Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • জুলাই ২৮, ২০২৪

এখানে ওখানে হৃদয়ে হৃদয়

বাহার উদ্দিন
এখানে ওখানে হৃদয়ে হৃদয়

আগস্ট ১৯০৯। মর্ডান রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত চিত্র

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ১৬৩তম জন্মদিনে বাংলার নবজাগরণ এর সভা

 
২ আগস্ট, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়-এর ১৬৩তম জন্মদিন। এদিন, শিশির মঞ্চে সন্ধ্যা ৬ টায় তাঁকে স্মরণ করবে ‘বাংলার নবজাগরণ’। অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক আর কবি জয় গোস্বামীকে নবজাগরণের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানাবেন সামাজিকবৃন্দ। ১৯৯৯ সালে, প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মদিনেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল যে সংগঠন, দেখতে দেখতে তাঁর ২৫ বছর অতিক্রান্ত। ২১ শতকের শুরুতেই বাংলার বাইরে ত্রিপুরা, অসম, ঝাড়খন্ড বিহার ও অন্যান্য রাজ্যে, বাংলাদেশেও নবজাগরণের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। কারণ কী ? নবজাগরণের উদ্যোক্তরা দাবি তুললেন, এক. নামফলকে বাংলা অক্ষরমালাকে গুরুত্ব দিতে হবে । দুই. ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং শিল্পে বাঙালির দুর্দশা ঘোচাতে সর্বস্তরে সতর্ক আয়োজন দরকার। তিন. দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতাকে রুখতে হবে। সমাজের কোনো ভাঙন, কোনো ফাটলকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। চার. ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পরিসরকে চওড়া করতে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
 
বছর কয়েকের মধ্যেই নবজাগরণ বৃহত্তর আন্দোলনের চেহারা নেয়। বাংলায় নাম ফলকের দাবিতে কলকাতায় রাস্তায় নামলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দিলীপ রায়, সম্বরণ ব্যানার্জি, আজিজুল হক, তপন মিত্র, সমর নাগ, অশোক দাশগুপ্ত, নজরুল ইসলাম, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল সেন, রঞ্জন সেন, পিকে বন্দোপাধ্যায়, প্রসূণ বন্দোপাধ্যায় সহ বহুজনের নেতৃত্বে অসংখ্য তরুণ । এ আন্দোলনকে ঘিরে তোলপাড় শুরু হলো, কেউ কেউ কটাক্ষ ছুড়ে দিয়ে নবজাগরণের নেতা কর্মীদের ‘বাংলাবাজ’ আখ্যা দিয়ে বিরোধিতা শুরু করলেন । কোনো একজন ব্যবসায়ী, বণিকসভায়, হিন্দি মিশ্রিত বাংলায় বললেন, বাঙালি নাকি ব্যবস্যা করবে! শিল্প গড়বে ! তাহলে গান করবে কে? নাটক করবে কারা ? এসব বিদ্রুপ আর কটাক্ষকে তোয়াক্কা করেননি নবজাগরণের সংগঠক ও কর্মীরা ।তাঁদেরই উদ্যোগে, জেলায় জেলায় বাঙালি জাতিসত্তার অবরুদ্ধ দাবি বাইরে বেরিয়ে এসে ঢেউ তুলল।
 
উনিশ শতকের অর্ধসমাপ্ত নবজাগরণ, যা ছিল মূলত বৌদ্ধিক আর সামাজ সংস্কারের, তারই চিন্তা-বিচিন্তার ব্যবহারিক প্রবক্তা হয়ে ওঠে একুশ শতকের নবজাগৃতির আন্দোলন। প্রাসঙ্গিকতা বাড়ল রসায়নবিদ, শিক্ষাগুরু এবং শিল্প গড়ার সফল স্থপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের। সঙ্গত কারণেই, প্রতিবছর ২ আগস্ট, সাড়ম্বরে আচার্যের জন্মদিন পালন করে ‘বাংলার নবজাগরণ’, পাশাপাশি সংবর্ধনা জানায় গুণীজনকে।
 
নবজাগরণের উৎসচিন্তা এবং ধারাবাহিক ইতিহাস লেখা দরকার। আগামীর সামনে তার জলস্রোতের বৃত্তান্ত তুলে ধরা আরো জরুরি। এই যেমন, স্মৃতির একুশে ফেব্রুয়ারি আর ১৯ মে-র ভাষা আন্দোলনের ভাবাবেগকে দ্বিখন্ডিত ভারতের দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়া— কিংবা গুজরাটে সাম্প্রদায়িক গণহত্যার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর নেতৃত্বে অশোক দাশগুপ্ত, রঞ্জন সেন, সমর নাগ সহ কয়েকটি উজ্জ্বল মুখ ছুটে গেলেন আমেদাবাদে, বরোদায় । দাঙ্গা পীড়িত উদ্বাস্তুদের সঙ্গে প্রবল ঝুঁকি নিয়ে দেখা করলেন, ফিরে এসেই দুর্গতদের দুর্দশার অশ্রুসিক্ত ছবি পেশ করলেন আজকাল পত্রিকায়, ঠিক একইভাবে, অসমে যখন উদ্বাস্তু বাঙালির অস্তিত্বের ওপর এনআরসির খড়্গ নেমে এল, বাংলার নবজাগরণের প্রতিনিধিরা ছুটলেন ঈশান বাংলার শিলচরে ; কিংবা ভয়াবহ বন্যায় যখন ভেসে গেল, ডুবে গেল দক্ষিণ বঙ্গ আর ওড়িশা, তখন ত্রাণ নিয়ে ছুটে গেলেন নবজাগরণের কর্মীরা। গত কয়েকদশকে বাংলার কোনো সামাজিক সংগঠনকে এরকম তৎপর, এরকম সতর্ক এবং যুক্তিপ্রবণ হতে দেখা যায়নি। বাঙালির বিবেক আর যুক্তি নিয়ে জাতিসত্তার উনিশ শতকীয় ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আর ভারতীয়তার খোরাক জোগাতে নবজাগরণ অবশ্যই সচল দৃষ্টান্ত।
 
 

যোগেন চৌধুরীকে দুবাই এ মাদার টেরেসা পুরস্কার

 
মাদার টেরেসা ইন্টারন্যাশেনাল অ্যাওয়ার্ড (২০২৪) পাচ্ছেন বিশ্ববন্দিত চিত্রকর যোগেন চৌধুরী । আগামী ২৬ আগস্ট, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দুবাই মহানগরীতে, বহু দেশের শিল্পী, শিল্প আলোচক এবং চিত্রপ্রেমীদের উপস্থিতিতে, যোগেনের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। মাদার টেরেজা পুরস্কার কমিটি একথা জানিয়েছে। ২৬ আগস্টের প্রাক্কালে দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেবেন সস্ত্রীক যোগেন।
 
বহু দেশের শিল্পজগতে, শিল্পাঙ্গনের বাইরেও তিনি সমাদৃত। পূর্ব-পশ্চিমের শিল্পী আর কলা সমালোচকরা যেমন, তেমনি চিত্রপ্রেমে প্রাণিত বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি তাঁর ছবি নিয়ে, ছবির স্বতন্ত্র ঘরানা নিয়ে আল্হাদিত।আধুনিক চিত্রকলার চর্চা আর বিস্তারে, যোগেন চৌধুরী নিঃসন্দেহে আত্মস্থ আর কল্যানমুখর ব্যক্তিত্ব।তাঁর শিল্পচেতনা কখনো সমাজবিমুখ নয়, আবার চকচকে, উগ্র রং ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়।নরনারী, মেরুদন্ডী কিংবা সরীসৃপ যখন তাঁর রেখা আর তুলিতে ছবি হয়ে ওঠে, সে মুহূর্তে কিংবা অবয়বের প্রস্তুতিপর্বে যোগেন আসাধারণ কৌশলী এবং সতর্ক। স্বতঃস্ফুর্ত আবেগকে, নিহিত বেদনাকে কীভাবে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে, কখনো বাঁকা ভঙ্গি আর দৃষ্টিগ্রাহ্যতা সৃষ্টি করে তাৎক্ষণিকতাকে অস্বীকার করতে হয়, এসব ব্যাপারে তাঁর অবস্থান অপূর্ব, অননুকরণীয়।অনুকরণের প্রবণতা যে কোনো বিশুদ্ধ মননচর্চার একটি সমস্যা, সে কবিতা হোক, গল্প হোক, কিংবা উপন্যাসের নির্মাণ। চিত্রকর্মের মতো জটিল মাধ্যমে এ সমস্যার বিস্তৃতি আরো বেশি।
 
দেশভাগের পূর্বে অবিভক্ত ফরিদপুরে, ফরিদপুর থেকে কলকাতার উপকন্ঠের উদ্বাস্তু জীবনে, কলকাতা আর্ট কলেজের ছা্ত্র জমানায়, মাদ্রাজে হ্যান্ডলুম ডিজাইনারের চাকরিজীবনে, ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে দুবছরের প্যারিসবাসে, ৬ মাস লন্ডনে আবার মাদ্রাজের পুরনো চাকরির পরিসরে, র‌াষ্ট্রপতি ভবনের কিউরেটারের দীর্ঘকালীন দায়িত্বে, শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনার ভেতরে ও বাইরে আগুন আর স্নিগ্ধতা ছোঁওয়া যে জীবন দেখেছেন যোগেন, সে সব এলাকায় মুক্ত দৃষ্টিপাতের সতর্কতা তাঁর আত্মতাবোধ এবং সমস্তের ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’-র, তাঁর উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর উত্তরণের আধার।এখানেই তিনি বিশ্বপথিক এবং বিশ্ব নাগরিক। এরকম এক শিল্পীকে, মাদার টেরেসার মতো আরেক বিশ্ব পথিকের নামে অঙ্কিত পুরস্কার দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের অভিমুখ আর গন্তব্য জানিয়ে দিল মাদার টেরেসা ইন্টারন্যাশেনাল অ্যাওর্য়াড কমিটি ।
 
 

আমাদের অংশুমান এবং তাঁর প্রথম কবিতা সংগ্রহের উন্মোচন

 
অংশুমান কর, সাম্প্রতিক বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান, সৃজনশীল কবি; না, এভাবে বলাটা ঠিক হল না, বলতে হবে এই মুহুর্তে, প্রায় ৩৪ বছর জুড়ে, বিরামহীন দাহ নিয়ে, সজল প্রেম নিয়ে, পারিপার্শ্বিকের ছবি আঁকছেন, মিশে যাচ্ছেন, উর্বর জলস্রোতে, মননের পলিমাটিতে, কখনো অন্যরকম স্বর বাজিয়ে আকার-ইঙ্গিতে সমূহের সত্তাকে সজাগ থাকবার কথা বলছেন — তিনি স্ব-উন্মেষিত, আপদমস্তক সংশয়হীন, এবং কবিতার আরেক নির্মেদ পুরুষ । উদাসীনতাকে, চৈতন্যের অতিমগ্নতাকে বিলকুল প্রশ্রয় দিতে রাজি নন অংশু। এমন একজন কবিকে, তাঁর কবি-স্বভাবকে [পয়েটিক পারসনালিটি] খুঁজতে হলে, এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত সমস্ত রচনার, বিশেষ করে কবিতা সংগ্রহের ভেতরের সমগ্র অর্জনে, শিল্পের শর্তরক্ষার ভুবনে আমাদের প্রবেশ করতে হবে। এ রকম প্রেক্ষিতকে সামনে আর পেছনে রাখার সুযোগ থাকলে তবেই তাঁর কবিতাযাপনের সুন্দরের, ঐতিহ্যপ্রীতির, গদ্য-পদ্যের সব নির্মিতির, আপসহীন নিষ্ঠার আবৃত পাত্রতল খতিয়ে দেখা সম্ভব। রণজিৎ দাশ, জয়দেব বসু আর জয় গোস্বামীর পর, দুজন কবির শিল্পস্বভাবের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে ভাবা দরকার। তাঁদের একজন নিভৃতচারী, অনুশাসনহীন, কবিতা-যাত্রী গোলাম রসুল। আরেকজন সংযত, স্বভাষায় উদ্ভাসিত অংশুমান কর।
 
১৯ জুলাই, অংশুমানের ৩৪ বছরের কবিতা সংগ্রহ প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হলো। যোগেন চৌধুরি সেন্টার ফর আর্টসের চারুবাসনা সভাকক্ষে। ঘনভিড় নিয়ে আয়োজিত এ-এক মনোহর ঘটনা। ঘটনাটির সাক্ষী হয়ে রইলেন অপরাজেয় জয় গোস্বামী; সপ্তর্ষি প্রকাশনের প্রাণপুরুষ সৌরভ মুখোপাধ্যায়, প্রাবন্ধিক তুষার পণ্ডিত এবং কবিতার অলিন্দঘেঁষা বহুমুখ। উল্লেখ করা প্রয়োজন, জীবনের অর্ধশতক সেদিন অতিক্রম করেছেন অংশু। তাঁর জন্মদিনটি উদযাপিত হয় কবিতা সংগ্রহের প্রথম খন্ডের প্রকাশ আর গদ্য বিষয়ক সঙ্কলনের মলাট উন্মোচনী- মুহূর্তের হর্ষধ্বনিতে। অংশুমানের দিনযাপনের ব্যক্তিকতা অনেকরকম চড়াই উৎরাই পথে ছড়িয়ে আছে। জন্ম বাঁকুড়ায়, স্কুল কলেজ ওখানেই, কিছুদিন জঙ্গলাকীর্ণ ঝাড়গ্রাম ছুঁয়ে থাকলেন, ঝাড়গ্রাম থেকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের সরস বিদ্যাদাতা। এসব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ অংশুমানকে, সাহিত্য আকাদেমির পূর্বাঞ্চলীয় পরিচালকের দায়িত্ব নিতে হল একসময়। তখন তাঁর সাংগঠনিক দায়িত্ববোধ লক্ষ্য করার সুযোগ হয়েছে অনেকের। সংক্ষিপ্ত মেয়াদেও সাহিত্য আকাদেমির পরিচালনা আর লক্ষ্য নির্ণয়ে নির্মল ভট্টাচার্যের মতো অংশুও হয়ে উঠলেন ‘এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম’। কেন জানি, সাহিত্য আকাদেমিতে তাঁর বেশিদিন থাকা হল না, ফিরে গেলেন অধ্যাপনার চতুষ্কোণে। এরকম আবহে তাঁর লেখালেখি, তাঁর কবিতা-ভাবনা, গদ্য নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা, কথা সাহিত্যে তাঁর বিস্তৃত, সুচিন্তিত অন্তঃস্রোত মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। সংযম আর আত্মবীক্ষণ তাঁর নিরলস নির্মাণের, বহুমাত্রিক সৃজনের, নাগরিকতাবোধের পাশাপাশি উৎসস্থলে প্রত্যাবর্তনের নিঃশব্দ, অনমনীয়, মূর্ত আর বিমূর্ত, সংযমাশ্রিত চেহারা ধারণ করে। অংশুমানের কবিতা-সংগ্রহটি সেদিন উদ্বোধন করে জয় গোস্বামী বলেছেন, ‘অংশু এমন একজন কবি, যিনি ইচ্ছে করলে, অনেক আগে, তাঁর কবিতার সংগ্রহের প্রথম খন্ড প্রকাশ করতে পারতেন, এবার তা করলেন ৫০ বছরে পেরিয়ে।
 
সমসাময়িক অনুজের প্রতি জয়ের এই শ্রদ্ধাবোধ আপ্লুত করছে আমাদের, হয়তো আরো অনেকের যুক্তিময়তাকে। সেলাম ক্রমশ উত্তরণের অক্লান্ত পথিক অংশুমান কর।
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!