- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- জুলাই ২১, ২০২৪
একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন ?

২০০৯ এর মার্চ, ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্সের সভায় রাষ্ট্রপুঞ্জের তৎকালীন মহাসচিব কোফি আন্নান, একটি সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশ যদি নিজেদের পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত করতে না পারে, তাহলে জল নিয়ে দেশে দেশে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে ।’
বছর কয়েক আগে জার্মানির বন শহরে জল বিষয়ক একটি সেমিনার হয়ে গেল । ১৩০ টি দেশের ৩০০০ প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন । সম্মেলনে এরকম একটা প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল যে, কিছুদিনের মধ্যে জলও পেট্রোলিয়ামের মত বিক্রি হবে । এবং একবিংশ শতাব্দীতে জল নিয়ে দেশে দেশে যুদ্ধ হতে পারে ।
এখন দেখা যাক, এ ব্যাপারে আমাদের দেশের অবস্থা ও ব্যবস্থা কেমন । ১৯৮৭-র সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় জল নীতি গৃহীত হয় । ২০০২ এবং ২০১২ সালে তা পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত চেহারা পায় । সেখানে বলা হয়, ‘ জল সংক্রান্ত বিষয়ে উত্তরোত্তর সমস্যা সমাধানে যথাযোগ্য আইন এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে । যা আইনের মারফতে তৈরি সংগঠন এবং সুচিন্তিত সমাধানের সপক্ষে …’ ( ‘ To take cognizance of the existing situation , to propose a framework for creation of a system of laws and institutions and for a plan of action with a unified. ….’ )
জলের ওপর মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা এই প্রস্তাবনায় স্বীকার করে নেওয়া হয় । তার সঙ্গে ভৌম জলের ব্যবহারের আওতায় কৃষিকাজ , শিল্পকে যথাসম্ভব আকৃষ্ট করা যায়, তার উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলা হয় ।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরকারি নীতিতে অনেক অনেক ত্রুটি অথবা ইচ্চছাকৃত ছাড় দেওয়া রয়েছে যার কুফল ভোগ করছেন সাধারণ মানুষ । এ কারণেও মানুষে মানুষে,গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে , রাজ্যে রাজ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যাচ্ছে ।
ভৌমজলের সমস্যা
আমাদের দেশে ভূগর্ভস্থ জলের মোট পরিমাণ ৪ হাজার ৩২০ কোটি কিউবিক মিটার । এর পুরোটা ব্যবহারযোগ্য নয় । সারা পৃথিবীর ১৮ % এর বেশি মানুষ ভারতে বসবাস করেন এবং পৃথিবীর মোট পুনর্ব্যবহারযোগ্য জলের মাত্র ৪ % এদেশে রয়েছে । অথচ পরিমাণে সামান্য ভৌম জলের অপচয় হচ্ছে দেশ জুড়ে । নিয়ন্ত্রণহীন খননে মাটির তলার জলভাণ্ডার কমছে । কৃষি ক্ষেত্রেও দেশের অনেকাংশে জলের অপচয় বাড়ছে । ফলে খরার অবস্থা তৈরি হচ্ছে অনেক জমিতে । জল অপচয়ের ফলে, দেশের উপকূলবর্তী এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত । সেখানের ভূগর্ভস্থ জলে লবণের পরিমাণ অত্যধিক বেড়ে যাচ্ছে । সঙ্গে বাড়ছে আর্সেনিকের হার, প্রকোপ বাড়ছে নানা রোগের ।
বোতল -দৈত্যদের বেলাগাম অপচয়
বহুজাতিক নরম পানীয় প্রস্তুতকারী, প্যাকেটজাত জল সরবারোহকারী সংস্থা নিজেদের ব্যবসার প্রয়োজনে বিপুল পরিমাণে ভৌমজল উত্তোলন করে এবং অপচয়ও করে তার বৃহদাংশ । পাশাপাশি এইসব উৎপাদক সংস্থা থেকে নির্গত রাসায়নিক বর্জ্য শুধু ভূগর্ভস্থ জলকে নয়, মাটিকেও বিষাক্ত করছে। ওইসব কল কারখানার আশপাশের জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, ব্যহত হচ্ছে চাষবাস । বহুজাতিকের অনৈতিক দাপট রুখতে কেরালার পালাক্কাড় জেলায় মানুষ, ২০০২ সালে ‘কোকাকোলা বিরোধী সমর সমিতি’ গঠন করেন । দেশের অন্যান্য জায়গায়তেও এদের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন বটে, তবে তা সংগঠিত নয় ।

বহুজাতিকের জল অপচয় রুখতে কেরালার পালাক্কাড় জেলায় মানুষ, ২০০২ সালে ‘কোকাকোলা বিরোধী সমর সমিতি’ গঠন করেন । দেশের অন্যান্য জায়গায়তেও এদের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন
বিশ্বে বোতলজাত পানীয় জলের ব্যবসার পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর প্রায় ৪৫% বিসলেরির দখলে। এইক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে বেইলির দখল ২৩ – ২৪%। পেপসি কোম্পানির অ্যাকোয়াফিনা এবং কোকাকোলার বাজারে দখল ৮ – ৯%। তারপর আছে অন্যান্য সংস্থাগুলো। তাদেরকে দেশের সমস্ত রকম প্রাকৃতিক সম্পদ ইচ্ছেমত ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে। ভারতবর্ষে বছরে ৫৫ % হারে বোতল -দৈত্যদের জলের ব্যবসা বাড়ছে।
২০০৯ ‘নয়াচর’-এ কেমিক্যাল হাব তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য । ২০১১ সালে মমতা বন্দোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই বাতিল করেন সেই প্রজেক্ট । কেমিক্যাল হাব নিয়ে পক্ষে এবং বিপক্ষে বিতর্কও কম হয়নি । আসলে নয়াচরে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বৃহৎ নদী, যেমন হুগলি, রূপনারায়ন, সুবর্ণরেখা, দামোদরের সংযোগ রয়েছে । নয়াচর সন্নিহিত সাগরের মোহনায় চার লক্ষ ধীবর নদীগুলোর ওপর তাঁদের জীবিকা নির্বাহের জন্য নির্ভরশীল । সেখানে কেমিক্যাল হাব হলে, যারা সেখানে বিনিয়োগ করতেন তারা পরিশ্রুত পানীয় জল অপচয়ের জন্য সারা বিশ্বে নিন্দিত । আমরা জানি হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্সে একটি জাপানি বহুজাতিক সংস্থা ভয়াবহ জল দূষণের জন্য অভিযুক্ত হয়েছিল । সে সময়কার রুপনারায়ণ নদীর ভয়াবহ সবুজ বিষাক্ত জলই বলে দেবে সে দূষণের তীব্রতার মাত্রা । তাদের জরিমানা হয়েছিল মোটে ৯৫ কোটি টাকা । মার্কিন যুকরাষ্ট্রে এই ঘটনা ঘটলে এই অঙ্কটা ন্যূনতম হত ১,৯৫,০০০ কোটি টাকা । এভাবে কোটি কোটি মানুষের জীবনের এপর হস্তক্ষেপ করে বৃহত্তর উন্নয়ড় কী সম্ভব ?

ছত্রিশগড়ের দূর্গ এ শিউনাথ নদী এবং খরখরা জলাধার
সরকারি চুক্তি অনুসারে জল কম্পানি রাজ্যের সরকারকে লিটার প্রতি ১২ টাকা ৬০ পয়সা হারে চল্লিশ মিলিয়ন লিটার জল যোগান দিতে শুরু করেছে । মজার কথা হলো, ভোক্তা কোম্পানিগুলো সরকারকে কর ফাঁকি দিচ্ছে অথচ জল কম্পানি সরকারের থেকে সুদে মূলে টাকা তুলে নিচ্ছে । ছত্তিশগড়ের জনসাধারণের অভিযোগ, স্বাভাবিক জলাধারকে বিক্রি করে, জনগণের করের টাকায় সেই জলই শিল্প গোষ্ঠীর থেকে কিনে তাদের মুনাফা বাড়াচ্ছে রাজ্যের সরকার
নদী বিক্রি, নদী চুরি
ছত্রিশগড়ের দূর্গ জেলার শিউনাথ নদীর ২৩ কিলোমিটার জুড়ে, প্রতিটি জল বিন্দুর মালিক এখন রেডিয়াম ওয়াটার কোম্পানি । সেখানকার রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তি করে ওই সংস্থা ঘোষণা করে, প্রবাহিত নদীর অববাহিকার এক কিলোমিটার পর্যন্ত কোনো কৃষিকাজ করা যাবে না । শিউনাথ নদীর দু-পাড় জুড়ে স্ক্রু আয়রণ, মদ, তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানা ছড়িয়ে আছে । ওইসব কারখানার পণ্য উৎপাদনে প্রচুর জলের প্রয়োজন । নদীতেও বছর জুড়ে জল থাকে না । ফলে নির্মিত হয়েছে ‘খরখরা’ জলাধার । সরকারি চুক্তি অনুসারে রেডিয়াম কোম্পানি ওই জলাধারেরও মালিক । তারা সে রাজ্যের সরকারকে লিটার প্রতি ১২ টাকা ৬০ পয়সা হারে চল্লিশ মিলিয়ন লিটার জল যোগান দিতে শুরু করেছে । মজার কথা হলো, ভোক্তা কোম্পানিগুলো সরকারকে কর ফাঁকি দিচ্ছে অথচ জল কম্পানি সরকারের থেকে সুদে মূলে টাকা তুলে নিচ্ছে । ছত্তিশগড়ের জনসাধারণের অভিযোগ, স্বাভাবিক জলাধারকে বিক্রি করে, জনগণের করের টাকায় সেই জলই শিল্প গোষ্ঠীর থেকে কিনে তাদের মুনাফা বাড়াচ্ছে রাজ্যের সরকার । অথচ সেই জলে যাদের স্বাভাবিক অধিকার, ওখানকার বাসিন্দারা পরিশ্রুত পানীয় জল পানে বঞ্চিত হচ্ছেন । দেশে নদী বিক্রির এ এক জলজ্যান্ত উদাহরণ । শুধু বিকিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না দেশের কুচক্রী রাজনৈতিক কারিগররা । জমি, জনগণের টাকা আত্মস্বাৎ করে তাদের লোভের খিদে আর মিটছে না, এখন তারা নদীও চুরি করছেন । যত্রতত্র নদী, জলাশয় বুজিয়ে বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি বানাচ্ছেন । তা নিয়ে উদাসীন দেশের প্রশাসন ।
জাতীয় জলধারা তৈরি হলে এবং উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমের নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ওই সমস্যা কমবে । কৃষিকাজ, যোগাযোগ ব্যবস্থারও প্রভূত উন্নতি হবে । পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি নদীগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ । বলতে গেলে, শুখা মরসুমে তাদের অস্তিত্বই থাকে না । তিস্তা, তোর্সা, বালাসন, মেচি, আত্রেয়ী, জয়ন্তী সহ বহু নদী প্রায় বিলুপ্ত হয়েও বর্ষায় ভয়াবহ আকার ধারণ করে
ভারতবর্ষে চারশোর মত নদী আছে । এর মধ্যে বড়ো নদী, গঙ্গা (২৫২৫ কিমি), ব্রহ্মপুত্র (২৯০০ কিমি, দেশ+বিদেশ ), সিন্ধু (১১১৪ মিমি,) নর্মদা (১৩১২ কিমি), কৃষ্ণা (১৪০০ কিমি), গোদাবরী (১৪৬৪ কিমি.)। মাঝারি দৈর্ঘ্যের নদী কাবেরী, মহানদী, তাপ্তী ইত্যাদি। এছাড়াও অসংখ্য শাখানদী, উপনদী, পাহাড়ি নদী রয়েছে । গঙ্গা ৮,৬১,৪০৪ বর্গ কিমি ভৌগলিক এলাকা জুড়ে বিস্তৃত । গঙ্গার বহমানতা ক্রমশ কমছে । অথচ এবিষয়ে কেন্দ্রের বা রাজ্যগুলির কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই । প্রবাহিত নদীর দুপাড়ে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চলের রাসায়নিক বর্জ্য ফেলার সহজ জায়গা গঙ্গা । এই বিপুল দূষণ রোধের কোনো সদিচ্ছা কেন্দ্র বা রাজ্যগুলোর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, অটলবিহারী বাজপেয়ির সরকার কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগের কাজ সম্পূর্ণ করলেও দেশের সব বড়ো এবং মাঝারি নদী গুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পণা বাস্তবায়িত করতে পারেননি । কাজটা সহজ নয়, কিন্তু দেশে ক্রম বর্ধমান জল সঙ্কটকে প্রতিহত করতে দ্বিতীয় প্রকল্প বাস্তবায়িত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । জাতীয় জলধারা তৈরি হলে এবং উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমের নদীগুলোকে সংযুক্ত করা গেলে, দেশের মানুষের অনেক সমস্যা লাঘব হবে । যখন দেশের উত্তর ভাগ বন্যায় ভেসে যায়, তখন দক্ষিণে শুখা মরসুম চলে । নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ওই সমস্যা কমবে । কৃষিকাজ, যোগাযোগ ব্যবস্থারও প্রভূত উন্নতি হবে । ক্ষয়িষ্ণু হিমবাহের ওপর নির্ভর করে থাকবে হবে না । পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি নদীগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ । বলতে গেলে, শুখা মরসুমে তাদের অস্তিত্বই থাকে না । তিস্তা, তোর্সা, বালাসন, মেচি, আত্রেয়ী, জয়ন্তী সহ বহু নদী প্রায় বিলুপ্ত হয়েও বর্ষায় ভয়াবহ আকার ধারণ করে ।
নদীগুলোকে যদি আমরা সারা বছর জলধারা বহনে সক্ষম করতে না পারি, তাহলে আগামী দিনে আমাদের অস্ত্বিত্বই বিপন্ন হবে । এখনই জাতীয় নদীনীতি গ্রহন করা আবশ্যক । নদী দূষণ বন্ধে কেন্দ্র রাজ্য সরকার একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে । নদীকে আরো আরো বেশি নাব্য করা হোক এবং নদীর দুধারে বৃক্ষরোপন করে নদীর অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা হোক । একশো দিনের কাজ, এম.জি.এন.আর.মি. এর অন্তত সত্তরভাগ কাজ নদী কেন্দ্রিক করা হোক । এখন ক্ষমতাসীন নেতা নেত্রীদের পকেটে পকেটে জব কার্ড ঘোরে । এসব প্রকল্পের টাকার সদব্যবহার কতটা হয়, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে । এসব প্রকল্পের এক বরিষ্ঠ সরকারি অধিকারীক একবার বলেছিলেন, বন্যা না হলে বিডিও অফিসগুলো উঠে যাবে ! তাই খরা ও বন্যা করার ব্যবস্থা সরকারই জাগিয়ে রাখে । জনসাধারণ মানুষ যদি এক হয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধে নামে তাহলে কি এটা বন্ধ করা যায় না ?
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
লেখক পরিচিতি: লেখক পরিচিতি: মনোজ দে নিয়োগীর জন্ম ১৯৬২ , হুগলির জাঙ্গিপাড়ায়। সমাজ কল্যাণ দফতরের প্রাক্তন আধিকারীক। কর্মসূত্রে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়েছে। জীবনের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণকে প্রতিফলিত করেছেন নিজের সাহিত্যকর্মে। প্রকাশিত হয়েছে একাধিক বই।
❤ Support Us