Advertisement
  • খাস-কলম দে । শ
  • জানুয়ারি ২৩, ২০২৫

দেশের প্রথম বাজেট পেশ করেছিলেন কে ? ফিরে দেখা, ভারতীয় বাজেট ব্যবস্থার ইতিহাস

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করতে চলেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। দেশের অর্থনীতির নীতিনির্ধারণের মেরুদণ্ড এই অধিবেশন প্রথম কবে শুরু হয়েছিল? কে করেছিলেন বাজেট উপস্থাপন? অধিবেশনের দীর্ঘতম বক্তৃতার রেকর্ড কার ? সেই বাজেট সম্পর্কিত খুঁটিনাটি ইতিহাস

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
দেশের প্রথম বাজেট পেশ করেছিলেন কে ? ফিরে দেখা, ভারতীয় বাজেট ব্যবস্থার ইতিহাস

৩১ জানুয়ারি থেকে পার্লামেন্টে শুরু হতে চলেছে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের বাজেট অধিবেশন। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ১ ফেব্রুয়ারি সংসদে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করবেন। দেশের জনকল্যাণমূলক কাজ ও অত্থনীতির ধারা সুনিশ্চিত করতে বাজেটের গুরত্ব অপরিসীম। ভবিষ্যতে দেশ নির্মাণের গতি কীভাবে প্রবাহিত হবে তার আভাস এই অধিবেশনেই পাওয়া যায়। এবারের বাজেটে কর ব্যবস্থার সংশোধন, নতুন কৃষি প্রকল্প, বড় শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পে সরকারি অনুদানের আলোচনা হতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাড়বে কি না – সেই প্রশ্ন ঘুরছে রাজনৈতিক মহলে।

কেন্দ্রীয় বাজেট দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো গঠনে অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে। বাজেটের শিকড় সন্ধান করতে গিয়ে পরাধীন ভারতের ঔপনিবেশিক যুগের কথা ফিরে আসে। ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল প্রথম ভারতের বাজেট ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্কটিশ অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিবিদ জেমস উইলসন এটি ব্রিটিশ ক্রাউনের কাছে উপস্থাপন করেন। সেই নথিতে ভারতের রাজস্ব, ব্যয় এবং রাজস্বনীতি সহ সরকারের অর্থের রূপরেখার কথা রয়েছে। এপর বছরের পর বছর ধরে, বাজেট ব্যবস্থা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে। সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে, পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন রূপে বাড়বার ফিরে এসেছে কেন্দ্রীয় বাজেট।

বাজেট শব্দটি মধ্য ইংরেজি শব্দ ‘bowgette’ থেকে এসেছে, যা ফরাসি ‘bougette’ থেকে এসেছে যার অর্থ চামড়ার ব্যাগ। ভারতের সংসদে বাজেট রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত তারিখে সংসদে পেশ করা হয়। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার সাধারণত দুটি অংশ থাকে। প্রথম পর্যায়ে বাজেট পেশ করা ও আলোচনা, দ্বিতীয় পর্যায়ে সীদ্ধান্তগুলি সর্বসম্মতি ক্রমে পাশ করানো। অর্থমন্ত্রী সাধারণত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে বার্ষিক কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করেন। এতে রাজস্ব বাজেট এবং মূলধন বাজেট দুটিই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আগামী অর্থবছরের জন্য নির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনাও করে রাখা হয়।কেন্দ্রীয় বাজেট ঘোষণার ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রক, পরিকল্পনা কমিশন, প্রশাসনিক মন্ত্রক এবং নিয়ন্ত্রক ও অডিটর জেনারেল প্রধান ভূমিকা রাখেন। ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে ব্রিটিশ ক্রাউনে ভারতে বাজেট প্রথম প্রবর্তিত হয়। ১৮৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জেমস উইলসন প্রথম ভারতীয় বাজেট পেশ করেন। মিস্টার উইলসন ছিলেন ইন্ডিয়া কাউন্সিলের অর্থ সদস্য, যিনি ভারতীয় ভাইসরয়কে এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন। জেমস ছিলেন একাধারে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ এবং উদারপন্থী রাজনীতিবিদ। তিনি দ্য ইকোনমিস্ট এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ভারতের প্রথম অত্থমন্ত্রী ছিলেন স্যার আর কে শানমুখম চেট্টি। শিল্পপতি, কোচিন রাজ্যের তৎকালীন দিওয়ান এবং চেম্বার অফ প্রিন্সেসের সাংবিধানিক উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। ব্রিটিশপন্থী জাস্টিস পার্টির সদস্য ছিলেন। দেশভাগ ও দাঙ্গার পটভূমিকায় ১৯৪৭ সালের ২৬ নভেম্বর স্বাধীন ভারতের প্রথম বাজেট পেশ করেন চেট্টি। তারপর থেকে ভারতে প্রায় ৮০টি বাজেট রয়েছে।ভারতের বাজেট ইংল্যান্ডের বাজেটকে অনেক ক্ষেত্রে অনুসরণ করে। যা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। ২০১৯ এ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে বাজেট সংক্রান্ত বেশ কিছু রীতি নীতির পরিবর্তন করেছিলেন মোদি সরকারের অর্থমন্ত্রক।

ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন জন মাথাই। ১৯৪৯-৫০ সালে সবচেয়ে স্পষ্ট ভাষণে বক্তৃতা করেছিলেন তিনি। সংসদে বাজটের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিল। এপর তিনি মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক নীতির ওপর একটি ছোট বক্তৃতা দেন। এটিই ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন ভারতের জন্য প্রথম বাজেট। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সীদ্ধান্তগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পরিকল্পনা কমিশন গঠন ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এরপর বহু অর্থমন্ত্রী ভারতীয় সংসদে একাধিক বাজেট পেশ করেছেন। ১৯৬৪-৬৫ সালে অর্থমন্ত্রী হিসাবে কৃষ্ণমাচারী ভারতে প্রথমবারের মতো গোপন আয়ের হিসেব প্রকাশের প্রচলন করেছিলেন।জওহরলাল লাল নেহেরু প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ১৯৫৮-৫৯ সালে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর পোর্টফোলিওতে বাজেট পেশ করেন। ইন্দিরা এবং রাজীব গান্ধি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার সময় বাজেট পেশ করেছেন। মোরাজি দেশাই কর ব্যবস্থার পূর্নাঙ্গ রূপ তৈরি করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। মোরারজি দেশাই এখন পর্যন্ত সর্বাধিক সংখ্যক বাজেট পেশ করেছেন – প্রায় দশটি। তারা দ্বিতীয় মেয়াদে পাঁচটি বার্ষিক এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট অন্তর্ভুক্ত করেছিল যখন তিনি অর্থমন্ত্রী এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কর্পোরেট ট্যাক্স (আজ ন্যূনতম বিকল্প কর নামে পরিচিত) রাজীব গান্ধী ১৯৮৭ সালের বাজেটে প্রথম চালু করেছিলেন।

ভারতের অর্থনীতিতে সদ্য প্রয়াত ড. মনমোহন সিংয়ের ভূমিকা নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা হয়েছে এবং হয়ে চলেছে।ভারতে নয়া উদারবাদের জনক বলা হয় তাঁকে। বিশ্ববাজারে নিম্নমুখী টানের সময় এই অর্থনীতিবিদ ভারতকে সেই কবল থেকে বাঁচিয়েছিলেন বলে মত অর্থনীতিবিদদের একাংশের। ১৯৯৬ সাল থেকে, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের দেখানো পথ ধরে, অন্তর্বর্তী বাজেটগুলি এমন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে যেখানে অতীতের কাজের কথা তুলে ধরা ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে নির্দেশ করে৷ মনমোহন সিং ১৯৯১ সালে তাঁর প্রথম বাজেট বক্তৃতায় কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন “আমি খরা প্রবণ এক গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। যা এখন পাকিস্তানের অংশ। ইউনিভার্সিটি স্কলারশিপ এবং অনুদানের কারণে আমার পক্ষে ভারত এবং ইংল্যান্ডে কলেজে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। এই দেশ আমাকে আমাদের সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিসে নিয়োগ দিয়ে সম্মানিত করেছে। এটা এমন এক ঋণ যা আমি কখনোই পুরোপুরি পরিশোধ করতে পারবো না। আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠার সাথে দেশের সেবা করার জন্য নিজেকে অঙ্গীকার করা ছাড়া আমি আর কীই বা করতে পারি ! আমি সংসদকে সেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”

কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৪-২৫ এমন সময়ে এসেছে যখন ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।‌ শুধু তাই নয়, দেশটি এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, দুই বছরে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি, এবং দশক শেষের আগেই ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। কৌশলগতভাবে, এটি একটি পরিবর্তিত ব্যবস্থার দাঁড়িয়ে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বব্যবস্থার গুরুত্বপুর্ণ মুখ হয়ে উঠতে চলেছে। ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রধান শক্তি হিসাবে ভারৎ নিজের অর্থনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। তবে কয়েকটি পরস্পরবিরোধী সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে নির্মলা সীতারমণের মন্ত্রককে, যেমন দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধি, চাকরি ও দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি, এবং আর্থিকীকরণ ও বাজার। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম বিষয়। দেশের অর্থনীতির বিকাশ ঘটলেও, সাধারণ মানুষের মাথাপিছু আয় সেভাবে বাড়েনি। একটি দেশের সার্বিক বিকাশের অন্য যা অন্যতম প্রধান শর্ত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। সীতারমন ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০-এ কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২০-২১ পেশ করার সময় ২ ঘন্টা এবং ৪২ মিনিটের জন্য বক্তৃতা করার সময় দীর্ঘতম বক্তৃতা দেওয়ার রেকর্ড করেন। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের দেওয়া ভাষণটি এর আগে দীর্ঘতম ছিল। সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত অন্তর্বর্তী বাজেট ছিল অর্থমন্ত্রী এইচ এম পটেলের ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসের বক্তৃতা। তার আগে জরুরি অবস্থার মাধ্যমে ভারতের উপর সবচেয়ে খারাপ আক্রমণ নেমে এসেছিল, যার ফলে কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে যায়। পটেল তাঁর ৭৯৮ শব্দের বক্তৃতায় আসন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনকে স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘‌‘‌আমাদের অর্থনৈতিক নীতি ও অগ্রাধিকারগুলি পুনর্নির্দেশ করার জরুরি প্রয়োজন রয়েছে।’‌’‌

উল্লেখ্য, কোভিড -১৯ মহামারীর সময়ে ২০২১-২২ এর বাজেট কাগজবিহীন হয়ছিল – স্বাধীন ভারতে এই ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। মহিলা হিসাবে ইন্দিরা গান্ধির পরে সীতারামন দ্বিতীয় মহিলা যিনি বাজেট পেশ করেছিলেন। ২০১৯ এর সেই অধিবেশনে সীতারামন ঐতিহ্যবাহী বাজেট ব্রিফকেসের পরিবর্তে এবং তার পরিবর্তে জাতীয় প্রতীকের চিহ্ন সম্বলিত ঐতিহ্যবাহী ‘বাহি-খাতা’ নিয়ে যান। এছাড়াও কেন্দ্রীয় বাজেট নানা সময়ে নানা নামে অভিভূত হয়েছে। যেমন ১৯৭৩-৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধি সরকারে যশবন্তরাও বি চ্যাভান যে বাজেট পেশ করেছিলেন তাকে ‘কালো বাজেট’ বলা হয় কারণ সেই বছরে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ৫৫০ কোটি টাকা। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬ তে কংগ্রেস সরকারের ভিপি সিং কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করেছিলেন। যা ছিল ভারতে ‘লাইসেন্স রাজ’ ভেঙে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। শাস্তি ও পুরষ্কার দুটোই প্রস্তাবিত ছিল বলে এটিকে ‘গাজর এবং লাঠি’ বাজেট বলা হয়। ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এ নির্মলা সীতারামন বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন, যাকে তিনি ‘শতাব্দীতে একবার’ বাজেট বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, এই বাজেট পরিকাঠামো এবং স্বাস্থ্যসেবাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে চলছে। আসলে আরো একটি বেসরকারিকরণের কৌশল এবং কর সংগ্রহের নতুন ফন্দি বলে মনে করেছিলেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!