্ণলীলাকে তুলে ধরা হয়েছে। মূলত জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ ও ভগবতের কাহিনি নিয়ে এই কাব্য গড়ে উঠেছে। কবি এগুলোকে বলেছেন, সদা গেয়ং। অর্থাৎ কবিতাগুলো গানের জন্যই লেখা হয়েছে এবং কোন কবিতা কোন রাগে গাইতে হবে, প্রতিটি কবিতার শুরুতে তা উল্লেখ করে দিয়েছেন। যেমন, শ্রী, কামোদ, করুণাশ্রী, মঙ্গল আসোআরি, মঙ্গল ধানসি, মল্লার, ইমন কল্যাণ ইত্যাদি। তেমনই আছে বেলেআরি, ভাটিআলি, ভাটালি, গাড়া, পাঠমঞ্জরি, বড়ারি, বিহাগাড়া জাতীয় ভারতীয় রাগ-রাগিণীর উল্লেখ। পাশাপাশি রয়েছে ‘তা তা থোই থোই বলয়ে মাত্র নাচিতে টুলিআ পড়ে‘-র মতো নাচের নিখুঁত বর্ণনা। যা থেকে সহজে অনুমান করা সম্ভব যে, ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত ও নৃত্যের সঙ্গে কবির গভীর পরিচয় ছিল। যার জন্য যে রাগের যে শৈলী, তার সঙ্গে মানানসই শব্দ জোগান দিতে গিয়ে তিনি যেমন বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার আঞ্চলিক বহু শব্দ ব্যবহার করেছেন, তেমনি ব্যবহৃত রয়েছে প্রাচীন বাংলা শব্দ, সংস্কৃত শব্দ এবং ব্রজবুলি শব্দ। যা মধ্যযুগের কোনো বৈষ্ণব সাহিত্যে সচরাচর নজরে পড়ে না। যেমন তুড়ি রাগে গাওয়ার জন্য লিখেছেন তিনি —
যদিও কাব্যের কোথাও কবি তাঁর রচনাকাল লিখে যাননি, তবু তিনি যে ষোড়শ শতাব্দীর একজন পদকর্তা, তাঁর লেখাগুলো বিশ্লেষণ করলে সহজে তা বোঝা যায়। যেমন, ১. বড়াই চরিত্রের সার্থক রূপায়ন। ২. ললিতা, বিশাখা-সহ রাধার অষ্টসখী, আয়ান ঘোষ ও রাধার শাশুড়ি-ননদের অনুপস্থিতি। ৩. রাধা চরিত্রের মধ্যে পূর্বরাগ ও ভাব সম্মিলনের অভাব। ৪. রাধা চরিত্রের চিত্রায়নে তার বংশ পরিচয় ও তার স্বকীয়তার অভাব। এমনকী, রাধা নামের বদলে তাঁকে বারবার গোপী, গোপিনী, গোপনারী, গোপবালা, ব্রজবধূ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এতগুলো কবিতার মধ্যে কেবল ৬-৭টিতে রাধা আর শুধুমাত্র দু–জায়গায় রাই শব্দের উল্লেখ রয়েছে। ৫. রাধার প্রেমকে পুরোপুরি পরকিয়া প্রেমে রূপান্তরিত করা ও তাকে সবলা নায়িকা রূপে তুলে ধরা হয়েছে। ৬. সপ্তদশ শতাব্দীতে যাকে আমরা দুর্গাপুজো বলা শুরু করি, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে তাকেই অম্বিকা পুজো বলা হত। এই কবির বিভিন্ন লেখায় ধর্মীয় লোক উৎসব হিসেবে আমরা বারবার অম্বিকা পুজোর বিবরণই পাই। ৭. বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ছন্দ, রীতি এবং নাটকীয় সংলাপের প্রভাব এবং তার অবৈষ্ণব সুলভ মানবতাবাদী জীবন দর্শনের প্রভাব। ৮. লেখা শুরু করার আগে চৈতন্য ও নিত্যানন্দের যুগ্ম বন্দনা ষোড়শ শতাব্দীর রীতি। সে রীতি এই কবির কাব্যেও আছে। ৯. তখনকার রীতি অনুযায়ী চৈতন্যচরিতামৃত বা কৃষ্ণকেলিচরিতামৃত-র ধাঁচে কাব্যগ্রন্থের নাম— কৃষ্ণলীলামৃত। ১০. বৈষ্ণব ভাবধারা ও দার্শনিক চিন্তার প্রভাব। ১১. ষোড়শ শতাব্দীর জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল [১৫৬০] কিংবা লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল কাব্যে যেমন রাগ-রাগিণীর প্রবল প্রভাব দেখা যায়, তেমনি এই কাব্যগ্রন্থেও নানান ঘরানার মার্গ সঙ্গীতের আনাগোনা চোখে পড়ে।
এভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে মনে হয় যে, রাধাদাসের কাব্যগ্রন্থটি ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে রচিত। প্রশ্ন উঠতে পারে, দ্বিতীয় ভাগে লেখা হলে তার প্রায় একশো বছর আগের, পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের এত প্রভাব তাঁর উপরে পড়ল কী ভাবে? সম্ভবত, সে সময়েও বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মানুষের মন জুড়ে ছড়িয়ে থাকত। হয়তো শ্রীচৈতন্যদেবও ওই কাব্য পড়তেন। তাই রাধাদাস এ প্রভাব এড়াতে পারেননি। তাই এত মিল।
বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা প্রথম দর্শনেই কৃষ্ণের সঙ্গে ঝগড়া করে। পরে কৃষ্ণ ছলে বলে রাধার শরীর ভোগ করেছেন। রাধাদাসের কাব্যেও তাই। যদিও রাধাদাসের প্রেম বাস্তব-সম্মত। এতে দার্শনিক ভাবনার কোনও অবকাশ নেই। তাঁর বিশ্বাস ছিল, দেহ ছাড়া প্রেম হয় না। দৈহিক সৌন্দর্যই নরনারীকে মুগ্ধ করে। প্রেমের পথে নিয়ে যায়। তাই প্রথম দর্শনেই কৃষ্ণের নারীমগ্নতা দেখে রাধা বিরক্ত হয়েছিলেন। পরে আরও বিরক্ত হয়েছিলেন যখন সে দেখলেন, কৃষ্ণ গাছের আড়াল থেকে ব্রজবধূদের নগ্ন হয়ে স্নান করা দেখছেন। রাধা তার উপরে প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে বুঝতে পেরেও, আজকালকার রাস্তার বখাটে ছেলেদের মতো কৃষ্ণ ব্রজবধূদের পিছু ছাড়েননি। নানা অছিলায় তাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছেন। পথ আগলে দাঁড়িয়েছেন। আঁচল ধরে টানাটানি করেছেন। রীতিমত ইভটিজিং।
বহু বয়স্ক মানুষ আছেন, যাঁরা বৃষ্টির দিনে ছাতা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন, কখন কোন মহিলা বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁর ছাতার তলায় এসে আশ্রয় নেবেন। সে রকম কৃষ্ণও যমুনার তীরে নৌকো নিয়ে বসে থাকতেন। কখন নৌকো আসবে তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ব্রজবধূরা অধৈর্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর নৌকায় উঠতে বাধ্য হতেন। এ ভাবেই মাঝে মাঝে নৌকোয় ধীরে ধীরে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার প্রেম হয়ে যায়। শুধু রাধা নয়, পরকিয়া প্রেমে ডুবে যাযন সমস্ত ব্রজবধূ।
মেয়েরা যখন প্রেমে পড়ে, তখন সব উজাড় করে বিলিয়ে দিতে থাকে। এত দিন রাধার পিছনে ঘুরঘুর করতেন কৃষ্ণ, এ বার রাধাই কৃষ্ণ কৃষ্ণ করতে লাগলেন। ঘরে তাঁর মন টেকে না। কোনো কাজে মন বসে না। কৃষ্ণের বাঁশি বাজলেই রাধা তাঁর স্বামীকে ঘুম পাড়িয়ে অভিসারে বেরিয়ে পড়তেন। গুরু গরবিত লাজ, কুল, মান, মর্যাদা সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হযন। অঙ্গের সঙ্গে অঙ্গের মিলন ঘটতে থাকে।
বড়ু চণ্ডীদাসের মতো অতটা খোলাখুলি রগরগে বর্ণনা না পেশ করলেও রাধাদাসও কোনো অংশে কম যাননি। যৌন বিজ্ঞান মেনেই দৈহিক মিলনেরই বর্ণনা করেছেন। রাধাকে জড়িয়ে ধরে কৃষ্ণ তার গলায় চুম্বন করছেন, বুকের কাপড় সরিয়ে স্তন যুগল উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন। কাম ভাবাবেগে তার স্তনবৃন্ত শক্ত। পরনের কাপড়, মাথার চুল সব এলোমেলো। শরীরের সঙ্গে শরীরের ঘর্ষণে দু–জনেই তৃপ্ত।
রাধাদাসের বর্ণনায় —
চারু রম্ভন গণ্ড চুম্বন,
উরজ খণ্ডন ভাতিআ।
বন্ধ বেণীর মুক্ত অঞ্চল,
মনেত ডর ছাড়িঞা।।
তুষি রতিপতি সঙ্গে রসবতী
বৃন্ত নীরস বঞ্ছিঞা।
বেশর ভূষণ কেশ বিগলিত
অঙ্গ অঙ্গ বিভাতিআ।
এ সব কবিতা একটু নাড়াচাড়া করলে পরিষ্কার হয়ে যায় প্রেম, মিলন ও বিরহের ক্ষেত্রে কবি রাধাদাস কোনও অবাস্তব চিন্তাধারায় প্রভাবিত হননি। কৃষ্ণকে তিনি অবতার বলে স্বীকার করেছেন। তাঁকে দিয়ে অলৌকিক কাজকর্ম করিয়েছেন। রাধা তাঁর কলমে শুধুই একজন মানবী। আমার মনে হয়, কবির নাম যেহেতু রাধা এবং তিনি নিজেও যেহেতু কৃষ্ণভক্ত, তাই ওই রাধার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখার সূক্ষ্ম ইচ্ছে হয়তো কবির অবচেতনে ছিল। রাধাকে দিয়ে তিনি কোনো অসম্ভব কাজ বা দেবীসুলভ আচরণ করাননি। রাধা গোকুলের একজন অতি সাধারণ ব্রজবধূ, যিনি প্রতিদিন মথুরার হাটে যাযন, দই বিক্রি করে সংসার চালান।
মধ্যযুগের কাব্যে নিখুঁত ট্র্যাজেডির কোনো স্থান ছিল না। অধিকাংশ বৈষ্ণব কাব্যে রাধার ভাবপ্রবাহ কবিতার ট্র্যাজিক ধর্মকে নষ্ট করেছে। অনেকে কাহিনিকে কংস বধ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য রসাসিক্ত করতে পারেননি। রাধাদাসের কাব্যটি মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রথম এবং শেষ বিয়োগান্ত কাব্য।
আগে যে কোনো কাব্য লেখা হত কাহিনিকে কেন্দ্র করে। বেশিরভাগই দেবদেবীকে ঘিরে। তাঁদের গুণকীর্তি বর্ণনা করাই ছিল কাব্যের মূল ধর্ম। সে কীর্তি-কাহিনি যখন সুরের মধ্যে দিয়ে গাওয়া হত, তাকে বলা হত গুণকীর্তন। ধীরে ধীরে ‘গুণ‘ বাদ দিয়ে যা পরে হয়ে যায় শুধুই— কীর্তন।
কীর্তন দু–রকমের – ১. নামকীর্তন। যা নগর সংকীর্তনেই মূলত শোনা যায়। ২. পালা কীর্তন। বৈষ্ণব মহাজনদের লেখা নানা পদে সুরারোপিত সংগীত। এরও আবার দুটো ভাগ । একটা চৈতন্য পূর্ব। অন্যটা চৈতন্য উত্তর। আগে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীকে নিয়ে পদ রচনা হত। পরে এলেন রাধা ও কৃষ্ণ। শ্রীচৈতন্য হয়ে উঠলেন যুগল অবতার। তিনি খানিকটা মেয়ে মেয়ে দেখতে ছিলেন বলে বৈষ্ণবেরা বলতেন, তিনি বহিরঙ্গে রাধা, অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ।
পরে, বৈষ্ণবরাই খোল-করতাল নিয়ে ভববাজারে, ভাববাজারে নেমে পড়লেন। তখনো তাঁরা জানতেন না, শুধু সুগার রোগী নয়, যে কোনো মানুষের পক্ষেই সকালে হাঁটা শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ভাল এবং গানে মত্ত হয়ে দু–হাত তুলে নাচাটাও সাঁতার কাটা বা সাইকেলিং করার চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর। শরীর চর্চার এমন আদর্শ ব্যায়াম পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
প্রায় পাঁচশো বছর ধরে বৈষ্ণব সাহিত্য নানা ভাবে, নানা রূপে, নানা রসে প্রবাহিত হয়ে সাহিত্য-শিল্প-সংগীত রসিকদের তৃপ্ত করেছে। কে নেই সে তালিকায়? জয়দেব, বিদ্যাপতি, গৌরচন্দ্রিকা, বৃন্দাবন থেকে শুরু করে বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস পর্যন্ত! যাঁর নাম এত দিন জানা যায়নি, শোনা যায়নি, সেই কৃষ্ণলীলামৃত গীত-এর পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের পরে এ বার নিশ্চয় সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারিত হবে রাধাদাসের নাম।
♦•♦–♦•♦♦•♦–♦•♦
❤ Support Us