- গল্প
- মে ৩, ২০২২
লাজুলি
ভাই-বোনে শরীর খেললে ভাই পাখি হয়ে যায়। নীল পাখি। রাতের বেলা একলা ডালে এসে বসে। একলা বসে বোনকে দেখে যেতে হয় পুরো একটা জীবন।

চিত্র: সঙ্কুল দাস
অনেক সবুজ পাতার গাছ। একটা পাখি। সূর্য লাল হতে চাওয়া রং হয়ে ফুটে উঠছে একলা।
একটা নীল হতে পারত পাখি। ভোরের আকাশ নীলে ভাসছে। শিশু জাগছে।
পাখি। আকাশ। এখানে সূর্যের রং অড়হরের মতো অনেকটাই।
আকাশপাখি। ফ্যাকসা হলুদ সূর্যের চারপাশ জুড়ে।
আকাশ। হলুদ ভুলে লাল হচ্ছে সূর্য।
আকাশ। একলা। লাল সূর্য।
একলা। সূর্য।
একা।
একলা থেকে একা হয়ে ওঠা অবধি পথ দিনের বেলা বা ছানি পড়তে থাকা এই বিকাল আলোয় যাওয়া গেলেও যেতে পারে। পাকদণ্ডীটি অবশ্যই কঠিন। অনেক অনেক দিন আগের সমুদ্রের স্মৃতি নিয়ে লতপত করা সবুজ ফার্নের বন নিজেদের সধ্যমতো পথ আটকাতে চায়। সবুজ হয়ে মাটির নিচে গিয়ে ভিজা শুঁটকির গন্ধ নিয়ে মাটির উপরে ফিরে আসা গুয়াকে হাজারবার জল দিয়ে ধোয়ার পরেও যে মাটি গুয়ার গা হয়ে থাকে সেই গন্ধের রং নিয়ে এখানের সবচেয়ে বুড়া হাতিটার চেয়েও বেশি বয়সি ওদাল গাছগুলির শিকড়-বাকড় পথের রেখাটুকু গিলে ফেলতে চায় বারবার। তবু রেখা বেয়ে বারবার নেমে এসেছে মানুষ। দল বাঁধা অনেক মানুষ। নেমে এসেছে হাতি , দল বেঁধে। দল বেঁধে উঠে গেছে হাতি। নেমেছে আবার, আবার উঠেছে। মানুষ দল বেঁধে উঠেনি আর। এইসবই হয়ে চলেছে। কত্তদিন ধরে! কত বছর ধরে! সেই হিসাব ওদালদেরও অজানা। অনেক অনেকের ভিতর কতজন একা মিশে আছে সেই হিসাব বরং ভালো জানে হাতির দল। তারা শরীরে বয়ে চলা ইতিহাস দিয়েই জানে অনেক থেকে একা হয়ে ওঠার পাকদণ্ডী একা হয়ে আসা কাউকে খুন বা মৃত্যুর কাছে টেনে আনে। একা হাতির দেখা মিললে এই পাকদণ্ডী তাই আরো বিপজ্জনক। একা মরতে আসা হাতিও খুন করতে পারে একা আসা কোনো মানুষকে। দিনের বেলায় তাই অনেকে মিলেই এই পথে আসে। এটাই দস্তুর। রাতে একটা বেঁচে থাকা মানুষকেও এই রেখা বরাবর দেখেনি অন্য কোনো বেঁচে থাকা মানুষ। পরদিন হাতি, হরিণ, চিতুয়ার পায়ের ছাপের পাশে মানুষের পায়ের মতো ছাপ দেখলে ভয় লাগে খুব জীবিত মানুষের। সে তখন শিব, কালী, বুদ্ধ সবার মন্ত্র ভুলে যায়। সব মন্ত্র ভুলে গিয়ে ছোটোবেলায় তার দিদিমার শিখিয়ে দেওয়া গাছপাতালির মন্ত্র বলতে বলতে এগোতে থাকে। একবার বাঁয়ে থুক ফেলে, থুক ফেলে একবার ডাইনে। কিন্তু শুরুর অনেক থেকে শেষের একা হয়ে ওঠার পথটুকু আসতে গেলে রাতের প্রয়োজন। সে জানে। আরো জানে যে একা একটা ডাল হতে গেলেও রাত লাগে। রাতটা নীল পাখি হয়ে থাকে একাই। একটু ভুল হলো বলে মনে হয় তার। সে জানে একটা নীল পাখি রাত হয়ে একলা একটা ডালের উপর এসে বসে। একা হয়ে। এই একা হওয়ার আগে অনেকজনের দাপট লাগে। মোচড় দেয় শরীরগুলা। ছিটকে বেরিয়ে আসতে চায় কতজনের জান। গলার ভিতরের ধুকপুকে গোলাপজামের তখন দাঁত পেতে ইচ্ছে করছে। চেনা দাঁত। অনেকদিনের চেনা দাঁত। দাঁত না গজানো মাড়িটাকেও সে চেনে সেই কতকাল! আঙুল পুরে দিচ্ছে মুখে। লালা মেখে বেরিয়ে আসছে আঙুল। আঙুল পুরে নিচ্ছে মুখে। লালা মেখে বেরিয়ে আসছে আঙুল। ভয় পেলে এখনো সে নিজের মাঝলা আঙুলটি নিজের মুখে ঢুকিয়ে চুষতে থাকে। কেউ তখন দেখে না তাকে। কেউ একটা থেকে সে তখন একা হয়ে ওঠে। আর চারপাশ জুড়ে নামতে থাকে রাত। একটা রাত নীল পাখির মতো একলা হয়ে একটা ডালের উপর এসে বসে। এক এবং এক এবং এক এবং এক এবং এক। একা। একটা নীল পাখি।
ঠোঁট , জিভ আর দাঁত দিয়ে শূয়োরের মতো ঘোঁতানি বের করছিল সে। চারটা গোলাপি সাদা শূয়োরের বাচ্চা সেই ঘোঁতানিকে সাগাই-ডাক ভাবল। নিজের প্রজাতিকে বড়ো একটা ভয় পায় না মানুষ ছাড়া আর কেউই। তাই নিজ রক্তের কেউ এসেছে মনে করে পঞ্চাশ বছরের উপর ফেলে যাওয়া কিছু মানুষের ঘরবাড়ি ছেড়ে তারা পা বাড়ায়। বেশ কিছু ওদাল জন্মেছে এই পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় জুড়ে। ছানাগুলো পা বাড়ায় তুরতুরে এক মৃত্যুর দিকে। এখানে সূর্যের রং অড়হরের মতো অনেকটাই। আকাশে পাখির ঝাঁক। এই ঘরবাড়িতে যারা থাকত তারা থাকলে শূয়োর ছানাগুলি কি আজ এইভাবে মরার দিকে এগুতে পারত? মাথায় ঝাঁস মেরে প্রশ্নটা এসেছিল তার। নোলার চোটে প্রশ্নটা একটা সুবিধাজনক সিধান্ত হয়ে খানিক বাদে মিলিয়ে যায়। শালা হারামিগুলারে বাষট্টির পর এখান থেকে খ্যাদায়ে ভালো করেছিল লোকজন। ছাপান্ন বছর পর খেদিয়ে দেওয়া চিনাদের বাড়িগুলায় চরতে আসা কোনো বাড়ির শূয়োরের পিল্লারা তার ঘোঁতানিকে সাগাই-ডাক ভেবে এগিয়ে আসে। তাদের চোখে নিজ কাউকে দেখতে পাওয়ার আকুলপনা। চারটি একটু থমকায় তাকে দেখে। তারপর চার-এক। তিন-এক- এক। এক-তিন-এক। দুই-দুই-এক। দুই-এক-এক-এক-এক। দুই-এক-এক। দুই–। দুই। একের হাতে দুই। শূয়োর ধরতে মানুষের দৌড় কেমন দেখায়, তা শূয়োরের পিছনে সরপট দেওয়া মানুষ জানতে পারে না কোনোদিন। সে এখন চাষের মতো স্বাভাবিক। বাড়িতে বোনা জারুল গাছের ডালে প্রতি বছর গরমের সময়ে আসা হলুদ রঙের অর্কিডের মতো সুন্দর। শূয়োরদুটোর গা তার দেড় বছরের ভাগ্নাটার মতোই নরম। পিছিল ও ল্যাগব্যাগা। ঘোঁতঘোঁতানি এখন আকুতি হয়ে গেছে। বোন তার এই চোর স্বভাব পছন্দ করে না। তার বোন শূয়োর খেতে পছন্দ করে খুব। বোনকে সে ভালোবাসে খুব। একটার ঠ্যাঙে রশি বেঁধে ওদালের গায়ে বেঁধে অপরটাকে বড়ো যত্ন করে কাছে টেনে নেয়। মাথায় হাত বুলায়। নাকের ফুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখেও চোখ রাখে। আঁও শব্দ করে নিজের মাংস ছেড়ার দাঁত দেখায় হাতে ধরে থাকা এখনো শ্বাস নিয়ে চলা মোটের ওপর দুই থেকে খুব জোর পৌনে তিন কেজি হতে পারে পরিমাণ মাংসকে। ধরা না পড়া বাকি দুটো চিৎকার করছে না একদম। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার হাতে ধরে থাকা ছানাটিও এখন শান্ত। সবচেয়ে চিল্লানি জুড়েছে ঠ্যাঙে রশিটা। হাতে ধরে থাকা শূয়োরটাকে ছেড়ে দেয় সে। চিল চিৎকারে তা ছুটে যায় বাকি দুটোর কাছে। ঠ্যাঙে রশি আরো চিল্লায়। রশি না বাঁধা তিন ঠ্যাঙ দিয়ে যেন পুরা ওদাল গাছটাকেই উপড়ে ফেলতে চায়। গজালে এফোঁড়-ওফোঁড় হয় শিশুর গলা। ফিনকি দিয়ে ওদালের গুঁড়ি ভিজে ওঠে খানিক। তারপর ফোঁটা ফোঁটা দিয়ে মাটির ভেজার পালা। রক্তের টানেই রক্ত আসতে থাকে। গরম ভাপে মাটি জাগে। চিৎকার নিবে আসে। খোলা থাকা তিনটা ঠ্যাঙ জোর ঝটকিয়ে থম মেরে যায়। ওদাল অনড়। সে দূরে আসে। বাকি তিনটা ছানা কাছে আসে খানিক পর। মাটি শুঁকে। বাতাসে বাস পায় কীসের যেন। রক্ত ও মাটির মেলামেশা খেয়াল করছে তাদের চোখ। বুঝতে চাইছে গরম হয়ে ওঠা মাটির সাথে তাদের ঠান্ডা হয়ে যাওয়া সঙ্গীর সম্পর্ক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুটোর গর্দানে নেমে আসে প্রিয় মানুষদের প্রিয় খাবার খাওয়াতে চাওয়া ভালোবাসার হাত। আজ বাড়িতে বোন আর বোনের বরকে ডাকবে। বোন রাঁধবে। ভাগ্নার সাথে খেলবে। সে এখন চাষের মতো স্বাভাবিক। বাড়িতে বোনা জারুল গাছের ডালে প্রতি বছর গরমের সময়ে আসা হলুদ রঙের অর্কিডের মত সুন্দর।
ওদাল গাছের নিচের বোনকে মনে করতে চায়। ভারী বুক নিয়ে বারবার বোনের সামনে এসে দাঁড়ায় মা। মা’কে দেখে স্রোত জাগছে তার। তার পাখি হওয়া খুব দরকার। মায়ের আড়াল থেকে উঁকি মারছে বোন। দুলতে থাকা মায়ের বুকে চোখ যায় তার বারবার। কার টানে তার হাত ভিজে ওঠে সে আর আলাদা করতে পারে না। কাগজ দেখানোর সময় আসার আগে রোজ এমন করতে হবে।
“ এওডা কাগজ খোঁজনুই পড়ছ”— পদম দাজুর এই কথাই যথেষ্ট ছিল তার সমস্ত খোঁজ বন্ধ করার জন্য। সে জেনেছে তাকে খুঁজে বার করতে হবে সেই কাগজ যা দেখাবে যে সে এই মাটির। জানার পর চুপচাপ বাড়ি চলে আসে সে। বাড়ির বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে খানিক বাগবকরি খেলে। নিজের কাছে নিজেই কোয়াশের জরার দম খাওয়ার বায়না করে। নুন জলে চোবানো ডল্লের পিচ্চি এক টুকরা রুটিতে লাগিয়ে জরার দমের কমলাটে ঝোলে মিশাচ্ছে। ডল্লেতে কতকালের অভ্যস্ত জিভ , তবু চোখে জল এল। নিজেকে পাইলসের ভয় দেখালো সেই জল দেখে। তার বোনেরও পাইলস আছে। বাপেরও ছিল। মায়েরও খানিক কষ্ট হতো কি? পাইলসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবতে গিয়ে সে কাগজ খুঁজে পাওয়ার বিষয়টা নিয়েই আগ্রহ হারিয়ে ফেলল আজকের মতো। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। ডল্লের ঝাল অনেক দিন পর এমন পিছন চিরতে চিরতে নামছে। তার কাগজ খোঁজার কথা মনে আসে আবার । খুঁজতে গেলে কিছু তো থাকা চায়। জমি, লেখাপড়া হাসপাতালে জন্মানো বা হাসপাতালে মরা কিছু তো একটা থাকতে হবে। যার কিছুই নাই সে কী খুঁজবে ভেবে তার ভারি আজব লাগে। সে আরো আজব হয়ে দেখে যে যারা কেউ এই মাটির নয় তারা কী মরিয়া হয়ে খুঁজে চলেছে। মাটির উপর খুঁজে না পেলে এরা যেন মাটির তল থেকে খুঁড়ে আনবে কাগজ। “এই কাগজ না থাকলে জেলে ঢুকাবে আমাদের”, ভয় পাওয়া গলায় নিয়েই বলেছিল তারই চেনা এক বংগালি। প্রতি রবিবারের হাটেই দেখা হয়। এক প্লেট মোমো খাওয়ার পর তখন বারোটা পিঁয়াজু মুখে চালান করছিল সে। “নেপালেও খ্যাদায় দিতে পারে”, পরের হাটে ভয় কমে একটু চিকন হয়েছে সেই গলা। সেদিন এক প্লেট মোমোর পর এগারো নম্বর পিঁয়াজুটা মুখে ফেলেছিল সে। “ কাগজ বাইর কইর্যা ফ্যালাইসি। তোর কী খবর?”, পরের রবিবার বংগালির গলায় জোর। এক প্লেট মোমো খাওয়ার পর তার তখন পনেরো নম্বর পিঁয়াজু চলছে। “হ্যাঁ রে তোরা কি ভেগে থাকা ভূপালি?”, এই কথা শোনার পর জেলটেলকেও আর ভয় লাগে না তেমন জোরালো ভাবে। বরং পেট জুড়ে মোমোর পর অতটা পিঁয়াজুর অস্বস্তিটা ছড়িয়ে পড়েছে। ফ্যাকসা হলুদ সূর্যের চারপাশ জুড়ে। ভুটভাট শব্দে পেট জেগে উঠেছে। খুব চাপ। জোর আওয়াজে পেদে দেয়। পেদে একটু সুস্থ বোধ হয়। নাক কুঁচকে সরে যায় তার চেনা বংগালিখান। জেলে ঢুকাবার ভয় খানিকটা ফিরেও আসে তার। তারপর আবার একটা পিঁয়াজু মুখে চালান করে। অস্বস্তি লাগে। জেলের ভয় দূর হয়। ফের পেটে চাপ পড়ে। পাদ উসখুসায়। পাদ বেরিয়ে গেলে জেলের ভয় ফিরে আসে। ফের ভয় কাটে, আবার ফিরেও আসে।
তবে জবর ভয় এল খানিক দিন বাদ। ভাটিয়াগুলান ছাড়াও রাজবংশী, মদেশীয়, গোর্খা, টোটো, রাভা সকলেই নিজ নিজ কাগজ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দিনের কাজ সেরে সবাই তাড়া তাড়া কাগজ নিয়ে আসে। লেডের সাদাটে আলো, বাল্বের হলদেটে আলো, হ্যারিকেন, মোমবাতি, কুপ্পি সবের কাঁপা কাঁপা আলোয় সন্ধ্যা থেকে লোকগুলান ব্যস্ত হয়ে পড়ে একাত্তরের আগের এক যে কোনো সময়কে খুঁজে পেতে। এক মজাদার খেলা। ভয় পেতে পেতে খেলা চলে। আজ হারাধন বিশ্বাস নিজের জমির পঁয়ষট্টির আগের পর্চা পেলে একশোতে একশো পঞ্চাশ, না পেলে একশোতে পাঁচশো। সুলাই বিশ্বকর্মার বাপের ক্লাস এইট পাশের কাগজ আজ না বেরুলে একশোতে একশো দশ, আর বেরুলে একশোতে হাজার—- মাদুর পেতে জুয়া চলে। কাগজ খুঁজে চলা মানুষগুলা ফুরসত মতো টাকা লাগায়। টাকা জিতলে মদ খায়। সবচেয়ে দরকারি কাগজগুলোর ছবি তুলে নিয়ে সাগাই-কুটুমদের হোয়াটস্যাপ করে দেয়। যারা নিজেরা পারে না তাদের হয়ে অন্যরা করে দেয়। যত্ন করে সব কাগজ গুছায়ে ফেলে বাড়ি ফেরার আগে। কোনো সন্ধ্যায় নিজদের বাপ-ঠাকুর্দার নামে জিন্দাবাদ ওঠে। বিকালের মুখে ঝিলুক অসুর “ জয় বাবা মহাকাল!” হাঁক দেয়। পাঙাস মাছ কিনতে এসেছে সে। হাঁক শুনে চমকায়। শেষ আলোয় মাছের চোখ স্থির এক নেশা হয়ে আছে। “ যা রগড় হয়েছে না ল্যাওড়া!”, বঁটিতে পাঙাসকে ফালি করতে করতে বলে চলে মাছওয়ালা। দিনে ধরা পাঙাসের রক্ত এখন কালচে লাল হয়ে গড়াচ্ছে। হলুদ ভুলে লাল হচ্ছে সূর্য। বটি দিয়ে শরীর চিরতে চিরতে মাছওয়ালা রগুড়ে ভাবে বলতে থাকে, “ শালা এনার্ছির ভয়ে অসুরদার বিচি যখন শুকায়ে গুয়া হয়ে গেছে অসুরদার মা সাক্ষাৎ মা দুর্গার মতো বাঁচায়ে দিল। নিজের লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে বের করল সত্তর সালে ফরেস্টের দেওয়া সার্টিফিকেট। ওটায় লেখা আছে নাকি লেড়ু অসুর এই ফরেস্টরই আদি বাসিন্দা। হাতি তাকে শুঁড়ে প্যাচায়ে পা দিয়ে থেঁতলে দেওয়ার জন্য তাই ফ্যামিলি টাকা পাবে”। কোনো সন্ধ্যায় নিজেদের মরে যাওয়া বাপ-ঠাকুর্দাকে সামনে পেলে গাঁড়ে বাঁশ ঢোকাবার শপথ নেওয়া হয়; লেড়ু অসুরের মতো পরিবারকে বাঁচিয়ে দেওয়ার কাজ না করতে পারায়। রোজকার এই জিন্দাবাদ আর গাঁড়ে বাঁশ দেব খেলা দেখতে দেখতে সে বোঝে তার এই খেলায় জেতা দূরে থাক, হারারও অধিকার নাই। তাকে অন্য খেলা খেলতে হবে।
“দাই! তাপাইলায় পাহাড়কো পোখরি ইয়াদ ছ?” “ মোটো ওদাল রুখ কো কুড়া?” “ আমালে হামিলাই কিনা রিসাউনু দিয়ে ভয়ে ন?” “ দাই! আমাকো ভন্নু ভয়েকো কাহানি ইয়াদ ছ?” “লিম্বু বাহে অরু কোই কেস্তৈ ছ?” “ কে ভয়ো! তপাই কিনা কেহি কেন্নুহুন্ন!”… শূয়োরের খুট্টা রাঁধতে রাঁধতে ঝ্যাঁঝ্যাঁয় তার বোন। বোনের চোখে রক্সি ঠিক সন্ধ্যা হওয়ার আগের লাল নিয়ে আসছে যেন আকাশ থেকে টেনে। এই অবস্থায় টানা প্রশ্ন করে গেলে এবং কোনো উত্তর না পেলে ঝেঁঝিয়ে ওঠা স্বাভাবিক। তেমনই স্বাভাবিক মায়ের চিৎকারে তার ভাগ্নার কেঁদে ওঠা। যেমন স্বাভাবিক তার চুপ থাকা। রক্সির গ্লাস হাতে বসে আছে। প্লেটে আধ খাওয়া পাঙাস টুকরো। বোনের বরের আসতে আরো এক ঘন্টা। আকাশে একলা লাল সূর্য। সে মোবাইল ফোন ঘাঁটছে। ছবি দেখছে। ছবি কাটছে। আবার ছবি দেখছে। অবশ্য বিকালে মাছ কিনতে গিয়ে অসুরের গল্প শোনা, দুপুরে শূয়োর চুরি এইসবের আগে শেষ চেষ্টা হিসেবে ইস্কুলে গিয়েছিল সে। এই ইস্কুলে সে আসে নাই কোনোদিন। তবু গিয়েছিল। যেসব বংগালি, বাহে , সাদ্রীদের কিছুই নাই পাঁচশো টাকা নিয়ে নাকি সার্টিফিকেট দিচ্ছে মাস্টার। “কোনোদিন পড়েছিলা এই ইস্কুলে?” ছাদের দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা চালায় সে। “ সকাল সকাল নেশা করে ইস্কুলে চলে এসেছে। কী রে, বাজারে কি মাইকিং হয়েছে ইস্কুল থেকে এন আর সি’র হাত থেকে বাঁচার কাগজ দিচ্ছে!” জানলার দিকে তাকিয়ে যে তাকে ইস্কুলে আসতে বলেছিল তার মুখ মনে করার চেষ্টা চালাতে থাকে সে। দশ মিনিট চুপচাপ দাঁড়ায়ে থেকে সে বোঝে এখান থেকে কিছু পাবে না। বেরিয়ে আসে। পিছনে পড়ে থাকে মাস্টারের গলা, “ শালা বাংলাকেই ভাগ করতে চায়, আর বাঙালির কাছেই দু-নম্বরি সাহায্য চাইতে এসেছে! সব্বাইকে দেব, খালি একটা নেপালিকেও না। এন আর সি করে গোর্খাল্যান্ডের শখ মিটিয়ে দেওয়া দরকার।” ইস্কুল থেকে খানিক দূরে বাষট্টির যুদ্ধের পর খেদিয়ে দেওয়া চিনাদের ফেলে যাওয়া বাড়িগুলোর দিকে এগুতে থাকে সে।

চিত্র: সঙ্কুল দাস
ছয় গ্লাস রক্সির পর মানুষ সহজ হয়ে ওঠে। তার মাথায় গাছ, পাখি, হাতি, পুখরি ইত্যাদিদের দেশ নিয়ে সহজ প্রশ্নগুলি ঘুরপাক খেতে থাকে। প্রশ্নগুলিকে খুবই জটিল দার্শনিক সমস্যা বলে মনে হতে থাকে তার। বাঙালি হাতি আর নেপালি হাতির পার্থক্য কী? ভারত থেকে যখন হাতি ভুটানে ঢোকে তখন ওই হাতি ভারতের না ভুটানের? আবার যখন হাতি নামে তখন কি ভুটানি হাতি ইন্ডিয়ান হাতি হয়ে যায়? নেশা চড়লেও সে জানে এইসব প্রশ্ন বোন কিংবা বোনের বরকে করা যাবে না। তাই সে চুপ করে রক্সি খেয়ে চলে। পাখিদেরই এত ঝামেলা নাই। কিন্ত পাখি হতে ঝামেলা খুব। ছোটোবেলায় তাও সহজ ছিল। এখন সে বোনকে বলতেই পারবে না। বোন রাজিও হবে না। আচ্ছা মা যদি সেদিন পাহাড়ের গায়ের পুখরিটার কাছে না যেত? মোটা ওদাল গাছটার নিচে তাদের দেখতে না পেত? দেখতে যখন পেলই মা বকা দেয়নি কেন? গল্পটা মা না বললে এতদিনে সে কি আর সে থাকত? যারা লিম্বু না তাদের কী হয়? বোনের জিজ্ঞাসা করা প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন হয়েই তার কাছে রয়ে গেছে। সে চুপ থাকে আর বোন ঝেঁঝিয়ে ওঠে তার ঘুম পাড়িয়ে রাখা প্রশ্নগুলোকে বিঁধতে চেয়ে। ভাগ্না কেঁদে ওঠে। বোনের কাছ থেকে নিজের কোলে নেয় সে। আঙুল পুরে দিচ্ছে মুখে। লালা মেখে বেরিয়ে আসছে আঙুল। আঙুল পুরে নিচ্ছে মুখে। লালা মেখে বেরিয়ে আসছে আঙুল। গলার ভিতরের ধুকপুকে গোলাপজামের তখন দাঁত পেতে ইচ্ছে করছে। চেনা দাঁত। অনেকদিনের চেনা দাঁত।
এই ঘন অন্ধকারে পাহাড়ের গা বেয়ে পুখরিতে ওঠার সাহস তার কোনো পূর্বপুরুষের ছিল বা। তার নেই। তাকে পাকদণ্ডী তৈরি করতে হয়। বাচ্চার কান্নাও থেমে গেছে। তার বোন আর বোনের বর কী করছে? চুপিসাড়ে লোহার পলকা মই লাগিয়ে সে ছাদে ওঠে। জারুলের ছায়া আর চাঁদ মিলে পাকদণ্ডী তৈরি করেছে। মোবাইল ভর্তি বোনের ছবি। শুধু বোনের ছবি। আজ সারা সন্ধ্যা রক্সি খেতে খেতে সে ছবিগুলো থেকে বাদ দিয়েছে তার বোনের বর আর ভাগ্নাকে। ছবির দিকে তাকিয়ে বাঁড়া ধরে কচলাচ্ছে বহুক্ষণ। তবু কোনো স্রোত নেই। তাহলে কি তার আর পাখি হওয়া হবে না? ওদাল গাছের নিচে মোচড় দিচ্ছে দুটো শরীর। ষোলো বছরের সে। বোনের বয়স তখন চোদ্দ। এরকম কতদিন ধরে মোচড় দিয়েছিল শরীর দুটো সে ভুলে গেছে। বরং স্পষ্ট মনে আছে পুখরির ধার ধরে মায়ের এগিয়ে আসা। তাকে অবাক করে মা খুলে ফেলেছিল মায়ের শরীর থেকে সমস্ত পোশাক। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আর কেউ আসবে না পুখরিতে। জলের গভীর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে দুটি সালমান্দার। সেই কত পুরনো পৃথিবীর চোখ নিয়ে। মা তাদের নীল পাখির গল্প বলছিল। লিম্বুদের নীল পাখি। একই মায়ের পেটের ছেলে-মেয়ের ভিতর শরীরের টান থাকে সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে টানের জিনিস না পেলেই মানুষ এই দুনিয়াকে চিনতে শেখে। দুনিয়াকে বোঝার জন্যই বড়ো হলে ভাই-বোনকে তাই আলাদা হতে হয়, ছাড়তে হয় শরীর। এই কথা না মেনে ভাই-বোনে শরীর খেললে ভাই পাখি হয়ে যায়। নীল একটা পাখি। রাতের বেলা একলা ডালে এসে বসে। একলা বসে বোনকে দেখে যেতে হয় পুরো একটা জীবন। পাখির কোনো মাটি নাই। যার মাটি নাই তার এই দুনিয়াতে থাকা আর না থাকা সমান। তাকে নিয়ে কারো মাথাব্যথাও থাকে না। পরদিন হাতি, হরিণ, চিতুয়ার পায়ের ছাপের পাশে মানুষের পায়ের মত তিন জোড়া টাটকা ছাপ দেখে বেজায় ভয় পেয়েছিল সকালে পুখরিতে আসা এক লোক। মোবাইল রেখে দেয় সে। শুকনা অর্কিডের ছায়া নড়ছে জারুল পাতাদের ছায়ার ভিতর। ওদাল গাছের নিচের বোনকে মনে করতে চায়। ভারী বুক নিয়ে বারবার বোনের সামনে এসে দাঁড়ায় মা। মা’কে দেখে স্রোত জাগছে তার। তার পাখি হওয়া খুব দরকার। মায়ের আড়াল থেকে উঁকি মারছে বোন। দুলতে থাকা মায়ের বুকে চোখ যায় তার বারবার। কার টানে তার হাত ভিজে ওঠে সে আর আলাদা করতে পারে না। পাখি হয়ে গেলে সে বোনকে দেখতে পাবে পুরো একটা জীবন। হাল্কা লাগে তার। কাগজ দেখানোর সময় আসার আগে রোজ এমন করতে হবে। চাঁদের আলোয় পা দুখান হাল্কা ঠেকে তার। হাত নাড়ায়ে দেখে শূয়োর ধরার ব্যথা নাই আর পিঠের পাখনায়। অনেক দৌড়য়। অনেক হাত নাড়ে। পায়ের আওয়াজ নিচের ঘরে শুয়ে থাকা ওরা কি তাহলে পাচ্ছে না? তাহলে কি সে উড়ছে? তবে কি খানিক পাখি হয়েছে সে? অনেকক্ষণ ছাদ জুড়ে উড়ে বেড়ায় সে। এবার আসল পরীক্ষা। লোহার পলকা মইটা মাটিতে ফেলে দেয়। ভোর হয়ে এসেছে। অনেক সবুজ পাতার গাছ। একটা পাখি। সূর্য লাল হতে চাওয়া রং হয়ে ফুটে উঠছে একলা। ছাদ থেকে উঠানে নামার উড়ান দিতে দূরত্ব মেপে নেয়। উড়ে উড়ে আসতে থাকে ছাদের কিনারে। একা। বোনের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। “মই কে ফেলল? “—- চিৎকার জুড়েছে।”
♦–♦♦–♦♦–♦
লেখক পরিচিতি: দক্ষিণ ২৪ পরগনার আদি গঙ্গার তীরে তাঁর আবাস । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর।আরম্ভ প্রকাশনার অন্যতম এই সহযোগী নেপথ্যচারী, মানসে ভ্রাম্যমাণ। অবসরে পতঙ্গদের চলাফেরা দেখেন। প্রকাশিত কবিতার বই তিনটি ও একটি অনুবাদ-বই :অবগাহনের শব্দ , যন্ত্রণাপ্রবাহ, কে গো তুমি সারল্যময় আলো , পশ্চিম এশিয়ার কবিতা ও অন্যান্য ।
চিত্রি পরিচিতি: সঙ্কুল দাস বারাসাত আকাদেমি অফ কালচারের ছাত্র। উত্তর চব্বিশ পরগণার বাসিন্দা
গল্পের সমস্ত চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই, কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।
❤ Support Us