- ব | ই | চ | র্যা রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫
মৃণাল-মনোজের স্মরনে দুই কৃতি সন্তান

২০২৫ এর কলকাতা বইমেলায় দুটি বই নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল। দুই সন্তানের লেখা তাঁদের প্রয়াত বাবাকে নিয়ে দুটি বই। হয়তো আলাদা করে বইগুলিকে নিয়ে লিখলে ভাল হতো। কিন্তু কে জানে কেন, পড়বার পর মনে হয়েছে, দুটি বই আলাদা হলেও বিষয়ের নিরিখে তারা অভিন্ন।
বাবার হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে হাঁটা, তাঁর কথা কানে পৌঁছালেও মরমের বাইরে থেকে যাওয়া, অবুঝ আবদারে ব্যতিব্যস্ত করা, নিঃস্পৃহতার ক্ষণিক শীতলতা – পিতৃত্বের আদর, প্রশ্রয়, রাগ, অভিমান, তাঁদের থেকে দূরত্ব গড়ে তোলা, দূরে থেকে তাঁদের টান অনুভব করা। যে কথাগুলি আগে বোবা ছিল, নতুন করে তা মনে পড়া, নিজের মতন করে বুঝে নেওয়া – স্মরণ, সম্ভ্রম, দীর্ঘশ্বাসের এসব যতিচিহ্ন বাবা হয়ে থেকে যাবে আমরণ।
পেশায় বিজ্ঞানী, যাপনে শিল্পী কুনাল সেন ছোট থেকে তাঁর বাবাকে ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করতেন। মৃণাল সেনও ছেলেকে একই ভাবে কাছে ডাকতেন। চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনকে কখনো কাছ থেকে, কখনো নৈর্ব্যাক্তিকভাবে যতদূর দেখেছি, কর্মজীবনে তিনি দূরত্বকে মুছে দিয়েছেন, অনায়াসে। কাঁধে হাত রেখে পরিচয়ের উষ্ণতা সঞ্চারিত করে অপরিচয়ের দেওয়াল ভেঙেছেন।
চলচ্চিত্রকে যিনি যাপন ও মননের সঙ্গতি নির্ণয়ের একমাত্র উপায় বলে জেনেছেন, তিনি এক অর্থে যাযাবর। উষর মরুভূমিতে প্রখর রোদে হাঁটতে মরূদ্যানে পৌঁছান অবধি প্রগাঢ় সংযমে একাকিত্ব বাহী মানুষটির যাঁরা আপনজন, তাঁদের দুর্গতির শেষ নেই। মরূদ্যানে সৃজনেরতৃষ্ণা মিটলে সংসারে ফিরে আসা, স্বল্পকাল পরেই আবার নতুনের কায়াকল্পের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু।
প্রবৃত্তি আর নিবৃত্তির এই অবিরাম চক্রে মা গীতা সেন এবং মামা ‘অনু’ (অনুপকুমার)-এর আশ্বাসভরা উপস্থিতির স্মৃতি সযত্নে রোমন্থন করেছেন লেখক। কিশোর এবং যৌবনের প্রথম পর্যায়ে ‘বন্ধু’-র ক্ষণিক ভূমিকার মুহূর্তগুলিকে বলিষ্ঠ রেখায় এঁকেছেন। পরবর্তীকালে প্রকৃত অর্থেই ‘বন্ধু’ হয়ে যিনি লেখকের স্বাধীন সত্ত্বাকে যথার্থ গুরুত্ব দেবেন। চলচ্চিত্রকারের ছেলে কেন বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন না, তা ‘বন্ধু’-রই ব্যক্তিপ্রতিভার স্বীকৃতির নিয়তি হয়ে দাঁড়াল পরে ।
জীবনের সায়াহ্নে স্ত্রীকে হারিয়ে বিস্মৃতির কুয়াসায় ক্রমশ ডুবে যাওয়া ‘বন্ধু’-র বিবরণটি পড়তে পড়তে নিজেরই কোনও আপনজনকে ফিরে দেখছিলাম। যে ঘর-বাড়ি দিনরাত সহকর্মী-বোদ্ধা-ভক্তজনের স্বচ্ছন্দ যাতায়াতে মুখর থাকত, একসময় সে ঘর-বাড়ির জমাট নৈশব্দ বুকে এসে ধাক্কা দেয়। প্রবল ধার্মিক মৃণাল সেনের বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা, নীরবতা, তাঁর নির্জন মৃত্যু আমাদের নিরেট সাংস্কৃতিক পরিচিতিতে আঁচড় কাটতে চায়, ব্যর্থ হয় – তবু চেষ্টা করে।
অন্য বইটির কথায় আসি। লেখক, অভিনেতা আর নির্দেশক ময়ূরী মিত্রের সঙ্গে পরিচয় স্বল্প। সমাজ মাধ্যমেই। বাবা মনোজ মিত্রের মেয়ে হিসেবে নয়, তাঁর স্বতন্ত্র পরিচিতির বিভা আমাকে আকর্ষিত করে। ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে ওনার সামাজিক দেওয়ালে তিনি যা লেখেন, তাতে মানবিকবোধ এতই সম্পৃক্ত যে আগলহীন হয়েই অন্তরের বার্তা বাইরে বেরিয়ে আসার পর খোঁজে। বস্তুত, এই প্রগাঢ় মানবিকবোধ থেকেই তাঁর প্রয়াত বাবার স্মৃতিকথাটি পড়তে গভীর আগ্রহ জন্মায়।
তাঁর লেখা পড়তে পড়তে বহু প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কাছের মানুষের চলে যাওয়ার অভিঘাত সামলে নেওয়ার পর্বে চিন্তায় নানা ধরণের ভাবের কাটাকুটি চলে। দূরে চলে যাওয়া প্রিয়জনকে কাছে পাওয়া যাবে না, যুক্তি-বুদ্ধি তা স্বীকার করলেও, হৃদয় তা মেনে নিতে চায় না। ব্যক্তিগত স্তরে এই লেখার আয়োজন কেন জানি বড্ড অশান্ত আবেগের উদযাপন হয়ে উঠেছে আমার ক্ষেত্রে। আবেগের উষ্ণতায় যুক্তির বরফ কঠিন ছুরি চালানোর কথা আমাকে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন অরুণ খোপকর। মন যা নিয়ে তাড়িত, তাপিত তা থেকে প্রয়োজনীয় দূরত্ব রচনা করে তা নিয়ে অরুণজির বস্তুনিষ্ঠ লেখা দুটি বই ইতোমধ্যে অনুবাদ করেও বুঝতে পারছিলাম না, কী করে এ অনুশীলন আয়ত্ত করি। সে ক্ষেত্রে, ময়ূরী মিত্র আমার দ্বিতীয় শিক্ষক।
নাট্যকার-অভিনেতা-নির্দেশক মনোজ মিত্র অসুস্থ হয়ে হঠাৎ চলে গেলেন। যাওয়ার পর থেকে বিয়োগব্যাথা অনুভব করেছি। কিন্তু তাঁর আত্মজা যে অনুভবের তীব্রতার মধ্যে দিয়ে এই পর্বটি অতিক্রম করে আলোচ্য বইটি রচনা করেছেন, নিবিড় স্মৃতিকথার এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে তা চিহ্নিত হয়ে থাকবে। লেখায় তাঁর গভীর মায়া জড়িয়ে রয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত মমত্বের এই বীজকে তিনি যে নিবিষ্ট চিত্তে ছায়াদাত্রীর অবয়বে পরিণত করেছেন, তার পরিচয় তো আগেই মিলেছে। এবার তা ছাড়িয়ে, বইটির প্রতিটি বাক্যবিন্যাসের অবয়বে তাঁর জন্মদাতাকে অন্যেরও একান্ত আপনজন করে তুললেন ময়ূরী।
দেশভাগের সময়ে অল্পবয়সী মনোজ মিত্রের সীমানা পেরনোর চালচিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত সারল্য অভিভূত করে। অসুস্থ চতুস্পদের পরিচর্যা ছেড়ে চলে আসা ছেলেটি প্রাণীটিকে ‘ফিরে আসছি রে!’ বলে আশ্বস্ত করে হেঁটে যাচ্ছে। তাঁর জন্মাঞ্চলে ফিরতে না পারা থেকে যে আর্তির জন্ম, নাট্যকার হিসেবে মনোজ মিত্র সে আর্তির বিভিন্ন রূপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে গেছেন, নানা স্তরে, সজল নয়নে। সে আর্তিকে যাপন করবার দিনগুলির মরমী বিবরণ প্রয়াত নাট্যকারের মায়ের মুখনিঃসৃত হয়ে, মেয়ের স্মৃতিচারণে কমনীয় হয়ে পাঠকের অন্যমনস্কতা দ্রবীভূত করে দেয়। জন্মের কত আগের কথা, তবু সে বেদনা হৃদয়ের তন্ত্রীতে অনবরত বাজছে শুনতে পাই।
ময়ূরী মিত্রের প্রতি নাট্যকার-নির্দেশকের নির্দেশগুলির কথাও লেখা হয়েছে বইটিতে। অসামান্য অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় ছড়িয়ে আছে তাতে। জীবনে ভালো যা কিছু আহরণ করেছি, তা বৃথা যাবে না, এই আশায় বেঁচে থাকাতে ইন্ধন যোগায় সে সব গল্প। নাটকের কথা হোক, কিংবা অভিনয়ের কথা – সে তো জীবনকে যাপিত করবারই সাধন। ময়ূরী মিত্রের বিয়োগস্মৃতিতে অবিরত জীবনের এমন হৃদস্পন্দন অনুভব করবেন তাঁর পাঠক। বাবাকে হারাননি তিনি। ময়ূরী মিত্রের মধ্যেই জেগে আছেন তাঁর বাবা।
আমার বন্ধুলেখক : কুনাল সেন
প্রকাশক : সপ্তর্ষি প্রকাশন, ২০২৫
••••••••
সাঁঝের রোদে নাট্যকারলেখক: ময়ূরী মিত্র
প্রকাশক: আরম্ভ পাবলিশার্স, ২০২৫
❤ Support Us