Advertisement
  • খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • জানুয়ারি ১২, ২০২৫

তৃতীয় ভুবনে স্বামী বিবেকানন্দ

সঞ্জীব দেবলস্কর
তৃতীয় ভুবনে স্বামী বিবেকানন্দ

১৯০১ । ঢাকা থেকে অসম সফরে গিয়েছিলেন বিবেকানন্দ

বাঙালির তৃতীয় ভুবন, দেশের, বিশেষ করে বাঙালি শ্রেষ্ঠপুরুষদের, প্রত্যক্ষ   এবং পরোক্ষভাবে সম্পর্কধন্য হয়েছে। সেদিকেই এবার  দৃষ্টিপাত। কারণ বাঙালি আজ এক দুঃসময়ের কালো অধ্যায়ের সামনে সম্মুখীন হয়েছে। তা শুধু  এপারে-ওপারে নয়, দেশের ভিন্নতর ভূখণ্ডেও। যে-সব বাঙালি মনীষী তুচ্ছ জাতপাত, ধর্ম, ভাষা এবং আঞ্চলিকতার উর্ধ্বে উঠে চিরকাল মানবতার জয়গান গেয়েছেন, তাঁরা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্দরে নানা উপলক্ষে বিচরণ  করেছেন, যেখানে প্রত্যক্ষভাবে পৌঁছোতে পারেননি, সে স্থানগুলোও নানা সূত্রে তাঁদের মানসভূমিতে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ঢাকা, সিলেট সহ ভারতের আসামে স্বামীজির পদার্পণ ঘটেছে, এবং এ ভুবনের নানা জনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ঘটেছে। ১৯১৯ সালের ৪ নভেম্বর যেমন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাছাড়ের করিমগঞ্জ রেলস্টেশনে কুড়ি মিনিটের জন্য বিরতি নিয়ে শ্রী ভূমিকে ধন্য করেছেন, যার অভিঘাত অদ্যবধি সচল এবং এরপর, কয়েকদিন জুড়ে তাঁর সিলেটে অবস্থানকালে যাঁরাই কবির সংস্পর্শে আসেন তাঁরা পরবর্তী জীবনে কৃতবিদ্য হয়ে উঠেন এক অত্যাশ্চর্য পরশপাথরের ছোঁওয়ায়। এর মধ্যে যেমন বঙ্গজন, তেমনি বিশেষ জাতিগোষ্ঠীও রয়েছে (যেমন মণিপুরি কাছারি, জনগোষ্ঠী)। এ সূত্রেই শান্তিনিকেতনে পৌঁছে যান এ ভুবনের একঝাঁক নক্ষত্র। সিলেটের মরমিয়া পদকর্তা হাসন রাজা যে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এর সূত্রপাতও সম্ভবত কবির ওই সফর পর্বেই। স্বামী বিবেকানন্দ অবশ্য এ ভুবনে আসেন আঠারো বছর পূর্বে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রয়াণের (৪ জুলাই ১৯০২) ১৪ মাস আগে। এ আগমনের বিস্তারিত বিবরণ এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য নয়। বিবেকানন্দ যখন বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেন নি, অর্থাৎ যখন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, বি, এ পরিচিতিও কমগুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তখনই তিনি এ ভুবন থেকে দু দুটো অমূল্য রত্ন আহরণ করেছেন এ ব্যাপারে  দৃষ্টি আকর্ষণ করা এ রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য। তবু প্রসঙ্গক্রমে, ১৯০১ সালের ঘটনা একটু বলতে হচ্ছে। স্বামীজি ওই বছর ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে এলেন আসাম ভ্রমণে, গৌহাটিতে কামাখ্যাতীর্থ দর্শন করে তিনি যান শিলং। ১ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ শেষ করে ঢাকা হয়ে স্টিমারে করে গৌহাটি পৌঁছান। ঢাকা থেকে ৫ এপ্রিল স্টিমারে তিনি রওয়ানা হন। আসামের ধুবড়িতে নৌযাত্রার সমাপ্তি হয়। এরপর মোটরে করে পৌঁছোন গৌহাটিতে। তারিখটি সঠিকভাবে নির্ণীত হয়নি, তবে ১৭ এপ্রিল তারিখে কামাখ্যায় শিবকান্ত আর লক্ষ্মীকান্ত পান্ডার খাতায় তাঁর স্বাক্ষরসহ একটি প্রশংসাবাক্য পাওয়া গেছে। এই দুই ভ্রাতার সেবা যত্নে তিনি যে খুশি, একথাই লিখে গেছেন। তিনদিন কামাখ্যাধামে বাস করেন স্বামীজি। ওখান থেকে শিলং যাবার আগে কটন কলেজ, সোনারাম হাইস্কুল এবং আরও দু’জায়গায় স্বামীজির বক্তৃতা অনুষ্ঠানও ছিল, যদিও তাঁর স্বাস্থ্য মোটেই অনুকূল ছিল না। বিবেকানন্দের ওই ভ্রমণের পুঙ্খানুপুঙ্খ কোন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না, যা পাওয়া যায় তা হল পণ্ডিত পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদের স্মৃতিচারণে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু মন্তব্য (যা আবার একটু রুঢ় সমালোচনামূলকও বটে)। বিদ্যাবিনোদের ‘রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ প্রসঙ্গ’ শীর্ষক নিবন্ধে যা আছে, তা নিতান্ত অসম্পূর্ণ। পদ্মনাথের সঙ্গে স্বামীজির সম্পর্ক খুব যে মধুর ছিল তা নয়, বরং তাঁর মুক্তচিন্তা, বেদান্ত দর্শনের ভাষ্য, রক্ষণশীলতার প্রতি কটাক্ষ বিদ্যাবিনোদনকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আসামে বিশ্বজয়ী এ সন্ন্যাসীকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য অর্থব্যয়কে তিনি সমর্থন করতে পারেননি। বিশ্ববিজয়ী বীর সন্ন্যাসীর এ হেন রুঢ় সমালোচনাও যে কোনও সাধারণ মানুষের কম্ম নয়, এ বিবেচনায় পদ্মনাথের প্রতিও আমরা কৃতজ্ঞ, কারণ এ সূত্রে বিবেকানন্দ-মানসে আসামের একটা স্থানলাভ তো ঘটল।

পদ্মনাথ প্রসঙ্গে একটু বিস্তারিত বলা যেতে পারে। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’ (১৯৮০) গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে পাদটীকায় প্রসঙ্গটি উধৃতিসহই এসেছে। গৌহাটিতে পদ্মনাথের সঙ্গে স্বামীজির (প্রথম?) সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি বেশ চিত্তাকর্ষক। তাঁর নিজস্ব বয়ানে–‘বারান্দায় একখানা টুলের উপর একটি গৌরবর্ণ গেরুয়া ধুতি ও গেঞ্জি-পরা লোক বসিয়া আছেন–চুলগুলি এলোমেলো, পান চিবাইয়া ঠোটগুলি লাল হইয়াছে।’ বিবেকানন্দ অতি অবশ্যই এ পণ্ডিতপ্রবরের ধরনধারণ জানতেন, তিনি যে তাঁর মাংসভক্ষণ এবং সঙ্গে ফরাসি সংগীতের বই রাখার জন্য এই ব্যক্তি কর্তৃক নিন্দিত, এও বোধহয় জানতেন। বিদ্যাবিনোদের উক্তি-‘ফরাসীদের সঙ্গীতের বৈরাগ্যের উদ্দীপক উপাদান আছে কি না জানি না’-এ সম্বন্ধেও স্বামীজি সম্ভবত অবহিত ছিলেন। কৌতুকপ্রিয় স্বামীজি এ দর্শনে তাঁর প্রতি একপ্রকার প্রত্যহ্বান ছুড়ে দিলেন–‘এই যে আপনার গলায় পৈতা, এটাও পারসিকদের কাছ হইতে পাওয়া গিয়াছে’। অতঃপর ‘যজ্ঞোপবীতং পরমং পবিত্রং’ মন্ত্র সম্বন্ধে স্বামীজি বলেন–‘দেখুন, ও মন্ত্র প্রক্ষিপ্ত; ইহার শব্দ ও ছন্দ আধুনিক’। এরপর শাস্ত্রলোচনা যে আর বেশিদূর এগোবার কথা নয় তা তো বোঝাই যাচ্ছে। পদ্মনাথ একপ্রকার রণে ভঙ্গই দিলেন এই বলে যে, ‘এরূপ অবস্থায় কোনো তর্ক চলিতে পারে না’। লক্ষণীয়, এ সমস্ত কথাই একেবারে উধৃত সংলাপ সহই আমরা পদ্মনাথের নিজস্ব বয়ানে পাচ্ছি। শঙ্করীপ্রসাদ বসু জানিয়েছেন, ‘পদ্মনাথকে নিয়ে নাড়াচড়া করার ইচ্ছা বোধহয় স্বামীজির এর পরও যায়নি’। উভয়ের দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার হয় কটন কলেজে, স্বামীজির বক্তৃতা সভায়, যেখানে  পদ্মনাথ উপস্থিত থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে ছিলেন একটু আড়ালেই। অসুস্থ স্বামীজি খুব প্রস্তুত ছিলেন না, কী নিয়ে বলবেন, তাই শ্রোতাদের মতামত চাইলে সবাই নিরুত্তর রইলেন দেখে স্বামীজির প্রশ্ন– ‘সেই ভট্টচার্জি কোথায় ?’ ভট্টচাষযমশাই অবশ্য জনতার অন্তরালেই থাকা শ্রেয় ভেবেছিলেন। স্বামীজি এরপর যে বিষয়ে বক্তব্য পেশ করেন, এতেও পদ্মনাথের খুশি হওয়ার খুব কারণও দেখি না। জাতিবিচার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ‘হাঁড়ি ধর্ম’, ‘ডুৎমার্গ’ ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করে তাঁর কথনে ছিল এই জড়পদার্থ জাতির প্রতি কটাক্ষ ‘জড়তায় দেশ উচ্ছন্ন হইতে বসিয়াছে– বুদ্ধি খাটাইয়া একটা কিছু করো-না হয় বড়-দরের একটা চুরি-ডাকাতি করিয়া বুদ্ধি খোল-‘। পণ্ডিতপ্রবরের স্বীকারোক্তি (অনেকদিন পর, ১৯২০ সালে)- ‘সে দিনকার বক্তৃতা শুনিয়াই স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে আমার আমার পূর্ব ধারণা বহুল পরিবর্তিত হইয়া যায়।’ তিনি সম্যক উপলব্ধি করলেন স্বামীজি আসলে বেদান্তবাদী, ধর্মপ্রচারক নন, এটা একটি বাহ্যিক ‘খোলস’ মাত্র। স্বামীজির এ মত তাঁর মনঃপুত হয়নি যে, খাদ্যাখাদ্য বিচার ইত্যাদি জাতিকে সংঘবদ্ধ হতে দিচ্ছে না; আর চুরিডাকাতি করে বুদ্ধি খোলার পরামর্শও তাঁর বিলকুল নাপসন্দ। পদ্মনাথের কাছে মনে হয়েছে বিবেকানন্দ নিছক একজন ‘রাজনীতি প্রচারের যোগ্য ব্যক্তি’। তবে বিবেকানন্দের অসাধারণ বাগ্মিতা, পাণ্ডিত্য, ইংরেজি ও সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তি স্বীকার করেই বলেন–‘এই সন্ন্যাসীর সাজ-পরা লোকটি যেন মেষচর্মাচ্ছাদিত একটি কেশরী’। (পৃ.১৫৬-৫৮)

দুই

সূচনায় যে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলাম, আমাদের এই প্রান্তিকভূমি কী ভাবে বিবেকানন্দ-স্পর্শে গৌরবান্বিত হয়ে আছে। ১২৯৪ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ২৪ বৎসর বয়স্ক বিবেকানন্দ অপর সহযোগী বৈষ্ণবচরণ বসাকের সঙ্গে একযোগে একটি সংগীতসংগ্রহ প্রকাশ করেন। ১১৮ নং আপার চিৎপুর রোড, কলকাতা, আর্যপুস্তকালয় থেকে শ্রীচণ্ডীচরণ বসাক কর্তৃক প্রকাশিত এই গ্রন্থের নাম ‘সঙ্গীতকল্পতরু’। ৬৪৭টি গান নিয়ে প্রকাশিত এ সংকলনে ১৭৬ জন রচয়িতার নামাঙ্কিত পদ ছাড়া রয়েছে অজ্ঞাত কবির পদও। এই সংকলন করতে গিয়ে সংগ্রাহকদ্বয় বিচরণ করেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন প্রাদেশিক গানের জগতেও। তখনও বিবেকানন্দ সন্ন্যাসব্রত ধারণ বা সন্ন্যাস নাম গ্রহণ করে বিবেকানন্দে পরিণত হননি। সংগীতে পারদর্শী, সংগীত ভাবুক নরেন্দ্রনাথ এ কাজটি যে কী কঠোর পরিশ্রমে এবং গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন এর পরিচয় পাওয়া যায় ২০০০ সালে ড.সর্বানন্দ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সংগীতকল্পতরু’ গ্রন্থটির নবসংস্করণের ভূমিকা এবং সংযোজিত তথ্যপঞ্জিতে। আটটি পরিচ্ছদ বিভাজিত হয়েছে জাতীয়সংগীত, ধর্মবিষয়ক সংগীত, পৌরাণিক সংগীত, ঐতিহাসিক সংগীত, সামাজিক সংগীত, প্রণয় সংগীত, বিবিধ সংগীত এবং নানাবিষয়ক সংগীত পর্যায়ে। এখানে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভাবশিষ্য সংগীতে বিচিত্রগামী নরেন্দ্রনাথ অধ্যাত্মচেতনা সম্পৃক্ত গান ছাড়াও চটুল হাস্যরসের গান, ব্যঙ্গাত্মক গান ছাড়াও ইসলামি গান এবং খ্রিস্টীয় সংগীতকে স্থান দিয়েছেন তাঁর এই মহাগ্রন্থে। এই সংকলনে সঙ্গতকারণে বাংলাগান প্রাধান্য লাভ করলেও তিনি সংস্কৃত, হিন্দি, সাওতালি, ওড়িয়া, এমনকী অসমিয়া গানও গ্রহণ করেছেন। শেষ উল্লেখটি বিশেষ অর্থবহ। যখন একটা অভিযোগ ছিল (এখনও আছে) যে, অসমিয়া ভাষার স্বাতন্ত্রে সেকালের বাঙালি বিদ্বৎজন নাকি সন্দিহান তখন বিবেকানন্দ একটি অসমিয়া গানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন যা আসামসহ উত্তরপূর্বাঞ্চলে এ মুহূর্তে একটি বিশেষ বার্তা বহন করে বৈ কি। আমরা আসাম ছাত্রসভার বাৎসরিক উৎসব উপলক্ষে পরিবেশিত ওই গীতটি এখানে উদ্ধার করি-

কি সুখর দিন আজি, কেনে প্রীতি ভাব এ
আনন্দে নধরে হিয়া সকলো ভাই বন্ধুর এ।
ঈশ্বরর কৃপাগুণে, আহি সবে জনে জনে,
প্রাণভরি মহারঙ্গে করিছো উৎসব এ।
বছরে বছরে যেন, হয় এনে সুমিলন,
আহি যেন পুন সুকার্য্য সাধয় এ।
(রাগিণী ঝিঝিট, বানান অপরিবর্তিত, পৃ৪৭৫)

এ গানের রচয়িতা সম্পর্কে কোন তথ্য জানা গেল না। তবে এরকম আরও অনেক গান এখানে রয়েছে যে গানের রচয়িতা সম্বন্ধে তথ্য নেই, কোথাও বা আবার রচয়িতা সম্পর্কে লেখা হয়েছে ‘অপ্রকাশিত’। নতুন সংস্করণেও এ দিকে কোন আলোকপাত করা হয়নি।

আরেকটি গান, যে-গান ১৯০২ সাল থেকে আসামের কাছাড় জেলায় (এবং অতি অবশ্যাই সিলেটে) গীত হয়েছে, যে গানের মাধ্যমে এ অঞ্চলে স্বদেশি আন্দোলনের বার্তা পৌঁছোতে শুরু করেছে, আসা যাক এ প্রসঙ্গে। গানটির পদ নিম্নরূপ-

না জাগিলে সব ভারত ললনা,
এ ভারত আর জাগে না, জাগে না।
অতএব জাগ, জাগ গো ভগিনি,
হও বীর জায়া, বীর প্রসবিনী।
শুনাও সন্তানে শুনাও তখনি,
বীরগুণ গাথা, বিক্রম কাহিনী,
স্তন্যদুগ্ধ যবে পিয়াও জননী;
বীর গর্ব্বে তার, নাচুক ধমনী।
তোরা না করিলে এ মহা সাধনা,
এ ভারত আর জাগে না জাগে না। (পৃ.১২০)

নানা সূত্রে এ গানটি সিলেটের সুসন্তান বিপিনচন্দ্র পালের রচনা বলেই সনাক্ত করা হয়েছে, যদিও বিবেকানন্দর কাছে বিষয়টি অজ্ঞাত ছিল। বিপিনচন্দ্র (১৮৫৮-১৯৩২) তাঁর সমসাময়িক কালে জাতীয় রাজনীতিতে বিশিষ্ট স্থান দখল করেছিলেন সাংগঠনিক ক্ষমতা, অপূর্ব বাচন ক্ষমতা এবং সৃজনশীলতার জন্য। তৎকালীন জাতীয়স্তরের তিন বিশিষ্ট জননেতা, লাল-বাল-পাল–এর অন্যতম, বিপিনচন্দ্র পাল সম্বন্ধে অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকারের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য–‘বিপিনচন্দ্রের গলার আওয়াজ না শুনলে যুবক বাংলার জন্ম হতো না’ (‘বিনয় সরকারের বৈঠক’ গ্রন্থে উদ্ধৃত)। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রের প্রথম পর্বে, উনবিংশ শতকের শেষ অধ্যায় থেকে বিংশ শতকের দুটি দশক বিপিনচন্দ্র দেশবিদেশে বক্তৃতা করে ঘুরে বেড়াতেন। জওহরলাল নেহেরুর আত্মজীবনীতে, ক্যামব্রিজে বিপিনচন্দ্রের বক্তৃতার কথাও উল্লিখিত হয়েছে। বিপিনচন্দ্র সিলেট শহরে ১৮৬৬ থেকে ১৮৭৪ পর্যন্ত স্কুলের পাঠ নিয়ে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে চলে যান। আমাদের মনে রাখতে হবে, ওই সময় ছাত্র নরেন্দ্রনাথ দত্ত কলকাতা শহরে একজন মেধাবী ব্যক্তিত্ব, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন পরমহংস অনুগামী এবং সুকণ্ঠের অধিকারী গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সুন্দরীমোহন দাসের সান্নিধ্যে এসে একই সময়ে বিপিনচন্দ্রও ব্রাহ্ম ভাবান্দোলনে সামিল হন এবং তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজভুক্ত গুণীজনের সংস্পর্শে আসেন। অর্থাৎ বিবেকানন্দ- পরিচিত সামজেই বিপিনচন্দ্রের বিচরণ যে ছিল তা বোঝা যায়। এ সূত্রেই হয়তো নরেন্দ্রনাথ দত্ত না ‘জাগিলে ভারত ললনা’ গানটির সঙ্গে পরিচিত হন। সম্পাদিত ও প্রকাশিত গ্রন্থে লেখকের নাম না থাকাতে, এ গানের রচয়িতা সম্বন্ধে অনিশ্চিতি থাকতেই পারে। গ্রন্থটিতে সুবক্তা, সুলেখক বিপিনচন্দ্রের সংগীত প্রতিভার কিছু সাক্ষ্যও ছড়িয়ে আছে। ১৯০৭ সালের মার্চ মাসে বিপিনচন্দ্র স্বদেশী আন্দোলনের বার্তা নিয়ে কাছাড়ে আসেন। শিলচর শহরে তাঁর বক্তৃতা শুনতে শিলচরের মহিলারাও উপস্থিত থাকতে চাইলে তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। সেদিনের বক্তৃতা অনুষ্ঠানে বিপিনচন্দ্রের সঙ্গে সিলেট থেকে আগত একজন গায়ক বিপিনচন্দ্র রচিত  নারীজাগরণের বিশেষ গানটিই পরিবেশনের কথা ঐতিহাসিক জয়ন্তভূষণ ভট্টাচার্য তাঁর ‘কাছাড় আন্ডার ব্রিটিশ রুল ইন নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া’ (১৯৭৭) লিখেছেন। গানটি বিপিনচন্দ্রের রচনা বলে এ অঞ্চলে প্রচলিত। নারী জাগরণ এবং নারীশিক্ষা নিয়ে তৎকালীন স্বদেশী নেতৃবর্গের বিশেষ ভাবনার প্রকাশ বিপিনচন্দ্রের নামে প্রচারিত এ গানটি মহাগ্রন্থ, ‘সংগীতকল্পতরু’তে স্থান লাভ করে এ ভুবনকে গৌরবান্বিত করেছে। এ প্রসঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন, ১৯০৮ সালে শহিদ ক্ষুদিরামের ফাঁসি বিষয়ক যে গানটি সিলেট-কাছাড়ে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে সেই ‘ভুলিবে কি প্রাণান্তে। বড়ো অবিচারে হইল রে আমার ক্ষুদিরামের ফাঁসি’, গানের ভনিতায়ও বিপিনচন্দ্রের নাম একাধিক সূত্রে পাওয়া গেছে, যদিও আরেক অজ্ঞাত পদকর্তা ‘বৃন্দাবন’-এর নাম সম্বলিত ভনিতাও ভিন্নতর সূত্রে লভ্য। ক্ষুদিরামের ফাঁসি বিষয়ক গানটির শেষাংশটি নিম্নরূপ—

কেঁদে বিপিন পালে বলে
বুক ভেসে যায় নয়ন জলে,
দেশের কথা ভাবলে আমার মন হয় উদাসী,
বড়ো অবিচারে হইল রে আমার ক্ষুদিরামের ফাঁসি।

[ আমার বাবা, স্বাধীনতা সংগ্রামী, তৎকালীন আসাম বিধান পরিষদের সদস্য যতীন্দ্রমোহন দেবলস্কর (১৯০১-১৯৯১) আট/নয় বছর বয়সে এ গানটি শুনে শিখেছিলেন। নব্বই বছর বয়সেও এ ভনিতা সম্বলিত গানটি গেয়ে গেছেন। আকাশবাণী শিলচর কেন্দ্র থেকে ৩ নভেম্বর, ১৯৮৪ তারিখে প্রচারিত কথিকায়ও গান প্রসঙ্গে স্মরণ করেছেন, এবং ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ তারিখে বেতার কেন্দ্রের একটি সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠানে গানটি গেয়েও শুনিয়েছিলেন তিনি।

তিন

‘সংগীতকল্পতরু’ গ্রন্থে যে দ্বিতীয়, কিংবা অসমিয়া গানটিকে ধরলে তৃতীয় গানটি গানটি স্থানলাভ করেছে, এ গানের রচয়িতা সিলেটের অপর সুসন্তান সুন্দরীমোহন দাস (১৮৫৭-১৯৫০) যাঁর ঘনিষ্টতা ছিল তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজের প্রথমসারির নেতৃত্বের সঙ্গে। ড.সুন্দরীমোহনের সংগীত প্রতিভার খ্যাতি কলকাতার বোদ্ধা সমজের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। এমনকী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও, তাঁকে কীর্তন শোনানোর জন্য সুন্দরীমোহনকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বিবেকানন্দ অর্থাৎ নরেন্দ্রনাথ দত্ত অবশ্য ‘সংগীতকল্পতরু’তে সুন্দরীমোহন দাসের নামটিও রেখেছেন। তাঁর রচিত গানটি প্রসঙ্গত স্মরণে রাখা প্রয়োজন—

চেয়ে দেখ দীনবন্ধু ভারতরমনী পানে।
কে দেখে তাদের দশা দীণনাথ তোমা বিনে।।
আজ্ঞান-আঁধারে তারা             হয়ে আছে পথহারা,
হইয়ে গো শান্তি হারা ভ্রমিছে ভব-কাননে।
কোমল কুসুম সম,                        প্রাণের ভগিনী মম,
অবরোধ-কারা মাঝে, বিষাদে কাটে জীবন;
সমাজ-চরণ-তলে,                          তাদের সতত দলে,
রাখ হে রাখ হে প্রভু দুখিনী রমণীগণে।
বিধবা-নয়নাসার,                           ঝরিতেছে অনিবার
ভাসায়ে ভারতহৃদি দেখিয়ে বাঁচি কেমনে;
তোমা বিনে কে গো বল, মুছাইবে আঁখিজল
উদ্ধারিবে দুখিনীরে তাপিত প্রাণে।। (রাগিণী ভৈরবী, তাল কাওয়ালী, পৃ।৩০২)
একটি প্রাসঙ্গিক সংযোজন:

২০১৪ সালের ৬ মে তারিখ আসাম টাইমস পত্রিকায় রাজীব রয় লিখিত ‘আননোওন সাইড অফ্ স্বামী বিবেকানন্দ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  ২৭ এপ্রিল স্বামীজি শিলঙে একটি বক্তৃতা দেন। কুইন্টন মেমরিয়েল হলে এ বক্তৃতায় আসামের চিফ কমিশনার স্যার হেনরি কটন সভাপতিত্ব করেন। হেনরি কটনের নামে যে আবার ২৭ মে (মাসটি মে, এপ্রিল নয়) ১৯০১ সালে গৌহাটিতে বিখ্যাত কটন কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়, এর কোনও উল্লেখ নেই ওই প্রতিবেদনে।

আসাম টাইমসে খবরটি প্রকাশিত হয় যে স্বামীজি ওই বছর ঢাকা থেকে ৫ এপ্রিল স্টিমারে গৌহাটি রওয়ানা হন। আসামের ধুবড়িতে নৌযাত্রার সমাপ্তি হয়। এরপর তিনি মোটরে পৌঁছোন গৌহাটিতে। তারিখটি সঠিকভাবে নির্ণীত হয়নি, স্বামীজি ১৭ এপ্রিল যে তিনি গৌহাটিতে ছিলেন তার প্রমাণ আছে পান্ডার খাতায়। এর পরবর্তী ক’টা দিন তিনি গৌহাটিতে কাটান। ওখান থেকে তিনি যান শিলঙে। ২৭ এপ্রিল বক্তৃতা দেন। ২০/২৫ দিন শিলং কাটিয়ে ১২ মে, ১৯০১ বেলুড় মঠে ফিরে যান। আমাদের সমস্যাটা হচ্ছে তারিখ নিয়ে। কটন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২৭ মে, ১৯০১ সালে। তাহলে তাঁর বক্তৃতার তারিখ নিশ্চয় এপ্রিল মাসের আগে, কারণ তিনি গৌহাটি পর্ব শেষ করেই শিলং গেছেন, আবার তিনি গৌহাটি-শিলং পর্ব শেষ করে বেলুড়ে ফিরে গেছেন ১২ মে, ১৯০১ সালে। কটন কলেজের ওয়েব সাইটেকে প্রামাণ্য ধরলে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিবেকানন্দ বেলুড়ে ফিরে যাবার ১৫ দিন পর। তা হলে কটন কলেজ বক্তৃতাটা কবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ? ১৭ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিলের মধ্যে ? তখন তো কটন কলেজের জন্মই হয়নি।

পদ্মনাথ কটন কলেজে যোগদান করেননি। তিনি কটন কলেজের ইতিহাস ও সংস্কৃত সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন ১৯০৫ সালে, এ তথ্য দিয়েছেন প্রসূন বর্মন (ভূমিকা, মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ প্রণীত ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন’, বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, ২ অক্টোবর, ২০১৮)। তবে কটন কলেজে পদ্মনাথের যোগদানের ব্যাপারে কোন সমস্যা নেই, শিক্ষক না হয়েও তিনি বক্তৃতানুষ্ঠানে জনতার ভিড়ে যেতেই পারেন। কিন্তু কলেজটির প্রতিষ্ঠার আগেই এ অনুষ্ঠান হয়েছে তা কি বিশ্বাসযোগ্য? শঙ্করীপ্রসাদ বসু যে সূত্র ব্যবহার করেছেন, সেটা মূলত ১৯২০ সালে প্রকাশিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকা। আর কাশীধাম ব্রাহ্মণসভা প্রকাশিত ‘রামকৃষ্ণ- বিবেকানন্দ প্রসঙ্গ’ বইটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যও শঙ্করীপ্রসাদ বসু বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’ বইতে দেননি। আসলে বিবেকানন্দের আসাম আগমন নিয়ে আরও গভীর অন্বেষণ এবং প্রাপ্ত সূত্রগুলোর বিশ্লেষণের প্রয়োজন। নতুন কোনও তথ্য আবিষ্কৃত না হলে আমরা যেন তথ্য তৈরি করার স্বস্তা পথে না চলি, একথা দৃঢ়তা আর বিনয়ের সঙ্গে বলা প্রয়োজন।

♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦

লেখক প্রাবন্ধিক, শিলচরের বাসিন্দা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!