শিবভোলার দেশ শিবখোলা
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
টান টান উত্তেজনায় সকলের চোখ টিভির পর্দায়, পাগলের কারবার বলে ঘটনাটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়
১
কলকাতা পোস্টাল কোডে তিন-চারটে ক্ষেপণাস্ত্র হানা হয়েছে।
মৌলালি যুবকেন্দ্রের কাচ ভেঙেছে। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস পাওয়া গেছে। অম্বেদকরের পরে এই প্রথম একজন শিডিউলড কাস্ট নেতার ভয়েস শোনা গেল, জনগণ মুগ্ধ। গড়ের মাঠের ব্যাপারটা ওবিসিরা দেখছেন। সেনাছাউনিতে ক্ষয়ক্ষতির কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি, তবে বাচ্চাদের খেলার মাঠে গোলপোস্ট কেৎরে পড়ে থাকতে অনেকেই দেখেছে।
সোনারপুরের ঘটনায় নিন্দা করার ভাষা আমার নেই। পলাশ হাগতে গেছিল (ওর নাকি কমোডে সুখ হয় না, তাই মাঝে মাঝে যায় অভিসারে), সেইসময় কাঠপোলের পাশে কালীমন্দিরের মাঠে আলোর ঝলকানি। পোলটাই কি ওদের টার্গেট ছিল? ওপারে মোল্লাপাড়া। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপরে এই ন্যক্কারজনক আঘাতের পরিকল্পনায় স্তম্ভিত বিশিষ্টজনেরা, তাছাড়া হেগে ছোঁচাতে না দেওয়াটা যুদ্ধপরাধ।
এক মুরুব্বি আমাকে বলেছিল সাহিত্যে রেফারেন্স দেখলে তাঁর গা বমি বমি করে, আমারো একই সমস্যা, স্যার, সকালবেলায় ব্রাশ করতে গেলেই টকটকে টক পেট খিঁচে গলা মুখ আলটাগরা চটচটে করে। সরমার জিভ চেটে দেখেছি, স্বাদ নেই। অপর্ণার ইচ্ছে কৈখালির দিকে যাওয়া। আমার দাদুর বাবা বেণিমাধব সাঁপুই সম্ভবত জানত না যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। পুরনো দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখেছি জনৈক ভুবনমোহিনী দেবীর কাছ থেকে তিনি বিঘের পর বিঘে জমি কিনেছেন, কড়ি ফেলে না মাগনায় তা জানার উপায় নেই। অপর্ণাকে বিষয়টা বলতেই ঝাঁঝিয়ে উঠল, “তোমার সারাদিন এইসব ভাবনা। মেয়েটা সারাক্ষণ ধিঙ্গিপনা করে বেড়াচ্ছে, ওটাকে তো একটু পড়াতে বসালে পারো।”
২
তিনটে খুন হয়ে গেল।
প্রথমটা কলকাতায়। শহীদ মিনারের মাথায় উঠে একজন চিৎকার করছিল, “খাবার চাই।” ফটফটে দিনের বেলা, সবে দশটা এগারোটা বাজে, লোকজনের ব্যস্ততায় জমজমাট পথঘাট, তখনই বিপত্তি।
পথচারীরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল, দু-একজন দাঁড়িয়ে গেল তামাশার লোভে। আজকাল শহরে প্রচুর পাগল বেড়েছে এবং পাগলদের অদ্ভূত নেশা হলো উঁচুতে চড়া, তারপর তাদেরকে নিচে নামিয়ে আনা পুলিশের কাছে চ্যালেঞ্জ। এমনকি এর জন্য বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন হয়েছে।
·লোকটাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নামানোর চেষ্টা ব্যর্থ হলো, তার একরোখা দাবি, “খাবার চাই।” হলদিরাম থেকে আনা প্যাকেটও দেখানো গেল, কিন্তু লোকটার সেদিকে খেয়াল আছে বলে মনে হয় না, ও গ্র্যান্ডের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ তুলছে। একেবারে বদ্ধ পাগল। অগত্যা দমকল ভরসা। উপরে খাবার পাঠানো হবে কিনা সে বিষয়ে কোনো নীতিগত সিদ্ধান্তে আসা গেল না, খিদে পেলে লোকে খাবার চাইতেই পারে, কিন্তু তার একটা পদ্ধতি আছে, হুজ্জতিকে প্রশ্রয় দিলে পরের দিন আরো একজন যে কোনো টাওয়ারে উঠে একইরকম দাবি করবে। পুলিশকে তাহলে আইনরক্ষার কাজ ছেড়ে ডেলিভারি বয়ের ভূমিকা পালন করতে হয়। দমকলের দুজন ভেতরের সিঁড়ি বেয়ে উন্মাদটার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছিল, টের পেয়েই লোকটা ঘোষণা করল তার পায়ের কাছে রাখা ব্যাগে বোমা আছে, বেশি চালাকি করার চেষ্টা করলে সে নিজেকে সহ মনুমেন্ট উড়িয়ে দেবে। ব্যাপারটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। প্রশাসনের কপালে ভাঁজ, লাইভ টেলিকাস্ট শুরু হয়ে গেছে, স্কুল কলেজ অফিস কাছারি দোকানপাট সব স্তব্ধ।
চিত্র: চিত্তরঞ্জন কুণ্ডু
টান টান উত্তেজনায় সকলের চোখ টিভির পর্দায়, পাগলের কারবার বলে ঘটনাটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, বিশেষত সাঁপুই পাড়ার ওদিকে চিনা আগ্রাসন হয়েছে বলে খবর। এটা বিদেশি চক্রান্ত নয় তো? মিলিটারি পৌঁছে গেছে, দিল্লিতে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে এএসআই অফিসারদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির হলো গুলি চালানোই যুক্তিযুক্ত, তাতে স্থাপত্যের যা ক্ষতি হবে তা মেরামত-যোগ্য। শেষ পর্যন্ত খচ্চরটা “খাবার চাই”, “খাবার চাই” বলে ঝামেলা পাকালো, তবে শেষ দৃশ্যটা মানবিকতার খাতিরে সম্প্রচারিত হয়নি।
দ্বিতীয় সিন চারমিনারে। লোকটার দাবি, “বলতে চাই”। অদ্ভুত ব্যাপার, তোমার বলা কে আটকাচ্ছে ভাই? দেশে জনদরদি সরকার আছে, আইন-আদালত আছে, সর্বোপরি মাথার ওপর সংবিধান আছে। তবে এবারের নৌটঙ্কি বেশি জমেনি, টিআরপি বাড়বে না বুঝে কোনো ন্যাশনাল চ্যানেল লাইভে আগ্রহ দেখায়নি।
তবে টনক নড়ে গেল লালকেল্লার ঘটনায়, নিরাপত্তার বেড়াজাল ডিঙিয়ে লোকটা যে কীভাবে ঢুকল সেটাই বিস্ময়ের। বিরোধী দল জাতীয় সুরক্ষার ফাঁকফোকর নিয়ে সরকার পক্ষকে চেপে ধরেছে।
লালকেল্লা আমাদের জাতীয় ভাবাবেগ, সেখানে দাঁড়িয়ে কিনা বিদেশি চক্রী বলতে পারে, “বাঁচতে চাই।” সারা পৃথিবীর কাছে মাথা হেঁট হয়ে গেল, সারাদিন ধরে এই নিয়েই কথা চালাচালি চলছে। দেশজুড়ে গুঞ্জন। কিছু আঁতেল বলতে চেয়েছিল ওদের দাবি ন্যায্য, জনগণ এইসব কীটস্য কীটকে ঘৃণার চোখে দেখছে। সরকার ও বিরোধী দল একমত যে এই দালালদের ইউএপিএতে আটক করা দেশের স্বার্থে জরুরি।
খুনের সংখ্যা বাড়ছে রোজ, কাল শুধু নাগাল্যান্ডেই চল্লিশজনকে মারতে হলো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লাশগুলো বেমালুম গায়েব হয়ে যাচ্ছিল, পোস্টমর্টেম করার সুযোগ হয়নি। ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ উদ্বিগ্ন।
৩
সোনারপুর জায়গাটা ছিমছাম। সাঁপুই পাড়ার দিকে এখনো বাঁশবন আছে, তবে সেখানে শেয়াল নেই। রাতে বাড়ির আনাচে-কানাচে ভামবেড়ালের বোঁটকা গন্ধ পাওয়া যায়।
এমন অখ্যাত জায়গায় হুহু করে মিলিটারি ট্রাক ঢুকতে দেখে ছেলে বুড়ো সবাই আশ্চর্য। জেসিপি দেখেছি, লোকাল পার্টি-নেতাদের দামি গাড়ি, তা বলে চিনা আর্মি? হচ্ছেটা কি? ওরা কি গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার পরিকল্পনা করছে? পোদ বাগদিদের দেশে চাইনিজ ভেঁপু’র পর মিসাইলবাজি বাড়াবাড়ি।
গোপু উঠতি রাজনীতিওয়ালা।বলে গেল, “ ভয় নেই কাকু, সেনা এসে গেছে।”
সব মিলিটারি ট্রাকেরই মুখভোঁতা, সবুজ রঙের, কোনটা আমাদের আর কোনটা ওদের বোঝা দায়।
গোপুর জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে দেখা বাজারে। উনি পৈতেতে হাত দিয়ে ভূত ভবিষ্যৎ সবকিছু বুঝতে পারেন। কইমাছের দর করতে করতে বললেন, “জানতাম আসবে। ৬৫তে নেহরু অনেক কান্নাকাটি করে অরুণাচল বাঁচিয়েছে, ওদের পড়তায় পোষায়নি। জিন পিং অনেক ঘোড়েল, সহজে ছাড়বে না।”
কৌতূহল দমাতে পারলাম না, “কিন্তু এল কোত্থেকে, বঙ্গোপসাগর কি অলরেডি ওদের দখলে?”
উনি জানালেন, “এসব চিনা কায়দা বাপু, মাটি ফুঁড়ে বেরোতে পারে। ওদের ট্যাঙ্কেরও হাত পা ও ডানা আছে।”
খানিকটা স্বস্তি পাওয়া গেল, গত শীতে কৈখালি গিয়ে পুরনো নৌকোর দরদাম করে এসেছি। ওখান থেকে বাংলাদেশ তিন–চার ঘন্টা। আবহাওয়া বেগতিক বুঝলেই কেটে পড়ব। বাঁটুল মাঝির পাকা হাত, মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে আশ্বাস দিয়েছে।
আমি ছাপোষা মানুষ, দেশের জন্য জীবন দেবার গোঁয়ার্তুমি আমার সাজে না। তাছাড়া চাইনিজ ফৌজিরা শুনেছি খুব ক্যালায়, আর রক্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় মাইক্রোচিপ, মাথা থেকে পা মায় ফুসফুস হৃদপিণ্ড যৌনাঙ্গ সবই সুপার কম্পিউটারের আন্ডারে, খ্যাচ খ্যাচ ফটো উঠবে দিনরাত।
৫০-এ নিরাপত্তা পরিষদে ওদের অন্তর্ভুক্তিকে আমরা সমর্থন জুগিয়েছি, তাও এমন খচরামি? সম্ভবত ওরা ভারতীয় সাবকন্টিনেন্টের আবহাওয়া বিশ্লেষণ করে বুঝেছে এখানে আরশোলার খামার তৈরির বিপুল সম্ভাবনার কথা।
৪
লাশ হয়ে যাওয়ার সুবিধা অনেক। লাশেরা ঘুরছে ফিরছে, স্লোগান দিচ্ছে, জ্যান্ত মানুষদের দিকে তাকিয়ে খ্যা খ্যা করে হাসছে, ঘোঁট পাকাচ্ছে। লাশেদের ভিড়ে রাস্তায় হাঁটা দায়, ওদের বাজারে যেতে হয় না, দশটা-পাঁচটার অফিস নেই, ইটভাটা কয়লাখনিতে ঘাম ঝরাতে হয় না, অথচ মৃত্যুভয় ছাড়াই দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে, সারাদিন চরকিবাজি আর গণ্ডগোল পাকানো ছাড়া কোনো কাজ নেই।
জেলে মাঝিদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে নদীতেও নাকি লাশ ভাসছে, জলের ভেতর সে কি হুটোপুটি, লাশ হয়ে বেঁচে থাকার মজাই আলাদা।
সেদিন সতীশ সামন্তর বড়ো ছেলে স্কুটার নিয়ে বেরিয়েছিল। রাস্তায় পেট্রোল কমে গেলে পাম্পে যায় তেল ভরতে। দাম শুনেই চক্ষু চড়কগাছ, গাড়ি রেখে সে সটান পেট্রোল পাম্প-এর মাথায় চেপে বসে, সঙ্গে “তেল চাই” স্লোগান। এত বোমার মশলা কীভাবে আসছে কে জানে, প্রত্যেকের ব্যাগে ব্যাগে ঘুরছে ফর্মুলা। পুলিশ আজকাল ব্যাগ ঘাঁটাঘাঁটির ঝুঁকি নেয় না, আচমকা বিস্ফোরণ এড়িয়ে যেতে চায় সবাই। যাই হোক, ব্যাপারটা কী ভয়ংকর ভাবুন, পেট্রোল পাম্পে বোমা ফাটলে কি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত!
ইন্টারনেট বন্ধ, যে কোনো ধরনের গুজব তৈরি ও ছড়ানো নিষিদ্ধ এখন। ব্যাঙ্কের সামনে বিশাল লাইন, ম্যানুয়ালি পরিষেবা চালু রাখা গেছে সেটাই পাবলিকের ভাগ্য। টাকা তোলার সীমা নির্ধারিত হয়ে গেছে শুনে অম্বরীশ রায়ের মাথা খারাপ হয়ে গেল, তার তিল তিল করে জমানো টাকা, তাতেও হারামির বাচ্চাদের খবরদারি! ভদ্রলোক লাশ হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, রোদের ইয়ার্কি মাত্রাতিরিক্ত হলে যা হয় আর কি।
সমস্ত বড়ো বড়ো টাওয়ার মুড়েছে কাঁটাতারে, গুলি কেনার খরচ সামলাতে সেস বসেছে পেট্রোপণ্যে। রাষ্ট্রপুঞ্জে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে লাশের রাজনীতি বন্ধ না করলে দেখে নেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনের ব্যথা অনুষ্ঠানে দেশবাসীকে মনের জানালা খুলে দিতে বলেছেন, এই দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়াটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা, পশ্চিমা বাতাস বইবে অচিরেই।
৫
বাঁধাছাঁদা সম্পূর্ণ, ওটা অপর্ণার এলাকা। ওকে বলেছি লোটাকম্বলের ভার কম হলেই ভাসতে সুবিধা। ও নাছোড়বান্দা, মুড়ির কৌটোটা অনেক খুঁজেপেতে কিনেছে, নিতেই হবে। তাছাড়া হামানদিস্তাও রাখতে হলো, বিদেশ বিভুঁইয়ে মশলা বাটবে কীভাবে? নুনের কৌটো, কাঁসার থালা প্রত্যাখ্যান করেছি দৃঢ়চিত্তে, যেমনভাবে অস্বীকার করি দেশের জন্য বলিকাঠে পাঁঠা হতে।
খবরে প্রকাশ, হানাদার ঠেকাতে বর্ডার সীল করা হয়েছে।
♦–♦♦–♦♦–♦
গল্পের সমস্ত চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই, কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।
মিরিক নামটি এসেছে লেপচা ভাষার “মির-ইওক” শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পুড়ে যাওয়া জায়গা।
15:34