Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • জুলাই ৩১, ২০২২

আত্মজন

মন্ত্রী হলে আর লুকিয়ে দিদির বাড়ি আসা যায় না। খবর হয়ে যায়।

পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়
আত্মজন

অলঙ্করণ: দেব সরকার

 

 এক 

গাড়িটা মেন গেটের সামনে পৌঁছলে সিকিউরিটি দরজা খুলে দিল। গাড়ি ঢুকে গেল  কোয়ার্টারের একদম ভেতরের গেটের সামনে। ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়াল। মনীশ গাড়ি থেকে নেমে  চলে গেলেন ভেতরে। ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে গেল পেছনের গ্যারেজে।

দু

মনীশ তখন ছোট্ট শিশু। তখনও তার নাম মনীশ হয়নি। শুধুই মনুয়া।বালিগঞ্জ প্লেসের চৌধুরী ভিলা। বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে সে। দূর থেকে বরেন সাহেবের গাড়ি দেখা মাত্র ছুট্টে ভেতরে খবর দেয় । ভেতর মহল দ্রুত তটস্থ হয়ে পট পরিবর্তন করে। হারু উর্দি পরে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে বলে ,  গুড ইভিনিং সার। পুরো ইংরিজি বলা চাকর চৌধুরী সাহেব খুঁজে পাননি। তাই এটুকুতেই তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

সাহেবের পৈতৃক ভিটা চৌধুরী ভিলা দুরকম জীবন যাপনে অভ্যস্থ। সাহেব থাকলে এক রকম, না থাকলে আরেক রকম। বরেন রায় চৌধুরী সাহেব মানুষ। কিন্তু তাঁর স্ত্রী  ভারতী ঘরোয়া বাঙালিনী। শ্বশুরের পছন্দ করা মেয়ে। নইলে এ বিয়ে হত না হয়ত। সাহেব যতক্ষণ থাকে,সাহেবিয়ানার পান থেকে চুন খসে না। সাহেব বেরিয়ে গেলে হারু উর্দি ছেড়ে একটা বিড়ি ধরায়। তারপর বাজারে ছোটে সাহেব-গিন্নি মানে তাদের সকলের গিন্নিমার নিত্য পুজোর ফুল মিষ্টি কিনতে। দারোয়ান চৌবে খৈনি ডলে দেশোয়ালি সুর ভাঁজে। দাসী চিন্তা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। গিন্নিমা হাউসকোট ছেড়ে গরদ পরে পুজো করেন। সকলে প্রসাদ পায়। লুকোন জায়গা থেকে বেরোয় আচার, নভেল, সেলাইয়ের ফোঁড়। পুজো সেরে গিন্নিমা কোনদিন সেলাই করেন, কোনদিন নভেল পড়েন। চিন্তা দাসী আচার রোদে দেয়। মনুয়ার মা সাবিত্রী হল গিন্নিমার খাস দাসী।  বাবা গগন হল সাহেবের ড্রাইভার। দাসদাসী সকলে বাড়ির পেছনের আউট হাউসে থাকে।

মনুয়ার মা সাবিত্রী ছেলেকে পইপই করে বলেন, খপরদার মনু, কখনও মুখ ফকসে বাপেরে কিছু কয়ে ফেলবিনি। সপ্পোনাশ হবে তাইলে।
মনুয়ার বাপ শুধু সাহেবের ড্রাইভারই নয়। মনেপ্রাণে দাসানুদাস ভক্ত একেবারে। সাহেবের প্রশংসায় সদা   উচ্চকিত। সাহেবের খাস লোক। ফলে এই চৌধুরী ভিলার মত সাবিত্রীকেও দুরকম জীবন চালাতে হয়। পতি পরমেশ্বরের সঙ্গে ছলনা করতেই হয়।

একদিন চাপ না নিতে পেরে ভারতী দেবীকে বলল, গিন্নিমা, মোর নাম সাবিত্তী। অথচ সোয়ামীর সঙ্গে ছল করছি। এ কি ধম্মে সইবে মাঠান?
ভারতী দেবী বলেন, যার যার নিজের বিশ্বাস মত কাজ করাই সতীত্ব। বলে কয়ে করতে গেলে যদি অশান্তি হয় ঝগড়া বাঁধে, তখন সেটা এড়ানোর জন্য চাতুরী করলে তাতে দোষ হয় না। বিষ্ণু আর তাঁর অবতার কৃষ্ণই তো কত ছল করেছে। করেনি? পুরাণ, মহাভারতের গল্প শোনাই যে এত? আমিও করছি তো।

সেই থেকে সাবিত্রীর অন্তর সাফ। কিষন কানহাইয়া ছল করেছেন, মাঠান ছল করছেন। তাইলে ওতে পাপ হয় না।
মনুয়া তখন শিশু। অত বোঝে না । শুধু বোঝে ও মাঠানকে ভালোবাসে, মাঠানও ওকে ভালোবাসে, তাই ও মাঠানের জন্য সব কিছু করবে।
মাঠানই বলেছিল, তুই আমাকে বম্মা বলবি। আমি তোর বড়মা। আর তোর মা হল শুধু মা।

তাই মনুয়ার কাজ হল সাহেব আসার আগে দরজার মুখে দাঁড়ানো আর গাড়ির টিকি দেখলেই খবর দেওয়া। দারোয়ান দরজা খুলতে খুলতে বাড়ি ভোল বদলে ফেলবে। তাছাড়া, সাহেবের সময়ও ঘড়ি ধরা। রাস্তায় কোন গোলযোগের জন্য একটু এদিক ওদিক হলেও প্রায় ঘড়ির কাঁটা ধরে ফেরেন। সকলে মোটামুটি প্রস্তুত থাকে। সাহেবের গাড়ি গ্যারেজ করে গগন নিজের আউটহাউসের ঘরে আসে। সাহেব ফিরলে সাবিত্রীও ঘরে ফেরে। হারু সাহেবি উর্দি পরে সাহেবের কাজ করে। চিন্তা, সাবিত্রী সাহেবের সামনে যায় না।

সাহেব যখন থাকে না তখন মাঝেমধ্যে বম্মার ভাই দীপেন আসে। বম্মার একমাত্র ভাই। কিন্তু এ বাড়ি আসা তার মানা। সে যে-রাজনীতি করে সেটা নাকি সাহেবের উল্টো দিক।তাই ভাইকে লুকিয়ে আসতে হয়। মনুয়া অত বোঝে না। বড়দের কথা গিলে গিলে যেটুকু জ্ঞান।
তবে শালা জামাইবাবুতে একটা মিল আছে। দীপেনও পুজো আচ্চা মানে না। ঠাকুর দেবতা নিয়ে এন্তার ঠাট্টা তামাশা করে। দিদিকে বলে, কী এত গোপাল পুজো করিস? তারপর মনুয়াকে চোখের ইঙ্গিতে দেখিয়ে বলে, এই দেখ কেমন আসল জ্যান্ত গোপাল। এর সেবা কর।

বম্মা কিছু বলে না। ভাইয়ের কথায় হাসে। বলে, মস্করা করিসনি। আমার তোরা দুজনও গোপাল, আবার ওই যে সিংহাসনে বসে আছেন, তিনিও গোপাল।

তারপর ঠাকুরের ফুল ভাইয়ের মাথায় ঠেকিয়ে মুখে প্রসাদ গুঁজে দেয়। ভাইও বাধা দেয় না। দিদিকে খুব ভালোবাসে। মাথায় ফুল ছোঁয়ালে দিদিকে প্রণাম করে। বম্মা বলে, ঠাকুরের সামনে অন্য কাউকে প্রণাম করতে নেই রে দীপু। দীপেন মামা বলে, আমার তুমিই মা, তুমিই দুর্গা। আমার আর অন্য কোন ঠাকুর নেই।

দীপেন মামা যেদিন আসে সেদিন দিদির সঙ্গে গল্পের ফাঁকে মনুয়াকেও পড়ায়, গল্প বলে নানা রকম। দীপেন মামাই একদিন দিদিকে তাগাদা দেয়, হ্যাঁরে দিদি, তোর মণি কি মুখ্যু হয়ে থাকবে? ইস্কুলে পাঠাবি না?

বম্মা তখন বললেন, তুইই একটু ব্যবস্থা করে দে না রে। আমার বাড়ির ব্যাপার তো জানিসই। তখন দীপেন মামা একদিন তাকে নিয়ে গিয়ে পাড়ার ইস্কুলে ভর্তি করে দিল। ইস্কুলে মনুয়া বা মণির নাম লেখানো হল মনীশ। মনুয়ার বাপ গগন তাতে অবশ্য খুশিই হল। বলল, যাক, ছেলে আমার সাহেবের মত ইনজিরি বলবে। সুট টাই পরবে। বড় চাকরি করবে।

যতই হোক, বাপ তো, আশীর্বাদ ফলে গেছে। মনীশ এখন সাহেবের মতই ইংরিজি বলে, বড় চাকরি করে, সুট পরে। কিন্তু ও তো বম্মা আর দীপেন মামার হাতে মানুষ, তাই চায়নি যে, ওর চেয়ে নীচু স্তরের মানুষেরা তাকে ভয়ে ভক্তি করুক। সে চায় তারা তাকে আপন জন ভেবে সম্মান করুক। আজ মনীশ সেভাবেই অফিস চালাতে পারে।

স্কুলে ভর্তি হবার পর মনীশকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। তার আগ্রহ দেখে স্যারেরা সাহায্য করেছে, উঁচু ক্লাসে দীপেন মামার শিক্ষক অধ্যাপক বন্ধুরা সাহায্য করেছে। মনীশ টপাটপ সিঁড়িগুলো টপকে গেছে।

এর মধ্যে মনীশ যখন কলেজে তখন এক বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। দীপেনের পার্টি ক্ষমতায় এসেছে। দীপেন মন্ত্রী হয়েছে। মন্ত্রী হলে আর লুকিয়ে দিদির বাড়ি আসা যায় না। খবর হয়ে যায়। শ্যালক মন্ত্রী হওয়ায় সাহেবের বিরাগ যেন তার ওপর আরো বেড়ে গেছে। ফলে বম্মা তাকে দীপেন মামার কাছে পাঠায় খোঁজ খবর নিতে, খাবার পৌঁছে দিতে। দীপেন মামা একটুও পাল্টায়নি। একদম সাদাসিধে। এক ঘর লোকের সঙ্গে অট্টহাসি, গল্প, কাজ সবই হচ্ছে। আবার বেয়ারা আবদার কেউ করলেই ধমক।

এমনই একদিন সকলের সামনেই দীপেন মামা তাকে বললেন, ওরে, এবারে তুই কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বোস। মামা মন্ত্রী বলে হাতের মোয়ার মত চাকরি পাবি এই আশা করিসনি। সকলেরই তো চাকরি প্রয়োজন। পক্ষপাত করলে চলবে কেন? যার যেমন যোগ্যতা সে তেমন পাবে।
মনীশ বুঝল, মামা এটা শুধু তাকে নয়, তাকে বলার মধ্য দিয়ে সকলকেই একটা মেসেজ দিল।

মনীশ লেখাপড়ায় ভালো। ও ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় প্রথম দশ জনের মধ্যে স্থান পেল। বরেন রায় চৌধুরীর মুখ হাঁড়ি। মনীশের স্কুলে যাওয়া, কলেজে পড়া কিছুই তার পছন্দ হয়নি। কিন্তু গগনকে খুশি রাখতে বাধা দেননি। গগনের মত খাস লোক কাম পাকা ড্রাইভার পাওয়া সহজ নয়। চাকর ইংরিজি বললে তার স্ট্যাটাস বাড়ে। কিন্তু চাকরের ছেলে একেবারে অফিসার হয়ে যাবে এ তার হজম হল না। বললেন না কিছুই। সব তাঁর হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। দীপেন মন্ত্রী, মনীশ অফিসার।

গগনের বাড় বাড়ল কি না পরীক্ষা করার জন্য একদিন বললেন, কি রে, তোর তো আর চাকরির দরকার নেই। অফিসারের বাপ। তোকে তো এবারে আপনি এজ্ঞে করতে হবে।

গগন আকর্ণ হেসে হাত কচলে বলল, কি যে কন স্যার। আপনে হলেন অন্নদাতা। আপনের অন্নেই তো ছেলেটা বড় হল স্যার। আমি আপনার নোক হয়েই এই জেবনটা কাটিয়ে দেব। ছেলের ব্যাপার ছেলের মা বুজুক।
বরেন খুশি হলেন। যাক, সবকিছু এখনও হাতের বাইরে চলে যায়নি।

ট্রেনিং শেষে চাকরির জায়গায় যোগ দেবে মনীশ। কোয়ার্টার পাবে। গগন বলল, আমি সাহেবকে ছেড়ে যাব না বাপ আমার। তোর যদি নজ্জা হয় তো ড্রাইভার বাপের পরিচয় দিস নে কারুর কাচে।

সাবিত্রী বলল, মনু, তোর বাপেরে একেনে ফেলে আমি যাই কেমনে? তাছাড়া দেক, আমরা মুখ্যু মানুষ। তোর একন বড় বড় নোকজন। কি কইতে কোথায় কি কইব। তুই একন কত্ত উইচ্চে উটে গেচিস। আমরা গেলে তোর খেতি হবে। তুই তাড়াতাড়ি তোর মত একটা মেয়ে দেকে সমসার পেতে নে। সেই তোকে দেকবে। তোর বম্মার আর দীপেন মামার আশীব্বাদ আচে। তুই ভালো থাকবি।
কিন্তু সকলকে আশ্চর্য করে দিয়ে ভারতী দেবী বললেন, আমি মণির সঙ্গে যাব।

এই প্রথম মাথা উঁচু করে স্বামীর চোখে চোখ রেখে কথা বললেন। ভাইয়ের জন্য যে বিদ্রোহ করেননি, পাতানো ছেলের জন্য সেটা করলেন। বললেন, আমি ওর যশোদা মা। ওকে নতুন জায়গায় এভাবে একা ছাড়ব না। তাছাড়া তোমার বাড়িতে আমি পুজো করতে পারি না। তোমার বাড়িতে আমার ভাই আসতে পারে না। আমার ছেলের বাড়িতে আমি পুজো করব, আমার ভাই সেখানে যাবে। আমি সেখানে স্বাধীন ভাবে বাঁচব।
বউয়ের এরকম মূর্তি দেখে সাহেব ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন বোকার মত। চিরকাল শুধু সাহেবিয়ানা করেছেন, টাকা রোজগার করেছেন, লোককে ভয় পাইয়ে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন। বউকে সন্তান দিতে পারেননি, বউয়ের মন পড়তে পারেননি। বউয়ের ভেতরে এতটা বিদ্রোহের আগুন ছিল বুঝতে পারেননি।

মনীশের অপ্রস্তুত লাগছিল।অপরাধী লাগছিল। ভারতী দেবীই তার হাত ধরে টেনে বললেন, চল মণি, তোকে জয়েন করতে হবে।
সাবিত্রী ছুটে এসে তার মাঠানকে পেন্নাম করে চোখে আঁচল দিল।

তি

আজ এখন মনীশকে নামিয়ে গাড়ি চলে গেল। মনীশ ঢুকবেন ভেতরে। বম্মা তার জন্য খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করেন। বলেন, দীপু তো ঠিকই বলত। তুইই তো আমার আসল জ্যান্ত গোপাল। তাই শেষ বয়েসে তোর সেবা করছি। তোকে ধরেছি। বলেই এক গাল হাসেন।
বম্মা এখন আর পেতলের গোপালের জন্য অত বেশি  সময় দেন না। নাঃ, মনীশ কিন্তু নিষেধ করেনি।

♦–♦♦–♦♦–♦

লেখক পরিচিতি: গল্পকার কলকাতার বাসিন্দা। 


গল্পের সমস্ত চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । কোন মিল অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।



❤ Support Us
error: Content is protected !!