- গল্প
- মে ৩, ২০২২
হেলেনারা চিরকাল
আজরাইলের মতো হাজির হতো আমার কাছে। প্রতিবার আমাকে সে হত্যা করত। প্রতিবার আমি জন্ম নিতাম। প্রমিথিউসের মতো, কিংবা আগুন পাখির মতো। হত্যার সময় আমি বাধা দিতে পারতাম না

চিত্র: দেব সরকার
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, একদিন বলেছিলাম, আপনাকে একটি গল্প শোনাব। আমার জীবনের গল্প। আপনি সেদিনই শুনতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, আজ নয়, অন্য কোনোদিন, যখন আমরা ভ্রমণে যাব কক্সবাজার কিংবা শ্রীমঙ্গলে। কিন্তু গল্পটা আমি আজই, এখুনি, আপনাকে বলতে চাই। কারণ ভ্রমণে গিয়ে গল্পটা শুনলে এমনও হতে পারে, আমাকে রেখেই আপনি ফিরে আসবেন। কারণ এই গল্প শোনার পর, আমি নিশ্চিত, আমার সম্পর্কে আপনার ধারণা পাল্টে যাবে। আমার প্রতি কোনো প্রেম, কোনো আকর্ষণ, কোনো টান আর না-ও থাকতে পারে।
আমি তখন কিশোরী। তেরোতে পড়েছি। জীবনকে, সংসারকে, পৃথিবীকে তখনো ভালোভাবে বুঝতে শিখিনি। নারী-পুরুষের সম্পর্ককে বুঝতে শিখিনি। মনে হতো, আমাকে কেউ জন্ম দেয়নি, আমি কারো ঔরস থেকে, কারো গর্ভ থেকে জন্ম নিইনি। আমি এসেছি শিবসার স্রোতে কলার ভেলায় ভেসে। কিংবা আমার বাবা-মা আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছে আম-জাম-কাঁঠাল কি লিচু গাছের তলায়। মনে হতো, এই জীবন আনন্দের। বিপুল আনন্দের। উঠানের কোনায়, গাছের ছায়ায়, নদীর তীরে সমবয়সিদের সঙ্গে খেলাধুলায় কাটিয়ে দেওয়াই জীবন। ভাইবোনের সঙ্গে মাণ্ডা, চারগুঁটি, চক্কা খেলাটাই জীবন। মাঠে গোল্লাছুট, কানামাছি, দাঁড়িয়াবাঁধা খেলা আর পুকুরে সাঁতার কাটাটাই জীবন।
কিন্তু না, সেদিন জীবনের মানে পাল্টে দিল সুনাম। বাড়িতে কেউ ছিল না তখন। শুক্র-শনি ছাড়া বাড়িতে কেউ থাকেও না। বাবা-মা তো সপ্তাহের পাঁচ দিন অফিসেই থাকে। ছোট ভাইবোনেরা স্কুলে। সেদিন আমি স্কুলে যাইনি। শরীর খারাপ ছিল। পেট ব্যথা করছিল খুব। দুপুরের দিকে কমে এসেছিল ব্যথা। বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। আকাশ ডাকছিল ভুখা সিংহের মতো। শিলা পড়ছিল বিস্তর। শিলায় শিলায় সাদা হয়ে উঠেছিল বাড়ির উঠান। জানালার কাছে বসে বৃষ্টি দেখছিলাম। হঠাৎ টের পাই, আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। ঘাড় ঘোরাতেই দেখি সুনামকে। ভাবলাম, সেও বুঝি বৃষ্টি দেখতে এসেছে। বৃষ্টি তার খুব পছন্দ। বৃষ্টিতে সে ঘরে থাকতে পারে না। ঘুরে বেড়ায় মাঠে-ঘাটে, সাঁতরে বেড়ায় পুকুরে। বললাম, দেখ দেখ, কী সুন্দর সব শিলা। চল আমরা বাইরে গিয়ে শিল কুড়াই।
সুনাম আমার দুই কাঁধে দুই হাত রাখল, যেভাবে হাত রাখে আম পাড়তে গাছে ওঠার সময়, কানামাছি কি গোল্লাছুট খেলার সময়। তখন তার হাত দুটিকে মনে হয় তুলার মতো। অথচ এখন মনে হচ্ছে পাহাড়ের মতো। যেন লাখ লাখ টন ওজনের পাহাড় চেপে বসেছে আমার কাঁধে। সুনাম আমার কাঁধে মৃদু চাপ দিল। আমার মনে হলো এই হাত সুনামের নয়, অন্য কারো, যাকে আমি চিনি না, কোনোদিন যাকে দেখিনি, যার হাতের পরশ কখনো পাইনি।
আমি একটু সরে বসতে চাইলাম, আর তখনই সে জড়িয়ে ধরল আমাকে। শুইয়ে দিল খাটে। সেও শুয়ে পড়ল আমার পাশে। কাঁথাটা টেনে দিল গায়ে। আমি তো হতবাক। উঠে বসতে চাইলাম। সুনাম আমাকে উঠতে দেয় না, টেনে আবার শুইয়ে দেয়। আমি আবারও উঠে বসার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। কীভাবে পারব? পুরুষ তো চিরকালের আগ্রাসী, সহিংস। এ তার জিনগত বৈশিষ্ট্য। তা ছাড়া সুনাম তো তখন কেবল পুরুষ নয়, কামোন্মাদ হিংস্র পশু। কবে কোন হিংস্র পশুর কাছে হরিণীরা অপরাজেয় ছিল?
মাত্র এক মিনিট। এক মিনিটের মধ্যে সে আমার হাশর-নশর শেষ করে দিয়ে চলে গেল। আমি শুয়ে রইলাম। পঙ্গুর মতো পড়ে রইলাম। আমার হাত কাজ করছিল না, পা কাজ করছিল না, মাথা কাজ করছিল না। মনে হচ্ছিল, আমি তলিয়ে যাচ্ছি, পাতালদেশে তলিয়ে যাচ্ছি
সুনাম এবার চড়ে বসল আমার ওপর। তার হাত চলে গেলে আমার কোমরে। এক টানে খুলে ফেলল পায়জামা। আকশটা ভয়ানক শব্দে ডেকে উঠল। আমার মনে হলো, গোটা আকাশ ভেঙে পড়ছে আমার মাথায়। দ্রুত কাঁথাটা টেনে ঢেকে ফেললাম আমার মুখ। বুঝতে চেষ্টা করলাম আমার সাথে কী করতে চায় সুনাম।
আমি তাকে বলতে চাই, কী করছিস তুই? এসব কী? কী হচ্ছে আমার সাথে? কিন্তু বলতে পারি না। কেউ যেন আমার মুখটি সেলাই করে দিয়েছে। শরীরের সব শক্তি প্রয়োগ করে সুনামকে সরিয়ে উঠে বসতে চাই, পারি না। কেউ যেন আমার শরীরটি খাটের সঙ্গে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। আমি কি তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম? আমার বোধশক্তি কি তখন আমাকে ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছিল? সম্ভবত। নইলে সুনাম আমার সাথে কী করল, পরে কিছু মনে থাকল না কেন?
তারপর তো আমি আমার কাছ থেকেই হারিয়ে গেলাম। আমি আমাকে আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খেতে বসলে মনে পড়ে যেত সেই দৃশ্য। পড়তে বসলে মনে পড়ে যেত সেই দৃশ্য। খেলতে গেলে মনে পড়ে যেত সেই দৃশ্য। কোথাও মন স্থির করতে পারছিলাম না। কেবলই মনে হতো, আমি আর আগের আমিটি নেই, সুনাম আর আগের সুনামটি নেই, দুজনেই বদলে গেছি। সব কেমন উল্টেপাল্টে গেছে, সব কেমন অচেনা হয়ে গেছে। সুনামের মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। তার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইতাম। কখনো সে সামনে পড়ে গেলে কেঁচোর মতো মাটির গভীরে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করত, পাখির মতো দূর অজানায় উড়ে যেতে ইচ্ছে করত। সেদিনের সেই ঘটনা আমি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছিলাম সুনামের সঙ্গে। আর কখনো বাড়িতে একা না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
তিন দিন পর, বাবা গিয়েছিল খুলনা শহরে। রাতে ফিরল না। মা ছিল অসুস্থ। ঘুমের ওষুধ খেয়ে আটটা না বাজতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি ঘুমাচ্ছিলাম আমার রুমে। ভাইবোনেরাও গভীর ঘুমে। রাত তখন দশটা-এগারোটা হবে বুঝি। অন্ধকারে আমার সিথানে এসে দাঁড়াল সুনাম। শুয়ে পড়ল আমার পাশে। খাটে মড়মড় শব্দ হলো। সেদিনের মতো জড়িয়ে ধরল আমাকে। কী হবে, কী হতে যাচ্ছে―আমি বুঝতে পারছিলাম। চিৎকার দিতে চাইলাম। কিন্তু না, আমার কণ্ঠ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারি না। যেন আমাকে বোবায় ধরেছে। আমি তাকে জোরসে ধাক্কা মারলাম। সে ঝাপটে ধরল আমাকে, বাঘ যেভাবে ধরে হরিণকে। আমি তার কবল থেকে সেদিনও মুক্তি পেলাম না। মাত্র এক মিনিট। এক মিনিটের মধ্যে সে আমার হাশর-নশর শেষ করে দিয়ে চলে গেল। আমি শুয়ে রইলাম। পঙ্গুর মতো পড়ে রইলাম। আমার হাত কাজ করছিল না, পা কাজ করছিল না, মাথা কাজ করছিল না। মনে হচ্ছিল, আমি তলিয়ে যাচ্ছি, পাতালদেশে তলিয়ে যাচ্ছি, গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি।
তারপর সুনাম কখনো দিনে, যখন বাড়িতে আমি একা থাকতাম, কখনো রাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত―আজরাইলের মতো হাজির হতো আমার কাছে। প্রতিবার আমাকে সে হত্যা করত। প্রতিবার আমি জন্ম নিতাম। প্রমিথিউসের মতো, কিংবা আগুন পাখির মতো। হত্যার সময় আমি বাধা দিতে পারতাম না। আমার হাত-পা-চোখ-মুখ-মাথা কিছুই কাজ করত না। আমি এক জড়পদার্থে পরিণত হতাম। যেন রাস্তার ধারে বিদ্যুতের খাম্বাটির মতো, যার নড়ার কোনো ক্ষমতা নেই। যেন আমি পুকুরঘাটে পাথরটির মতো, নিরবধি কাল যে অনড়, অটল।
তবে সুনাম কখনোই এক মিনিটের বেশি থাকতে পারত না। এই উঠত তো, এই নামতো। মনে আছে, একবার শুধু দুই মিনিটের মতো ছিল। খুব ব্যথা পেয়েছিলাম সেদিন। ব্যথায় ককিয়ে ককিয়ে উঠছিলাম। সে আমার মুখে গুঁজে দিয়েছিল তার লুঙ্গি। আমি চাইলে লুঙ্গিটা সরিয়ে চিৎকার করতে পারতাম। চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি তো তখন জড়পদার্থ। আমি তো তখন রাস্তার ধারের খাম্বাটির মতো, পুকুরঘাটের পাথরটির মতো।
কখনো কখনো কথাটা মাকে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করত। মা জানুক। জেনে সুনামকে বাড়িতে থেকে বের করে দিক। কিন্তু সাহস পেতাম না। এক অজানা ভয় আমাকে আঁকড়ে ধরত। মা যদি অবিশ্বাস করে! উল্টো যদি বলে, আমিই খারাপ, আমিই সুনামকে প্রলুব্ধ করেছি। কখনো কখনো বাবাকে জানাতে ইচ্ছে করত। তা-ও সাহস পেতাম না। বাবা যদি আমাকেই ভুল বোঝে! যদি তার স্নেহ হারিয়ে ফেলি!
একবার খুব জেদ চেপেছিল মাথায়। ডরভয় ঝেড়ে ফেলে কথাটা জানাতে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবা তখন স্কুলের খাতা দেখছিল। যেই না তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, অমনি হাত-পা কাঁপতে শুরু করল। অমনি আমাকে বেঁধে ফেলল ভয়। কিচ্ছু বলতে পারলাম না বাবাকে। একটা শব্দও না।
সুনাম তো শহরের কলেজে পড়ত। মাঝেমধ্যে আমার জন্য সে চটি বই কিনে আনত শহর থেকে। আমাকে বলত, পড়। মজা পাবি। প্রথম বইটা আমি পড়েছিলাম বটে। পড়ে বুঝেছিলাম, বইতে যা যা লেখা আছে, তার অনেক কিছুই আমার সাথে করেছে সুনাম। বইটি পড়ে সত্যি বলতে আমি মজা পেয়েছিলাম। জেনেছিলাম, জীবন আনন্দের বটে। তবে আনন্দ কেবল উঠানের কোনায়, গাছের ছায়ায়, নদীর তীরে সমবয়সিদের সঙ্গে খেলাধুলায় কাটিয়ে দেওয়াই নয়। আনন্দ কেবল ভাইবোনের সঙ্গে মাণ্ডা, চারগুঁটি, চক্কা খেলাই নয়। আনন্দ কেবল মাঠে গোল্লাছুট, কানামাছি, দাঁড়িয়াবাঁধা খেলা আর পুকুরে সাঁতার কাটাটাই নয়। এর বাইরেও আনন্দ আছে, যার কথা আমি জানতাম না। কেউ কখনো আমাকে বলেনি।
কিন্তু ওই একটাই পড়েছি, আর কখনো সেসব চটির পাতা উল্টিয়েও দেখিনি। সুনাম আমাকে নতুন নতুন চটি এনে দিত। কোনোটি দশ পাতার, কোনোটি কুড়ি পাতার। আমি কখনো মলাট উল্টিয়েও দেখতাম না, তোশকের নিচে ফেলে রাখতাম। সুনাম জানত না। তাকে কিছু বুঝতে দিতাম না। সে ভাবত, আমি নিশ্চয়ই পড়েছি। একদিন সব কটি জড়ো করে চুলায় ফেলে দিলাম।
সেদিন বিকেলে সুনাম এসেছিলাম আমার কাছে। বাড়ির সবাই তখন আড্ডা দিচ্ছিল পুকুরঘাটে। আমার রুমে এসে সুনাম আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দিলাম। দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেল। ব্যথা পেল খুব। ভেবেছিলাম এবার নিশ্চয়ই তার শিক্ষা হবে। কিন্তু না, চট করে সে উঠে আবার জড়িয়ে ধরল আমাকে। বলল, কিচ্ছু হবে না, মাত্র তো এক মিনিট। বলতে বলতে আমার পায়জামা খুলে ফেলল, মুখটা চেপে ধরল। আবার হারিয়ে গেল আমার শক্তি। আবার আমি জড়পদার্থে পরিণত হলাম। এক মিনিট পর সে আমাকে ছাড়ল। প্রথমবারের মতো আমি মুখ খুললাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, অনেক হয়েছে, আজই শেষ। সাবধান, আর কখনো এরকম করতে এলে আমি মাকে বলে দেব সব।
সুনাম হে হে করে হাসে। হাসতে হাসতে বলে, পারবি না। তোর সাহস নেই। বললেও বিশ্বাস করবে না। বলবে, সুনাম কখনো এই কাজ করতেই পারে না। অসম্ভব।

চিত্র: দেব সরকার
আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা? আপনাকে কেমন উন্মনা দেখাচ্ছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনি আগের মানুষটি নেই। বদলে গেছেন, সম্পূর্ণ বদলে গেছেন। ভাবছেন, এসব কথা যদি আগে জানতেন, তবে আমাকে কখনো বলতে না, ভালোবাসি হেলেনা। তুমি মানুষ নও, পরী। পরীর দেশ তুমি কেবল আমার জন্য, কেবলই আমার জন্যই এই পৃথিবীতে এসেছ। কেন তোমার দেখা এতদিন পাইনি? আগে জানলে আমাকে একনজর দেখার জন্য আপনি এত অস্থির থাকতেন না। দিনের পর দিন এভাবে ছুটে আসতেন না এখানে। ঠিক না? আমি কি ঠিক বলছি না?
না, এজন্য আমি আপনাকে দোষ দিচ্ছি না। পৃথিবীর সব প্রেমিকেরই প্রত্যাশা থাকে তার প্রেমিকা এমন এক কুমারী, যাকে কেউ কোনোদিন ছুঁয়ে দেখেনি, যার দিকে কেউ কখনো তাকায়নি। আপনি আলাদা হবেন কেন? বিশেষ হবেন কেন? আরেকটু সময় দিন, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, যেদিন আমি রুখে দাঁড়িয়েছিলাম, সেদিনই বুঝি সুনামের সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্ক শেষ, আর বুঝি কখনো তেমন কিছু ঘটেনি।
না, ঘটেছে। আরো ঘটেছে, অনেক বার। আমি নিরুপায় ছিলাম। আমার কিচ্ছু করার ছিল না। এই পৃথিবীর একজনও মানুষ ছিল না, যার কাছে আমি সুনামের বিরুদ্ধে নালিশ করব। নালিশ তো দূরের কথা, একটা মানুষকেও খুঁজে পচ্ছিলাম না, যার কাছে গোপন কথাগুলো ব্যক্ত করব। ব্যক্ত করে নিজেকে হালকা করব। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করত আমার ছোটবোন মুন্নিকে বলি, সব জানিয়ে দিই। জানিয়ে নিজেকে কিছুটা হালকা করি।
কিন্তু পারতাম না। মনে হতো, কী লাভ তাকে জানিয়ে? তার কাছে তো আমি ধবধবে সাদা কাপড়ের একটা পুতুল, যার কোথাও এক ফোঁটা দাগ নেই। সে জানার পর সেই ধবধবে পুতুলে দাগ পড়ে যাবে। সে না চাইলেও পড়বে। চিরকাল তার কাছে আমি একটা দাগ পড়া পুতুল হয়ে থাকব। এমনও হতে পারে, মুখ ফসকে কথাটা সে কাউকে বলে দিল। তার বয়স কম। না বুঝে কাউকে বলেও তো দিতে পারে। দ্বিতীয় মুখ থেকে কথাটা চলে যাবে তৃতীয় মুখে। তৃতীয় মুখ থেকে চতুর্থ মুখে। এভাবে ছড়িয়ে পড়বে সারা পাড়ায়, সারা গ্রামে। অসম্ভব নয়। পড়তেও পারে। তখন আমার মুখ লুকানোর মতো কোনো জায়গা থাকবে না।
হ্যাঁ, আমি প্রতিরোধ করেছিলাম। আমি তখন এসএসসি পাশ করেছি। জীবনের অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি। সংসারের অনেক অজনা কিছু জেনেছি। নারী-পুরুষের সম্পর্কের জটিল সূত্রগুলো বুঝেছি। আমের মৌসুম ছিল তখন। স্কুলমাঠের মেলা থেকে আম কাটার জন্য একটা ছুরি কিনেছিলাম। লোহার ছুরি। ছোট্ট, কিন্তু ধারালো। পাথরে শান দিয়ে দিয়ে আরো ধারালো করে তুলেছিলাম। ছুরিটা রাখতাম তোশকের নিচে, যাতে ভাইবোনেরা খুঁজে না পায়। একদিন সুনাম এল আমার রুমে। আমি টের পচ্ছিলাম তার গরম নিঃশ্বাস। চট করে তোশকের নিচ থেকে ছুরিটা বের করে বললাম, সাবধান শুয়োর! এই মুহূর্ত থেকে তোর সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ। তুই আমার কেউ না। আর কখনো যদি আমার দিকে হাত বাড়াস, আমি তোর হাত কেটে ফেলব, এই ছুরি ঢুকিয়ে দেব তোর পেটে।
খুব ভয় পেয়ে গেল সুনাম। ছুরি দেখে নয়, ভয় পেয়েছিল আসলে আমার চোখ দেখে। সেদিন বুঝি আমার চোখ ডাইনির চোখের মতো হয়ে উঠেছিল। যেন আমি চোখ দিয়ে তার বিনাশ করে দিতে সক্ষম। সে বেরিয়ে গেল। চিরতরে। আর কখনো আমার রুমে ঢোকেনি। গত আট বছরে একবারও আমার মুখের দিকে তাকায়নি। আমার পথ থেকে সে সরে দাঁড়িয়েছে চিরতরে। আমিও ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি সেসব দিনের কথা। কিন্তু পারিনি। এখনো বৃষ্টি এলে আমি বিষাদজলে ডুবে যাই। এখনো আকাশ ডাকলে আমি কেঁপে উঠি। এখনো শিলাবৃষ্টি দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে যাই। এখনো ঘুমের ঘোরে কঁকিয়ে উঠি।
আপনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি জানতে চাইছেন, সুনাম কে? কী তার পরিচয়? সে এখন কোথায়? তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে কি না?
আপনার সব কটি প্রশ্নের একটাই উত্তর : একই পিতার ঔরস থেকে, একই মায়ের গর্ভ থেকে আমাদের জন্ম। সুনাম আমার ভাই।
♦–♦♦–♦♦–♦
লেখক পরিচিতি: জন্ম ১৯৮০ সালের ৮ নভেম্বর, বাংলাদেশের ফেনীর পরশুরাম উপজেলার বিলোনিয়ায়। জ্ঞানার্জন ও লেখালেখি তাঁর জীবনের প্রধান কাজ। প্রকাশিত উপন্যাস : রাজনটী, বেগানা, হীরকডানা, কালকেউটের সুখ, শেষ জাহাজের আদমেরা, মায়ামুকুট, উজানবাঁশি, মহুয়ার ঘ্রাণ। পাঠক সমাবেশ দুই খন্ডে প্রকাশ করেছে তাঁর উপন্যাস সংগ্রহ। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে রয়েছে তাঁর আরও বই। এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার, এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কারসহ ভূষিত হয়েছেন নানা সম্মাননায়। বর্তমানে তিনি বাংলা একাডেমিতে কর্মরত।
চিত্রি পরিচিতি: আলোকচিত্রি, কলমবাজ চিত্রকর দেব সরকার আরম্ভ প্রকাশনার একনিষ্ঠ সহযোগী। বারুইপুরের বাসিন্দা।
গল্পের সমস্ত চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই, কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।
❤ Support Us