Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • আগস্ট ৩, ২০১৯

ডোরাকাটা মানুষ

রাজু বিশ্বাস
ডোরাকাটা মানুষ

রায়মঙ্গল আর কালিন্দীর মধ্যবর্তী দ্বীপে এখনও মাঝেমাঝে বাঘের উৎপাতে প্রাণ যায় বহু মৎস্যজীবী, অরণ্যজীবী মানুষের। বর্ষায় ধানখেত জুড়ে মাতাল হাওয়া খেলা করে। পাকা ধান চাষিরা গোলায় তোলার পর সারা বছর সে মাঠ একাকী মরুভূমির শূন্যতা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এক ফসলি জমি বন্ধ্যা হয়ে গেছে। সমুদ্র এখান থেকে নদীপথে চার ঘন্টার পথ।

এখানে একটা হাইস্কুলে ডেপুটেশনে চাকরিসূত্রে যোগেশগঞ্জের বাজারের কাছে একটা ছোটো ভাড়া বাড়িতে আমরা দুজন থাকি।  বন্ধু উজান কালিন্দীর ওপারে সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামের ছেলে। প্রথম যখন এলাম এখানে, আমার দুচোখে অপার বিস্ময়। এই বিভুঁই জল-জঙ্গল-জীবনের রহস্য আমার সম্পূর্ণ অজানা! বিভূতিভূষণের লেখা ‘সুন্দরবনে সাতছর’ বইটা পড়ে ছেলেবেলা থেকে সুন্দরবনের প্রতি অদম্য একটা আকর্ষণ জন্মেছিল। সত্যিই যে সেখানে কোনোদিন এসে থাকার সুযোগ পাব, এমন প্রত্যাশা ছিল না। তাই মাত্র দুছরের জন্য হলেও চাকরিটা পেয়ে মনে মনে খুই উত্তেজিত ছিলাম। উজান আমার কলেজের বন্ধু। এখানে এসে দুটো সাইকেল কিনে নিয়েছি। ও ইংরাজি পড়ায় আর আমি বাংলা। দুজনেই লিটারেচারের ছাত্র বলেই হয়তো  দুজনের অনুভবের শিকড় একই মাটি থেকে প্রাণরস পায়। আরও একটা বিষয়ে ˆযে আমাদের মিল ছিল, দুজনেই বাবাকে খুব ছোটোবেলায় হারিয়েছি।

বিশ্বকর্মা পুজোর সকাল। বাড়িওয়ালা কাকিমা সক্কালবেলা এসে বলে গেল, আজ রান্না করতে নেই। আগুন জ্বালানো যাবে না। তাহলে আজ খাব কী? আশপাশে ভাতের কোনো হোটেলও নেই। বাঙালি নাড়ি তো, দুপুরে ভাত না হলে আমাদের চলে না। সাধে কি বলে ভেতো…

উজান বলল, আজ তো মহাছুটি, চল দূরের কোনো গ্রাম থেকে ঘুরে আসি। দুপুরে কোথাও কিছু খেয়ে নেব।ছুটি পেলেই আমরা মাঝেমাঝে সাইকেল নিয়ে আশপাশের গ্রামগঞ্জ গুলো ঘুরে আসি। এক একদিন এক এক গ্রামে। কত মানুষেˆর দেখা পাই। মনে হয়, নাগরিক জীবন থেকে দূরে বাংলার নিভৃত এই সব জাযগায় এখনও কত সব আশ্চর্য্য মানুষ আছে। যাদের হৃদয় আলোর মতো পবিত্র, ফুলের মতো শুভ্র। এ যেন আমাদের অমৃতকুম্ভের সন্ধান।

 

দুজনে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছি। ছোটো বাজারটার দোকানপাট সব প্রায় বন্ধ। কিছু করাতকল আর যন্ত্রপাতির দোকানে  পুজোর মহড়া চলছে। দোকানের সামনে কলাগাছ আর মঙ্গলঘটের বাহার। পাড়ার ছেলেরা প্রসাদ নিতে বেরিয়েছে। তাদের বেশিরভাগের গায়ে জামা নেই, কোমরের ঘুমসিতে জাল কাঠি বাঁধা। কিছু লোক প্রসাদ নিতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের মফস্সল শহরে বিশ্বকর্মা সরস্বতী পুজোয় ব্রাক্ষ্ণণকে নিয়ে টানাটানি করতে দেখেছি। এখানে তেমন তাড়া নেই। শান্তভাবে পুজো চলছে। কিছু কিছু জাযগায় মাইকে গান বাজছে। ডিজের দাপাদাপি নেই কোথাও। বাজারটা ছাড়িয়ে আমরা একটা মাঠের রাস্তা ধরলাম। সেপ্টেম্বর মাস; দীর্ঘ মাঠ এখন ফসলে ভরা, তার বুক চিরে জিবের মতো বেরিয়ে গেছে পিচের  সড়ক। তো ভাবতে অসুবিধা হয় না, পথ একদিন কতটা দুর্গম ছিল। দূরের গ্রামের মানুষˆ এ পথ পেরিয়ে হয়তো পায়ে হেঁটে যোগেশগঞ্জ বাজারে আসত। ইতিহাস সে কাদা জলে ভরা মেঠো পথের চিহ্ন মুছে ফেলেছে। এখন এ পথে দিব্যি অটো ট্রেকার ইঞ্জিনভ্যান চলে।

বর্ষার শেষ মরশুমের বাতাসে একটা প্রদাহ আছে। সাইকেল প্যাডেল করতে করতে শরীর ঘেমে উঠছে। অনেকটা চলার পর রাস্তার ধারে প্রতীক্ষালয় দেখতে পেলাম। এটাও নতুন। দেখলাম তার সামনের দেওয়ালে লেখা আছে, ‘দাঁড়াও পথিক বর’…বাঃ, আমাদের মফস্সলের বাসশেডগুলোর দেওয়ালে তো মহাপুরুষের ছবির মাঝখানে নতুন মঙ্গল কাব্যের দেবদেবীরা সবসময় বিরাজমান। শেডটার নীচে বসে উজান বলল, কোনোদিন হুঁকো টেনেছিস?

আমি অবাক হয়ে বললাম, ধুত, হুঁকো টানা তো দূরের কথা, কোনোদিন ছুঁয়ে দেখিনি।

আমি টেনেছি, আমার বাবা হুঁকো খেত। বিচুলির চালের বাতায় হুঁকো গোঁজা থাকত। বাবার আগে দাদু…

আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুই কি এখন আমাকে হুঁকো খাওয়ানোর প্ল্যান করছিস?

ও হেসে বলল, আরে না না, ওই দেখ…

ও আঙুল দিয়ে দেখাল আমরা যেখানে বসে আছি, তার নিচে একটু আড়ালে পেরেকের সঙ্গে বাঁধা আছে একটা আস্ত হুঁকো! আশ্চর্য এখানকার মানুষˆ এই ‘ফোর জি’র যুগে এখনও হুঁকো টানে! ওটা দেখে সিগারেটের তেষ্টা পেল। পকেট থেকে ভার্জিনিয়ার প্যাকেটটা বের করে সিগারেট নিয়ে জ্বালাতে যাবো, এমন সময় কেউ একজন বলে উঠল, বাবা আমার একটা হবে নাই?

একটু দূরে রাস্তার ওপারে এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়িয়েছে হাত পেতে। মুখে তার সরল অকৃত্রিম হাসি। গায়ে জীর্ণ ধূসর ফতুয়া,পরনে বিবর্ণ কোঁচকানো লুঙ্গি।

যাহ্ বাবা, এ লোকটা আবার কোত্থেকে উদয় হল! কাছে ডাকলাম। তাকে একটা সিগারেট দিলাম। সিগারেট নিয়ে লোকটা প্রসন্ন হাসি মুখে নীরবেই চলে গেল।

উজান কটাক্ষ করে বলল, শালা হুঁকোখোড় বুড়োর আবার সিগারেট খাওয়ার শখ…।

আবার চলা শুরু। আমাদের টাট্টু ঘোড়া টগবগিয়ে এগোচেছ। দুপাশে আদিগন্ত ধান খেত। বরষার জল জমে আছে মাঠে। রাস্তার পাশে ডোবায় পদ্ম ফুল ফুটেছে কত! আকাশের ঘর পালানো অভিমানী মেয়ের মতো এক টুকরো মেঘ। পথটা একবারে সোজা চলে গেছে দূরে।

অনেকটা দূরে দু’একটা বাড়িঘর চোখে পড়ছে। বাড়িগুলো যেন ছবির বই থেকে উঠে এসেছে। খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোটো  ছোটো ঘরগুলোর সামনে গোবর নিকানো পরিপাটি উঠোন। আর কদিন পর খেতের ধান উঠে, কিষাণ বধূ তাই সারা উঠোন শুভ্রতায় ভরিয়ে তুলেছে। তুলসী মঞ্চ, ধানের গোলা সব মিলিয়ে মনে হচিছল যেন রূপকথার দেশে এসে পড়েছি। ভেসে আসছে হালের জনপ্রিয় এক বাউল গানের সুর।

কত সাধনার ফলে এমন সাধের মানব জনম পেলে
দুদিন পরে সবাই চলে যাব
এই হরিনাম তুমি গাইবে কবে…

শুনেছি দূরের বাদ্যি মিষ্টি লাগে। এখানে এসে বুঝলাম, কতটা মিষ্টি। সেই কোন সকালে বেরিয়েছি। এখনও পেটে কুটোটি  পড়েনি। টানা রোদ্দুরে সাইকেল চালিয়ে দুজনেই বেশ কাহিল। উজান বলল, আর পারছি না। পেটে তো ছুঁচোয় ডন মারছে।

বললাম, আর একটু সামনে এগিয়ে দেখি গ্রামের মধ্যে কোনো খাবারের দোকান পাই কি না। যদিও তেমন কোনো আশা নেই। একে তো ভর দুপুর; তার উপর আবার বিশ্বকর্মা পুজো। আরও কিছুটা দূর এগিয়ে মাঠের ভিতর পোড়ো মন্দির দেখতে পেলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম,বনবিবির মন্দির। এখানকার মানুষেˆর কাছে বনবিবি  সব দেবীর উপরে। সবাই তাঁর পুজো করে। সুন্দরনে বাঘের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার সবচেয়ে বড়ো আশ্রয় এই দেবী। বনবিবির মূর্তির পাশেই দেখলাম যোদ্ধার বেশে বাঘের ঘাড়ে চেপে বসে আছে একজন পুরুষˆ দেবতা। উজান বলল, উনি দক্ষিণরায়। দক্ষিণরায়ের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে আরও দুজন; একজনের মুখে চাপ দাড়ি, অন্য জনের কপালে লাল ফেট্টি বাঁধা, হাতে লাঠি। উজান বলল, এরা কালু রায় আর  রখা গাজি। এই স্থানীয় দেবদেবী সম্পর্কে পরে স্থানীয় মানুষেˆর কাছেই অনেক আশ্চর্য গল্প শুনেছি। ফাল্গুন-চৈত্র মাস এখানে বড়ো মেলা বসে। দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে অসংখ্য মানুষˆ এসে পুজো দেয়। মন্দিরের দশা দেখে মনে হয় বহুযুগ আগে প্রতিষ্ঠিত। পলেস্তারা খসা দেওয়ালে বড়ো বড়ো ফাটল অশ্বত্থের চারা বেরিয়ে ডালপালা মেলেছে।

   

চলতে চলতে এক সময় থামতে হল। সামনে মহাভারতের বিস্মৃত অধ্যায়ের মতো বয়ে চলেছে উন্মত্ত রায়মঙ্গল। আদিগন্তহীন। দুকূল ছাপানো জলরাশি তার আছাড় খেয়ে পড়ছে পারে। শেষˆ দুপুরের রোদ্দুরে অজস্র মুক্তো ঝিলিক দিয়ে উˆঠছে অজগরসফেন শীর্ষেˆ। অপার পারের ধোঁয়াশা, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে নদীটা। শেষˆ দেখা যায়না। ভালো করে তাকিয়ে থাকলে শুধু ধূসর দিগন্তরেখা ভেসে ওঠে। ম্যানগ্রোভের নিশ্ছিদ্র জঙ্গল। ভয়াল সে জঙ্গলে পদে পদে ষˆড়যন্ত্রের ফাঁদ। রয্যাল বেঙ্গলের নিভৃত আবাসভূমি। বিস্ময় জাগে এত বড়ো নদী সাঁতরে দক্ষিণরায়ের বাহন মাঝে মাঝে চলে আসে এ পারে। গোয়ালের গোরু-বাছুর, সামনে পড়া ভয়ার্ত মানুষেˆর ঘাড় মটকে পেট ফুটো করে নাড়িভুঁড়ি বের করে টেনে নিয়ে যায়  জঙ্গলের গভীরে।

নদীর পারে এসে দেখি সুন্দর বাঁধানো জেটিঘাট। এখন জোয়ারের জলে সে ঘাটের বেশিরভাগটাই ডুবে আছে। নদীর পার বরাবর সুন্দরী ক্যাওরা ওচ্চাকা আর বান গাছের সারি। আরও কিছু অজানা লতাগুল্মের ঝোপ । মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে লক্ষ লক্ষ শ্বাসমূল। সুন্দরী গাছের লম্বা মসৃণ সোনালি ঝুরি নেমে এসেছে নীচে। কেন যে নাম ‘সুন্দরী’ এ গাছ না দেখলে তা বোঝা যাবে না। এত সুন্দর গাছ সত্যিই কোথাও চোখে পড়েনি। কোনো ইতালিয়ান চিত্রকর যেন গাছগুলির পত্র-কাণ্ড শাখাপ্রশাখা নিপুণ শিল্পীর তুলির টানে নির্মাণ করেছে।

নদীর বাঁধানো পার দিয়ে আমরা এগোচিছলাম। অদম্য আকাঙ্ক্ষায় মনটা উচাটন। উজানের সঙ্গে উজানের পথেই চলেছি।  কিছুটা এগোতেই দেখলাম উঁচু পাঁচিলে ঘেরা দোতলা বাড়ি। বাড়িটা বিশাল। পাঁচিলের ভিতরে বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ আকাশে মাথা তুলেছে। জলের কল মাটি থেকে প্রায় এক তলা সমান উঁচুতে। সেখানে ওঠার পাকা সিঁড়ি। আশ্চর্য! বাড়িটার কাছাকাছি যেতে দেখলাম এটা আসলে ফরেস্ট অফিস,দোতলায় সরকারি গেস্ট হাউস। এখনও এখানে তেমন কোনো পর্যটক আসেনি। শীত পড়তে শুরু করলে মরশুমি পাখিদের মতো শহরের মানুষ পিলপিল করে এসে ভিড় জমাতে থাকে। অকৃত্রিম  নিভৃতি, মেঠো নৈঃশব্দ্য মুছে যাবে।

উঁচু ভেড়ি পথে হাঁটার ফলে পাঁচিলের ভিতরে বাড়িটার উঠোন দেখতে পাচিছলাম। কয়েকজন ফরেস্ট অফিসার দুপুরে পড়ন্ত  রোদ্দুরে তাস পেটাচেছ। কেউ কেউ তাকিয়ায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে। কয়েকটা খাঁকি উর্দি ভাড়ায় শুকোচেছ। এলোমেলো  কয়েকটা এঁটো বাসন পড়ে আছে। বিস্ময়ে ঘোরে এতক্ষণ ভালো করে বুঝিনি আমরা সকাল থেকে প্রায় উপোস। উজান খেপে উঠে বলল, সামনে একটা দোকান দেখা যাচেছ না? চল, খোলা থাকলে ভালো, নইলে লুট করে খাব।

নদীর একদম ধারে একটা দোকানের মতো ঘর। আলকাতরা মাখানো কালো দোকানটার পাশে জীর্ণ বাঁশের মাচা। কাছে যেতেই দেখলাম, বন্ধ মনে হয় বহু দিন ধরেই। পর্যটকরা আসতে শুরু করলে সম্ভবত খোলে; তারা ফিরে গেলে এ দোকান বন্ধ হয়ে যায়। বাঁশের মাচাটায় কিছুক্ষণ অসন্ন শরীরটাকে এলিয়ে আমরা আবার ছুটতে শুরু করলাম। ভেড়িপথ অপ্রশস্ত; সাইকেল নিযে চলা যায় না। সামনের পথটা মনে হয় জঙ্গলে ঢুকে গেছে।

   ৪

উজান বলল, ফিরে চল। সুন্দরন দেˆখা সার্থক। ছুঁচোর ডন পেটে নিয়ে কতক্ষণ আর পাকৃতিক রূপ দেখে, নদীর কল্লোল শুনে  থাকা যায়! পথঘাট চেনা নেই। বিভুঁই দেশ। সুন্দরীর বন থেকে ঝপাং করে যদি ডোরাকাটা বেরিয়ে আসে!

এদিকটায় জন-মানবের কোনো চিহ্ন নেই। ফরেস্ট অফিসটা ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে চলে এসেছি। সামনে আর এগোনোর পথ    নেই। পথের উপরেই লতাগুল্মের ঝোপ জন্মেছে। রাযমঙ্গল এখানে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো পারের ভঙ্গুর মাটি গুঁতিয়ে চলেছে। নোনা হাওয়ায় হাত-পায়ে জ্বালা ধরেছে। শিরশির করছে। ঘাম বসে নুন জমেছে গায়ে এখনও চচ্চড়ে রোদ্দুর। তবু এগোচিছলাম। হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হল। উজান আমার হাত চেপে ধরেছে। আমিও সাইকেলের হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছি। সামনের লতা ঝোপটা নড়াচড়া করছে। কিছু একটা হঠাৎ এগিয়ে আসছে আমাদের দিকেই। এগোব না পিছব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, মা বনবিবি এ যাত্রায় রক্ষা করো।

কয়েকটা রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত কাটার পর দেখলাম নির্জন দুপুরের ভূতুড়ে নদী পারের লতাপাতার ঝোপ জঙ্গলের সংকীর্ণ শুঁড়ি-পথ দিয়ে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এল ফুট পাঁচেকের মিশমিশে ডোরাকাটা একটা শরীর। তার মাথায় দস্তার বালতি। রূপকথার গল্পে পড়েছিলাম অরণ্যের পশুরা অনেক সময় মানুষেˆর রূপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়; ছদ্মবেশি রাক্ষসের মতো। মায়া দিয়ে মানুষˆকে ভুলিয়ে তারপর সুযোগ বুঝে ঘাড় মটকে ধারালো থাবা বসিযে দেয়। এখানও ঘোর কাটেনি। মানুষˆই বটে! তবে ওর মুখে কোনও মায়াবী রাক্ষস বা জানোয়ারের ছায়া নেই। সরল ও নিরীহ মুখখানিকে দেখে বুকের ভিতরটা কেমন মুচড়ে উঠল। কালো শরীর থেকে তার সহস্র ধারায় নামছে স্বেদবিন্দু। মনে হল দূর থেকে লোকটা হেঁটে আসছে। আমাদেরকে এ পথের  মাঝখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাতে লোকটা যেন একটু অবাক হল। থমকে দাঁড়িয়ে মাথা থেকে বালতি নামিয়ে প্রশ্ন করল,তোমরা কারা?

সংক্ষেপে আমাদের পরিচয় দিলাম। প্রচণ্ড হাঁপ হচিছল লোকটার; কিছু না বলেই বালতিটা পারের সবুজ ঘাসের উপর নামিয়ে   রেখে পথের মাঝখানে হঠাৎ থপ করে বসে পড়ল। তাকিয়ে দেখি অনচছ পলিথিনে ঢাকা বালতিটার ভিতর থেকে উঁকি দিচেছ অনেকটা পান্তাভাত, কচুর ডাঁটা আর ছোলার ঘন্ট, বাঁধাকপি আলুর চচ্চড়ি, চালকুমড়োর ছেঁচকি, একটু পায়েস, কিছুটা মটর ডাল, বেগুন আর নারকেল ভাজা।

লোকটা মাথা নিচু করে লুঙ্গির খুঁট দিযে মুখের ঘাম মুছে নিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, বাবা তোমাদের বাড়ি কোথায়? বললাম । লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার?

আঙুল তুলে পিছনের দিকে একটা অনির্দেশ্য জায়গা নির্দেশ করে লোকটা বলল, হু…ই মালেকানাঘুমটি।

কতটা পথ?

তা ছ-সাত মাইল হে…

জিজ্ঞেস করলাম, বালতিতে এ সব কী?

পান্নার রান্না।

আমি উজানের দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। বলল, অরন্ধনের প্রসাদ। বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন রাতে রান্না করে  রাখা হয়। বাসি করে তবে প্রসাদ হিসাবে খাওযয়া হয়।

লোকটা একটু ধাতস্থ  হবার পর  বলল, ঠাকুরের প্রসাদ, নিয়ে যাচিছলাম ফরেস্ট অফিসারদের জন্য। আমি ওদের ওখানে রান্না করি। কাল রাত্তিরে বড়ো বাবু বলল, হরি আমাদের পুজোর প্রসাদ খাওয়াতে পারিস?

হরির বালতিটা হাতে তুলে নিয়েছিল উজান। বলল, চলুন আমরা পৌঁছে দিচিছ।

দোকানটার কাছে পাতা বাঁশের মাচার কাছে এসে হরি বলল, তা বাবাদের চোখ-মুখ দেখি তো মনে হচেছ পেটে কিছু পড়েনি!  চলো তিন বাপ- বেটায় ইকিনে বসি চাড্ডি খেয়ি নেওয়া যাক…

তা কী হবে, এসব তো ফরেস্ট অফিসারদের জন্য।

হরি অত্যন্ত সরল গলায় বলল, ওরা এতক্ষণ হয়তো দুপুরের খাবার খেয়ি দেয়ি ঘুম দেচেছ,আমার শরীরডা এ কদিন ধরে  ভালো যাচেছ না। হাঁটতি কষ্ট হচিছল পথে বিরাম নিয়ে আসতি আসতি অনেকটা দেরি হয়ি গেল। এখন পান্নার পেসাদ নিই গেলি বাবুরা হয়তো আর খাবে না; তাছাড়া তোমরা অভুক্ত, তোমরাই খাও বাবা।

হরির আদুল গা চেহারা রুগ্ন। দেখে মনে হয়, সেও এখনও কিছু খায়নি। পাঁজরের হাড়গুলো বেরিয়ে আছে। শরীরের পিছন  দিকে ঘাড়ের নীচের অংশে অনেকগুলো ডোরাকাটা দাগ। মনে হল কেউ যেন ধারালো নখ কিংবা অস্ত্র দিয়ে অচড় কেটেছে। জিগ্যেস করলাম, কীসের দাগ?

হরি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল, আমার বারো বছরের ছাওয়ালরে নিয়ে গিয়লাম জঙ্গলে মধু ভাঙতি; বনবিবির বাহন এসে ঝাঁপ দিল খোকার উপর। আমার চোকির সামনেই জানোয়ারটা খোকারে টেনি নে যাচিছল, সহ্য করতি না পেরি আমিও মারলাম ঝাঁপ। সে থাবা আঁচড়ি ঘায়েল করি ফেলল। দেখলাম বাঘটা আমারে থুয়ি খোকারে নে চলি গেল বনের ভিতর। জ্ঞান হারালাম। তারপর থেকি পিঠে এই ডোরাকাটা চিহ্ন।
হরির চোখে জল। গলার স্বরও ভিজে উঠেছে, হাতের তালুর উলটো পিঠ দিয়ে  চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, নাও বাবারা।  তারাতারি খেয়ি নাও, সারা দিন কিছু খাওনি…

খ্যাপা রাযমঙ্গলের জল নেমে যাচেছ। ভাঁটার টানে সমুদ্রগামী জলে পড়েছে অস্ত সূর্য্যের আভা। বাঁশের মাচার উপর সে আমার  তিন বাপ বেটায় পাত পেড়ে ভাত খেয়েছি। উদরপূর্তির খাবারই্ তো খেয়ে এসেছি এত কাল। আজ সুন্দরনের ছোটো নিভৃত দ্বীপে এ কোন অমৃতের আস্বাদ পেলাম! ভেড়ি পথটা দিয়ে অবশিষ্ট প্রসাদসহ মাথায় দস্তার বালতিটা তুলে নিয়ে ফরেস্ট অফিসের দিকে হেঁটে চলে যাচেছ ডোরাকাটা হরি। তার অপস্রিয়মাণ ছায়াটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ক্রমশ ঢেকে ফেলেছে আমাদের নাগরিক শরীর…

♦—♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!