- প্রচ্ছদ রচনা
- জুন ১৩, ২০২২
কারখানায় নয়, শৈশব কাটুক স্কুলে

অতিমারির আবহ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে আবার টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। ভারতের বাজারে প্রতিদিনই পড়ছে টাকার দাম। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে আর্থ-সামাজিক কাঠামোয়।ফলে রুটি-রুজির অনিশ্চয়তায় বাড়িয়ে দিচ্ছে শিশুশ্রম। রুটি-রুজির যোগান করতে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণের । তার উপর দোসর আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে শুধু বড়োরা নন পরিবারের ছোটোদের অবস্থাও শোচনীয়। তারা না পাচ্ছে পুষ্টিকর খাবার না পাচ্ছে সুনিশ্চিত ভবিষ্যত। লেখাপড়া পাট চুকিয়ে, ভবিষ্যত কল্পনা দূরে সরিয়ে রেখে সংসারের হাল ফেরাতে লেগে পড়ছে কাজে।বিশ্বজুড়ে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা ঘোষিত হওয়ার পর চিত্রটা বদলাতে শুরু করেছিল কিন্তু করোনা এসে আবার সব হিসেবের গড়মিল করে দিয়েছে ।
২০০২ সালে সর্বপ্রথম ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করা শুরু করে ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবর অর্গানাইজেশন’। ইউনাইটেড নেশনসের মতে, ২০২০ সালের শুরুর দিকে পাঁচ বছর বয়সী ১০ জন শিশুর মধ্যে অন্তত একজন বিশ্বজুড়ে শ্রমের কাজে জড়িত ছিল। যার মোট করলে দাঁড়ায় প্রায় ১৬০ মিলিয়ন, তাদের মধ্যে ৯৭ মিলিয়ন ছেলে ও ৬৩ মিলিয়ন মেয়ে। ২০২১ সালের জুন মাসের ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন-র হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৬০ লক্ষ । এর মধ্যে গত চার বছরে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৮৪ লক্ষ ।গত কুড়ি বছরে মধ্যে ২০২০ ও ২০২১ সালেই প্রথম শিশুশ্রম বিলোপের প্রয়াস বাধা পায়। অথচ অতিমারির আগে পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রয়াসের ফলে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমেছিল ১০ কোটি। তথ্য বলছে আফ্রিকায় ১০০ জনের মধ্যে ২০ জনই শিশুশ্রমিক। আইএলও-র হিসেব অনুযায়ী ভারতে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১৫ কোটি ২০ লক্ষ।
বিশ্বে শিশুশ্রমের ইতিহাস যথেষ্ট পুরনো। ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, সুইৎজারল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকায় শিশুশ্রম দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচলিত ছিল । এখনও ধীরে ধীরে তা কমছে । ভারতেও ভোজনালয়, চায়ের দোকান, সবজি-মুদি-স্টেশনারি দোকানে রাজমিস্ত্রি, জোগাড়ে, ইটভাটা, কৃষিক্ষেত্রে ফ্যাক্টরিতে, গ্যারাজে সামান্য পয়সার বিনিময়ে শিশুশ্রমিকের দেখা মেলে ।
আইএলও-র নিরয়মে ১৩ বছরের কম কোনও শিশুকে অর্থ প্রদানের বিনিময়ে কাজে নিয়োগ করা যাবে না। ১৪ বছরে কেবল হল্কা কাজ, ১৫ বছর থেকে শ্রমিক হিসেবে কাজে নিলেও ১৮ আগে বিপজ্জ্নক কাজে নিয়োগ করা যাবে না । বালিকা বা কিশোরী হলে তার বিপদ শতগুণ বাড়ে। এমনিতেই পাঁচ বছরের পর থেকেই ভারতীয় মেয়েদের বাড়ির কাজ শেখানো হয়। বাসন মাজা, কাপড় কাচা । ইদানীং শিশু ও বালিকা পরিচারিকার ওপর নিগ্রহের ঘটনা প্রায়ই সংবাদে শোনা যায় । যৌন পেশায় নাবালিকাদের বাধ্য করার খবরও মাঝেমধ্যে শোনা যায়। পূথিবীতে ১৮ অনূর্ধ্ব যৌনশ্রমিকের সংখ্যা কয়েক কোটি। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, বাংলাদেশ প্রভূতি এশায়ার দেশ, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকায় বহু সংখ্যাক রাষ্ট্রে এ সমস্যা আছে। ১৪ বছরের নীচে ঠিক কতোজন এ পোশায় নিযুক্ত রয়েছে ভারতে তার যথাযথ পরসংখ্যান নেই । ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) দ্বারা প্রকাশিত ভারতের সর্বশেষ ক্রাইম 2020 রিপোর্ট অনুসারে, শিশু শ্রম (নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ) আইনের অধীনে ৪৭৬ টি এফআইআর দায়ের হয়েছে। যার মাধ্যমে পুলিসি তৎপরতায় ৭০৫ শিশু শ্রমিককে উদ্ধার করা গেছে ।
ইউনিসেফের বিশ্বব্যাপী ‘এন্ডিং ভায়োলেন্স এগেনস্ট চিলড্রেন’ ক্যাম্পেনের সেলিব্রিটি অ্যাডভোকেট হিসেবে বলিঅভিনেতা আয়ুষ্মান খুরানা যোগদান করেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। তারপর থেকেই দেশে শিশুশ্রম রুখতে উদ্যোগী হয়েছেন আয়ুষ্মান। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবসে সামাজিক মাধ্যমে বিশেষ বার্তা দিয়ে আয়ুষ্মান লেখেন, ‘শিশুরা স্কুলে যাবে, খেলার মাঠে যাবে। ওদের স্থান কারখানা, ওয়ার্কশপ, কৃষিজমিতে নয়। শিশুশ্রম তাদের অধিকার থেকে, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। এর ফলে তাদের ঠেলে দেয় অনিশ্চিত ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে। যে সকল শিশু নিয়মিত স্কুলে যায়, ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, রোজগার করার সুযোগ তাদের অনেক বেশি। এইভাবেই দেশে দরিদ্রতার হার কমবে একদিন। সমাজে শিশুশ্রম বন্ধ করতে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের এলাকায় শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য উদ্যোগী হলেই পরিবর্তন আসবে গোটা দেশে। পাশাপাশি, যে সকল শিশুকে শৈশবেই কাজ করতে বাধ্য করা হয়, তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
অনুরাগীদের সকলের কাছে আয়ুষ্মান অনুরোধ করে বলেন, যদি কোথাও শিশুশ্রমিক দেখেন বা কোনও শিশুকে বিপদে দেখেন তাহলে চাইল্ডলাইন নম্বর ১০৯৮-এ ফোন করার আবেদন করেন অভিনেতা।
শিশুশ্রম বন্ধ করার উদ্দেশ্যবিশ্বব্যাপী বহু সংগঠন কাজ করছে। ভারতে নোবেল শান্তি জয়ী কৈলাস সত্যার্থীর সংগঠন, ‘বচপন বচাও আন্দোলন’ অন্যতম। তবে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে সর্বব্যাপী উদ্যোগ দরকার। গত মাসে ডারবানে অনুষ্ঠিত শিশু শ্রম নির্মূলের পঞ্চমতম বিশ্ব সম্মেলনে ১৭ বছর বয়সী তারা বানজারা আইএলও মহাপরিচালক গাই রাইডারের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে, তারা শুনিয়েছিলেন, কীভাবে তাঁকে শিশুশ্রম থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল এবং তার স্বপ্নগুলি স্বার্থক করতে কিভাবে তাঁকে সাহায্য করা হয়।
একজন প্রতিশ্রুতিশীল আইনজীবী, অমর লাল, যাকে বাচপন বাঁচাও আন্দোলনের দ্বারা একটি ইটের ভাটা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল, ডারবানে আরেকটি মাত্রা এনেছিলেন তাঁর বক্তব্য । অস্ত্র কেনা এবং সামরিক অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করা অর্থের মাত্র একটি শতংশ শিশু শ্রমের দুর্ভোগ মোকাবেলায় সাহায্য করতে পারে বলে তিনি মনে করেন।কৈলাশ সত্যার্থী সামাজিক সুরক্ষাকে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে দেখেন। তাঁর বিশ্বাস, আমাদের নীতি এবং সম্পদ বরাদ্দে শিশুদের জন্য ন্যায্য অংশ বরাদ্দ করতে হবে, ডারবান সম্মেলনে তিনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে শিশুদের জন্য সরাসরি সামাজিক সুরক্ষার দিকে কাজ করার আহ্বান জানান। যা শুধুমাত্র শিক্ষার প্রবেশাধিকার এবং ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করবে না, বরং শিশুদেরকে একাধিক ঝুঁকি থেকেও রক্ষা করবে।
শিশুশ্রম বন্ধ করতে গেলে সবার আগে নাগরিকদের আয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে। কৈলাশ সত্যার্থী, আয়ুষ্মান খুরানারা চান বিশ্ব বিবেক গর্জে উঠুক শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে। শিশুদের শিক্ষার বিস্তার ঘটালেই দারিদ্রের মূল কারণও বুঝতে পারবে তারা, মানুষ হয়ে অনুসন্ধান করার সামার্থ্য অর্জন করবে। দারিদ্র কমলে শিশুশ্রম ধীরে ধীরে কমে যাবে । তবে কোভিড-উত্তর পৃথিবীতে তেমনটা কবে হবে, সেই আশায় দিন গুনছে নিরন্ন, দরিদ্র শিশুরা।
❤ Support Us