- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- আগস্ট ৭, ২০২২
মুক্তধারা
পাগলীর ঝুলেপড়া উন্মুক্ত কালো দুটো স্তন।খোকা তার একটা ধরে সোঁসোঁ করে টেনে খাচ্ছে।এজগতে মায়ের কোনো জাত হয়না !

অলঙ্করণ: দেব সরকার
পাগলীটাও মা হয়েছে! কানাঘুষো শোনা যায়, একসময় কদমতলীর বেশ্যাপট্টিতে বাজারদর ছিল তুঙ্গে।কোন বাবুকে নাকি জানের থেকেও বেশী ভালবেসে বেটি এখন পাগলী হয়েছে।পেটে বাচ্চা আসার আগেই বাবুটা ভেগেছে।কথা দিয়েছিল ,এই গলি থেকে বের করে একদম দালানকোঠায় নিয়ে গিয়ে তুলবে।শ্যামলী তাঁকে বারবার সাবধান করেছে – “এ ঢ্যমনা গুলো এমনই বলে।শেষে কিন্তু কিছুই করেনা।”
তবু বাবুর নির্মল চোখে চোখ রেখে মেয়েটি নিজেকে সামলাতে পারেনি! শেষমেশ প্রহেলিকায় গা ভাসিয়ে আজ সে নিঃস্ব।বাবুর চিন্তায় যখন হালকা হালকা মাথাটা বিগরোচ্ছে ,তখনই তাকে সেই পট্টি থেকে বের করে দেওয়ার কথা চলছিল।কে বইবে পাপের ভাগ! আর এই খোঁড়া গাই কে পুষেই বা কী লাভ! শেষে যখন পাঁচ মাস।বাচ্চা পেটে উন্মাদ পাগলী নামল রাস্তায়।
সবাই কুদৃষ্টিতে চেয়ে দেখে।পাতলা একটা ন্যাকড়া শুধু তলদেশটাকে আবৃত করে রাখে।তাও চিমটি কাটলে ময়লা ওঠে।বিভৎস এই শরীর নিয়ে শহরতলির প্রায় সব গলিতেই দেখা যায় তাকে।গায়ে পেচ্ছাবের বোটকা গন্ধ।ধার দিয়ে গেলে সবাই নাকে রুমাল দেয়।মা হওয়ার গল্পটা যে যার মতো করে সাজিয়ে নেয়।কেউ বলে, রাতের আঁধারে মদের নেশায় ছেলে ছোকড়ার দল ঠুঁকে দিয়ে গেছে।কেউ আবার,ওর মতই কোনো পাগল ওর পেট করে ভেগেছে।
কানা ঘুষো পাগলী কানেও নেয়না, বিড় বিড় করে কি সব যেন বলে, আর মাথায় উকুন হাঁতড়ে মরে।
দেখতে দেখতে দিন ঘনিয়ে এল। ফিনফিনে ময়লা কাপড়ের আড়াল থেকে পেটটা আকাশ চুম্বি! দিন ক্ষনের ঠিক নেই।ওষুধের বালাই নেই।এদিকে সারা পেট ময় অসহ্য যন্ত্রনা।বাচ্চা হবে। খালি দুহাত দিয়ে চুল ছেঁড়ে আর কাটা গাইয়ের মতো দাপড়ে মরে।দু পায়ের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলে অবিরল রক্তের ধারা।শেষে মাঝ রাতে ভোলার চায়ের দোকানে পাগলীটা জন্মদেয় মরা একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা পেটেই মরেছে নাকি পেটের বাইরে; রাতের আঁধারে একথা কেউ জানতেও পারেনা।সকালে উঠে কাতারে কাতারে লোক শুধু এটুকুই দেখেছে, পাগলীটা নাড়িভুরি চটকে মরা বাচ্চা আগলে শুয়ে আছে।পাড়ার মেয়ে বউরা লজ্জায় মুখে কাপড় চাপা দিয়েছিল।কেউ কেউ বলে, “আহা ছেলে হয়েছিল গো!” কেউ আবার বলে-“পাগলীর কোল ভাল।কেমন ফুটফুটে হয়েছিল দেখো!”
ভোলা সবাইকে তাড়িয়ে ছেড়েছিল।সাথে পাগলীকেও।সকাল সকাল তাকে দোকান খুলতে হয়।এসব নাটক দেখলে তার পেট চলবে কেমন করে!
পাগলী ব্যথা শরীর নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সামনে বসাকদের বাড়ির বেড়াটার ধারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।তার একটা হিল্লে করতে মহিলা সমিতি থেকে খান পাঁচেক মহিলারা এসেছিল।কিন্তু কাউকে গায়ের কাছে ঘেঁষতে দিল না ও! কাছে এলেই সদ্য মা হওয়া মহিষের মতো গায়ের দিকে তেড়ে যায়! এরপর থেকে সবাই ঠিক করে পাগলী যেমন আছে তেমনি থাক।কারো ক্ষতি না করলেই হল।সকলে মিলে ধরে বেঁধে মরা বাচ্চাটার সৎকার করে দিল।
এখন লোকেতো বলেই খালাস ! এরপর বিপত্তি বাধল বসাক বাড়ির কত্তা গিন্নির মধ্যে।বেড়ার একধারে পড়ে থাকলেও আরে বাবা সে তো পাগলীই! এই বাড়ির তিনটি প্রাণী।ভদ্দরলোকের নাম প্রবীর বসাক।সদ্য জায়গা কিনে দালান তুলেছে। থাকার মধ্যে সে,তার স্ত্রী সুব্রতা, আর তাদের তিনমাসের নরম তুলতুলে একটা খোকা।বাড়িটা এপাড়ায় একদম প্রান্তিকে।খুব একটা দরকার না পড়লে সচারচর এদিকটা তেমন কেউ আসেনা।পাড়ায় খুব লোডশেডিং হয়।রাতের অন্ধকারে বাচ্চাটাকে নিয়ে গিন্নির বুক ঢিপ ঢিপ করে। এদিকে বাড়ির পূব-দক্ষিন কোনে পাগলীটা আশ্রয় নিয়েছে!
লাঠি,ঢিল,গাল-মন্দ কোন কিছু করেই তাকে তাড়ানো যায় না।এমনিতে পাগলী কিছুই করেনা, সারাদিন পাড়া ঘুরে ভিক্ষে করে আর রাতে এসে মুখ গুঁজে কিছুটা খায় কিছুটা ছড়িয়ে একসা করে।মাঝেমাঝে একা একাই কাঁদে, আবার কখনো বকবক করে।দুপুর রোদে সে যখন হেঁটে যায়,তার ময়লা বুকের ওপর টাটানো স্তন দুটো চকচক করে। কখনো আবার গাঢ় দুধ বুকের দুধার দিয়ে অবিরল ধারায় বেয়ে যায়।কচি ঠোঁটের অভাবে তার স্তন দুটো যন্ত্রনায় টনটন করে।তখন পাগলি না বুঝে তার স্তন দুটোকে উন্মাদের মতো খামচে ধরে।তারপর মুক্তধারার মতো অমৃত রস ফিনকি দিয়ে ময়লা শরীর বেয়ে অঝরে ঝরে পরে।আর পাগলী মুখে শব্দ করে- “আহ! আহ! আহ!…
ও কারো ক্ষতি করেনা।তবে হ্যাঁ, সেদিন খোকাকে দাবায় শুইয়ে বসাক গিন্নি সবেমাত্র ফোঁড়ন দিতে গেছে ডালে।ফিরে এসে দেখে পাগলি খোকার একদম কাছে এসে খটাশের মতো চেয়ে আছে। সুব্রতা ‘ওমাগো’, বলে কোন রকমে দুধের শিশুটাকে বুকে আগলে রক্ষে পেয়েছে।
“রাক্ষুসী! নিজের টাকে খেয়ে হয়নি! এবার কি আমার টাকে…. দুর হ দুর হ….”
পাগলী ভয়ে হতভম্ব হয়ে দৌড়ে পালায়।কত্তাকে অনেকবার বলেও কিছু হয়নি! কত্তা খালি বলে- “থাকনা, ওতো এক কোনেই পড়ে আছে।দেখলে তো কত তাড়ানোর চেষ্টা হল।তুমি বরং খোকাকে একটু আগলে রেখো।আমি দেখছি সামনের মাসে বাড়ির চৌহদ্দিটা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া যায় নাকি।”
সুব্রতার ভারি রাগ হয়! ‘কোথা থেকে দয়ার সাগর এলেন রে! কোথাকার কোন এক পাগলী তার ওপর এত দরদ!’
তবে সেদিনের দুপুরের পরে আর কোন রিস্ক নেয়নি সুব্রতা।স্বামীকে বলে তার পরের দিনই কাঁটাতার দিয়ে সারা বাড়ি ঘিরিয়ে নিয়েছে।তবু কি পাগলীকে দমানো গেছে ! একদম না। কাঁটাতারের গা ঘেষেই বেড়ার ওপারে নর্দমার ধারটায় আশ্রয় নিয়েছে।তবু শান্তি।সে বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারেনা ! কিন্তু রাস্তার ওপর থেকেই পাগলী খোকার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে।খোকা দুধ খেতে বায়না করলে সুব্রতা আদর করে খোকাকে বলে- “খেয়ে নাও খেয়ে নাও।নয়ত পাগলী আসবে।এই আয়তো পাগলী।আমার সোনাটা একদম খাচ্ছে না !”
মায়ের কথা মা বলে, দুধের শিশু কেঁদেই চলে। ওদিকে বেড়ার ওপারে পাগলী কিছুই বোঝেনা ! খালি ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে, আর বুকের স্তন দুটো খামচে ধরে। সাথে মুখে ওই একটাই শব্দ…….
আজ সকাল থেকেই সুব্রতার শরীর মন দুটোই খারাপ।কদিন ধরে কী যে হয়েছে সে নিজেও বোঝেনা।তার বুকে একদম দুধ হয়না।খোকাটারো খেয়ে পেট ভরে না! সারাটা রাত কাঁদে।খাওয়ানোর সময় পাগলীটা ওভাবে চেয়ে থাকলে এমনটাতো হবেই! এদিকে প্রবীরের বাজারটাও ভালো যাচ্ছেনা।আগের মতো প্রায়শই মদ খেয়ে বাড়ি ঢোকে! এই সব দোষ ওই হাভাগী পাগলীটার। বেশ কিছুদিন যাবৎ সুব্রতা লক্ষ্য করেছে, কাজে যাওয়ার সময় পাগলী ডাইনির মতো প্রবীরের দিকে চেয়ে থাকে।ওর কু দৃষ্টিতেই এইসব ঘটছে। সুব্রতার মন মোচড় দিয়ে ওঠে।আচ্ছা আপদ এসে জুটেছে তার কপালে।কী করে তাড়ায় সে এই রাক্ষুসীকে!
টর্চটা মারতেই নালার মধ্যে ফুটে উঠল চাপ বাঁধা গাঢ় জমাট রক্ত।টর্চ টা আর একটু উপরে তুলতেই দেখতে পেল রক্তে ভেজা নিথর কালো দেহ।একদম শক্ত হয়ে গেছে।
যাইহোক আজ তো রবিবার।দোকান সেরে প্রবীর সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরবে।ফিরলেই তাকে নিয়ে একটু ডাক্তার খানায় যেতে বলবে।এই সব ভেবে সুব্রতা সকাল সকাল সমস্ত কাজ সেরে, হেঁসেল সামলে, খোকাকে বারান্দায় শুইয়ে কলতলার দিকে গেল।দুপুরের রোদে রান্না সেরে তার সর্ব অঙ্গ লঙ্কাবাটার মতো জ্বলে। তাই রোজ দুপুরে ভাতঘুমের আগে গাটাকে একটু ভিজিয়ে না নিলে চলেনা। ‘কলতলাটা বেশ পিছল হয়েছে। শনিবার মাথা ঘষার দিন নারকোলের মালা দিয়ে ঘষে ঘষে শ্যাওলা গুলো তুলে ফেলতে হবে।
না ! ঝটপট গা ধুয়ে বাইরে যাই, খোকাটা দালানে একা শুয়ে।’
এই বলে প্রথম মগের জলটা ঢালতে না ঢালতেই খোকা কঁকিয়ে কেঁদে ওঠে।
কি হল! কিছুতে কামড়াল!! নাকি পাগলী…
সুব্রতা পিছন ফিরতেই শাড়ির আঁচল বেধে একদম ছিটকে গিয়ে পড়ে মেঝেতে।আর মাথাটা পড়ে পাতকুয়ার কার্নিশে।শুধু ফট করে একটা শব্দ। তারপরেই ফিনকি দিয়ে রক্ত।এর পর পুরো নিস্তব্ধ!
সন্ধ্যায় প্রবীর বাড়ি ফিরে দেখে সারা ঘর অন্ধকার।এদিকে লোডশেডিং।কী ব্যাপার! সুব্রতা এখনো আলো জ্বালেনি!
“সুব্রতা, এই সুব্রতা?”
হাঁকতে হাঁকতে ঘরে ঢুকল প্রবীর।দরজাটা হাট করে খোলা! ঘরে ঢুকে তাক থেকে টর্চটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোল।
“সুব্রতা? এই সুব্রতা?? আশ্চর্য! কোন আওয়াজ নেই কেন? খোকাই বা কোথায়! এই ভর সন্ধ্যা বেলায় কোথাও বেরানোর মেয়ে তো সুব্রতা নয়!” এইসব ভাবতে ভাবতে সে এল কলতলার দিকটায়।টর্চটা মারতেই নালার মধ্যে ফুটে উঠল চাপ বাঁধা গাঢ় জমাট রক্ত।টর্চ টা আর একটু উপরে তুলতেই সুব্রতার রক্তে ভেজা নিথর কালো দেহ।একদম শক্ত হয়ে গেছে।প্রবীরের শরীর অবশ হয়ে এল।মুখ দিয়ে আর কথা সরে না, দু হাত- পা থরথর করে কেঁপে ওঠে।সুব্রতার মাথার কাছটা হাঁ হয়ে আছে।সারা দিন ওখান থেকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত প্রায় শেষ হয়ে গেছে।মানুষ মরলে শক্ত হয়ে যায়, প্রবীর সেটা জানে।তবু সে সুব্রতার নিথর দেহটাকে নিয়ে ঝাঁকাতে থাকে।
‘এই সুব্রতা সুব্রতা? কিগো?…’
এরপর তার মাথায় এল খোকার কথা। -‘সে কোথায়? সেও হয়তো এতক্ষন কাঁদতে কাঁদতে গলা শুকিয়ে মরে গেছে।’একই সব্বনাশ হল প্রবীরের! প্রবীর ছিটকে বেরিয়ে এল শোয়ার ঘরের দিকে।অন্ধকার ঘরটায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল।
“খোকা কোথাও নেই! খোকা তাহলে কোথায়? পাগলী? সব্বনাশ! তাহলে কী পাগলী…
প্রবীর এক দৌরে বাইরে বেরিয়ে এল।ছুটে গেল পূব-দক্ষিন কোনটায়।টর্চ মারতেই পাগলীর চোখ দুটো ডাহুকের মতো জ্বলে উঠল।টর্চটা আর একটু নিচে নামাতেই; পাগলীর ঝুলেপড়া উন্মুক্ত কালো দুটো স্তন।খোকা তার একটা ধরে সোঁসোঁ করে টেনে খাচ্ছে।এজগতে মায়ের কোনো জাত হয়না ! থমথমে সন্ধ্যার ভ্যাপসা গরমে সে এক নৈসর্গিক দৃশ্য ! চারি দিকে মশা ভন ভন করছে, আর পাগলী-মা দুহাতে আঁকড়ে তার কোলের বাছাকে অমৃত সুধা পান করাচ্ছে।সারা শরীরে তার আঁচড়ের দাগ।সম্ভবত কাঁটাতারের বেড়া ভাঙতে গিয়ে সে এই আঘাত পেয়েছে।তবু মায়ের কাছে সব আঘাত তুচ্ছ।সন্তান কে স্তন পান করানোর থেকে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে! খোকাও মহা আনন্দে সেই জমাট বাঁধা সুধা পান করে চলেছে।
প্রবীরের মাথার ওপর দিয়ে বুনো কালো মেঘ চাঁদের গা ঘেসে বয়ে চলে।তার মাথা কাজ করেনা।শরীর হালকা হয়ে আসে।সে শুধু থমকে দাঁড়িয়ে থাকে।তার মনে পড়ে যায় সেই রাতের কথা।যে রাতে শেষবার বুকে মাথা রেখে সে দিয়ে এসছিল হাজার প্রতিশ্রুতির মিথ্যে কথা।প্রবীরের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আর চোখের কোন দিয়ে বয়ে চলে অবিরল অশ্রুধারা।
ওদিকে অন্ধকরে ঝোপের আড়াল থেকে তখনও সেই একি শব্দ-
আহ! আহ! আহ!……..
♦–♦♦–♦♦–♦
লেখক পরিচিতি: গল্পকার বর্ধমানের বাসিন্দা।
গল্পের সমস্ত চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । কোন মিল অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।
❤ Support Us