শিবভোলার দেশ শিবখোলা
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
বাড়ির রকে ছবিগুলো নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে ভবেশ, ফুকফুক করে বিড়ি টানে আর বিড়বিড় করে
চিত্র: দেব সরকার
বুড়োর চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে একটা গলি চলে গেছে। কিছুটা গেলেই, কৌটোর মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়ার মতন করে ভবেশ বসে থাকে। গায়ের জামাটাও যেন গুটিসুটি মেরে আছে। বয়স ভালোই হয়েছে । ছিপছিপে। সরকারি বাসের ডিপোতে কাজ করত। হিসেব একদম জানত না বলে উন্নতি হয়নি। সামান্য টাকার মাইনে। জীবন প্রায় চলেই গেল। এখন ভাড়া বাড়ির রকে বসে নিজের সঙ্গে গুনতুলি মেরে সময় কেটে যায়। জীবনে কিছু বলার মতন ঘটেনি। বাড়িতে তেমন কেউ আসে না। আলেকালে দূর সম্পর্কের এক ভাগ্নে আসে। তাও এই দু বছরে বন্ধ। বাবরের আমলের একটা দেয়াল ঘড়ি আছে। খুব ভুলভাল ঘণ্টা বাজে। ভবেশ মাঝে মধ্যেই ভুল ঘণ্টার আওয়াজে সময় গণ্ডগোল করে। একটা খুপরির মতো ঘর। আলনাতে কিছু জামাকাপড়। সকালে মিঠু আসে। রান্নাবান্না করে কাজ করে চলে যায়।
কিছুদিন আগে মিঠু গজগজ করে ঘর ঝাড়ার সময় খাটের তলা থেকে কিছু ডেবোঢাকনার সঙ্গে একটা বাক্স বের করেছিল। সেখানে পুরোনো ইলেকট্রিক বিল থেকে শুরু করে সত্যনারায়ণের ফর্দ সবই ছিল! ছোটোবেলার সোয়েটার, স্কুলের জামা, পুরোনো ছবি, বিয়ে অন্নপ্রাশন থেকে শ্রাদ্ধ বাড়ির কার্ড, নামাবলি, ছোট গীতা, টেলিফোন নম্বরের খাতা… মিঠু একতাল ধুলো মেখে এইসব বের করতে করতে বলছিল, এবার কী কী বেরোবে কে জানে? ফেলে দেন না কেন? আমার বাড়িতে এইসব কবেই ফেলে দিয়েছি। কাগজওলাদের কাছে তো বেচে দেওয়া যায়! ভবেশ উত্তর দেয়নি। খানিক পরে বলেছিল আচ্ছা তোকে পঞ্চাশ টাকা দেব। একটু ঝাড়পোঁছ করে দে। খুব ইঁদুরের উৎপাত, বুঝলি। হঠাৎ মিঠু লাফ মেরে ওঠে। খালি জুতোর বাক্স থেকে ইঁদুরের বাচ্চা আর একটা নেংটি ভবেশের পায়ের ওপর দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। দেখলি দেখলি এইবার বেটাগুলোকে ধরেছি। শালা সারারাত ঘুমোতে দেয় না। কোনো খাবার ভয়ে বাইরে রাখতে পারি না। ঘরে সবকিছু নষ্ট করে দিচ্ছে। ও মিঠু মা রাগ করছিস কেন? আচ্ছা তোকে একশো টাকা দেব। একটু ভালো করে ঝেড়ে দে। আর আমি এই গণেশের বাউনগুলোকে বিদায় করে আসি।
একটা ছেঁড়া খাতার ভেতর থেকে কয়েকটা ছবি বেরোয়। ভবেশ ফিরে এলে মিঠু জিজ্ঞেস করে, ও জেঠু, এইগুলো কাদের ছবি? হঠাৎ করেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে ভবেশের! বলে, বাবার আমলের বাক্স, সে কি আর মনে থাকে… এইসব যে ছিল তাই জানতাম না। তখন কত আত্মীয় বাড়িতে আসত। অনেক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও আসত রে। এখন আর এইসব মনে নেই…!
কিছু কাচের কাপ ডিশ থালা গেলাস বাটিও বেরিয়েছিল। মিঠু বলে, এইগুলো কোথায় রাখব? ওইগুলো সব নতুন রে। তুই বাড়ি নিয়ে যা। আমার এখানে কে আর আসে। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। আর শোন খাটের তলায় ভালো করে ওষুধ দিয়ে দিস।
মিঠু চলে গেলে ভবেশ চা নিয়ে বিড়ি ধরিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে আবার ছবিগুলো দেখে। জানতই না যে ছবিগুলো এখানেই আছে! মনে করার চেষ্টা করলে আবছা কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে। সেই সময়, সেইসব কথা… খুব মনখারাপ হয়ে যায়। কিন্তু নামগুলো মনে পড়ে না! কোথায় থাকে? কার মারফত এই ছবিগুলো কিছুই মনে পড়ে না। ভবেশের বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধড়ফড় করতে থাকে।
এখন দিনরাত এই ছবিগুলো নিয়েই থাকে। বালিশের তলায় রেখে শুয়ে ভাবতে থাকে কেন ওই ছবিগুলোতে ভবেশ ছিল না। কেন নেই? কেন থাকতে পারল না? কেন দেরি হয়েছিল? ভবেশের জীবন এখন কেনতে আটকে গেছে। মিঠুকেও সারাদিন এইসব বলে যায়। দিন নেই রাত নেই ফুকফুক করে বিড়ি টানে আর বিড়বিড় করে। মিঠু ভাবে কী কুক্ষণে যে খাটের তলা ঝাড়ার কথা বলেছিলাম! বাড়ির রকে ছবিগুলো নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে ভবেশ…
চিত্র: দেব সরকার
জানলার ধারে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। বেশ সুন্দর শাড়ি। সাদাকালো ছবি। ভবেশ তাহলে ওই সময় ছিল না। মেয়েটার বাড়িটাও চিনত না। কে ছবি তুলেছে সেটাও জানে না! ভবেশ মনে করার চেষ্টা করে যদি ওকে টেলিফোন করে বলা যেত! তাহলে হয়তো পাশে দাঁড়িয়ে যেত ভবেশ। কিন্তু কোনোটাই হয়নি। ভাবতে থাকে কেন দেরি হয়েছিল…
একটা অনুষ্ঠান বাড়িতে মেয়েটা খুব সেজেগুজে ছবি তুলেছে। ভবেশ ভাবতে থাকে কার বিয়েতে গেছিল? শ্রাদ্ধ না অন্নপ্রাশন। ভবেশ কেন নিমন্ত্রিত ছিল না? বিয়েটা কোন মাসে হয়? বিয়ে ছিল না বউভাত? কী কী খাইয়ে ছিল? ভবেশ ভাবতে থাকে কেন দেরি হয়েছিল?
দূরে পাহাড়। মেয়েটা একটা উঁচু টিলার ওপর বসে আছে। খুব সুন্দর জায়গা। ভবেশ কোনোদিন ঘুরতে যায়নি। খুব ভালো হতো ভবেশ পাহাড়ি পথ ধরে ওর সঙ্গে হাঁটত। কী সুন্দর ফুল ফুল শাড়ি পরে ও টিলার ওপর বসে আছে। ভবেশের খুব মন খারাপ হয়। ভবেশ ভাবতে থাকে জায়গাটা ঠিক কোথায়? কোন ট্রেন যায়? কেমন খরচ হতে পারে? ঠান্ডা আছে? থাকার জায়গা? কিন্তু কেন ওখানে যেতে পারেনি? কেন দেরি হয়েছিল?
একটা আয়নার সামনে মেয়েটা বসে আছে। আয়না দিয়েও দেখা যাচ্ছে। ভবেশের ঘরে আয়না তেমন নেই। খুব ছোট্ট একটা আয়না আছে। শুধু মুখ দেখা যায়। ছবিতে আয়নাটা অনেক বড়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায়। ভবেশ ভাবে এমন একটা আয়নার কেমন দাম হতে পারে? সেই আয়নাতে ভবেশকে কেমন লাগতে পারে? মেয়েটার পাশে! পাঞ্জাবি পরে দাঁড়ালে? কিন্তু ভবেশ তো বাড়িটা চিনত না! কেন যে সময় মতো যেতে পারেনি! কেন দেরি হয়েছিল?
বারন্দায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। বারান্দাটা খুব সুন্দর। এমন বারান্দা ভবেশ অনেক দেখেছে। পাড়াতেও আছে। কিন্তু ভবেশ সেই সময় বারান্দায় কেন ছিল না? যে ছবি তুলেছিল তার সঙ্গেও যদি আলাপ থাকত! কেন যে একটাও ছবিতে ভবেশ নেই? তাহলে এই ছবিগুলো ভবেশ বাঁধিয়ে রাখত! কেন যে দেরি হয়েছিল?
রাতের খাবার খেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে ভবেশ রকে বসে থাকে। ঠান্ডাটা বেশ ভালোই পড়েছে এবার। বিড়ি ধরিয়ে ও কুয়াশামাখা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা ভাঙা গাড়ি সেই কবে থেকে দত্তবাড়ির নিচে পড়ে আছে! তার পাশেই পরিমলের রিকশ । “কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়…” রেডিও থেকে মান্না দে-র গলা ভেসে আসছে। ভবেশের রকের পাশেই একটা কালো কুকুর থাকে। এখন ভবেশের দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে। ভবেশ বিড়ি ফেলে ঘরে ঢুকে যায়।
শীতের দুপুরে ডিমের ঝোল ভাত খেয়ে বিড়ি ধরিয়ে ভবেশ রকে বসে আছে ছবিগুলো নিয়ে। আজকাল ভাগ্নে ঘনঘন আসছে। গত সপ্তাহেও এসেছিল। আজকালকার ছেলেছোকরা, কথাবার্তা ভালো না, বলে কিনা, মামা সারাদিন এই ছবি ধরে থাকতে থাকতে নিজেই তো ছবি হয়ে যাবে। ভবেশের পিত্তি জ্বলে যায়। হ্যাঁ রে হারামজাদা, মামার কষ্ট আর কীইবা বুঝলি? পোঁদ খোলা মামা। টাকা পয়সা থাকলে কি আর এমন ভাবে ছবি নিয়ে বসে থাকতাম। তাহলে দেখতে পেতিস, এই সব ছবিতে আমিও থাকতাম। কত করে বললাম, একটা কিছু করে এই ছবির মধ্যে আমাকেও ঢুকিয়ে দে। না পারলি না! একটু কিছু খরচ হয় হবে। আর তো কটা দিন… মরে গেলে তো ল্যাটা চুকে গেল। কিছু টাকা পাবি। রেখে দিয়েছি। কিছু একটা ব্যবস্থা করে দে আমার মানিক। ভাগ্নে বলে, আচ্ছা তোমার একটা পুরোনো ছবি দাও আর এই ছবিগুলো দাও। ভবেশ চিৎকার করে বলে, বাল আমার এই ছবিগুলো হাতছাড়া করা যাবে না। ভাগ্নে বলে, তাহলে আমি মোবাইলে এই পাঁচটা ছবি তুলে নিই। আর তোমার পুরোনো ছবি দাও। ভবেশের একটাই ছবি ছিল। তারপর আর কোনো ছবি তোলা হয়নি। শার্ট প্যান্ট পরা ছবি। বছর তিরিশ বয়স তখন। ভাগ্নে বলে গেল, ঠিক আছে আমি দেখছি!
আজকে ফ্রেমের মধ্যে ওই পাঁচটা ছবি আটকে নিয়ে এসেছে। মাঝখানে বড়ো করে ভবেশের ছবি। ভবেশের রাগে কান্না পেয়ে যায়। বলে শালা, আমি ঠাকুর? আমি ওই ছবির মধ্যে কোথায়! হারামজাদা, এই বুঝলি? মামার কষ্ট নিয়ে মজা করলি? বেরিয়ে যা… বেরো বেরো বেরো… আর আসবি না। বাল টাকা দেবে তোকে!
রকে বসে বিড়ি ধরায় ভবেশ। ছবির ফ্রেমের দিকে তাকায়। ভাবে, যদি একটাও ছবির মধ্যে থাকা যেত! কেন যে দেরি হলো? একজনও তো রাজি হতে পারত! বাবা মা অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু ভবেশের বিয়ে হয়নি। পছন্দই হতো না। ভবেশের একটাই শখ ছিল। সুন্দরী বউ। এদিকে সুন্দরীরা কেউই ভবেশকে পছন্দ করত না। মা মরার সময় বলেছিল পোকা বাছতে বাছতে নিজেই পোকা হয়ে গেলি ভবা! তোর আর বিয়ে হলো না। ভবেশ ওই ছবিগুলো নিয়েই ঝুলে থাকে। তাদের কারোর নাম আর মনে নেই। বিয়ে থাও নিশ্চয়ই হয়ে গেছে! বাচ্চাকাচ্চাও আছে। সুন্দর বড়লোক বর পেয়েছে। ভবেশ ভাবতে থাকে… দেশলাই কাঠি দিয়ে কান খুঁটতে থাকে। চা নিয়ে এসে আবার বিড়ি ধরায়। ছোট্ট আয়নায় নিজের মুখ দেখে বোকার মতন হাসার চেষ্টা করে, কালো কুকুরটাও দাঁত বের করে হাসে ।
♦–♦♦–♦♦–♦
গল্পের সমস্ত চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই, কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।
মিরিক নামটি এসেছে লেপচা ভাষার “মির-ইওক” শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পুড়ে যাওয়া জায়গা।
15:34