- ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
- মে ১৮, ২০২৫
মাহমুদ দারবিশ যদি আজ লিখতেন

চিত্রকর্ম: সুহাদ
তোমাদের রক্ত কি আমার কালি হতে পারবে
আমার কবিতা আজ থেমে গেছে,
খাতার প্রতিটি পাতায় কালির বদলে ছোপ ছোপ রক্ত ছড়ানো।
নিস্পাপ সন্তানেরা আমার, তোমাদের নিঃশ্বাস থেমে গেলে
আমার শব্দরা কি বাঁচতে পারে ?
আমি লিখতে বসেছিলাম একটি নদীর কথা,
তোমাদের চোখ হয়ে গেল সেই নদী—
জলের বদলে যেখানে এখন বইছে শুধু রক্ত।
তোমরা জীবন দিলে মাতৃভূমির জন্য,
অথচ জীবনতো তোমাদের শুরুই হয়নি তখনও।
আমাকে জিজ্ঞেস করে কাগজ —
তোমার কবিতা কি এখন যুদ্ধ ঘৃণা করে ?
আমি বলি—না, আমার কবিতা এখন কেবল
বুকে কান্না চেপে রাখে।
ধ্বংসস্তুপের পাশে পড়ে ছিল তোমাদের ছিন্নভিন্ন দেহ,
খেলনা, স্কুল ব্যাগ, এটা ওটা, কত কী
আমি শুধু তাকিয়ে থেকেছি, কেবল তাকিয়ে থেকেছি ।
যেন অনন্তকাল এরকম তাকিয়ে থাকাই আমার নিয়তি !
হে ইব্রাহিম, হে রিম, হে ইয়াসমিন—
তোমাদের নাম জানে না পৃথিবী, কিন্তু আমি জানি,
তোমাদের মৃত্যু আমার কবিতাকে অনাথ করেছে।
তোমরা আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকো-
আমরা মরলাম কেন ? কী আমাদের অপরাধ ?
আমি জবাব দিই না, কিংবা দিতে পারি না।
আমি শুধু লিখে যাই অসমাপ্ত কয়েক পংক্তি—
তোমাদের রক্ত কি আমার কালি হতে পারবে ?
তাহলে আমি আবার ফিরবো প্রতিবাদে, আবার ফিরবো কবিতায়।

চিত্রকর্ম : কিভারা আমার
সে যদি কবর থেকে জেগে উঠে
আমার দেশ এখন এক ঘুমন্ত শিশু —
জুলুমের মরুভূমিতে ফুল হয়ে ফোটার আশায় তার বুকের নিচে
গুটিশুটি হয়ে লুকিয়ে আছে একটি গোলাপ কলি।
তোমরা বোমা ফেলে সেই শিশুটিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলে,
পুড়ে ছাই করেছিলে তার বুকের ভেতরে লুকানো গোলাপটিকেও।
কিন্তু সে মরেনি, কবরে শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে
নতুন করে স্বপ্ন দানা বাঁধবে বলে।
তোমরা তো জানোই আমি আর লিখি না গাজার জন্য —
গাজাই এখন দখল করে নিয়েছে আমার কলম।
তোমরা তাই পারবে না আমার কবিতা থামাতে,
কারণ আমি এখন আর খাতা-কলমে লিখি না —
আমি কেবল এখানকার বাতাসকে অনুবাদ করি রিমের শেষ নিশ্বাসে,
ফাতেমা, হামজা, আয়েশা, আলি ইব্রাহিমের শেষ নিঃশ্বাসে।
তোমরা ফলাও করে প্রচার করো: ‘এটা তো রাজনীতি, এটা সন্ত্রাস।’
আমি বলি: ‘না, এটা ঘুমন্ত একটি শিশুর স্বপ্ন।
এটাকে এভাবে হত্যা করা যায় না।’
শান্তির নামে তোমরা সেই স্বপ্নের দিকে বন্দুক তাক করো,
বোমার বোতামে রাখ হাত।
তোমরা যদি তাকে না মারতে—হয়তো সে একজন শিক্ষক হতো,
নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক, শিল্পী, কিংবা আমার মতো বাউল কবি।
কিন্তু এখন সে শুধুই স্মৃতি—একটি শূন্য ঘরে এলোমেলো পড়ে থাকা
একজোড়া জুতো, কিংবা রক্তমাখা একটি স্কুল ব্যাগ।
কালো পর্দার ওপাশে তোমরা যারা অন্ধ, আপাত: ভয়ঙ্কর-
তারা তো জানোই না, একটি শিশুর ঘুম ভাঙলে তার স্বপ্ন
আবার ডানা মেলে আকাশে।
আমার দেশ সেই ঘুমন্ত শিশু—তাকে জাগিয়ে দিও না আগুনে,
সে যদি কবর থেকে জেগে ওঠে, তোমার বুলেটের ভাষা
তখন আর কাজ করবে না,
লিখে রেখো, জাগবেই সে- হয়তো আজ, আগামীকাল,
কিংবা অন্য কোনোদিন।

চিত্রকর্ম : আবেদ আব্দি
আমরা কবরেই জন্মাই
তারা ভাবে আমরা মরে গেছি, কিন্তু আমরা কবর থেকে জন্মাই—
মাটির নীচ থেকে মাথা তুলে দাঁড়াই প্রতিরোধের গাছ হয়ে।
তারা ভাবে আমাদের কবিতা থেমে গেছে— কিন্তু প্রতিটি ধ্বংসস্তূপে
আমি শুনি অনুচ্চারিত ছন্দ, যা এখনও লেখা হয়নি,
আগামীতে লেখা হবে বলে মিশে আছে রক্তস্রোতে।
তারা ভাবে যুদ্ধ জিতে গেছে, কিন্তু আমি দেখি উমর কিংবা
আয়েশার গুলিবিদ্ধ জামা এখন গাজার সবচেয়ে পবিত্র পতাকা।
তারা ভাবে ঈশ্বর আমাদের ভুলে গেছেন,
কিন্তু আমি দেখি প্রতিটি গণকবরের পাশে
একটি করে পাখি বসে থাকে—নিঃশব্দে, স্থির।
কাঁপতে কাঁপতে কী যেন বলে যায় তারা।
তুমি যাকে বলো ‘শোক’, আমি তাকে বলি ‘প্রতিবাদ’কিংবা ‘প্রতিরোধ’।
তারা ভাবে ইতিহাস তাদের হাতে, কিন্তু ইতিহাসও জল চায় —
আর তাদের হাতে তো কেবল ধ্বংস, কেবল আগুন।
আমাদের কবর তারাই খনন করে,
কিন্তু সেই মাটিই আমাদের করে তোলে অমর, অবিনশ্বর।
তারা জানে না হয়তো—আমরা কবরেই জন্মাই।
আমরা মরেও জন্মাই।
আমরা হারালেও বারবার ফিরে আসি—আমরাই ফিলিস্তিন।

চিত্রকর্ম : হাজিম বিতার
কবরে দাঁড়িয়ে কবিতা
হানান, তোমার হাত ধরা ছিল আমার কবিতায়,
আমার প্রেমের পংক্তিমালায়—
তুমি বলেছিলে: যুদ্ধ শেষ হলে চুম্বন কুড়বো আকাশ থেকে।
আমি বলেছিলাম– আকাশ থেকে কুড়নো যায় না,
কুড়নোর মাটি থাকতে হয়।
তখন তুমি কোনও কিছু না বুঝেই শুধু মুচকি হেসেছিলে।
তারপর আগুন এল, সর্বগ্রাসী আগুন।
কোনও শব্দ ছাড়াই চলে গেলে তুমি।
তোমার কণ্ঠস্বর আর পাওয়া গেল না কোথাও
শুধু কিছু গন্ধ, কিছু পুড়ে যাওয়া চিঠি
আর এক টুকরো নীল ওড়না – যা গাজার আকাশে এখনও উড়ে।
হানান, তুমি কি জানো —
তোমার গলির পাশের মসজিদটা এখন আর নেই ?
সেই দেয়াল যেখানে আমরা যোগ চিহ্ন দিয়ে
নাম লিখেছিলাম পরস্পরের —
তা এখন কেবলই ধ্বংসস্তূপ।
ধূলোয় ধুসরিত পবিত্র গ্রন্থের দিকে তাকানোরও কেউ নেই।
বুঝিনা, মানুষ না থাকলে কী হবে এই গ্রন্থ দিয়ে ?
আমার কলম এখন মরুভূমিতে পাথর খোঁজে —
হয়তো তোমার নিঃশ্বাস আটকে আছে কোনও এক নীল পাথরে।
আমি আজ শুধু লিখি না তোমার জন্য—
আমি লিখি মাতৃভূমির জন্য,
যা একদিন তোমার মতোই ছিল সুন্দর, লাজুক, আর কাঁপা কাঁপা।
হানান, জেনে রেখো তোমার মৃত্যুও এখন প্রেম হয়ে
এই কবির বুক জ্বালিয়ে রাখে, আর কবরের উপর দাঁড়িয়ে
তাকে কবিতা লিখতে বাধ্য করে।

চিত্রকর্ম : হানি খৌরি
তোমাদের নীরবতাও তাকে মেরেছে
সে বলেছিল, যুদ্ধ শুরু হোক, তবুও আমি থাকব এখানে,
মাতৃভূমি ছেড়ে যাব না কোথাও—
প্রতিদিন তোমার কফির মগ ধুয়ে রাখব ।
তোমার প্রিয় ফুলের গাছটিতে জল ছিটিয়ে দেব সকাল-সন্ধ্যা।
আমি হেসে বলেছিলাম–
এই যুদ্ধ শেষ হবে না, মগটিই থেকে যাবে তোমার স্মৃতি হয়ে-
ফুলের গাছগুলোও তাই।
সে জানত না, যুদ্ধ শুধু দেয়াল ভাঙে না — মানুষের হৃদয়ও ভাঙে।
আজ আমি ধ্বংসস্তূপে হাঁটতে হাঁটতে হাতের তালুতে রাখা
ছোট্ট কাগজে তার নাম, চোখের বর্ণ আর ওড়নার গন্ধ খুঁজি।
জানি সে নেই, তবুও আমি তার খোঁজে পাথর সরাই,
খুঁজি, কেবল খুঁজতেই থাকি –
কোনও এক খোঁজ না থাকলে মানুষ যে আর মানুষ থাকে না।
তুমি যদি দেখ, গাজার ধ্বংসস্তূপে এক টুকরো লাল সুতো
বুকে নিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাঁদছে কেউ একজন —
জেনে রেখো সে আমার প্রেম, সে আমার দেশ, সে সেই নারী—
যাকে কেবল যুদ্ধ নয়, তোমাদের নীরবতাও মেরে ফেলেছে।
♦–♦–♦♦–♦–♦♦–♦–♦
❤ Support Us